thereport24.com
ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল 24, ৬ বৈশাখ ১৪৩১,  ১০ শাওয়াল 1445

১৯৭১-৭২ থেকে ২০১৫-১৬ অর্থবছর

প্রতিশ্রুতির ৩০ শতাংশ অর্থছাড় করেনি উন্নয়ন সহযোগীরা

২০১৭ মে ২১ ২২:২৯:২৪
প্রতিশ্রুতির ৩০ শতাংশ অর্থছাড় করেনি উন্নয়ন সহযোগীরা

ভৌত অবকাঠামোসহ আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নে বিদেশি ঋণ ও সহায়তার ওপর বড় ধরনের নির্ভরতা রয়েছে বাংলাদেশের। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নে বড় অংশই জোগান দিয়ে আসছে ইউএনডিপি, বিশ্বব্যাংক, এডিবি, আইএমএফ, আইডিবিসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও দাতাগোষ্ঠী। কিন্তু প্রতিশ্রুতি দেওয়া সত্ত্বেও ঋণ ও অনুদানের একটি বড় অংশই ছাড় করেনি তারা।

অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) তথ্যানুযায়ী, স্বাধীনতার পর থেকে ২০১৫-১৬ অর্থবছর পর্যন্ত বিভিন্ন প্রকল্পে ঋণ ও অনুদান বাবদ নয় হাজার ৯১৯ কোটি ডলার বাংলাদেশি মুদ্রায় সাত লাখ ৯৩ হাজার কোটি টাকা (১ ডলার=৮০ টাকা ধরে) দেওয়ার প্রতিশ্রুতি ছিল। কিন্তু বাস্তবে ছাড় হয়েছে ছয় হাজার ৯১৫ কোটি ডলার অর্থাৎ বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় পাঁচ লাখ ৫৩ হাজার কোটি টাকা। এ হিসাবে দেখা যায়, প্রতিশ্রুত অর্থের ৩০ শতাংশই ছাড় দেয়নি উন্নয়ন অংশীদার বিভিন্ন সংস্থা ও দাতাগোষ্ঠী।

সংশ্লিষ্টরা জানান, বিদেশি অর্থ সহায়তাপুষ্ট প্রকল্প বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর একধরনের অনাগ্রহ রয়েছে। বৈদেশিক ঋণের অর্থ ব্যয় করতে গিয়ে নানা প্রক্রিয়া সমাপ্ত করা, দাতাদের আমলান্ত্রিকতা, দুর্নীতির সুযোগ কম থাকা এবং ব্যাপক মনিটরিংসহ নানা কারণে এমন ঘটনা ঘটছে এ কারণে সরকারের অভ্যন্তরীণ ঋণের ওপর চাপ পড়ছে এবং বেসরকারি বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

এ বিষয়ে বেসরকারি উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. মোস্তাফিজুর রহমান দ্য রিপোর্ট টুয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছেন, ‘বাস্তবায়ন সক্ষমতার অভাব, প্রকল্প বাস্তবায়নে দেরি হওয়া, নানা শর্ত পরিপালনে ব্যর্থতার কারণে অর্থ চলে গেছে। আবার শর্ত পালন করে অর্থ সহায়তা নেওয়ার ক্ষেত্রে অনাগ্রহের কারণেও অর্থছাড় হয়নি। এ প্রসঙ্গে আইমএফের তিন বিলিয়ন ডলারে অর্থ সহায়তার উদাহরণ তুলে ধরে বলেন, এক বিলিয়ন ডলার অর্থছাড়ের পর বাংলাদেশের পক্ষ থেকে শর্ত পালন না করার বিষয়টি জানানো হলে তারা বাকি দুই বিলিয়ন ডলার ছাড় দেয়নি।’

মোস্তাফিজুর রহমান আরও বলেছেন, ‘বিদেশি সহায়তাপ্রাপ্ত অনেক প্রকল্পে দেশীয় অর্থায়নের বিষয়টিও অনেক ক্ষেত্রে যুক্ত থাকে। দেশীয় অর্থায়নের অনিশ্চয়তার কারণেও বিদেশি সহায়তা বাবদ অর্থ ছাড় করা সম্ভব হয় না।’ তবে প্রকল্প বাস্তবায়নে আমাদের আরও সক্ষমতা বাড়ানোর ওপর গুরুত্বারোপ করে এ গবেষক বলেছেন, ‘সক্ষমতা বাড়ানো গেলে আমাদের উন্নয়ন আরও ত্বরান্বিত হবে এবং জনগণও তার সুফল পারে।’

