thereport24.com
ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ 24, ১৪ চৈত্র ১৪৩০,  ১৮ রমজান 1445

সীমানা পিলার চুরিতে বেড়েছে বজ্রপাতে প্রাণহানি!

২০১৭ মে ১৩ ২০:১৬:৫১
সীমানা পিলার চুরিতে বেড়েছে বজ্রপাতে প্রাণহানি!

নতুন দুর্যোগ হয়ে দেখা দেওয়া বজ্রপাতে প্রাণহানি বেড়েই চলেছে। সরকারি হিসাবেই চলতি বছর বজ্রপাতে ৬২ জন মারা গেছেন। তবে এর অর্ধেকেরও বেশি মারা গেছেন চলতি মাসের (১৩ মে পর্যন্ত) ১৩ দিনের মধ্যে।

বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বজ্রপাতের পরিমাণ এখন হয়তো কিছুটা বেড়েছে। কিন্তু বজ্রপাতের ঘটনা আগেও ঘটত। তবে এত হতাহতের ঘটনা ঘটত না। গত এক দশক ধরে বজ্রপাতের মানুষ মারা যাওয়ার ঘটনা বেশি ঘটছে।

বিপুল মানুষের প্রাণহানির ঘটনায় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় ২০১৫ সালের ২৭ আগস্ট বজ্রপাতকে দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণা করে।

বজ্রপাতে হতাহতের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার কারণ নিয়ে বাংলাদেশে কোনো গবেষণা নেই। তবে বিশেষজ্ঞ মহল থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ পর্যন্ত একটি ধারণা বিরাজমান, ব্রিটিশ শাসনামলে মাটির নিচে মৌজা, জেলা, উপজেলার সীমানা নির্ধারণী ধাতুর পিলার নির্বিচারে চুরি হওয়ার কারণে বজ্রপাতে হতাহতের সংখ্যা বেড়ে চলেছে।

বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত ঘেঁটে জানা গেছে, ব্রিটিশ শাসনামলে এ দেশে বিভিন্ন স্থানে নির্দিষ্ট দূরত্বে মাটির নিচে পিলারগুলো পুঁতে রাখা হয়েছিল। যেগুলো ছিল পিতল, তামা, লোহা, টাইটেনিয়ামসহ চুম্বকের সমন্বয়ে তৈরি। কেউ কেউ একে ম্যাগনেটিক পিলার বা ক্যাডেস্ট্রাল সার্ভে বা সিএস পিলারও বলে থাকেন। ধারণা করা হয়, বজ্রপাত হওয়ার সময়ে উচ্চ ইলেকট্রিক চার্জ সরাসরি এই পিলারগুলো শোষণ করে আর্থিংয়ের কাজ করত। তাই বজ্রপাত হলেও মানুষ মারা যেত না।

কিন্তু প্রচারণা রয়েছে, এ পিলারগুলো ‘মহামূল্যবান’। এ জন্য একশ্রেণির অসাধু মানুষ রাতের অন্ধকারে পিলার তুলে নেয় এবং এখনো নিচ্ছে বলে অভিযোগ আছে। পিলার চুরি করার ও পিলারসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে ধরা পড়ারও অসংখ্য ঘটনা রয়েছে। পিলার চুরির বিভিন্ন চক্র সক্রিয় রয়েছে। কিন্তু এ বিষয়টিকে সরকার এখনো গুরুত্ব সহকারে নেয়নি।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. শহীদুল ইসলাম খান দ্য রিপোর্ট টুয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছেন, ‘ওয়েদার প্যাটার্ন চেঞ্জ হয়ে গেছে। মে মাসে যে বৃষ্টি বৃদ্ধি হয় তা এপ্রিল মাসে হলো। ফেব্রুয়ারিতে শীত পাওয়া গেল না। মেঘ অসময়ে বেশি হচ্ছে, বাতাসে মনে হয় ধূলিকণার পরিমাণও বেশি, চার্জও বেশি হচ্ছে। এ জন্য হয়তো হাইভোল্টেজ বজ্রপাত বেশি হচ্ছে। তবে আগে এত মৃত্যুর কথা আমরা শুনতাম না।’

