thereport24.com
ঢাকা, মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ 24, ৫ চৈত্র ১৪৩০,  ৯ রমজান 1445

প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির ৪২ বছরে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়

২০২০ নভেম্বর ২২ ১০:৩৯:২৭
প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির ৪২ বছরে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়

ইবি প্রতিনিধি: শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতির বহু মনীষীর স্মৃতি বিজড়িত ভূমি কুষ্টিয়া। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বাংলা সাহিত্যের শক্তিমান ঔপন্যাসিক মীর মশাররফ হোসেন, বাউল সম্রাট লালন শাহ, সাংবাদিকতার পথিকৃৎ কাঙাল হরিনাথসহ অনেক প্রবাদপ্রতিম মানবের স্মৃতিধন্য শহর কুষ্টিয়া। জেলাটিকে দেশের সাংস্কৃতিক রাজধানী হিসেবেও অভিহিত করা হয়।

১৯৭৯ সালের ২২ নভেম্বর কুষ্টিয়া-ঝিনাইদহ জেলার সীমান্তে শান্তিডাঙা-দুলালপুর নাম নিভৃত জনপদে প্রতিষ্ঠিত হয় দেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় (ইবি)। স্বাধীন বাংলায় প্রতিষ্ঠিত প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়ও এটি। বিশ্ববিদ্যালয়টি হাঁটি হাঁটি পা পা করে ৪২ বছর পূর্ণ করলো।

কুষ্টিয়া-খুলনা মহাসড়কের পাশে দৃষ্টিনন্দন ও সুবৃহৎ প্রধান ফটক হয়ে ভেতরে প্রবেশ করতেই চোখে পড়বে বঙ্গবন্ধুর সুবিশাল ম্যুরাল ‘মৃত্যুঞ্জয়ী মুজিব’। সেখানে দাঁড়িয়ে ডানে তাকালেই মুক্তিযুদ্ধের স্মারক ভাস্কর্য ‘মুক্ত বাংলা’। আর বাঁয়ে সততার স্মারক ‘সততা ফোয়ারা’। পাশেই রয়েছে ভাষা শহীদদের স্মৃতিতে তৈরি ক্যাম্পাসভিত্তিক বৃহৎ শহীদ মিনার এবং স্বাধীনতা যুদ্ধে নিহত শহীদদের স্মরণে নির্মিত দৃষ্টিনন্দন কারুকার্যের ‘স্মৃতিসৌধ’।

এইতো গেল কৃত্রিম সৌন্দর্য। সেখান থেকে একটু সামনে পা বাড়াতেই পাওয়া যাবে বিস্তৃত সবুজে ঘেরা ‘ডায়না চত্বর’। চত্বরটি ক্যাম্পাসের প্রাণ। শিক্ষার্থীদের আড্ডায় মুখরিত থাকে পুরোটা সময়। ডায়না চত্বরের বাম দিকে শিক্ষার্থীদের আসাসিক হল এলাকা, আর ডানে শিক্ষক-কর্মকর্তাদের ডরমিটরি। এ দুয়ের মাঝে একাডেমিক ও প্রশাসনিক ভববসমূহ। পশ্চিম কোণে ছাত্রীদের হল ঘেঁষে উত্তর দিকে বয়ে গেছে মনোরম লেক। সকাল থেকে দুপুর শিক্ষার্থীদের পদচারণা মুখর একাডেমিক এলাকা আর বিকেলে কোলহল বাড়ে লেক আর হল এলাকায়। এ দৃশ্যগুলো যে কারো মন কাড়তে বাধ্য।

সবুজে ঘেরা এই ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পেছনে রয়েছে এক সুদীর্ঘ ইতিহাস। দেশের গণমানুষের চাহিদা পূরণ করতে তৎকালীন সরকার ১৯৭৬ সালে ১লা ডিসেম্বর ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন। পরে ১৯৭৯ সালের ২২ নভেম্বর ঝিনাইদহ-কুষ্টিয়ার সীমান্তে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। পরবর্তীতে ইসলামী ও আধুনিক শিক্ষার সমন্বয়ে উচ্চশিক্ষা প্রদানের লক্ষ্যে জাতীয় সংসদে ১৯৮০ সালের ২৭ ডিসেম্বর ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাক্ট ১৯৮০ (৩৭) পাস হয়।

বহু চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে বর্তমানে ১৭৫ একর ভূমির ওপর ৮টি অনুষদ, ৩৪টি বিভাগ, ১টি ইনস্টিটিউট, ১টি ল্যাবরেটরি স্কুল এন্ড কলেজ নিয়ে পরিচালিত হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়টি। এখন পর্যন্ত ১৩ জন উপাচার্য বিশ্ববিদ্যালয়ে দায়িত্ব পালন করেছেন। প্রথম উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ড. এ.এন.এম. মমতাজ উদ্দিন চৌধুরী এবং বর্তমানে রয়েছেন অধ্যাপক ড. শেখ আবদুস সালাম।

