দেশে অনলাইন সংবাদ মাধ্যমের জনপ্রিয়তার ইতিহাস কমবেশি তিন বছরের হবে। এরই মধ্যে অনলাইনভিত্তিক সংবাদ প্রতিষ্ঠান হয়েছে অনেক। দৈনিকসহ নানা ধরনের পত্রিকার অনলাইন সংস্করণ হয়েছে। টেলিভিশন ও রেডিওসহ অন্যান্য গণমাধ্যমও নিজেদের অনলাইনে হাজির করেছে। এ সব গণমাধ্যমে অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, কোনো ধরনের মডারেশন ছাড়া বা অপর্যাপ্ত মন্তব্য মডারেশন ব্যবস্থা রয়েছে।

অথচ এই নতুন ধারার গণমাধ্যমে মন্তব্য মডারেট করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সাবেকি পত্রপত্রিকায় পাঠকের প্রতিক্রিয়া বা পাল্টা প্রতিক্রিয়া ছাপানোর আগে সম্পাদনা করা যতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল, অনলাইনে মন্তব্য মডারেট করা তার চেয়ে কম জরুরি নয়। বাংলা ভাষায় যা ‘পরিমিত’ ও ‘সংযত’ বলে বুঝি, তা ইংরেজিভাষীরা ‘মডারেট’ (Moderate) নামে জানে। প্রকাশিত মন্তব্য অবশ্যই পরিমিত ও সংযত হতে হবে এবং এটা নিশ্চিত করতে সংবাদ প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিজেদের দায়িত্ব পালন করতে হবে।

মডারেশনের প্রথম প্রয়োজনীয়তা হিসেবে আমি বলব, আমাদের পেশাদার নীতিনিষ্ঠ সাংবাদিকতার স্বার্থরক্ষা। গণ্যমাধ্যমগুলো অনলাইনে যে সব সংবাদ বিতরণ করছে, অনলাইন ব্যবহারকারী শুধু তাই পাচ্ছে না এখন। একই সঙ্গে একই সময়ে অন্যান্য ব্যবহারকারীর মন্তব্যও তার সামনে হাজির হচ্ছে। একটি সংবাদের ব্যাপারে কারো মন্তব্য নিশ্চিতভাবেই লোকেদের দৃষ্টিভঙ্গি প্রভাবিত করে। সংবাদটির ব্যাখ্যা করে। ফলে গণমাধ্যমগুলোকে অবশ্যই এ সব মন্তব্য যাচাই-বাছাই করতে হবে। সংশ্লিষ্ট সংবাদের ব্যাপারে বিভ্রান্তি তৈরি করে কিনা তা নজরদারি করতে হবে।

এ সব মন্তব্যের কৃতিত্ব বা দায় কোনোটিই অস্বীকার করার সুযোগ নেই গণমাধ্যমগুলোর। কারণ এ সব মন্তব্যের বাহক হিসেবে সংশ্লিষ্ট গণমাধ্যমই কাজ করছে। ফলে মন্তব্যে ঘৃণা প্রচার ও যে কোনো ধরনের আক্রমণ বন্ধ করার ভূমিকা নিতে হবে গণমাধ্যম কর্তৃপক্ষকেই। হোক সে আক্রমণ কোনো বিষয়, ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে কেন্দ্র করে; কিংবা অন্যান্য মন্তব্যকারীদের উদ্দেশে। সংবাদের মাধ্যমে ঘৃণা প্রচার বা আক্রমণ বা সাংবাদিকতার পেশাগত নীতির লঙ্ঘন যেমন গণমাধ্যমের জন্য দায়, ব্যবহারকারীর মন্তব্যও তেমনি।

সংবাদের ব্যাপারে ও ব্যবহারকারীদের মধ্যে আলোচনার পরিবেশ তৈরি করা ও বজায় রাখতেও মডারেশন দরকার। গণ্যমাধ্যমগুলোর দায়িত্ব হচ্ছে, ব্যবহারকারীদের আক্রমণমূলক বক্তব্য ও অপব্যবহার থেকে সুরক্ষিত রাখা। অনলাইনে এমন পরিবেশ তৈরি ও বজায় রাখা যাতে যে কেউ নিজের বক্তব্য প্রকাশে অস্বস্তি বোধ না করে। স্বস্তির পরিবেশ তৈরি যে হয়েছে, সেটা বোঝা যাবে তখন, যখন দেখা যাবে মতের দিক থেকে যারা সংখ্যালঘু, তারাও কোনো আক্রমণ বা উপহাসের শিকার না হয়ে নিজেদের বক্তব্য জোরালোভাবে উপস্থাপন করতে পারছে, করছে। কোনো মতের ধারায় যদি খুব কম সংখ্যক ব্যবহারকারী থাকে, তবে সংখ্যালঘুদের আক্রমণ থেকে তাদের সুরক্ষা দেওয়াও মডারেশনের কাজ। আলোচনা ছেড়ে তাদের যাতে চলে যেতে না হয়, সে পরিবেশ তৈরি রাখতে হবে সংবাদ মাধ্যমকেই।