ব্রিটিশ আমলে বিভিন্ন স্থানে পুঁতে রাখা ধাতুর সীমানা পিলার নির্বিচারে তুলে নেওয়ার কারণে বজ্রপাতের পরিমাণ বেড়ে গেছে বলে মানুষের মধ্যে ধারণা রয়েছে। এ বিষয়ে তিনি বলেছেন, ‘তারা (ব্রিটিশ শাসকরা) হয়তো ওটা সীমানার জন্য দিয়েছিল কিন্তু ইট হেল্প দ্য লাইটনিং টু ডাউন আর্থ। লাইটনিং অ্যারেস্টারটাও (বজ্র নিরোধক দণ্ড) কিন্তু মেটাল দিয়ে মাটির নিচে পুঁতে দেওয়া হয়। যাতে বজ্র দালান থেকে মাটিতে যায়।’

তিনি আরও বলেছেন, ‘লাইটনিং (বজ্র) যাতে মাটিতে চলে যায় সে জন্য হয়তো ওই পিলারগুলো হেল্প করত। সেগুলো যদি উঠিয়ে নেওয়া হয় তবে তো প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কিছুটা নষ্ট হয়ে যেতেই পারে। যদিও পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়া নিশ্চিতভাবে এটা বলা যাচ্ছে না।’

শহীদুল ইসলাম খান বলেছেন, ‘আমাদের দেশে বজ্রপাত নিয়ে মৌলিক গবেষণা হয়নি। লাইটনিং নিয়ে গবেষণার জন্য কোনো গ্রুপও বাংলাদেশে নেই।’

সাদা মেঘের উপাদানের অধিকাংশই জলীয়বাষ্প বা পানির কণা হয়। ফলে সাদা মেঘে ঘর্ষণের বা সংঘর্ষের ফলে যথেষ্ট ইলেকট্রন সৃষ্টি হয় না। কিন্তু কালো মেঘে নাইট্রোজেন ও সালফার গোত্রের গ্যাসের পরিমাণ বেশি থাকায় দ্রুত গতির কারণে এসব যৌগিক গ্যাসের মধ্যে সংঘর্ষে প্রচুর পরিমাণ ইলেকট্রনের সৃষ্টি হয়। আর এসব ইলেকট্রন বাতাসের জলীয়বাষ্পের মাধ্যমে ভূমিতে চলে আসে এবং সৃষ্টি হয় বজ্রপাতের।

আবহাওয়াবিদ আরিফ হোসেন দ্য রিপোর্টকে বলেছেন, ‘মাটির নিচের পিলার উঠিয়ে নেওয়ায় বজ্রপাতে বেশি মানুষ মারা যাচ্ছে এ ধরনের কোনো বৈজ্ঞানিক গবেষণা আবহাওয়া অধিদফতরের নেই। দেশের বিভিন্ন স্থানে ব্রিটিশ শাসনামলে মৌজা ছাড়াও আন্তঃবাউন্ডারি যেমন জেলা, উপজেলার সীমানায় মাটির নিচে পিলারগুলো বসানো হয়েছিল। কিন্তু এগুলো সঙ্গে বজ্রপাতের সম্পর্ক নিয়ে তুলনামূলক কোনো স্টাডি আমাদের নেই।’

‘আগেও বজ্রপাত হতো, বজ্রপাতে মানুষের মৃত্যুও আগে হতো। তবে আগে সেটা এতো হাইলাইটেড হতো না। এখন একটা অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুও আর অজানা থাকে না’, বলেন আবহাওয়াবিদ আরিফ।

