thereport24.com
ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল 24, ৭ বৈশাখ ১৪৩১,  ১১ শাওয়াল 1445

সাগরে ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ, মিলছে না নদীতে

২০১৭ আগস্ট ০৯ ২০:০৩:৫৪
সাগরে ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ, মিলছে না নদীতে

বিধান সরকার, বরিশাল ও জুয়েল সাহা বিকাশ, ভোলা : হিসাব অনুযায়ী ইলিশের ভরা মৌসুম চলমান। রাখী পূর্ণিমা শুরু হয়েছে সোমবার (০৭ আগস্ট) থেকে। গভীর সাগরে প্রচুর ইলিশ ধরা পড়লেও তা আকারে ছোট। অপরদিকে বরিশাল-ভোলা অঞ্চলের স্থানীয় নদীতে ইলিশের দেখা নেই মোটেও। ষাট ভাগ জেলে ভিতর নদীতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন। এতে করে কেবল জেলেরাই নয়; যেসব আড়ৎদার স্থানীয় নদীর ইলিশের ওপর নির্ভর করেন তাদের ব্যবসায় মন্দাভাব বলে জানালেন জেলা মৎস্য আড়তদার এসোসিয়েশনের সভাপতি। আর সপ্তাহ খানিকের মধ্যেই স্থানীয় নদীতে ইলিশের দেখা মিলবে বলে জানালেন ওয়ার্ল্ডফিশ ইলিশ প্রকল্পের টিম লিডার ড. ওহাব।

মেহেন্দিগঞ্জের জেলে মো. বাসেত মাঝি মেঘনায় ইলিশের সাদা জাল পাতেন। গত বছর এই সময়ে মেঘনায় বেশ ইলিশ ধরা পড়লেও এবার হাতে গোনা দু’চারটা মাত্র। তার বক্তব্য- এতে করে সংসার চালানো এখন দায়। আক্ষেপ করে চন্দ্রমোহনের সোবাহান ঢালী বলেন, কেবল মেঘনা নয়, কালাবদর, ইলিশা, তেঁতুলিয়া, পায়রা, বিষখালী এসব ভিতর গাঙ্গে এখন পর্যন্ত ইলিশের দেহা নাই। বারো মাসে তেরো অভিযান থাহে ইলিশ রক্ষার নামে। যেমন ধরেন ২৫ সেপ্টেম্বর থেকে ৯ অক্টোবর পর্যন্ত চলে মা ইলিশ রক্ষা অভিযান। আবার পয়লা নভেম্বর থেকে ৩০ জুন এই ৮ মাস থাহে জাটকা রক্ষায় নিষেধাজ্ঞা। এছাড়া মাছের ডিম পাড়ার জন্য এলাকাভিত্তিক ১৫ দিন করে চলা এই অভিযানের স্থায়ীত্ব অয় ২ মাস। তাইলে ইলিশ ধরার জন্য সময় থাকে কতডুক? এই প্রশ্ন তোলেন তিনি। মধ্য শ্রাবণ থেকে শুরু হয়ে মধ্য আশ্বিন পর্যন্ত থাকবে ইলিশ পড়ার মৌসুম। তবে এবার শ্রাবণের শেষ সপ্তাহে এসে ঠেকেছে নদীতে ইলিশের দেখা নেই। এমন কথা বলে নিজ থেকেই উত্তরে এই জেলে বলেন, বাও বাতাস নাই, দক্ষিণা বাতাস না আইলে নদীতে ইলিশের দেখা মিলবে ক্যামনে। এ বছর এহন পর্যন্ত বানের পানি আহে নাই।

ভোলার দৌলতখান উপজেলার মেদুয়া ইউনিয়নের বাঁধের পাড়ে থাকেন মো. হানিফ (৩৪)। মেঘনা নদীতে মাছ ধরে সংসার চলে তাঁর। ইলিশের আকালে অচল হওয়ার পথে তার পাঁচ সদস্যের সংসার। তিনি জানান, ভোরে ফজরের আজানের আগে ৪-৫ জন জেলে মিলে তারা নদীতে জাল ফেলেন। জাল তোলার পর মাত্র দুটি ইলিশ দেখা পান। তা বিক্রি করে পাওয়া গেছে ২৫০ টাকা। তা-ও আবার চার ভাগ হয়েছে।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, হানিফের মতো অনেক জেলে মেঘনায় ইলিশ না পেয়ে বেকার বসে আছেন। তাঁরা জানান, ইঞ্জিনচালিত নৌকা নিয়ে গেলে তাঁদের জ্বালানি তেল ও খাবার খরচই উঠতে চায় না। এ জন্য মাছ ধরতে না গিয়ে বসে আছেন।

