thereport24.com
ঢাকা, শুক্রবার, ২৯ মার্চ 24, ১৫ চৈত্র ১৪৩০,  ১৯ রমজান 1445

শহীদুল জহির : জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা

২০১৪ মার্চ ২২ ২০:২৭:২০
শহীদুল জহির : জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা

মহিউদ্দীন মোহাম্মদ

অকালপ্রয়াত কথাসাহিত্যিক শহীদুল জহিরের মৃত্যু দিবস ২৩ মার্চ। অনতিদীর্ঘ ৫৪ বছরের জীবনে তিনি সৃষ্টি করেছেন বাংলা সাহিত্যের স্মরণীয় বেশ কিছু মুহূর্ত— তার উপন্যাসে, তার গল্পে। স্বাধীনতার মাস হিসেবে মার্চ বাঙালীর কাছে একটি জ্বল-জ্বলে মাস। স্বাধীনতা আন্দোলনের গনগনে স্মৃতির শেকড় এ মাসেই প্রোথিত হয়েছিল। “স্বাধীনতা তুমি রবি ঠাকুরের অজর কবিতা, অবিনাশী গান / স্বাধীনতা তুমি কবি নজরুল ঝাকড়া চুলের বাবরি দোলানো মহান পুরুষ, সৃষ্টি সুখের উল্লাসে কাঁপা—” এমন উপমার আরও গভীরে আমাদের স্বাধীনতার বীজ। এমত প্রত্যয় দৃঢ় উচ্চারণ— লেখক হিসেবে আমাকে বিমুগ্ধ করে। পাশাপাশি গভীর বেদনা এই যে, বাংলাকে নিয়ে নানা রাজনৈতিক চাতুর্যতা আমাদেরকে অনাহুত পীড়নে ব্যাধিগ্রস্ত করে। আর সেই পীড়নের দায় থেকে চিন্তার এক ঘূর্ণিপাক তৈরী হয়। চিন্তাশীল মানুষ হিসেবে সেই পাক শহীদুল জহিরকেও ছুঁয়েছে একই পরম্পরায়। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীকালে যে হাওয়ার দোলায় আত্মভোলা বাঙালী ক্রমাগত আত্মঘাতী রাস্তায় ধাবমান হচ্ছিল, এমন একটা বিমূর্ত সময় কখনই কাম্য নয়। আত্মবিস্মৃতির জালে আটকা পড়ে সাময়িক যুদ্ধের গৌরবগাথা অপ্রয়োজনীয় হয়ে ওঠানোর দুলকি চালের কাছে নিজেকে না সপে দিয়ে সচেতন হয়ে উঠলেন শহীদুল। তার দেখা জীবনটাকে আলাদাভাবে উপস্থাপনে সচেষ্ট হলেন। কালের সাক্ষী হিসেবে বাংলা ভাষার এই কীর্তিমান লেখক প্রস্তুত করলেন একটি অনবদ্য উপন্যাস ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা'।

