thereport24.com
ঢাকা, রবিবার, ৫ মে 24, ২১ বৈশাখ ১৪৩১,  ২৬ শাওয়াল 1445

ভোটার ও পর্যবেক্ষকের উপস্থিতি ছাড়াই ভোট

৩৭ কেন্দ্র ছিল ভোটশূন্য

২০১৪ জানুয়ারি ০৬ ০৩:১৬:৩৫
৩৭ কেন্দ্র ছিল ভোটশূন্য

ন্যূনতম সংখ্যক ভোটার ও পর্যবেক্ষকের উপস্থিতি ছাড়াই শেষ হলো দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। বিরোধী দলবিহীন এ নির্বাচনে মোট ৩৭ কেন্দ্রে কোনো ভোট পড়েনি, আগে কোনো নির্বাচনে এমনটি ঘটেনি।


এ ছাড়া নাশকতার কারণে ৪৪১ কেন্দ্রের ভোটগ্রহণ স্থগিত, ভোট জালিয়াতি ও কারচুপির অভিযোগে ২৫ প্রার্থী ভোট বর্জন ও নির্বাচনী সহিংসতায় ১৯ জন নিহত হওয়ার ঘটনাগুলোও নতুন দেখা দিল এবারের নির্বাচনে।

দেশের ইতিহাসে অন্য একতরফা নির্বাচনগুলোকে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন হার মানিয়েছে বলে মনে করছেন দেশের বিশিষ্টজনরা। একই সঙ্গে আগেকার একতরফা নির্বাচনগুলো নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সকল গ্লানি ও অপবাদ ছাপিয়ে তা এখন আওয়ামী লীগের ওপর পড়বে বলেও তাদের অভিমত।


সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) নির্বাহী পরিচালক ড. বদিউল আলম মজুমদার দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘সর্বাধিক সংখ্যক ভোটকেন্দ্রে কোনো ভোট না পড়ার ঘটনা বাংলাদেশের নির্বাচনী ইতিহাসে একটি রেকর্ড। পূর্বে কোনো নির্বাচনে অন্তত একটি কেন্দ্রে কোনো ভোট না পড়ার ঘটনা ঘটেছে বলে আমার মনে পড়ে না। এবারের নির্বাচনে এ বিষয়টি স্পষ্ট করে দিল জনগণ এ নির্বাচনকে গ্রহণ করেনি।’


বদিউল আলম আরও বলেন, ‘বিভিন্ন গণমাধ্যমের সংবাদগুলোতে ভোটার শূন্যতার এই বিষয়টি উঠে এসেছে। কিন্তু ভোটগ্রহণ শেষে কোনো কোনো আসনে ৬০ থেকে ৭০ ভাগ ভোট কাস্টিং দেখানো হয়েছে। এতে প্রতীয়মান হয় ব্যাপক ভোট কারচুপি ও ভোট জালিয়াতিরও ঘটনা ঘটেছে। ইতোমধ্যে নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থা ফেমা দাবি করেছে এবারের (রবিবার) নির্বাচনে ১০ শতাংশেরও কম ভোটার ভোটপ্রদান করেছে। কিন্তু সরকারিভাবে ভোটগ্রহণের যে হার দেখানো হচ্ছে, তা নিশ্চয়ই কারও কাছে গ্রহণযোগ্যতা পাবে না।’


তিনি বলেন, ‘এ নির্বাচনকে প্রতিহত করতে বিরোধী দলও ছিল মরিয়া। দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষে রেকর্ড সংখ্যক মানুষ নিহত হয়েছে, যা কখনোই কাম্য নয়। ব্যাপক সহিংসতা ও ভোট জালিয়াতির অভিযোগ নিয়ে দশম জাতীয় সংসদ কত দিন চলতে পারবে, তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। আর সারাজীবন আওয়ামী লীগকে এমন একটি ন্যক্কারজনক নির্বাচন অনুষ্ঠানের গ্লানি ও অপবাদ বয়ে বেড়াতে হবে।’

এ ব্যাপারে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘আজকের নির্বাচনে কোনো পক্ষই জয়ী হয়নি। আজ বাংলাদেশ, দেশের জনগণ, গণতন্ত্র ও বিবেক পরাজিত হয়েছে। ক্ষমতায় টিকে থাকতে একটি দল নির্লজ্জ, সহিংস ও নৃশংসভাবে চেষ্টা চালিয়েছে। আর এতে দেশের ইতিহাসে লজ্জাজনক কিছু ঘটনা ঘটেছে। গণতন্ত্রের দোহাই দিলেও কোনো লাভ নেই। আজ আন্তর্জাতিক ও দেশীয় পর্যবেক্ষকদের কাছে এ নির্বাচনটি অগ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হয়েছে।’