মেদুয়া মাঝিরহাটের মো. ফারুক মাঝি (৩২) বলেন, মৌসুমের শুরুতে অনেক আশা নিয়ে তিনি জাল নিয়ে নদীতে যান। মাছ না পেয়ে শেষে তাঁকে শূন্য হাতে ফিরতে হয়েছে। বারবার একই ঘটনা ঘটায় এখন ইলিশ ধরতে যাওয়ার উৎসাহও কমে গেছে। জ্বালানি তেলসহ আনুষঙ্গিক খরচ বেড়ে যাওয়াও তাদের মাছ ধরতে না যাওয়ার একটি বড় কারণ।

মদনপুরের জেলে সিরাজ মাঝি (৪৫), নাছির মাঝি (৩৫), নুরুল ইসলাম মাঝিসহ (৪৯) অনেক জেলে বলেন, ট্রলার নিয়ে মাছ ধরতে গেলে দুই-তিন হাজার টাকা খরচ হয়। প্রথম দিকে প্রতিবারে দুই-এক হালি করে ইলিশ পাওয়া গেলেও এখন মাছ পাওয়াই দায়। এতে খরচ ওঠে না। তাই তাঁরা উৎসাহ পাচ্ছেন না।

ভরা মৌসুমেও মাছ না পড়ার কারণ হিসেবে সদর উপজেলার তুলাতুলির জেলে আ. মতিন মাঝি (৬১) জানান, ইলিশের উৎস হিসেবে পরিচিত ছিল মেঘনার শাহবাজপুর চ্যানেল। ঝাঁকে-ঝাঁকে ইলিশ পড়ত সেখানে। এখন সেখানে হরদম ট্রলার চলাচল করায় ইঞ্জিনের বিকট শব্দে ইলিশ আসে না। ওই চ্যানেলে একজন জেলে এখন দিনে দু-একটি ইলিশও পায় না।

দৌলতখান মদনপুরের জেলে রহমত মুন্সী (৮০) বলেন, ‘ইলিশ মাছ আইবো কোইত্তন! নদীডার মাইদ্যে যে পরিমাণ চর পড়ছে, বাডা (ভাটা) ওইলে হাডু পানি থাহে। এই পানিতে আইয়ে সব জাটকা ইলিশ। হেগিন ধরি হালায় পিডাইন্যা জাইল্যারা। ওরা তো মাছেরে বড় অইতো দেয় না। আমরা পামু কুডে?’

২৭ বছর ধরে মাছ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত দৌলতখান গুপ্ত বাজারের ব্যবসায়ী আলম মাঝি (৫২) বলেন, নদীতে ডুবোচর রয়েছে। এতে পানির গভীরতা কমে যাওয়ায় ইলিশ আসতে চায় না। ইলিশ তাড়াচ্ছে ট্রলারের শব্দ। বর্ষাকালে আগে যে পরিমাণ বৃষ্টি হতো, এখন তা হচ্ছে না। এই প্রাকৃতিক পরিবর্তনের কারণে জুন-জুলাই মাসেও ইলিশের দেখা নেই।

ভোলা সদর উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কমকর্তা মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ইলিশ মাছ চলাচলে যে পরিমাণ স্রোত প্রয়োজন নদীর তলদেশ ভড়াট হয়ে যাওয়ার কারণে ওই পরিমাণ স্রোত নেই। তাই ইলিশ চলাচলে বাধা সৃষ্টি হওয়ায় নদীতে ইলিশ কমে গেছে। তবে দু’এক সপ্তাহর মধ্যে ইলিশ কিছুটা বাড়বে।

