thereport24.com
ঢাকা, রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১,  ২২ জমাদিউল আউয়াল 1446
কাওসার আজম

দ্য রিপোর্ট

এখন তারা এমপি...

২০১৪ জানুয়ারি ০৪ ১৭:৩২:০৩
এখন তারা এমপি...

কোনো রাজনৈতিক পরিচিতি নেই। নেই এলাকার মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ-যাতায়াত। আবার কারো কারো রাজনৈতিক পরিচয় থাকলেও নির্বাচন করে বিজয়ী হওয়ার মতো অবস্থা নেই। অথচ এখন তারা এমপি, দেশের আইনপ্রণেতা। রাজনৈতিক কূটকৌশল বা টাকার জোরে এমন অনেকেই বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন।

রবিবার অনুষ্ঠিতব্য ১০ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন ১৫৩ জন সৌভাগ্যবান ব্যক্তি। এটা অনেকের কাছে যেন আলাদিনের চেরাগ হাতে পাওয়ার মতো অবস্থা। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে খোয়াব (স্বপ্ন) দেখে সকালে তা বাস্তবায়ন দেখতে পাওয়ার পর যেমন মানুষ উল্লাসিত হয়, অনেকের ক্ষেত্রে এমনিই হয়েছে। বিএনপি-জামায়াত জোটসহ অন্যান্য বিরোধী দল নির্বাচনে অংশ না নেওয়ায় ভাগ্য খুলেছে তাদের।

রবিবার ১০ম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এ নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করে প্রতিহতের ঘোষণা দিয়ে শনিবার থেকে টানা ৪৮ ঘণ্টার হরতাল ডেকেছে ১৮ দলীয় জোট। তবে ভোটের আগেই ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫৩টি আসনে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, ওয়ার্কার্স পার্টি ও জাসদ মনোনীত প্রার্থী।

তাদের মধ্যে প্রায় অর্ধেকই বিএনপি জোট নির্বাচনে আসলে বিজয়ী হওয়ার মতো কোনো অবস্থা নেই। এমনও ব্যক্তি রয়েছেন যারা কোনোদিন সক্রিয় রাজনীতি করেননি। জনগণের সঙ্গে কোনো ধরনের যোগাযোগ ছিল না অতীতে, এখনো তাদের ভোটাররা চেনেন না। অনেকেই আছেন যারা দলের নেতা হলেও ভোটের রাজনীতিতে এমপি হওয়ার মতো অবস্থা নেই।

১০ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কুমিল্লা-২ (হোমনা-তিতাস) আসনে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে রীতিমতো হৈ চৈ ফেলে দিয়েছেন জাতীয় পার্টির (এরশাদ) প্রার্থী আমির হোসেন ভূইয়া। এ আসনের বর্তমান এমপি বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য এমকে আনোয়ার।

জেলার তিতাস উপজেলার কড়িকান্দি গ্রামের বাসিন্দা মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান আমির হোসেন ভূইয়া ১৯৯৬ সালে দাউদকান্দি হাসানপুর শহীদ নজরুল ইসলাম সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। এরপর বিদেশ চলে যান। বিদেশ ফেরত আমির হোসেন ৭-৮ বছর আগে ঢাকার উত্তরায় ছোট ভাই জামানের নামে ‘জামান কনফেকশনারি’ চালু করেন। এরপর উত্তরায় ছেলের নামে আরেকটি দোকান ‘আরাফাত ট্রেডার্স’চালু করেন।

২০১০ সালে জাতীয় পার্টির এক কেন্দ্রীয় নেতার হাত ধরে রাজনীতিতে আসেন তিনি। অথচ তার নিবার্চনী এলাকার (হোমনা-তিতাস) লোকেরা তাকে কখনো দেখেনি এবং তার সম্পর্কে তেমন কিছুই জানে না। তিনি এখন বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত এমপি। যদিও এখন পর্যন্ত তিনি এলাকায় যাননি বলে জানা যায়। ভোটের রাজনীতি কখনো না করেও শুধুমাত্র রাজনৈতিক কূটকৌশল আর অর্থ ব্যয়ের মাধ্যমে আমির এখন এলাকার এমপি। স্থানীয়দের বক্তব্য আমির এমপি নির্বাচিত হওয়া তো দূরের কথা বিএনপি নির্বাচনে থাকলে বিএনপির প্রার্থীর সঙ্গে ভোটের ব্যবধান হতো আকাশ-পাতাল।

এ ব্যাপারে আমির হোসেনের ব্যক্তিগত মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে রিসিভ করা হয়নি।