উপন্যাসটি সম্পর্কে শহীদুল জহির বিভিন্নজনের সাথে আলাপচারিতায় জানিয়েছেন কীভাবে এটি লেখা হয়েছিল। এখানে আমরা দু’টি সূত্রমুখ হাজির করব। চিন্তার কোনো স্রোতধারা তাকে স্পর্শ করেছিল। তার আগে আসুন পাঠক একবার আমরা তার উপন্যাসটি সম্পর্কে সামান্য একটু দৃকপাত করি। সৈয়দ শামসুল হকের জলেশ্বরী, শওকত আলীর দিনাজপুরসহ উত্তর বাংলা, হাসান আজিজুল হকের রাঢ়, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের পুরনো ঢাকা, অলিগলি, তার ভেতরে দমবন্ধ চাপা অন্ধকারের সুড়ঙ্গ থাকলেও তিনি ঢুকে পড়েছেন। শহীদুল জহির লক্ষ্মীবাজার, ওয়ারী, নারিন্দা, ভূতেরগলি, আগারগাঁও মহল্লা, তার আশপাশের বিশদ চালচিত্র তার সাহিত্যের পটভূমি হিসেবে ব্যবহার করেছেন। বিশেষ এ অঞ্চলসমূহ লেখকের গল্প-উপন্যাস থেকে বেরিয়ে গোটা দেশের প্রতিনিধি হয়ে ওঠে। খণ্ড-খণ্ড এলাকা হয়েছে অসংখ্য ভূমি, বিশাল বাংলার সমান। শহীদুল জহির নিভৃতচারী কিন্তু অনুসন্ধানী, কোলাহলবিমুখ কিন্তু প্রাণাবেগ ও জীবনের চাঞ্চল্য প্রকাশে দৃঢ় ও দক্ষ। গোষ্ঠী-বিচ্ছিন্ন কিন্তু প্রভাব বিস্তারকারী, ক্রমশ চিন্তামনস্ক পাঠকের লেখক হয়ে উঠেছিলেন। শহীদুল জহিরের সাহিত্যচর্চার সময়সীমা প্রায় ত্রিশ বছর। এই সময়ে তিনি লিখেছেন কম, পড়েছেন বেশী। স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে শহীদুল জহির নিশ্চিত উজ্জ্বল নাম যার পাঠ তৃষ্ণা ছিল বিশ্বব্যাপী, ভূবনডাঙ্গা থেকে বীজ সংগ্রহ করে নিজের সাহিত্যের স্বতন্ত্র চারা রোপণ করেছিলেন স্বভূমিতে। স্বদেশের চৌহদ্দিতে ধীরে ধীরে শাখা-প্রশাখা মেলে হয়ে উঠেছিলেন একজন দ্যুতিময় লেখক।

শহীদুল জহির বাস্তববাদী লেখক। তিনি লাতিন আমেরিকার যাদুবাস্তবতার ধারারও লেখক। চরিত্র দেখার, দেখানোর জন্য পায়ের নীচে যে ভিত রেখে তিনি ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্রকে পর্যবেক্ষণ করেন এবং তার সারৎসার দ্বারা উদ্বোধিত হয়ে নিজের জন্য বিশ্লেষণ তৈরী করেন; অংশত এটা মার্ক্সবাদের আলোয় তৈরী। অংশত মানে ধ্রুপদী মার্ক্সবাদের জোরালো তত্ত্বেও তিনি আবৃত বা অভিভূত নন। তার দৃষ্টিভঙ্গি বরং সফিসটিকেটেড মার্ক্সবাদীর। এই অভিধা তাকে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে না। লেখার মধ্য দিয়ে লেখক জীবনবীক্ষা ছড়িয়ে দিয়ে যান। ছক বাঁধা নিজস্ব আইডিয়া বা চরিত্রের তৎপরতার মধ্য দিয়ে তার দার্শনিকতা ধারণ করে বিষয় ও চরিত্র দুই-ই অযথা ভারি হয়ে ওঠে না। কোথাও তারা সুতোয় বাঁধা পড়েন। লেখকের প্রকাশ্য বা গোপন ইচ্ছা জিতিয়ে দেওয়ার জন্য গল্প-উপন্যাসের চরিত্র পুতুল হয়ে যায় না। এ কাজটি তখনই সম্ভব লেখক যখন পরিমিতিবোধ ও নির্লিপ্তির মাত্রা যোগ্যহাতে মোকাবেলা করতে পারেন। 'পারাপার', 'ডলু নদীর হাওয়া', 'ডুমুর খেকো মানুষ' গল্পগ্রন্থ এবং 'জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা' উপন্যাস তার প্রমাণ।শহীদুল জহিরের 'জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা' উপন্যাস যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশ হলেও এর সূত্রপাত ঘটে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ কেন্দ্রে রেখে। ‘বদু মওলানার একাত্তরের প্রথম দিককার চেহারার টানাপোড়েন পঁচিশে মার্চের পর কেমন প্রশান্ত হয়ে আসে এবং মহল্লায় যে-দিন প্রথম মিলিটারি আসে সে-দিন সে কীভাবে আবিষ্কৃত হয়। মহল্লার লোকেরা সে-দিন মাত্র এক ঘণ্টার প্রলয়ের পর বুঝতে পারে তার বিশেষ মর্যাদার কথা।’ উপন্যাসে এমন ইঙ্গিতই একজন পাকিস্তানী দালাল চরিত্রের জন্য যথেষ্ট। বিকেলে বদু মওলানা মহল্লার আকাশে কাক ওড়াত। কাকের উদ্দেশে যে গোশতের টুকরোগুলো ছুড়ে দিত সেগুলো ছিল মানুষের। মানুষের শরীরের টুকরো টুকরো অংশের যে বর্ণনা এই উপন্যাসে শহীদুল জহির দিয়েছেন তা পড়তে গিয়ে পাঠকের স্নায়ু ও শিল্পের সংযম প্রায় ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়। আবার তিনি আমাদের বাঁচিয়ে দিয়েছেন প্রসঙ্গান্তরে সরে গিয়ে। একাত্তরের নিষ্ঠুর বাস্তবতা তুলে তিনি কি পাঠকের ধৈর্যের পরীক্ষা করেন? উপন্যাসটিতে নরঘাতক বদু মওলানা সম্পর্কে জানতে পারি : 'বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়া বিষয়ক তার যে দুর্যোগ হয় সেই অবস্থার ভেতর দিয়ে পার করে নিয়ে আসে এবং আশি সনে সেই একই দলের বড় নেতা হয়। আব্দুল মজিদ এখন দেখে আজিজ পাঠানদের সঙ্গে বদু মওলানার দল একসঙ্গে সরকারবিরোধী আন্দোলন করে।'

