thereport24.com
ঢাকা, রবিবার, ২ জুন ২০২৪, ১৯ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১,  ২৫ জিলকদ  ১৪৪৫

রামায়ণ ও মহাভারতের দুই নারী : সীতা ও দ্রৌপদী

২০১৬ ডিসেম্বর ০২ ১৫:২৪:৫৪
রামায়ণ ও মহাভারতের দুই নারী : সীতা ও দ্রৌপদী

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক : মহাভারত ও রামায়ণ এ দুই মহাকাব্যের দুটি অবিসংবাদিত নারী চরিত্র দ্রৌপদী ও সীতা । এরা দুজনেই ভূমিকন্যা, দ্রৌপদী যজ্ঞাগ্নি সম্ভূতা এব্ং সীতা লাঙল চালনার ফলে ভূমি থেকে উৎপন্ন। এরা উভয়েই রাজনন্দিনী।

বিবাহের জন্য স্বয়ম্বরা হয়ে দুই মহাকাব্যের সবচেয়ে বীরত্বপূর্ণ রাজপুরুষকে স্বামীরূপে লাভ করেছিলেন| মহাভারতের যুগে অর্জুন ও রামায়ণের যুগে রাম অপেক্ষা বড় ধনুর্ধর আর কেউ ছিলেন না। বিবাহের পরে স্বামীসহ দ্রৌপদীর হয়েছিল তের বছর অজ্ঞাতবাস, সীতার চৌদ্দবছর বনবাস। যার ফলে উভয়ের জীবন হযেছিল ঝঞ্ঝাটময়, বিপদগ্রস্ত ও অশান্তিপূর্ণ। আর যার ফলস্বরূপ রাজবধূ, রাজনন্দিনী সীতা ও দ্রৌপদী উভয়েই হয়ে উঠেছিলেন দুটি অসুখী সংসারের দুই প্রতিভূ।

এত সাদৃশ্যপূর্ণ দুই নারী চরিত্র কিন্তু ছিল বৈসাদৃশ্যে ভরা। সাহিত্যের পরম্পরা অনুযাযী এই দুই পৌরাণিক মহাকাব্য প্রাচীন ভারতীয় ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক। কিন্তু মহাভারত হল ইতিহাস| রামায়ণ হল কাব্যগ্রন্থ। মহাভারতের চরিত্রগুলোর বিন্যাস, বিভিন্নতা বৈচিত্র্যপূর্ণ। আমাদের সমাজের মত সেখানে যেমন আছে নায়ক তেমনি আছে খলনায়ক। সৎ, অসৎ, মূর্খ, জ্ঞানী, সুন্দর, কুৎসিত সব ধরনেরই চরিত্র স্থান পেয়েছে সেখানে, কিন্তু রাোয়ণের কাব্যকার প্রাধান্য দিয়েছেন কেবলই আদর্শবান চরিত্রগুলোকে।সৃষ্টি করেছেন আদর্শ মানুষকে, আদর্শ নারীকে, আদর্শ ভ্রাতাকে অথবা আদর্শ খলনায়ককে। রামায়ণ মুখ্যত একনায়কের কাহিনী, নায়ক রামচন্দ্রের আদর্শের উপস্থাপনা ও মাহাত্ম্যকীর্তন স্থান পেয়েছে সেখানে।

রামচন্দ্র লাভ করেছিলেন কোমল-পেলব-নিষ্পাপ নিষ্ঠাবান রূপবতী জনকনন্দিনীকে। চারিত্রিক দৃঢ়তা দিয়ে রাম নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছেন আদর্শ পুত্র বা ভ্রাতা হিসেবে, আদর্শ স্বামীরূপে নয়। যার জন্য সন্তানসম্ভবা সীতা হয়েছিলেন আশ্রমবাসিনী। দুঃখে, শোকে, লজ্জায় অপমানিত হয়ে পুনর্বার প্রবেশ করেছিলেন ভূগর্ভে।সীতার পিতা জনক রাজা না কি মহত ছিলেন একথা আমরা সকলেই জানি। কিন্তু কার্যকালে জনকের মহত্ত্বের কোনো প্রকাশ দেখি না।