বিএনপির ঘাঁটি বলে পরিচিত বগুড়ার ৭টি সংসদীয় আসনের মধ্যে ৫টিতেই আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির প্রার্থী বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। বলা হচ্ছে, তাদের মধ্যে এমন ৩ জন রয়েছেন যারা বিএনপি জোট নির্বাচনে অংশ বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীর অর্ধেক ভোটও পেতেন না।

আওয়ামী লীগের সঙ্গে আসন ভাগাভাগির ফলে বগুড়া-৩ (দুপচাঁচিয়া-আদমদীঘি) আসনে কপাল খুলেছে স্থানীয় জাতীয় পাটির সভাপতি অ্যাডভোকেট নুরুল হক তালুকদারের। এ আসনে বর্তমান এমপি বিএনপির হাফিজুর রহমান তালুকদার। গত নির্বাচনে এ আসনে আওয়ামী লীগ নেতা আনছার আলী মৃধা হাফিজুরের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বিপুল ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হন। এবার আনছার আলী মৃধার মনোনয়ন বাতিল হয়ে যাওয়ায় নুরুল হক বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ভোট হলে এমপি হওয়ার মতো অবস্থান নেই নুরুল ইসলামের। শুধু আসন ভাগাভাগির কারণেই আলাদিনের চেরাগ পেলেন তিনি।

নুরুল হক দ্যরিপোর্টকে বলেন, ‘আমি নির্বাচিত হয়ে অনেক খুশি। আমি ভাবিনি কখনো এভাবে এমপি নির্বাচিত হব।’

বগুড়া-৬ ( সদর) আসনটি বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার নিজের। এ আসনে অন্যদল থেকে নির্বাচিত হওয়া স্বপ্নের চাইতেও বেশি কিছু। অথচ বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন জেলা জাতীয় পার্টির সাধারণ সম্পাদক নুরুল ইসলাম ওমর। যদিও গত ৯ম সংসদ নির্বাচনে এ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিলেন মমতাজ উদ্দিন। কিন্তু আসন ভাগাভাগির কারণে জাপাকে আসনটি ছেড়ে দিতে দেওয়া হয়েছে।

এ ব্যাপারে নুরুল ইসলাম ওমর দ্যরিপোর্টকে বলেন, ‘নির্বাচিত হয়ে আমি অনেক খুশি ও আনন্দিত। তবে, নির্বাচন হলে আরও ভালো লাগত।’

একই অবস্থা বগুড়া-২ (শিবগঞ্জ) আসনে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়া জেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি শরিফুল ইসলাম জিন্নাহর ক্ষেত্রেও। বিএনপি নির্বাচন করলে তার নির্বাচিত হওয়ার সম্ভাবনা ছিল অনেক কম। এ ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘নির্বাচিত হয়ে নিজেকে ধন্য বলে মনে করছি। এবার বিএনপির প্রার্থী থাকলেও জনগণের ভোটে আমি নির্বাচিত হতাম।’

বাকি দুটি আসনে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত প্রার্থীদের ক্ষেত্রে প্রায় একই অবস্থা।

ফেনী-১ আসনটিতে বরাবরই নির্বাচিত হয়ে আসছেন বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়া। তার সঙ্গে আওয়ামী লীগের প্রার্থী সবসময়ই ধরাশায়ী হয়েছেন ব্যাপক ভোটের ব্যবধানে। এখানে ভাগ্য খুলেছে জাসদের (ইনু) প্রেসিডিয়াম সদস্য শিরিন আক্তারের। গত নির্বাচনে আওযামী লীগ প্রার্থী নির্বাচন করলেও এবার শিরিনকে ছেড়ে দেয়া হয় আসটি। ফলে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় তিনি এখন নির্বাচিত। এলাকার সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কোনোভাবেই শিরিন এমপি হওয়ার অবস্থা রাখেন না। রাজনৈতিক মারপ্যাঁচেই তিনি এখন আইনপ্রণেতা।

ময়মনসিংহ জেলার ১১টি সংসদীয় আসনের মধ্যে ইতোমধ্যেই ৬টি আসনে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় এমপি নির্বাচিত হয়েছে। তাদের মধ্যে আওয়ামী লীগের ৩ জন এবং জাতীয় পার্টির সাবেক ফার্স্ট লেডি রওশন এরশাদসহ ৩ জন।