শতভাগ আবাসিকতার মহাপরিকল্পনা নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়। তবে প্রতিষ্ঠার ৪১ বছর পার হলেও সে স্বপ্ন অধরাই রয়ে গেছে। যদিও কালের বিবর্তনে একসময়ের সেশনজটের যাতাকলে পিষ্ট বিভাগগুলোতে কিছুটা গতিশীলতা এসেছে। ক্যাম্পাসে শুরু হয়েছে সাংস্কৃতিক জোয়ার। বাঙালি জাতির রক্তাক্ত ইতিহাসের সমৃদ্ধ সংগ্রহশালা হিসেবে কেন্দ্রীয় লাইব্রেরিতে চালু হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ কর্ণার, একুশে কর্ণার এবং বঙ্গবন্ধু কর্ণার। বেড়েছে কাঠামোগত উন্নয়ন। ৫৩৭ কোটি টাকার মেগাপ্রকল্পে ৯টি ১০ তলা ভবনসহ ও ১৯টি ভবনের ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণের কাজ শুরু হয়েছে। যা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হলে স্বপ্ন পূরণের দিকে অনেক ধাপ এগিয়ে যাবে বিশ্ববিদ্যালয়।

একজন ছাত্র হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে আমার প্রত্যাশা অনেক। বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে দাঁড়িয়ে হিসেব কষতে গিয়ে একজন শিক্ষার্থী হিসেবে আমি পেয়েছি অনেক কিছুই; তবে না পাওয়ার বেদনাও রয়েছে। সবুজ ক্যাম্পাসে চার বছর পার করে জড়ো করেছি অনেক স্মৃতি। সে আলোকেই বলতে চাই কিছু প্রত্যাশার কথা।

উন্নত বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে যা যা অনুপস্থিত তার সবই প্রত্যাশা করি। তবে সব যে পাবো না, সেটা মেনে নিয়েই বলছি প্রথমেই যেটা দরকার তা হলো ‘ইউনিভার্সিটি বা বিশ্ববিদ্যালয়’ কনসেপ্টটি ছাত্র-শিক্ষকদের মাঝে সত্যিকার অর্থে স্পষ্ট করে তোলা। অবকাঠামো উন্নয়ন, পর্যাপ্ত ও মেধাবী শিক্ষক নিয়োগ, বিদ্যমান প্রশাসনিক জটিলতা নিরসন করাও জরুরি।

একাডেমিক গতিশীলতা বৃদ্ধি করতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের শতভাগ আবাসিকতা ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরে নিশ্চিত করা প্রয়োজন। ছাত্র-শিক্ষক দূরত্ব কমিয়ে শ্রেণিকক্ষের বাইরেও তাদের মিথস্ক্রিয়া নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি।

গবেষণায় জুনিয়র স্কলার হিসেবে শিক্ষকদের সাথে শিক্ষার্থীদের কাজ করার সুযোগ সৃষ্টি হলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সার্থকতা পূর্ণ হবে। শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বগুণ সৃষ্টির পাশাপাশি সামাজিক-সাংস্কৃতিক সচেতনতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। ভবিষ্যতের দক্ষ নেতৃত্ব তৈরী এবং নিজেদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে নিয়মিত ছাত্র সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে হবে।

বিশ্ববিদ্যালয়ে র‍্যাগিং-বুলিং কঠোরভাবে নিরুৎসাহিত করা প্রয়োজন এবং ক্যাম্পাসে অযাচিত বহিরাগত প্রবেশে বিধিনিষেধ আরোপ দরকার। জগদ্দল পাথরের মতো শিক্ষার্থীদের উপর চাপিয়ে দেয়া সকল প্রকার বর্ধিত ফি কমিয়ে আনা দরকার। ক্যাম্পাসের পরিচ্ছন্নতা ও সৌন্দর্য বৃদ্ধির মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মানসিক প্রশস্ততা বৃদ্ধি এবং নারী শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত দককার।

আমি প্রত্যাশা করি, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন গুণগত শিক্ষা ও মৌলিক গবেষণাকে সর্বোচ্চ অগ্রধিকার দেবেন। শিক্ষক কর্মকর্তা কর্মচারিদের ফলপ্রসু কর্মশালার মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপযোগী করে গড়ে তুলবেন। দলীয় সংকীর্ণতার বাইরে বেরিয়ে মেধার ভিত্তিতে শিক্ষক নিয়োগ ও যোগ্য ব্যক্তিদের পদায়ন করবেন।

বিভাগগুলো থেকে প্রকাশিত জার্নাল নিয়মিতকরণ, মৌলিক আর্টিকেল প্রকাশ এবং সেখানে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করবেন। যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে সেমিস্টার ও বার্ষিক পরীক্ষা পদ্ধতির ক্ষেত্রে ক্লাস বৃদ্ধি করবেন। গ্রামীণ জনপদে অবস্থিত হওয়ায় শিক্ষার্থীদের নাগরিক সুবিধা পেতে বেগ পেতে হয়। স্থানীয় ও গ্রাম্য রাজনীতি থেকে এখনো মুক্ত হয়নি ক্যাম্পাসের সার্বিক পরিবেশ। সেগুলো শক্ত হাতে দমন করবেন। প্রত্যাশা পূরণের আকাঙ্খায় সবাইকে জানাই প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর শুভেচ্ছা।

বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. শেখ আবদুস সালাম বলেন, প্রান্তিক জনপদের এ বিশ্ববিদ্যালয়টিকে একটি পূর্ণাঙ্গ আবাসিক হিসেবে গড়ে তোলার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছি। যুগের চাহিদানুযায়ী এখানের প্রতিটি বিভাগকে গবেষণা ও উদ্ভাবনের দুর্গ হিসেবে গড়ে তোলাই আমার প্রধান লক্ষ্য।

(দ্য রিপোর্ট/আরজেড/২২নভেম্বর, ২০২০)

পাঠকের মতামত:

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

SMS Alert

শিক্ষা এর সর্বশেষ খবর

শিক্ষা - এর সব খবর