আমরা বাস্তবেই দেখতে পাচ্ছি, রাজনৈতিক অস্থিরতা, সামাজিক অস্থিতিশীলতা এবং রাষ্ট্রক্ষমতার অন্যায্য একাধিক পরিবর্তনের সুযোগে যুদ্ধাপরাধীরা পুনর্বাসিত হয়েছে। আবার তারা শক্তি পেয়েছে। শহীদুল জহিরের এ উপন্যাসটি ছোট হলেও তলদেশস্পর্শী। শহীদুল জহির উদ্যোগী নিয়ত যত্নশীল পাঠকের নিশ্ছিদ্র মনোনিবেশ কামনা করেন। সময় খরচের সময় আছে এমন মজা-সন্ধানী পাঠক তার পাঠক হতে পারেন না। গভীর একাগ্রতা দিয়ে তার আখ্যানের অর্থোদ্ধার করতে হয়। এখানেই বারোয়ারী লেখকদের সঙ্গে শহীদুল জহিরের পার্থক্য। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, সৈয়দ শামসুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসকে আত্তীকরণ করলেও শহীদুল জহির নিজের মতো করে বেড়ে উঠতে নিষ্ঠাবান ছিলেন। তার প্রয়াস ছিল ঐতিহ্যকে খারিজ করে নয়, বরং ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় পরিবর্তিত জীবনকাল নতুনভাবে নির্ণয় করা। তার সম্পর্কে মূল্যায়ন করতে গিয়েআব্দুল মান্নান সৈয়দ বলেন, 'অনেকেই সৈয়দ ওয়ালীঊল্লাহর ধারাবাহিকতায় পুষ্ট ও বর্ধিত। এদের মধ্যে সবচেয়ে যার লেখা আমাকে বিস্মিত ও আশান্বিত করেছিল তিনি হচ্ছেন শহীদুল জহির।.... আমাদের সমসাময়িক বন্ধু প্রাবন্ধিক, অনুবাদক এবং অন্য বহু গুণে গুণান্বিত হায়াৎ মামুদও শহীদুল জহিরের লেখা পছন্দ করেছিলেন।'

সাধারণত আমরা উপন্যাস বলতেই ভাবি, কোনো একজন ঔপন্যাসিক বা লেখক শুধু তার কল্পনা থেকে তুড়ি মেরে বের করে আনেন ঘটনা, পরিবেশ, চরিত্র আর সে সবের পশ্চাৎপট। 'জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা'র কোথাও যেন উপন্যাসের সেই ব্যাপারটি নেই। নামের ভেতরই যেন এই ছোট্ট উপন্যাস বা নভেলেটের বাস্তবতা, যা নভেলেটের পুরোটা জুড়ে ম্যাজিকের মতো রুব্দশ্বাসে আবর্তিত হয়েছে। ইতিহাসের পাতা থেকে তুলে আনা— বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের আগে ও পরের কাহিনী। সময়ের ক্রম, বিভিন্ন স্থান এমনকি ঘটনাগুলো পর্যন্ত বাস্তবের সমান্তরালে আরেক বাস্তবের নির্মিতি। শহীদুল জহিরের যাদুবাস্তবতা আর হুয়ান রুলফোর যাদু বাস্তবতা একেবারেই এক নয় ‌'জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা' আমাদের স্বাধীনতার সবাক দলিল। ঘটনাক্রম ও কালপঞ্জি— নিয়ে যেমন নিপুণভাবে খেলা করেন হুয়ান রুলফো, আলেহো কার্পেন্তিয়ার, গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজরা, তেমনি নিপুণ খেলা খেলতে চেষ্টা করেছেন শহীদুল জহির।