ময়মনসিংহ-৪ (সদর) আসনে আওয়ামী লীগের বর্ষীয়ান নেতা অধ্যক্ষ মতিউর রহমান ৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নির্বাচিত হন। এ আসনে তিনি শক্তিশালী প্রার্থী হওয়া সত্ত্বেও কেন্দ্রের নির্দেশে আসনটি তিনি ছেড়ে দিয়েছেন জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য বেগম রওশন এরশাদকে। ফলে তিনিও বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত এমপি।

ময়মনসিংহ-৫ (মুক্তাগাছা) আসনে আওয়ামী লীগের কেএম খালিদ প্রার্থিতা প্রত্যাহার করায় বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে আলোচনায় এসেছেন উপজেলা জাতীয় পার্টির সাধারণ সম্পাদক সালাহউদ্দিন মুক্তি। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ঠিকাদারি ব্যবসায় ভালো হলেও সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার মতো অবস্থা ছিল না তার।

ময়মনসিংহ-৮ (ঈশ্বরগঞ্জ) আসনে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ফখরুল ইমাম। এ আসনে জাতীয় পার্টির তেমন কোনো কার্যক্রম নেই, নেই ভোট ব্যাংক। এরপরও তিনি বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত।

নারায়ণগঞ্জ-৩ আসন থেকে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন জাতীয় পার্টির যুগ্ম-মহাসচিব লিয়াকত হোসেন খোকা। বিএনপি জোট নির্বাচনে না আসায় আর নারায়ণগঞ্জের প্রভাবশালী একটি গোষ্ঠীর সঙ্গে ভালো সম্পর্ক থাকার সুবাদে এলাকায় জাতীয় পার্টির অবস্থান ভালো না হওয়া সত্ত্বেও তিনি এখন আইনপ্রণেতা।

একই অবস্থা সুনামগঞ্জ-৪ আসন থেকে নির্বাচিত পীর ফজলুর রহমান, সিলেট-৫ আসন থেকে নির্বাচিত সেলিম উদ্দিন, হবিগঞ্জ-১ আসন থেকে নির্বাচিত আবদুল মুনিম চৌধুরী, কক্সবাজার-১ আসন থেকে নির্বাচিত মো. ইলিয়াছের ক্ষেত্রেও।

শুধুমাত্র ভোটের রাজনীতিতে জাতীয় পার্টিকে সাথে রাখার জন্য এ সব আসনে নিজেদের প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নিয়েছে আওয়ামী লীগ। ফলে তারা এখন বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত সংসদ সদস্য।

সিলেট-৫ আসনে জাপার যুগ্ম-মহাসচিব সেলিম উদ্দিন দীর্ঘ দিন প্রবাসে থেকে জাতীয় পার্টির রাজনীতিতে আসেন বেগম রওশন এরশাদের সুবাদে। তার কারণেই তিনি এখন নির্বাচিত এমপি। অন্যদিকে, দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার পর নির্বাচনের ঠিক আগ মুহূর্তে জাতীয় পার্টিতে যোগ দিয়েই এমপি পদ বাগিয়ে নিয়েছেন সুনামগঞ্জ-৪ আসনের পীর ফজলুর রহমান।

১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে ৪৮ জন বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিলেন। বিএনপি ছাড়া অধিকাংশ দলই ওই নির্বাচন বয়কট করেছিল। ফলে ওই নির্বাচনে বিএনপি নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করে সরকার গঠন করে। তবে এ সরকারের মেয়াদ ছিল মাত্র দেড় মাস। বিতর্কিত ওই নির্বাচনে নির্বাচিতরা তাদের নামের পাশে এখনও ‘সাবেক সংসদ সদস্য’ লিখে রাখেন নিজেদের মর্যাদাবোধের স্বার্থে।

৫ জানুয়ারির বিরোধী দলবিহীন নির্বাচন সম্পন্ন হওয়ার পর আওয়ামী জোট সরকার গঠন করবে হয়ত। কিন্তু এ সংসদ কতদিন স্থায়ী হবে তা বলা কঠিন। তবে অতীতের মতো অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে নির্বাচিতরা সারাজীবন নিজেদের নামের সঙ্গে ‘সাবেক সংসদ সদস্য’ শব্দটি স্থায়ী হিসেবে লিখতে পারবেন এটাই বড় কথা।

প্রতিবেদন প্রস্তুতে সহায়তা করেছেন : ময়মনসিংহ, কুমিল্লা ও বগুড়া সংবাদদাতা

(দ্য রিপোর্ট/কেএ/ডব্লিউএস/সা/জানুয়ারি ০৪, ২০১৪)

পাঠকের মতামত:

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

SMS Alert

রাজনীতি এর সর্বশেষ খবর

রাজনীতি - এর সব খবর