এদিকে সংশ্লিষ্টরা জানান, বিদেশি অর্থায়নে প্রকল্প বাস্তবায়নে দাতাদের শর্ত ও নানা নিয়মকানুন থাকে। এসব শর্ত মানতে হলে নানা কাগজপত্র পূরণ করতে হয়। এ ছাড়া বিদেশি টাকা ব্যয়ের জবাবদিহিতা রয়েছে। প্রকল্প পরিচালকরা (পিডি) অনেক ক্ষেত্রেই দক্ষতার পরিচয় দিতে পারেন না। তা ছাড়া ভাষাগতসহ বিভিন্ন সমস্যার কারণে তারা উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে কার্যকর নেগোসিয়েশন করতে পারেন না। এসব কারণে পিডিরা বৈদেশিক ঋণের টাকা ব্যয় করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না। অন্যদিকে, সরকারি তহবিলের টাকা ইচ্ছামতো ব্যয় করা যায়। এ ক্ষেত্রে তেমন কোনো জবাবদিহিতা থাকে না। আবার দেশি টাকা আগে-পরে কিংবা সুবিধাজনকভাবে ব্যয়ের সুযোগ থাকে; যা বৈদেশিক ঋণের ক্ষেত্রে সম্ভব হয় না।

এ কারণে বৈদেশিক সহায়তায় বাস্তবায়নযোগ্য প্রকল্পে একধরনের ধীরগতি দেখা দেয়। সময়মতো প্রকল্প বাস্তবায়নের ব্যর্থতার কারণে প্রতিশ্রুতি থাকলেও অর্থ ছাড় দেয় না দাতারা।এর ফলে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে না।

আবার সরকারি ক্রয় আইন ও ক্রয় বিধিমালা এবং উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার প্রকিউরমেন্ট গাইড লাইনস সম্পর্কে প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মকর্তার পর্যাপ্ত ধারণা ও অভিজ্ঞতা না থাকায় প্রকল্প বাস্তবায়নে দেরি হয়। জনবল নিয়োগ নিয়েও প্রকল্প বাস্তবায়নে বিলম্বিত হয়। সাধারণ আউট সোর্সিংয়ের মাধ্যমে প্রকল্পে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া হয়। প্রকল্প চলাকালীন এসব কর্মচারী চাকরি ছেড়ে অন্যত্র চলে যায়। যার জন্যও প্রকল্প বাস্তবায়নে বিলম্বিত হয়।

প্রাপ্ততথ্যে দেখা যায়, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে অর্থাৎ ১৯৭১-৭২ সালে ঋণ ও অনুদানের প্রতিশ্রুতি ছিল ৬১ কোটি ৮ লাখ ডলার। এর মধ্যে অনুদান হিসাবে ৫১ কোটি ২৭ লাখ ডলার ও ঋণ হিসাবে নয় কোটি ৮০ লাখ ডলার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি থাকলেও অর্থছাড় হয়েছে যথাক্রমে ২৪ কোটি ৫২ লাখ ও দুই কোটি ৫৬ লাখ ডলার। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে বাংলাদেশে স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু হওয়ার কারণে ওই সময় অর্থছাড় না হওয়াটা অস্বাভাবিক নয় বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পূর্ণাঙ্গ বাজেটে অর্থাৎ ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরেও দাতাদের কাছ থেকে অর্থ সহায়তা পাওয়া যায়নি। ওই সময় অনুদান ও ঋণ মিলিয়ে মোট ৮৭ কোটি ৮৪ লাখ ডলার অর্থ সহায়তা পাওয়ার কথা থাকলেও পাওয়া গেছে ৫৫ কোটি ১৪ লাখ ডলার। অর্থাৎ প্রতিশ্রুতির তুলনায় ৩৭ শতাংশ কম অর্থ সহায়তা পাওয়া গেছে।

প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, প্রতিশ্রুতির তুলনায় বিভিন্ন অর্থবছরে ২৫ থেকে ৫০ শতাংশ কম অর্থ সহায়তার পাওয়ারও নজির রয়েছে।

