thereport24.com
ঢাকা, শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল 24, ১২ বৈশাখ ১৪৩১,  ১৭ শাওয়াল 1445

অ্যাকশন এইডের গবেষণা

দেশের নগরকাঠামো নারীবান্ধব নয়

২০১৭ মে ২০ ১৫:২১:৪৩
দেশের নগরকাঠামো নারীবান্ধব নয়

দ্য রিপোর্ট প্রতিবেদক : গণপরিবহন, রাস্তাঘাট, ফুটপাত, পাবলিক টয়লেট ও পার্কের মতো নগরকাঠামোগুলো নারীবান্ধব নয়। ফলে শঙ্কা, নিরাপত্তাহীনতা ও সহিংসতার ভয়ে নারীদের এসব গণপরিসর এড়িয়ে চলতে হয়।

অ্যাকশনএইড বাংলাদেশের ‘নারী সংবেদনশীল নগর পরিকল্পনা’ বিষয়ে এক গবেষণায় এমন চিত্র উঠে এসেছে।

শনিবার (২০ মে) অ্যাকশনএইড বাংলাদেশ তাদের গুলশান কার্যালয়ে ‘বিশ্ব নিরাপদ নগরী দিবস’ উপলক্ষে গবেষণাটি গণমাধ্যমের সমানে তুলে ধরে।

গবেষণার ফলাফল বলছে, ঢাকা শহরের ৫৬ শতাংশ নারী ভালো পরিবহন ব্যবস্থা না থাকায় ঘরের বাইরে যেতে চান না। ২৬ শতাংশ নারী বলেছেন, নিরাপত্তার অভাবে তাদের পরিবার ঘরের বাইরে যেতে দেয় না। ৬১.৫ শতাংশ নারী মনে করেন, ফুটপাতগুলো যথেষ্ট প্রশস্ত নয়। তাই চলাচলে সমস্যা হয়। ৯৩.৫ শতাংশ উত্তরদাতা পাবলিক টয়লেট ব্যবহার করেন না নিরাপত্তা ও সুবিধার অভাবে। গবেষণায় দেখা গেছে, ৮৭ শতাংশ নারী বলেছেন ঢাকা শহরে পর্যাপ্ত পার্ক ও উদ্যান নেই। আর যেগুলো আছে সেগুলোও নিরাপদ নয় বলে মনে করেন ৪২ শতাংশ নারী।

অনুষ্ঠানের শুরুতেই গবেষণার প্রেক্ষাপট ও মূল বিষয়গুলো তুলে ধরেন অ্যাকশনএইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ্ কবির।

তিনি বলেন, ‘নগরের অর্ধেক জনসংখ্যা নারী হলেও নগর পরিকল্পনা ও উন্নয়নে নারীর চাহিদা ও আকাঙ্ক্ষার বিষয়টি সক্রিয়ভাবে বিবেচনায় আসে না। নগর উন্নয়নে সিদ্ধান্ত গ্রহণ, পরিকল্পনা প্রণয়ন, প্রকল্প ডিজাইন, বাস্তবায়ন ইত্যাদি বেশির ভাগ কাজে নারীদের সংখ্যা কম থাকায় নারী ব্যবহারবান্ধব নগরকাঠামো তৈরি হয় না। ফলশ্রুতিতে রাস্তাঘাট, ফুটপাত, মার্কেট, শপিং মল, পরিবহন ব্যবস্থা, পাবলিক টয়লেট, পার্ক, উন্মুক্ত স্থানসহ সব গণপরিসরে নারীদের ব্যবহার উপযোগিতা সীমিত ও ঝুঁকিপূর্ণ।’

এরপর ‘নারী সংবেদনশীল নগর পরিকল্পনা’ বিষয়ে গবেষণা তুলে ধরেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক আক্তার মাহমুদ।

গবেষণায় আরও দেখা যায়, অতিরিক্ত ভিড়ের কারণে ৫৮ শতাংশ নারী গণপরিবহনে উঠতে পারেন না। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নিরাপত্তাহীনতা ও নগর উন্নয়ন পরিকল্পনায় নারীকে বাদ দিয়ে কাঠামো তৈরি করা। রাজধানীর গণপরিবহন সম্পর্কে ৮৬ শতাংশ উত্তরদাতা যানজট নিয়ে হতাশা। ৭৮.৫ শতাংশ নারী বলেছেন বাসের সংখ্যা অপ্রতুল। ২২.৫ শতাংশ নারী বাস সহকারি/চালক/সহযাত্রীর কাছ থেকে যৌন হয়রানির শিকার হন।