প্রতিষ্ঠান হিসেবে একটি গণমাধ্যমের সুনাম, গ্রহণযোগ্যতা, নির্ভরযোগ্যতা ও সম্মানজনক অবস্থানের স্বার্থেও মন্তব্য মডারেশন গুরুত্বপূর্ণ। মন্তব্য যদি সাংবাদিকতার পেশাদার নীতির লঙ্ঘন করে, আর সেই মন্তব্য যদি কোনো গণমাধ্যম তার অনলাইনে হাজির থাকতে দেয়, তবে নিশ্চিতভাবেই তার ব্র্যান্ডের মূল্য কমে যাবে সবার কাছে। আপনি যতই ঘোষণা দিয়ে বলেন না কেন যে, ব্যবহারকারীদের মন্তব্যের জন্য আমরা দায়ী নই। সাধারণত সবাই এটাই ধরে নেবে যে, আপনারা রেখেছেন বলেই ওই মন্তব্য আপনাদের অনলাইনে থাকতে পেরেছে। এটা আপনার ব্র্যান্ডকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে খুব মারাত্মকভাবে।

আপনার পরিবেশিত সংবাদের মাধ্যমে যেভাবে অনলাইন ব্যবহারকারীরা আপনাকে বিচার করে, আপনার অনুমোদিত মন্তব্যের বেলায়ও তেমনটি। কেমন মন্তব্য আপনি সবাইকে দেখতে দিচ্ছেন, তা দিয়ে আপনার সংবাদকক্ষের সম্পাদকীয় নীতির বিচার করতে পারে ব্যবহারকারীরা।

এই মডারেশনের মাত্রা কেমন হবে, তা নিয়ে অনেক মত থাকতে পারে। এটা নানা প্রতিষ্ঠান নানাভাবে দেখতে পারে। আমি বলব, মন্তব্য যে মাত্রায় সংযত ও পরিমিত হলে সংশ্লিষ্ট সংবাদের প্রতি ও অন্যান্য মন্তব্যকারীর প্রতি ‘উপযুক্ত’ হয় বলে মনে হবে, সে মাত্রায়ই মডারেশন দরকার।

মডারেশনের সবচেয়ে বেশি চর্চিত উপায় হচ্ছে সাধারণত নির্দিষ্ট মন্তব্য মুছে দেওয়া বা প্রকাশ না করা। বিষয়ের সঙ্গে সম্পর্কহীন মন্তব্য প্রকাশ করার প্রশ্নই আসতে পারে না। বাকিটা নির্ভর করবে আপনার প্রতিষ্ঠানের মন্তব্য-নীতি বা অনলাইনটি ব্যবহারের শর্তাবলির ওপর।

বার বার অনুমোদন না করার পরও একই ধরনের মন্তব্য করে যাওয়া ব্যবহারকারীকে সাধারণত ব্লক করে দেওয়া নিরাপদ। যদি সম্ভব হয়, ব্যবহারকারীর কাছ থেকে এ সংক্রান্ত পূর্বসম্মতি নেওয়া যেতে পারে যে, বানান বা অনিচ্ছাকৃত ভুলত্রুটি সম্পাদনা শেষে মন্তব্য প্রকাশ করা হবে। তবে এটা খুবই ন্যূনতম মাত্রায় রাখতে হবে।

ব্যবহারকারীরা যাতে নিজেরাই যেকোনো মন্তব্যের ব্যাপারে আপত্তি জানিয়ে সংবাদকক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে, সে সুবিধা রাখতে হবে কারিগরিভাবে। ফ্ল্যাগ করার সুবিধা দেওয়া যায়। তবে তা কখনোই মডারেশনের বিকল্প নয়, মডারেশনের ক্ষেত্রে ব্যবহারকারীদের সাহায্য নেওয়া মাত্র। মডারেশনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে, একটা নির্দিষ্ট সময় বা মন্তব্যের পর আর মন্তব্য না নেওয়া। অনলাইনে যদি মন্তব্যের পরম্পরা খুবই দীর্ঘ হয় তখন দেখা যায় এক সময় তা পুরোপুরি স্রেফ অপ্রাসঙ্গিক আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণে পরিণত হয়।

লেখক : সাংবাদিক। নির্বাহী পরিচালক, ইন্টার প্রেস নেটওয়ার্ক।

mohammadarju@gmail.com