শহীদুল জহিরের নবাবপুর, লক্ষ্মীবাজার সব তো আমাদের অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ ইতিহাসের কেন্দ্রে বিদ্যমান। তবে গার্সিয়া মার্কেজের মতো শহীদুল জহিরও শেষ পর্যন্ত এসে পৌঁছেছেন ইতিহাসেরই এক সজীব সংজ্ঞার্থে। মহল্লার প্রতিটি বালক ও বালিকার কাছে, পুরুষ ও রমণীর কাছে যেন এই প্রথম উৎঘাটিত হয়েছিল যে, জগৎ-সংসারে একটি ব্যাপার আছে যাকে বলে বলাৎকার। তারা আজীবন যে দৃশ্য দেখে কিছু বোঝে নাই, যেখানে একটি মোরগ তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায় মুরগীকে; মহল্লায় মিলিটারি আসার পর তাদের মনে হয়েছিল, প্রাঙ্গণের মুরগীর মতো তার মা ও কিশোরী কন্যাটি, পরিচিত ভালোবাসার মানুষ, তাদের চোখের সামনে প্রাণ-ভয়ে এবং অনভিপ্রেত সহবাস এড়ানোর জন্য ছুটে বেড়াচ্ছে... পাকিস্তানী মিলিটারি এক ঘণ্টায় বিশ লক্ষ বছর ধরে মানুষের বুনে তোলা সভ্যতার চাদর ছিঁড়ে ফেলে এবং লক্ষ্মীবাজারের লোকেরা তাদের মহল্লার মানুষের গুহাচারিতা হাজার এবং লক্ষ বছর পর এক মর্মান্তিক অক্ষমতা পুনরায় অবলোকন করে।