আবহাওয়া অধিদফতরের এ কর্মকর্তা আরও জানিয়েছেন, ১৩ মের পর বৃষ্টি ও বজ্রবৃষ্টির পরিমাণ বেড়ে যাবে। এ সময়ে বজ্রপাত থেকে সবাইকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম-সচিব (দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মসূচি-২) মো. মোহসীন দ্য রিপোর্টকে বলেছেন, ‘ব্রিটিশ আমলের সীমানা পিলারগুলো আগে লাইটনিং অ্যারেস্টার হিসেবে কাজ করত বলেই মনে হয়। এ বছরের মতো বজ্রপাত মোকাবিলায় আমাদের কার্যক্রম একটি নির্দিষ্ট আকারে চলে আসবে। তখন আমরা এ বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করব।’

সুনামগঞ্জের জাহাঙ্গীরনগর ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মো. আবদুল কাদির বলেছেন, ‘মাটির নিচের পিলারগুলো তো মানুষ বিভিন্ন সময়ে উঠিয়ে নিয়েছে। ব্রিটিশ আমলের এসব পিলারের বেশির ভাগ বর্ডার বেল্টে ছিল। আমরা ধারণা করি, পিলারগুলো না থাকায় বজ্রপাতে বেশি মানুষ মারা যাচ্ছে। এখন যেভাবে মারা যায় আগে সেভাবে মারা যেত না। যতটা শুনেছি পিলারগুলো বজ্র টেনে নিত।’

কুড়িগ্রাম সদর উপজেলা চেয়ারম্যান মো. আমান উদ্দিন আহমেদ বলেছেন, ‘মাটির নিচের পিলারগুলো তুলে নেওয়ার জন্য বজ্রপাতে মানুষ বেশি মারা যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটতে পারে। মুরুব্বিরা অনেকে এমনটা বলেন। তবে নিশ্চিত করে এটা বলা যাবে না।’

পটুয়াখালী জেলার দশমিনা থানার মাছুয়াখালী গ্রামের বৃদ্ধ মো. আমজাদ আলী মৃধা বলেছেন, ‘হুনছি পিলারের অনেক দাম। মানুষ উডাইয়া বেইচ্চা দেয়। এখন তো বৃষ্টি অইলেই ঠাডা (বজ্রপাত) পড়ে, মানুষ মরে। আগে পিলার ঠাডা টাইন্যা নিত। পিলার নাই, মাইনষের ওপরই তো ঠাডা পড়ব।’

বজ্রপাত মোকাবিলায় নতুন প্রকল্প আসছে

যুগ্ম-সচিব মো. মোহসীন বলেছেন, ‘মানুষের ঘনত্ব বেড়ে যাওয়া এখন বজ্রপাতে বেশি মানুষ মারা যাওয়ার একটি বড় কারণ।’

বজ্রপাতের বিষয়ে মন্ত্রণালয় খুবই সচেতন দাবি করে তিনি বলেছেন, ‘বজ্রপাত উঁচু স্থানে প্রথম আঘাত করে। এ জন্য আমরা এ বছর সারা দেশে ১০ লাখ তালগাছ রোপণ করব। এবার টিআরের বরাদ্দে তালগাছ রোপণের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। স্থানীয় সরকারকে তাদের রাস্তা ও পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়কে তাদের বাঁধে উঁচু গাছ লাগানোর জন্য বলা হয়েছে।’

যুগ্ম-সচিব আরো বলেন, ‘পৃথিবীর যে দেশগুলোতে বজ্রপাতে মৃত্যুর হার কম তারা কোনো ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহার করছে তা আমরা দেখছি। এ বিষয়ে ভিয়েতনাম বেশ এগিয়েছে। আমাদের একটি প্রতিনিধি দল প্রাথমিকভাবে ভিয়েতনামে তাদের প্রযুক্তি দেখে এসেছে। তারা (ভিয়েতনাম) ভবন নির্মাণে লাইটনিং অ্যারেস্টারের মতো এক ধরনের ডিভাইস ব্যবহার করে। তারা কিছু টাওয়ারও করেছে।’