ফলাফল তুলে ধরে অধ্যাপক আক্তার মাহমুদ বলেন, ‘নারীদের চাহিদা নগর পরিকল্পনা প্রতিফলনে দেখা যায় না। একটি নগর পরিকল্পনা যখন নারীবান্ধব হয় না, তখন স্বভাবতই নারীদের জন্য নগর ছোট হয়ে আসে ও অনিরাপদ হয়ে দাঁড়ায়। নিরাপত্তার অভাবে নারীরা তাদের চলাফেরা সীমিত করে ফেলে।’

তিনি আরো বলেন, ‘ঢাকা শহর পুরুষতান্ত্রিক শহর হিসেবেই গড়ে উঠেছে যা মহিলা ও নারীদের অবাধ চলাচলে বাধার সৃষ্টি করে। এর ফলে নারীরা বাড়ির বাইরে যেতে চায় না কিংবা কর্মক্ষেত্রে পূর্ণ ক্ষমতা প্রয়োগ করে না যা তাদের অধিকার ও দাবি থেকে বঞ্চিত করে, অর্থনৈতিকভাবেও ক্ষতির শিকার হয়।’

গবেষণার ফলাফলের ওপর কথা বলেন স্থপতি ইকবাল হাবিব। তিনি বলেন, ‘সত্যিকার অর্থেই আমাদের এই নগরী শুধুমাত্র সবলের জন্য। আর এই সবল হলো, যারা সামাজিকভাবে, অর্থনৈতিকভাবে ও রাজনৈতিকভাবে সবল। আমরা আমাদের ফুটপাতগুলো জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করতে পারিনি। নারীদের খেলাধুলার জন্য আমরা একটি জায়গাও তৈরি করিনি। নারীকে আমরা বন্দি করে রাখি আবার নারীকে মা দুর্গা রূপেও দেখি।’

তিনি আরো বলেন, ‘সরকারকে আরও উদ্যোগী হতে হবে। পথে-প্রান্তরে টয়লেট তৈরিতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে প্রয়োজনে বাধ্য করতে হবে। তা না হলে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। প্রকল্প নারীবান্ধব, শিশুবান্ধব ও প্রতিবন্ধীবান্ধব হয়েছে কি না তা অবশ্যই পরিকল্পনা কমিশনকে দেখতে হবে। আর তা নিশ্চিত না হলে প্রকল্পে অর্থায়ন বন্ধ করতে হবে।’

নগরের পর্যাপ্ত পাবলিক টয়লেট না থাকার কারণে নারীরা নানা ধরনের শারীরিক সমস্যায় ভুগছেন। এ বিষয়ে অ্যাকশনএইড বাংলাদেশের নির্বাহী বোর্ডের সদস্য ডা. খলিলুর রহমান বলেন, ‘শহরে পর্যাপ্ত পাবলিক টয়লেট না থাকায় নারীরা পানি খেতে ভয় পান। আবার প্রয়োজন হলে টয়লেটে যেতে পারেন না নারীরা। ফলে ঢাকা শহরের নারীরা নানা শারীরিক সমস্যায় ভোগেন। এতে পরিবারে নারীদের জন্য স্বাস্থ্য ব্যয় বাড়ছে। নগর কাঠামো যদি নারীবান্ধব হতো, তবে নারীর শারীরিক ও মানসিক পরিস্থিতির আরও উন্নয়ন হতো।’

গবেষণায় দেশে বিদ্যমান নীতি ও আইনের প্রেক্ষাপটও বিশ্লেষণ করা হয়। জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রায় ৫ ধারায় লিঙ্গ সমতা এবং নারী ক্ষমতায়নের কথা বলা হয়েছে। এই লক্ষ্য অর্জনের মাধ্যমে নারীদের সব বৈষম্য ও সহিংসতা দূরীকরণ, গৃহস্থালী কাজের স্বীকৃতি প্রদান, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক এবং সামাজিক জীবনে নারীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ও নেতৃত্বের সমান সুযোগ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে উপযুক্ত ও প্রয়োগযোগ্য আইন প্রণয়নের কথা বলা হয়েছে।