তবে প্রতিশ্রুতির তুলনায় বেশি অর্থ ছাড়ের ঘটনাও ঘটেছে। ১৯৭৯-৮০ অর্থবছরে প্রথমবারের মতো প্রতিশ্রুতির তুলনায় অতিরিক্ত অর্থছাড়ের ঘটনা ঘটেছে। ওই বছর ১১৫ কোটি ৩২ লাখ ডলারের বিপরীতে অর্থছাড় হয়েছে ১২২ কোটি ৩০ লাখ ডলার। এ ছাড়া ১৯৮৭-৮৮ অর্থবছরে ১৫২ কোটি ৯৮ লাখ ডলারের বিপরীতে ১৬৪ কোটি চার লাখ ডলার, ১৯৯০-৯১ অর্থবছরে ১৩৭ কোটি ডলারের বিপরীতে ১৭৩ কোটি ২৬ লাখ ডলার, ১৯৯২-৯৩ অর্থবছরে ১২৭ কোটি ৪৫ লাখ ডলারের বিপরীতে ১৬৭ কোটি ৫৪০ লাখ ডলার, ১৯৯৪-৯৫ অর্থবছরে ১৬১ কোটি ২২ লাখ ডলারের বিপরীতে ১৭৩ কোটি ৯০ লাখ ডলার পাওয়া গেছে। ১৯৯৯-২০০০ অর্থবছরেও প্রতিশ্রুতির তুলনায় বেশি অর্থ ছাড় হয়েছে। ওই অর্থবছরে ১৪৭ কোটি ৫০ লাখ ডলারের প্রতিশ্রুতি থাকলেও ছাড় হয়েছে ১৫৮ কোটি ৭৯ লাখ টাকা। এ ছাড়া ১৯৭৬-৭৭ সালের (৭২ কোটি ৭০ লাখ ডলার) পর ২০০১-০২ অর্থবছরে সবচেয়ে কম (৮৭ কোটি ৮৭ লাখ ডলার) অর্থছাড়ের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল দাতা উন্নয়ন অংশীদারি সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে। কিন্তু অর্থবছর শেষে অর্থছাড় হয়েছে ১৪৪ কোটি ২৩ লাখ ডলার। অর্থাৎ প্রতিশ্রুতির তুলনায় ৬৪ শতাংশেরও বেশি অর্থছাড়ের ঘটনা ঘটে।

অপরদিকে, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে মোট ৭০৪ কোটি ৮০ লাখ অর্থ সহায়তা্ পাওয়ার প্রতিশ্রুতি ছিল। এর মধ্যে অনুদান হিসাবে ৫৪ কোটি ৪৯ লাখ ডলার ও ঋণ হিসাবে ৬৫০ কোটি ৩১ লাখ ডলার। কিন্তু অর্থবছর শেষে মোট সহায়তা পাওয়া গেছে ৩৫৬ কোটি ৩৫ লাখ ডলার। এর মধ্যে অনুদান হিসাবে ৫৩ কোটি পাঁচ লাখ ও ঋণ হিসাবে ৩০৩ কোটি ৩০ লাখ ডলার পাওয়া গেছে। অর্থাৎ প্রতিশ্রুতির তুলনায় প্রায় ৫০ শতাংশ কম অর্থছাড় হয়েছে।

প্রসঙ্গত, বৈদেশিক সাহায্যকে সাধারণত চারটি প্রধান ভাগে ভাগ করা হয়। এগুলো হলো-দীর্ঘমেয়াদি ঋণ (যা সাধারণত দশ বা বিশ বছর ধরে গ্রহীতা দেশ কর্তৃক বৈদেশিক মুদ্রায় পরিশোধ যোগ্য), নমনীয় ঋণ (যা স্থানীয় মুদ্রায় পরিশোধ যোগ্য, যার পরিশোধের মেয়াদ দীর্ঘ, অথবা যা অত্যন্ত কম সুদে পরিশোধযোগ্য), সরাসরি অনুদান ও কারিগরি সাহায্য প্রদান।

(দ্য রিপোর্ট/এমকে/জেডটি/এনআই/এম/মে ২১, ২০১৭)

পাঠকের মতামত:

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

M

M

SMS Alert

এর সর্বশেষ খবর

- এর সব খবর