শহীদুল জহিরের এই উপন্যাস পড়লে বোঝা যায় কতটা ক্ষোভ, কত ঘৃণা লালিত হয়েছে ঔপন্যাসিকের গভীর মননে। এই উপন্যাসের পটভূমি হল স্বাধীনতা যুদ্ধের পটভূমি এবং যুদ্ধোত্তর দেশে রাজাকারদের সদম্ভ পুনর্বাসন এবং ক্ষমতায়ন। উপন্যাসটিতে ঘটনার বাস্তবতার ও বর্ণনার যাদুবাস্তবতার এক নতুন মাত্রা এনে দেয়— যা ট্রাডিশনাল ইউরোপীয় উপন্যাসের ধারাকে ভেঙে চুরমার করে দেয়। হুয়ান রুলফোর 'পেদ্রো পারামো'কে যেমন বলা হয় মেক্সিকোর আত্মা থেকে বেরিয়ে আসা অনন্য উপন্যাস, তেমনি 'জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা' হচ্ছে বাংলাদেশের অভ্যুদয় থেকে বেরিয়ে আসা অনন্য নভেলেট। পেদ্রো পারামোর চেয়েও ছোট্ট নভেলেট 'জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা'— মাত্র আটচল্লিশ পাতার এই নভেলেটের প্রতি বাক্যের শরীরজুড়ে জ্বলজ্বল করছে চাপা বিদ্বেষ। হুয়ান রুলফো আশ্চর্য দক্ষতায় থামিয়ে দেন চরাচরকে, আর শহীদুল জহির সেই দক্ষতার উত্তরসূরী হয়ে জাগিয়ে তোলেন রায়েরবাজারের বধ্যভূমিকে। মোমেনাকে আব্দুল মজিদ চার দিন পর খুঁজে পায় রায়েরবাজারের পশ্চিম প্রান্তে, বুড়িগঙ্গা নদীর কিনারে, বালুচরের মতো দেখতে এক মাঠের ওপর। আব্দুল মজিদ এখন বুঝতে পারে না এই চারদিন তার আদৌ সম্বিৎ ছিল কি-না। তার এখন শুধু মনে পড়ে খুঁজে খুঁজে সে যখন মোমেনাকে পায় সেই সময়টিকে। সে তখন তার বোনকে দেখে— তার একটি স্তন কেটে ফেলা, পেট থেকে ঊরু পর্যন্ত ক্ষতবিক্ষত, ডান ঊরু কোমর থেকে হাঁটু পর্যন্ত চিরে তরমুজের মতো হাঁ করে রাখা। নির্যাতনের এই চিত্র প্রত্যক্ষ করতে করতে পাঠকের দম বন্ধ হয়ে আসবে অপরদিকে যুদ্ধবন্দী মানুষদের মতো আরেক মোমেনা এদিকে প্রতিনিধিত্ব করে লাখ-লাখ নির্যাতিত নারীর। লক্ষ্মীবাজারের লোকদের মনে পড়ে একাত্তর সনে বদু মওলানা নরম করে হাসত আর বিকেলে কাক ওড়াত মহল্লার আকাশে। এক থালা গোশত নিয়ে ছাদে উঠে যেত বদু মওলানা আর তার ছেলেরা। একটি অদেখা মেয়ের জন্য লক্ষ্মীবাজারের এক বিষণ্ন বৃদ্ধের হৃদয় সে-দিন ভেঙে পড়ে। এখন তার বাড়ির আঙ্গিনায় তার নিজের আর তার বড় ছেলের জোড়া কবর। অন্য আরেকটি টুকরো পড়েছিল জমির ব্যাপারীর বাড়ির কুয়োতলায়, বিকেলে ভাতের চাল ধোয়ার সময়, হাঁড়ির ভেতর। এটা ছিল একটি কাটা পুরুষাঙ্গ। হাঁড়ির ভেতর এসে পড়তেই জমির ব্যাপারীর কিশোরী কন্যাটি চমকে উঠেছিল, কিন্তু হাঁড়ির ভেতর থেকে বের করে এনে সে বস্তুটি চিনতে পারে নাই। ছোট্ট একটি উপন্যাসের পুরোটা জুড়েই হত্যা-খুন, অত্যাচার-নিপীড়নের চিত্র দু'পাড় ভাঙা খরস্রোতা নদীর মতো বয়ে যাচ্ছে। রাজাকার আর পাকিস্তানী আর্মিদের এই নির্যাতন থেকে যেমন রেহাই পাইনি নারী, পুরুষ, উভয়লিঙ্গ; রেহাই পায়নি তেমন বাড়ির পোষাপ্রাণী কুকুর পর্যন্ত। নবাবপুর এবং লক্ষ্মীবাজারের বিধ্বস্তরূপ হয়ে ওঠে সারাবাংলা। আমাদের সমস্ত ইন্দ্রীয়ের মধ্য দিয়ে তা ক্রমাগত জীবন্ত হয়ে ওঠে, এর সব পরিবেশ আষ্টে-পৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে পাঠককে। আমরা যেমন শিউরে উঠি, তেমনি আমরা দেখতে পাই আমাদের নড়বড়ে অস্তিত্ব। যুগপৎভাবে ভয়ংকর নয়, মারাত্মক হিংস্র অনুপুঙ্খ গল্প সৃষ্টি করেছে শহীদুল জহির আশ্চর্য দক্ষতায় গ‌ভীর প্রখর অথচ সহজ, অনায়াস, স্বতঃস্ফূর্ত ভঙ্গিমায়; মনেই হয় না যে কোথাও একটা প্রখর শিল্পবোধ কাজ করে যাচ্ছে। আমরা জানি যে-কোনো ভালো লেখাতেই সে লেখা কীভাবে পড়তে হবে, তার চাবিটাও লুকিয়ে থাকে। শহীদুল জহির চেয়েছেন, তার পাঠকরা তার উপন্যাসের চরিত্র হয়ে অংশগ্রহণ করুক। বাক্যের পর বাক্য ভেঙে বিশ্লেষণ করে পাঠকরা বের করে নেবেন এর সমস্ত শাঁস, যেহেতু নভেলেটের কোনো প্রচলিত গড়নও মানা হয়নি এতে। এ এমন এক নভেলেট, যেখানে লেখক নিজে অনুপস্থিত থেকে বলে যাচ্ছেন পাঠককে কী করতে হবে আর তা না হলে তাকে আপাতত বদলাতে হবে তার ঠিকানা।