খসড়া জাতীয় নগরায়ণ নীতিমালা, স্থানীয় সরকার আইন ২০০৯, ঢাকা স্ট্রাকচার প্ল্যান (২০১৬-৩৫), জাতীয় গৃহায়ণ নীতিমালা, মহানগর ইমারত নির্মাণ বিধিমালা, জাতীয় বহুমাত্রীয় পরিবহন নীতিমালা, জাতীয় নারী নীতিমালা, বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোডে জেন্ডার সংবেদনশীল নগর পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করার কৌশল প্রণয়নের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। তবে বিষয়গুলো কাগজেই আটকে থাকে। বাস্তবায়নেই মূল সমস্যা।

ঢাকা শহরের রাস্তা, বাসস্ট্যান্ড, ফুটপাত, মার্কেট ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন বয়সের ২০০ জন নারীর ওপর জরিপ করে গবেষণাপত্রটি তৈরি করে অ্যাকশনএইড বাংলাদেশ। যেখানে কিছু সুপারিশ তুলে ধরা হয়। যেখানে বলা হয়, যেকোনো প্রকল্প প্রণয়নের ধারণাপত্র থেকে শুরু করে বাস্তবায়ন পর্যন্ত সব পর্যায়ে নারী সংবেদনশীল ধ্যান-ধারণার প্রতিফলন থাকতে হবে; নারীবান্ধব শহর এবং কমিউনিটি/নেইবারহুড উন্নয়নের পরিকল্পনা নীতি তৈরির সময় নারী সংগঠনের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে; ঢাকা স্ট্রাকচার প্ল্যানের ডিটেইল এরিয়া প্ল্যানে নারী সংবেদনশীল কৌশলনীতি অবশ্যই ব্যাখ্যা করতে হবে।

অন্যান্য সুপারিশের মধ্যে আছে, মূলধারার পরিবহন পরিকল্পনা ও প্রস্তাবনায় নারী সংবেদনশীল নীতি গ্রহণ করা; নারী ও শারীরিক প্রতিবন্ধীদের ব্যবহার উপযোগী রাস্তা, ওয়েটিং স্টেশন, টার্মিনাল ও স্টপেজ নির্মাণ করা; পার্ক, উদ্যান ও খেলার মাঠে অবৈধ দখলদারিত্ব প্রতিহত করা।

শহর ও গ্রামে নারীর চলাচলের জন্য যৌন হয়রানির ভীতি ও সহিংসতামুক্ত পরিবেশ নিশ্চিতসহ জেন্ডার সংবেদনশীল কাঠামো গঠনের লক্ষ্যে অ্যাকশনএইড বাংলাদেশ ২০১১ সাল হতে অ্যাকশনএইড ফেডারেশনের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে নারীর জন্য নিরাপদ শহর বিষয়ক প্রচারণা এবং কার্যক্রম গ্রহণ করে। এই পরিস্থিতিতে অ্যাকশনএইড ৭টি বিভাগীয় শহরে প্রাথমিক গবেষণার কাজ সম্পাদন করে এবং ২০১৪ সালে সেই গবেষণার ফলাফল প্রকাশের মাধ্যমে ‘নিরাপদ নগরী, নির্ভয় নারী’ ক্যাম্পেইন ঘোষণা করে। এরই প্রেক্ষিতে অ্যাকশনএইড ফেডারেশন ২০১৫ সালে ২০ মে-কে ‘বিশ্বব্যাপী নারীর জন্য নিরাপদ শহর দিবস’ নির্ধারণ করেছে এবং প্রচারণা চালিয়ে আসছে। বর্তমানে বিশ্বের ১৭টি রাষ্ট্র একযোগে এই দিবসটি পালন করছে। দিবসটি পালন উপলক্ষে ‘নারী সংবেদনশীল নগর পরিকল্পনা’ বিষয়ে গবেষণা পত্রটি তুলে ধরে অ্যাকশনএইড বাংলাদেশ।

(দ্য রিপোর্ট/এস/এম/মে ২০, ২০১৭)

পাঠকের মতামত:

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

M

M

SMS Alert

এর সর্বশেষ খবর

- এর সব খবর