ইফতেখার বলেন, ‘একটি ভোটারবিহীন, জালভোটের নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ তার দীর্ঘ রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের ওপর কলঙ্কের কালিমা লেপন করল। মানুষ এখন কথায় কথায় আর ১৫ ফেব্রুয়ারি নির্বাচনের উদাহরণ আনবে না। এখন থেকে দশম জাতীয় নির্বাচনই উদাহরণ হয়ে থাকবে।’


এদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. নুরুল আমীন বেপারির মতে, অতীতের সব একতরফা নির্বাচনের গ্লানি, কলঙ্ক ও অপবাদ এখন আওয়ামী লীগকেই ধারণ করতে হবে। তবে এই গ্লানির কিছুটা হলেও প্রশমন সম্ভব যদি তারা সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের লক্ষ্যে দ্রুততার সঙ্গে একাদশ নির্বাচনের আয়োজন করে। আর এ লক্ষ্যে তাদের অবশ্যই বিরোধী দলের সঙ্গে সমঝোতা করতে হবে।


রবিবার ভোটগ্রহণ শেষে নির্বাচনের সার্বিক দিক নিয়ে নুরুল আমীন বেপারি দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ এতদিন রাজনৈতিকভাবে নিজেদের গণতান্ত্রিক বলে যে অহঙ্কার করত, তা আজ ধূলিস্যাৎ হয়ে গেছে। অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে নির্লজ্জ একটি নির্বাচন জনগণকে উপহার দিল দলটি। এ নির্বাচনের পর গঠিত সরকার দেশীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। নতুন সরকার কখনোই নিজেদের গণতান্ত্রিক সরকার বলে দাবি করতে পারবে না।’


সকল অভিযোগ-অপবাদ ছাপিয়েছে দশম নির্বাচন : বিগত সময়কার সব একতরফা নির্বাচনের গ্লানি ও অপবাদ ছাপিয়ে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রথমবারের মতো অর্ধেকের বেশি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতার মাধ্যমে প্রতিনিধি নির্বাচন করা হয়। ১৫৩টি আসনে ভোটগ্রহণ ছাড়াই বেসরকারিভাবে একক প্রার্থীকে জয়ী ঘোষণা করা হয়। নির্বাচনের আগেই রেকর্ড সংখ্যক আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতার মাধ্যমে প্রার্থী জয়ী হওয়ার ঘটনায় নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন উঠে। তার পরও নির্বাচন অনুষ্ঠানে অনড় আওয়ামী লীগ নিজেদের অধীনে রবিবার ১৪৭টি আসনে ভোটগ্রহণ শেষ করে। ভোটারশূন্য এ নির্বাচনে শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত দেশের মোট ৩৭টি কেন্দ্রে একজন ভোটারও ভোটপ্রদান করেনি। এ সব কেন্দ্র থেকে শূন্য ব্যালট বাক্স নিয়েই ফিরে যেতে হয় নির্বাচনী কর্মকর্তাদের। বাংলাদেশের ইতিহাসে আগে কখনো কোনো কেন্দ্রে শূন্য ভোট পড়ার ঘটনা ঘটেনি।


পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, বাংলাদেশের ইতিহাসে এই প্রথম নির্বাচনী সহিংসতায় ১৯ জন নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। ভোটকেন্দ্র ও ব্যালট পেপারে আগুন দেওয়া, ব্যালট বাক্স ও ব্যালট পেপার ছিনতাইসহ নানা কারণে ৪৪১টি ভোটকেন্দ্রের ভোটগ্রহণ স্থগিত রাখতে বাধ্য হয় নির্বাচন কমিশন। নির্বাচনে ভোট কারচুপি, জালিয়াতি, ভোট ছিনতাই ও প্রভাব খাটানোর অভিযোগ মোট ২৫ জন প্রার্থী নির্বাচন বর্জন করেন। একই সঙ্গে বিভিন্ন বেসরকারি টেলিভিশন চ্যালেনে উঠে আসে জালভোটের মহোৎসবের চিত্র। জালভোটে সহায়তার অভিযোগ উঠেছে নির্বাচনী কাজে নিয়োজিত কর্মকর্তা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর।