এবার আসুন তার আলাপচারিতায় অংশ নিই। এখানে থেকে বোঝা যাবে তার এই উপন্যাস নির্মাণের কলা ও বিষয় নির্বাচনের ঘণীভূত চিত্রটি। কেননা আমরা জানি শিল্প হচ্ছে ব্যক্তিত্বের পোট্রেট। ব্যক্তির মানস গঠনের প্রক্রিয়ায় রচিত হয় সৃজনশীল কর্মকাণ্ড।

একবার শহীদুল জহিরকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, ''...‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’ উপন্যাসে স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তির জন্য একটা মুক্তিযোদ্ধা পরিবার স্থানান্তরে যেতে বাধ্য হয়, এটার সঙ্গে বাস্তবতার সাদৃশ্য কতটুকু? তিনি উত্তর করেছিলেন, এটা আমি বলতে পারব না। এখন এটা অবশ্য দাবী করা বেশী হয়ে যায় যে জনগণ ঠিক করবে, আমি ঠিক করব না, এটা জনগণের ওপর ছেড়ে দিলাম। কিন্তু আসলে তাই, কারণ আমার ধারণা যে, এখন হয়তো অবস্থা একটু পরিবর্তিত হয়েছে। আমার ওই লেখাটার একটা অংশ আমরা হয়তো বেশীর ভাগ লোকই খেয়াল করি না, সেটা হচ্ছে যে, এই যে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির উত্থান, এই অপশক্তির পক্ষে-বিপক্ষে সবাই এনকারেজ করছি। প্রত্যেকে, এটা সাধারণ লোকজন বা জনগণ স্বীকার করছে না, ওই শক্তি যদিও রাজনৈতিক শক্তি এবং অন্য রাজনৈতিক যত শক্তি আছে সবাই ওই শক্তিটাকে সাহায্য করছে এবং তাদের উত্থান এবং প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করেছে। এটাই হচ্ছে ওই গল্পের মূল বক্তব্য। মূলতঃ আর কিছু না। তা সিচুয়েশন তখন তাই ছিল। ওই গল্পটিতে একটা সময়ের ব্যাপার আছে। ওই স্ট্রাকচারের জন্য গল্পটিকে আমি শেষ তিন লাইনের পরে বদলাইছি। আর ওই বইটির সেকেন্ড এডিশনে শেষ তিন লাইন বদলানো হয়েছে। এটা হচ্ছে কাহিনী।'' তিনি প্রশ্ন কর্তার উত্তরে আরও যুক্ত করেন, ... 'শেষ তিন লাইন সেকেন্ড এডিশনে একটু পরিবর্তন করা হয়েছে, আনস্পেসিফাইড করা হয়েছে। নাইনটিন এইটটি ফাইভ এ ফার্স্ট এডিশনে এটা খুবই স্পেসিফাইভ ছিল। এটা হচ্ছে পঁচাশি সনের কনটেক্সেটে লেখা, পঁচাশি সনে আমার যেটা মনে হয়েছে যে শহীদের একটি মেয়েকে মেরে ফেলা হয়েছে, তার পরিবারের যে বেদনা এবং একই সঙ্গে রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে এদেরকে ব্যবহার। এ বিষয়টিই ওখানে উঠে এসেছে। আমার উদ্দেশ্য হচ্ছে যে, ওইখানে যাওয়ার কথা হচ্ছে যে, আমরা তাদেরকে যেভাবে ব্যবহার করছি, ব্যবহার করলে সেই ব্যবহৃত বস্তুটি লেজিটিভেট হয়। আপনি যাকে ব্যবহার করেন, সেই ব্যবহারের কারণেই সে আমার জন্য প্রয়োজনীয় না হোক একটা কিছুতে থাকার অধিকার পায়, সেটা পাবেই। তো এভাবে আগায়। তা হলে আমি উপন্যাসে বলতে পারি না যে সবাই লাঠিটাঠি নিয়ে তাদেরকে মেরে শেষ করে দিক। এটা উপন্যাসে বলার কিছুই নাই।'একই উপন্যাস নিয়ে ভিন্ন প্রেক্ষাপটে আরেক প্রশ্নকর্তার জবাবে শহীদুল জহির বলেছিলেন— গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ পড়ে আমার মনে হয়েছিল, কোথাও আমি এ রকম পড়িনি। এর মধ্যে চিত্রকর্মের একটা গড়ন আছে। পিকাসোর গোয়ের্নিকা যে রকম একটা কিউবিক ফর্ম, একটা জিনিস ভেঙে ভেঙে ছড়িয়ে দেওয়া আছে। ঘোড়ার মাথা একদিকে, পা অন্যদিকে। কিউবিক শৈলীতে এককভাবে আপনি বিষয়টি আঁকছেন না। আমার মনে হয়েছে, একটি গল্পও যেভাবে খুশী বলা যায়। সেখানে দেখবেন, একটি কথা বলতে বলতে পরের লাইনে আরেকটি কথা চলে আসছে। গল্পের ছক এভাবে ভেঙে ফেলার কারণে আমি যাতায়াত করতে পেরেছি খুব দ্রুত।