মহসীন আরো বলেন, ‘আমরা তাদের ওখান থেকে টিম এনে ওয়ার্কশপ করে আবার আমরা ওখানে গিয়ে দেখে প্রযুক্তিগতভাবে কীভাবে বজ্রপাত মোকাবিলা করা যায় সে জন্য একটি প্রকল্প নেওয়ার চিন্তা করছি। ভিয়েতনাম ও থাইল্যান্ডকে অনুসরণ করে আমরা প্রকল্পটি নেব।’

তিনি যোগ করেন, ‘আমাদের দেশে বাড়ি নির্মাণের সময় বজ্র নিরোধক দণ্ড ব্যবহার করা হচ্ছে না। নতুন যে বিল্ডিং কোড হচ্ছে সেখানে এটা ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে। সোলার ব্যবস্থা না থাকলে ভবন নির্মাণে যেমন অনুমোদন দেওয়া হয় না, আমরাও এমনটা করে ফেলব।’

যুগ্ম-সচিব আরও বলেন, ‘বজ্রপাত থেকে বাঁচতে হাওর এলাকায় আমরা একতলা শেল্টার করারও চিন্তা করছি। কারণ, হঠাৎ বজ্রবৃষ্টি শুরু হলে হাওরে কাজ করা লোকজনের নিরাপদ আশ্রয়ে যেতেও বেশ সময় লাগে। আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে মানুষ গরু-ছাগলসহ দ্রুত নিরাপদে আশ্রয় নিতে পারে।’

বজ্রপাতে মৃত্যুর মিছিল

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়য়ের যুগ্ম-সচিব মোহসীন জানিয়েছেন, চলতি বছরের ১৩ মে পর্যন্ত বজ্রপাতে মোট মারা গেছে ৬২ জন। এর মধ্যে অর্ধেকের বেশি মারা গেছে চলতি মাসে। গত ৯ মে-ই বজ্রপাতে মা-ছেলেসহ ১৯ জনের মৃত্যু হয়।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়য়ের জাতীয় দুর্যোগ সাড়াদান সমন্বয় কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর বজ্রপাতে মোট ২১৭ জন মারা যায়। এ ছাড়া বজ্রপাতে ২০১৫ সালে ১৮৬ জন, ২০১৪ সালে ২১০ জন, ২০১৩ সালে ২৮৫ জন, ২০১২ সালে ৩০১ জন ও ২০১১ সালে ১৭৯ জনের প্রাণহানি ঘটে।

অন্যান্য দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের তুলনা

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, বছরে এক কোটি মানুষের মধ্যে প্রতিবেশী দেশ ভারতে একজন, বাংলাদেশে ৯ জন, নেপালে ২৪ জন, শ্রীলঙ্কায় ২৭ জন বজ্রপাতে মারা যায়। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে বছরে বজ্রপাতে মৃত্যুর হার প্রতি কোটিতে ৪ জনেরও কম।

গত ১০ বছরে যুক্তরাষ্ট্রে ৩১৯ ও জাপানে ২৪ জন বজ্রপাতে মারা গেছে। বিশ্বে বছরে প্রায় দুই হাজার থেকে ২৪ হাজার লোক বজ্রপাতে মারা যায় এবং প্রায় দুই লাখ ৪০ হাজার লোক আহত হয়। পৃথিবীতে প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ১০০ বার বজ্রপাত হয় অর্থাৎ প্রতিদিন প্রায় ৮০ লাখ বার বজ্রপাত হয় বলেও ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

বজ্রপাতে বিশ্বে ক্ষতির পরিমাণ বছরে প্রায় ১০০ কোটি ডলার। বিশ্বে সবচেয়ে বেশি বজ্রপাত হয় ভেনিজুয়েলার মারাকাইবো লেকে। সেখানে বছরে গড়ে ৩০০ দিন বজ্রপাত হয়।

(দ্য রিপোর্ট/আরএমএম/জেডটি/এপি/এম/মে ১৩, ২০১৭)

পাঠকের মতামত:

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

M

M

SMS Alert

এর সর্বশেষ খবর

- এর সব খবর