thereport24.com
ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল 24, ৭ বৈশাখ ১৪৩১,  ১১ শাওয়াল 1445

কুড়িগ্রামে শুকনো জায়গার অভাবে রান্না বন্ধ

২০১৯ জুলাই ১৯ ১০:৩৭:৪৫
কুড়িগ্রামে শুকনো জায়গার অভাবে রান্না বন্ধ

কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি: রাত তিনটায় কলকল করে বানের পানি ঢোকার শব্দ শুনে ঘুম ভাঙল রবিদাস-শ্যামলী দম্পতির। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই পানিতে ভরে গেলো ঘর। বাধ্য হয়ে বাড়ির পাশের উঁচু সড়কে বিছানা পেতে বাকি রাত কাটাতে হলো। কিন্তু দিনের আলো ফুটতেই দেখেন, ঘর পেরিয়ে বন্যার পানি সেই সড়কেও উঠে আসছে। চুলা ভিজে যাওয়ায় সকালের রান্নাটুকুও সেরে নিতে পারেননি শ্যামলী, অ্যাজমা রোগী ষাটোর্ধ রবিদাসের মুখে তাই বেলা ১১টাতেও কোনও খাবার জোটেনি।

কুড়িগ্রামের চিলমারী উপজেলার বন্যাকবলিত একটি পরিবারের বাস্তব ঘটনা এটি। কী হতভাগ্য পরিবারটি! এটা শুধু একটি পরিবারের কথা নয়। মোটামোটি ওই এলাকায় সব পরিবারই এখন বানের পানিতে বাস্তুভিটা হারিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে ভবঘুরে জীবনযাপন করছে।

চোখের সামনে বানের পানি বাড়তে দেখার ব্যাপারে শ্যামলী বলেন, ‘রাইতে হঠাৎ ঘরত পানি উঠি সউক ভিজি গেইছে। সড়কত উঠছি, এটিইয়ো পানি। কই যায়া আশ্রয় নেই! সকাল থাকি কোনও দানা পেটত যায় নাই। এখনা শুকনা খাবার দিলে খাবার পাইলং হয়!’

ঘরের ভেতর কোমর সমান উচ্চতায় পানি থাকায় রান্না করতে পারছেন না উপজেলার বালাবাড়ি এলাকা সংলগ্ন পানফুল বেওয়া, বিবিজান বেওয়াসহ রমনা বাঁধে আশ্রয় নেওয়া কয়েকটি পরিবার। তাদের পানিবন্দি অবস্থার ছবি তুলতে গেলে পানফুল বেওয়া বলেন, ‘ছবি তুলি কী করবেন, হামাক এখনা শুকনা খাবার দ্যাও।’

এই বানভাসিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাদের ঘরে চাল রয়েছে কিন্তু সেই চাল রান্না করার জায়গা এবং শুকনো জ্বালানি নেই। তাই ভাত-তরকারি রান্না করতে পারছেন না। দোকান থেকে কিছু কিনে খাবেন, সে টাকাও তাদের কাছে নেই। যারা একটু উঁচু স্থানে আশ্রয় নিয়ে ঘরে থাকা চাল রান্না করছেন, তাদের অনেকে আবার টাকার অভাবে তরকারির সংস্থান করতে পারছেন না। পাচ্ছেন না বিশুদ্ধ খাবার পানি।

চিলমারী উপজেলার মতো কুড়িগ্রাম জেলার সব পানিবন্দি পরিবারেই প্রায় একই চিত্র। জেলার ৯ উপজেলার প্রায় পৌনে ২ লাখ পরিবার এখন বন্যাদুর্গত।

এদিকে উলিপুর উপজেলার বুড়াবুড়ি ইউনিয়ন, কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার ভোগডাঙ্গা ও হলোখানা ইউনিয়নসহ বন্যা কবলিত কয়েকটি এলাকা ঘুরে পানিবন্দি পরিবারগুলোর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অধিকাংশ পরিবার এখনও কোনও পর্যায়ের ত্রাণ সহায়তা পাননি। এমনকি স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরাও তাদের খোঁজ নিতে যাননি।

উলিপুর উপজেলার বুড়াবুড়ি ইউনিয়ন পরিষদের সচিব মো. কাওসার আলী জানান, ইউনিয়নের প্রায় ৯৫ ভাগ পরিবার পানিবন্দি। এরমধ্যে অনেকে বসত বাড়ি ত্যাগ না করলেও প্রায় ১০ হাজার পরিবার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও বাঁধে আশ্রয় নিয়েছেন।