উপন্যাসটি সম্পর্কে প্রসঙ্গক্রমে তিনি আরও যুক্ত করেন, 'এটা ভেঙে লিখলে হয়তো আরও বড় হতো। বড় করতে চাই নাই কয়েকটা কারণে। প্রথমত, এর প্রয়োজন ছিল না। এটার প্রকাশ নিয়েও সমস্যা ছিল। যত বড় হতো, প্রকাশ করতেও তত কষ্ট হতো। আর গল্পের চাহিদার চেয়ে জোর করে বড় করার তো দরকার নেই। এর কাহিনীতে অনেক সময় পার হয়েছে। ১৯৮৫ সালে শুরু হয়েছে, একাত্তরে ফিরে গেছে, আবার ১৯৮৫-র পরে এসে গল্প শেষ হয়েছে। তিনটা কালস্তরে চলাচলের একটা ব্যাপার ছিল। গল্পের ভেতরে তো লেখককেও চলাচল করতে হয়। আমাদের সাহিত্যের পরিচিত কাঠামোয় এভাবে চলাচল করা কঠিন। একটা থেকে আরেকটা সময়ে গেলে, লেখক হিসেবে আমি দেখি, বর্ণনায় সমস্যা তৈরী হয়। তখন যাদুবাস্তবতার মাধ্যমে এ কাজটা আমি করি। অনেকে এও বলেছে, এটা নাকি মার্কেজের লেখার অনুবাদ।' লেখকের এই দু’টি আলাপচারিতার সূত্রমুখ পাঠকক আলোচ্য উপন্যাসের করণকৌশল সম্পর্কে অবহিত করে। বোঝা যায় 'জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা'র বয়ান ও নির্মাণ কৌশল কীভাবে উপস্থাপিত হয়েছে।

সব দিক বিবেচনা করলে, জহিরকে স্পষ্টভাবে বোঝা যায়, যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটের (স্বাধীন-সার্বভৌম স্বনির্ভর বাংলাদেশের আশাভঙ্গের) সবচেয়ে শক্তিশালী ইন্টারপ্রেটর। তার গল্প-উপন্যাসে যুদ্ধপরবর্তী সময়ের রাজনৈতিক চালচিত্রের যে সন্নিবেশ ও চিত্রময়তা দেখতে পাওয়া যায় তা এক কথায় অতুলনীয়। তিনি বেঁচে থাকলে হয়তো আরও বেশী তার কর্মযজ্ঞের সাক্ষাৎ পেত পাঠকেরা। নতুন এক ধারা আরও পুষ্ট হতো তার হাতে। সেই আশার প্রলম্বিত অংশ থেকে আমাদের বিচ্ছেদ ঘটেছে নিরেট বেদনায়।


লেখক : কবি ও সাংবাদিক

পাঠকের মতামত:

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

M

M

SMS Alert

এর সর্বশেষ খবর

- এর সব খবর