রামায়ণে রাজকন্যা সীতার খোঁজ নিতে বা তাকে বিপদের সময় সাহায্য করতে বা তাকে উদ্ধার করতে তাঁর পিতৃকুলের কেউই এগিয়ে আসেননি সেদিন। অপর দিকে দ্রৌপদীর পিতা পাঞ্চালরাজ দ্রুপদ বহু কাঙ্ক্ষিত পুত্রলাভের আশায় যে যজ্ঞ করেছিলেন সেই যজ্ঞের অগ্নিসম্ভূতা কন্যা হলেন আদরিণী দ্রৌপদী, যিনি কখনো কৃষ্ণা, কখনো বিদেহী, কখনো পাঞ্চালী, কখনো বা যাজ্ঞসেনী।

অতএব, এ যুগের একমাত্র কন্যার মত সে যুগেও নাম নিয়ে কত আদিখ্যেতাই না হয়েছিল দ্রৌপদীর! আবার মহাভারতের কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে দ্রৌপদীর ভ্রাতা ধৃষ্টদ্যুম্ন পঞ্চপান্ডবের পক্ষে প্রধান সেনাপতির ভূমিকা নিয়েছিলেন। ঠিক যেমন এখনকার কালে আদরের একমাত্র বিবাহিত বোনের বিপদে আপদে ভগ্নীপতির পাশে এসে দাঁড়ান তাঁর ভ্রাতা। অভাগিনী সীতা কি তাহলে অবাঞ্ছিতা? যার জানকী বা সীতা অর্থাৎ "লাঙল চিহ্নিত রেখা" ছাড়া অন্য কোন আদরের নামও জোটেনি। যদিও দ্রৌপদী রাজা দ্রুপদের এবং জানকী রাজা জনকের পালিত কন্যা ছিলেন।

কৌরবদের চক্রান্তে ধাবিত, ছদ্মবেশী পঞ্চপান্ডব দ্রুপদের রাজসভা থেকে দ্রৌপদীর ন্যায় রূপবতী ও গুণবতী স্ত্রীধন লাভ করে রাজকন্যা ও রাজত্ব ছাড়াও পেয়েছিলেন সামাজিক মর্যাদা। অন্যথায় রামচন্দ্র নিজ পরিচয়ে রূপবতী সীতাকে লাভ করে বরং সীতার রাজমর্যাদাই এক ধাপ বাড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন এর বেশি কিছুই নয়। হ্যাঁ একথা অনস্বীকার্য যে সীতা ছিলেন কেবল-ই রামের সম্পত্তি।

কিন্তু দ্রৌপদী ছিলেন বহুবল্লভা, নাথবতী পঞ্চপান্ডবের সম্পত্তি। এবং সম্ভবত এই কারণেই পান্ডবভ্রাতাদের মধ্যে একতা, সংহতি ও ভ্রাতৃত্ববোধকে দ্রৌপদী তাঁর জীবনের শেষ পর্যন্ত এক সুতোয় গেঁথে রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাঁর জন্যই পান্ডবরা বুঝতে পেরেছিলেন যে একতাই বল

আক্ষরিক অর্থে উভয়েরই বনবাস হয়েছিল। দ্যুতক্রীড়াসক্ত স্বামী রাজ্যপাট হারিয়ে দ্রৌপদীকে বাধ্য করেছিলেন বনবাসিনী হতে। অন্যথায় সীতার বনবাস ছিল তাঁর আদর্শ স্বামীর সত্যরক্ষার প্রতীকস্বরূপ। দ্রৌপদী বনবাসে থাকাকালীন আগের মতই তাঁর পাঁচ স্বামীর প্রতি যথোচিত কর্তব্যপরায়্ণ ও নিষ্ঠাবান ছিলেন। তাঁর সপত্নীগণ সেই সময় তাঁদের নিজ নিজ পিত্রালয়ে সুখেই কালাতিবাহিত করেছেন। দ্রৌপদী তাঁর সপত্নীদের প্রতি বিন্দুমাত্র ঈর্ষাপরায়ণ না হয়ে যেমন সুসময়ে তাঁদের পাশে ছিলেন, ঠিক তেমনই দুঃসময়েও তাঁদের অনবরত মনোবল ও সাহচর্য যুগিয়ে গেছেন।