বন্যা পরিস্থিতি
বাঁধে আশ্রয় নেওয়া পরিবারগুলোর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শুকনো খাবারের পাশাপাশি তাদের এখন জরুরি বিশুদ্ধ পানি ও শৌচাগারের পাশাপাশি গবাদি পশুর জন্যও খাদ্যের প্রয়োজন।

বেড়িবাঁধে গবাদি পশু নিয়ে আশ্রয় নেওয়া নয়াগ্রামের কছিমুদ্দি ও আফসার বলেন, ‘গরু নিয়া মহাবিপদে আছি। চারপাশে পানি, খড়ের ডিবিও ডুবি গেইছে। বউ-ছাওয়ার খাবার জোটাই না গরুর খাবার জোটাই, খুব পেরেশানিত আছি।’

এবারের বন্যা ১৯৮৮ সালের বন্যার ভয়াবহতাকেও ছাড়িয়েছে জানিয়ে চিলমারী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শওকত আলী সরকার বীরবিক্রম বলেন, ‘এবারের বন্যা ৮৮ সালের বন্যাকেও ছাড়িয়েছে। আমি নিজে ওই বন্যার প্রত্যক্ষদর্শী। তখন এতো মানুষও ছিল না। পানি এত বেশি প্লাবিত হয়নি, এতো ক্ষয়ক্ষতি ও হাহাকার ওঠেনি। এবারের বন্যা সবকিছুকে ছাড়িয়ে গেছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘মানুষের এখন শুকনো খাবার আর বিশুদ্ধ পানি প্রয়োজন। মানুষ রান্না করার জায়গা পাচ্ছে না। তাই শুকনো খাবার না পেলে কষ্ট আরও বাড়বে।’

পানিবন্দি পরিবারগুলোর জন্য শুকনো খাবারের বরাদ্দ প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল, বিষয়টি স্বীকার করে চিলমারী ও উলিপুর উপজেলার দায়িত্ব থাকা উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) আব্দুল কাদের বলেন, ‘আমরা দুই উপজেলার জন্য ছয়শ’ শুকনো খাবারের প্যাকেট বরাদ্দ পেয়েছি, যা বিতরণ করা হয়েছে। এছাড়াও উলিপুর উপজেলার জন্য যে জিআর ক্যাশ পাওয়া গেছে, তা দিয়ে বৃহস্পতিবার ১৮ শ’ প্যাকেট শুকনো খাবার ক্রয় করে বন্যা দুর্গতদের মাঝে বিতরণ করা হয়েছে। আমরা আরও চাহিদা দিয়েছি।’

এই দুই উপজেলায় অর্ধলক্ষাধিক পানিবন্দি পরিবারের জন্য শুকনো খাবার বেশি প্রয়োজন জানিয়ে ইউএনও বলেন, ‘অনেক পরিবারে চাল রয়েছে। কিন্তু এখন তাদের প্রয়োজন শুকনো খাবার। বিষয়টি আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি।’

এদিকে পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আরিফুল ইসলাম জানান, ব্রহ্মপুত্রসহ জেলার সবকটি নদনদীর পানি কমতে শুরু করেছে। আশা করছি বৃহস্পতিবার রাত থেকে একটা ভালো পরিবর্তন হবে।

জেলা প্রশাসক (ভারপ্রাপ্ত) মো. হাফিজুর রহমানকে একাধিকবার ফোন দিলেও তিনি রিসিভ করেননি। তবে তার স্বাক্ষরিত দুযোর্গ ব্যবস্থাপনা শাখার বন্যা সংক্রান্ত প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, ১৮ জুলাই পর্যন্ত কুড়িগ্রামের বন্যা দুর্গতদের জন্য ৫শ’ মেট্রিকটন চাল, ২ হাজার প্যাকেট শুকনা খাবার এবং সাড়ে ১৩ লাখ টাকা জিআর ক্যাশ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

(দ্য রিপোর্ট/আরজেড/জুলাই ১৯,২০১৯)

পাঠকের মতামত:

SMS Alert

জেলার খবর এর সর্বশেষ খবর

জেলার খবর - এর সব খবর