অপরদিকে বরিশাল জেলা মৎস্য আড়ৎদার এসোসিয়েশনের সভাপতি অজিত কুমার দাস জানান, এখন ইলিশের দেখা মিলছে গভীর সমুদ্রে। মংলা পোর্টের বাইরে যেখান থেকে জাহাজ চলাচল করে সেই খাড়িতে এবং সোনার চর থেকে ৬-৭ ঘণ্টা বোট চালানো দূরত্বে ইলিশ ধরা পড়ছে। কূলে মাছ নেই বলে সাদা জালে মাছ পাচ্ছে না জেলেরা। এখন লম্বা জাল ও লাল জালে ধরা পড়া ইলিশ আসছে বরিশালের মোকামে। সাগরে বৈরী আবহাওয়ার কারণে উত্তাল থাকায় মিষ্টি পানিতে মাছ এখনো আসতে পারছে না। এজন্য হিজলা, কালিগঞ্জ, মেঘনা, ঢালচর, সোনারচর, রূপারচর ছাড়াও স্থানীয় নদীতে ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে না। তাছাড়া এবার এখন পর্যন্ত বড় সাইজের ইলিশের খুব একটা দেখা মেলেনি। ফিসিংবোটে যে ইলিশ আসছে তা ৪ থেকে ৫’শ গ্রামেরই বেশি। এখন সাগরে মাছ পড়ায় ৪ থেকে ৫’শ গ্রামের মাছ ৩৫০ থেকে ৩৬০ টাকা কেজি আর ৬’শ থেকে ৭’শ গ্রামের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ৫ থেকে সাড়ে ৫’শ টাকা কেজি দরে। এই দর মাছের আমদানীর ওপর নির্ভর করে। দিনকয়েক মহিপুরে বিদ্যুৎ বিভ্রাটের কারণে চাহিদার বরফ সরবরাহ করতে না পারায় বরিশালের পোর্ট রোডের মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র দেড় হাজার মণ ইলিশ এসেছে। তবে স্থানীয় নদীর ইলিশের স্বাদ আলাদা বলে এর চাহিদা সবচেয়ে বেশি থাকে। তাদের ১৬৫ জন আড়তদারের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ আড়ৎদার স্থানীয় নদীর ইলিশ কেনাবেচা করে থাকেন। স্থানীয় নদীর জেলেদের ন্যায় এই আড়ৎদাররাও কষ্টে আছেন এযাবৎ ব্যবসা শুরু করতে না পেরে।

স্থানীয় নদীতে ইলিশের দেখা নেই আর আকার ছোট হওয়ার বিষয়ে ওয়ার্ল্ডফিশ ইলিশ প্রকল্পের টিম লিডার ড. ওহাব বলেন, ১৯৯০ সালের পর ২৫ বছর পাড় হয়ে ২০১৬ সালে প্রচুর ইলিশ মিলেছে। ৫ লাখ টন ইলিশ আহরণ করা হয়েছিল ২০১৬ সালে। আর সরকার অভিযান চালিয়ে প্রায় ৭০ ভাগ অবৈধ জাল বন্ধ করতে পেরেছেন। তাই তিনি মনে করেন এবছর ইলিশ না পাওয়ার কোন কারণ নেই।

তার কর্মরত ৯টি জেলায় বৈজ্ঞানিকদের সাথে কথা বলে জানতে পেরেছেন এবারের ইলিশের স্বাস্থ্যগত অবস্থা বেশ ভালো। তাই বড়ো সাইজের ইলিশ না পাওয়ার কোন কারণ দেখছেন না এই গবেষক। তবে জেলেদের দাবি নদীর মোহনায় চড় পড়ায় ইলিশ প্রবেশ করতে পারছে না, এই যুক্তি মানতে নারাজ তিনি। তার মতে সপ্তাহের মধ্যেই স্থানীয় নদীতে ইলিশ পড়বে।

মূলত ডিম পাড়ার জন্য ইলিশ সাগর থেকে মিঠা পানিতে চলে আসে। এখনো মাছের পেটে ডিমের দেখা মিলছে না বলে স্থানীয় নদীতে মাছ নেই এমনটা জানালেন মৎস্য কর্মকতা (ইলিশ) বিমল চন্দ্র দাস। এই কর্মকর্তার যুক্তি হলো, এখন সাগর মোহনা জুড়ে ইলিশের জালে ঘেরা। এজন্য ইলিশ স্থানীয় নদীতে প্রবেশ করতে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তবে ঝড় জলোচ্ছ্বাস হলে এই জেলেরা মোহনা ছেড়ে নিরাপদে আশ্রয় অবস্থান নিলে ওই সুযোগে মাছ স্থানীয় নদীতে প্রবেশ করতে পারবে। তাছাড়া সবে ৭ আগস্ট সোমবার রাখি পূর্ণিমা শুরু হয়েছে। এখন জল বাড়বে এবং দু’চার দিনের মধ্যেই স্থানীয় নদীতে ইলিশের দেখা মিলবে।

(দ্য রিপোর্ট/এপি/এনআই/আগস্ট ০৯, ২০১৭)

পাঠকের মতামত:

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

M

M

SMS Alert

এর সর্বশেষ খবর

- এর সব খবর