অজ্ঞাতবাসে থাকাকালীন দাদা ধৃষ্টদ্যুম্ন যখন দ্রৌপদীর সঙ্গে দেখা করতে গেলেন, তখন তিনি ছোট্ট এক বালিকার মত নিদারুণ অভিযোগের সুরে ডুকরে কেঁদে উঠে বলেছিলেন, "আমার কি স্বামী, ভ্রাতা, পিতা কেউ নেই? থাকলে আজ রাজসভায় বিবস্ত্রা হয়ে এমন অপমান সইতে হত না।" কত লাঞ্ছনা ও অপমান সহ্য করেও স্বামী বা ভ্রাতাকে পরিত্যাগ করেননি তিনি। তাঁর দুঃসময়ে পাশে এসেছেন সেই প্রবাদপুরুষ পার্থসারথি যিনি আগাগোড়া মনোবল যুগিয়েছেন শুধু দ্রৌপদীকেই নয়, প্রণাধিক প্রিয় অর্জুনসহ বাকি চার পান্ডবকে।

শোকে দুঃখে, অপমানে অবিচলিত সেই পুরুষোত্তম শ্রীকৃষ্ণের জন্য্ই পান্ডবরা কুরুক্ষেত্রে জয়লাভ করেছিলেন। ন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করে, সত্যকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য, ধর্মরাজ্য গড়ে তোলার অমোঘ বাণী প্রচার করেছেন। পাঞ্চজন্যের বজ্রনিনাদে অনুরণিত হয়েছে ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠার বাণী। সেই অনুরণনে অবিচলিত দ্রৌপদী হাল ছাড়েননি। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত লড়াই করে গেছেন। শ্রীকৃষ্ণের কৃপাধন্য দ্রৌপদীর উদ্দেশে বর্ষিত হয়েছে তাঁর অগণিত স্নেহবারি। তাঁর ধৈর্য্য, সহ্য, মনোবল এব্ং আত্মপ্রত্যয় প্রশংসার দাবি রাখে। সেই কারণে দ্রৌপদী পঞ্চকন্যার সঙ্গে স্মরণীয় ও বরণীয়।

দ্রৌপদী ও সীতা উভয়েই বিস্তর ভুল করেছিলেন এবং সেই জন্য জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সেই ভুলের মাসুলও দিতে হয়েছিল তাঁদের। সীতার ভুল হল মায়াবী সোনার হরিণের হাতছানিকে প্রশ্রয় দেওয়া এবং রাবণের বোন সর্পনখাকে দেখে ব্যঙ্গ করা। যার ফলে তিনি হলেন রাবণের দ্বারা অপহৃতা ও যা পুরো রামায়ণের গল্পের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। অন্যদিকে দ্রৌপদীর ভুল হল, ময় দানব নির্মিত, স্ফটিক খচিত ইন্দ্রপ্রস্থে দুর্যোধনের প্রথম পদার্পণেই পা পিছলে যাওয়া দেখে হেসে ফেলা। পরবর্তী কালে এর চেয়ে অনেক বেশি অপমান তাঁকে ফিরে পেতে হয়েছিল।

তবে এ কথা অনস্বীকার্য যে মহাভারতের শেষে পঞ্চপান্ডবসহ দ্রৌপদীর মহাপ্রস্থানের সময় একমাত্র মহাবল ভীমসেনই দ্রৌপদীর পাশে ছিলেন এবং দ্রৌপদী যেন ভীমকেই পরজন্মে স্বামীরূপে পান- এরূপ আশা নিয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

(দ্য রিপোর্ট/একেএ/এনআই/ডিসেম্বর ০২, ২০১৬)

পাঠকের মতামত:

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

M

M

SMS Alert

এর সর্বশেষ খবর

- এর সব খবর