বাক্স শূন্য ৩৭ কেন্দ্র : দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দেশের মোট ৩৭টি কেন্দ্রের ব্যালট বাক্স ছিল শূন্য। রবিবার বিকেল ৪টায় ভোটগ্রহণ শেষ হলে জেলা প্রতিনিধিদের দেওয়া সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী লালমনিরহাট জেলায় মোট ৮৯টি কেন্দ্রের মধ্যে ২৬টি কেন্দ্রের ব্যালট বাক্স ছিল শূন্য। ঝিনাইদহ জেলার ৫টি কেন্দ্রও ভোটার শূন্য ছিল। আর সাতক্ষীরা জেলার চারটি কেন্দ্রে কোনো ভোটার ভোট দিতে আসেনি। একই জেলার দুটি কেন্দ্রে পৃথকভাবে এক ভোট ও দুই ভোট পড়ারও ঘটনা ঘটেছে। সিলেট ও রাজশাহীতে একটি করে কেন্দ্রে কোনো ভোটার ভোট দেয়নি।


অন্যদিকে সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলায় বিএনপির নেতা ইলিয়াস আলীর গ্রামের বাড়ি রামদানা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রে কোনো ভোট পড়েনি। ওই কেন্দ্রে মোট ভোটারের সংখ্যা ১ হাজার ৯১০ জন।


প্রিসাইডিং কর্মকর্তাদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী দ্য রিপোর্টের লালমনিরহাট প্রতিনিধি জানান, জেলার ২৬টি কেন্দ্রে কোনো ভোট পড়েনি। ভোটশূন্য ২৬টি কেন্দ্র হলো- চর বাসুরিয়া, ছিরা মল্লিক, সোনাতলা, বলিরাম মাদ্রাসা, আইর খামার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, আমবাড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বড়বাড়ী আবুল কাশেম উচ্চ বিদ্যালয়, বানিয়া দীঘি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, হরি ঠাকুর দয়েজ উদ্দীন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, রাম দাস সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বুড়ির দীঘি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, পঞ্চগ্রাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, কাজীর চওড়া উচ্চ বিদ্যালয়, মহেন্দ্রনগর উচ্চ বিদ্যালয়, ভোলার চওড়া উচ্চ বিদ্যালয়, কাশিপুর উচ্চ বিদ্যালয়, ছিলাখানা উচ্চ বিদ্যালয়, শিবের কুটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, দক্ষিণ শিবের কুটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, নয়ারহাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, হরিদেব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ফুলাঘাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, নওদাবাস সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, হিরা মানিক উচ্চ বিদ্যালয়, সিন্দুর মতি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ধাইর খাতা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।


ঝিনাইদহ-৩ আসনের খালিশপুর, পুরন্দপুর ও বাজড়াপুর ভোটকেন্দ্রে কোনো ভোট না পড়ার ঘটনা ঘটেছে।
সাতক্ষীরা সদর আগরদাড়ী আমিনিয়া কামিল মাদ্রাসা ভোটকেন্দ্রে কোনো ভোট পড়েনি। এ কেন্দ্রে মোট ভোটার সংখ্যা ১ হাজার ৮৭৬। প্রিসাইডিং অফিসার আজিজুর রহমান বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
জেলার গোদাঘাটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ শেষে ব্যালট বাক্স শূন্য ছিল। এ কেন্দ্রে মোট ভোটার সংখ্যা ১ হাজার ৮৮৫।


আগরদাড়ী মহিলা দাখিল মাদ্রাসা কেন্দ্রে মোট ভোটার সংখ্যা ২ হাজার ৩৫৯, এই কেন্দ্রে কোনো ভোট পড়েনি। ধলবাড়িয়া কেন্দ্রের ব্যালট বাক্সও শূন্য ছিল ভোটগ্রহণ শেষে। এই কেন্দ্রে মোট ভোটার ছিল ১ হাজার ৯৪৫ জন।
এ ছাড়া একই জেলার শিয়ালডাঙ্গা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রে মোট ২ হাজার ৩৬৭ ভোটের বিপরীতে গৃহীত হয়েছে মাত্র একটি ভোট ও চুপড়িয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মাত্র দুজন ভোট প্রদান করেছেন। এই কেন্দ্রে মোট ভোটের সংখ্যা ২ হাজার ৪৯৪।


রাজশাহী-৬ চারঘাট উপজেলার মারিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রও ছিল ভোটশূন্য। এই কেন্দ্রে মোট ভোটার ছিল ২ হাজার ৭৯৭ জন।


দেশের জাতীয় নির্বাচনের ইতিহাসে আগে কখনো কোনো কেন্দ্র ভোটশূন্য ছিল না বলে জানিয়েছেন বিশিষ্টজনরা। বাংলাদেশের ইতিহাসে এই প্রথম কোনো কেন্দ্র ভোটশূন্য থাকার ঘটনা ঘটেছে।


নির্বাচনী সহিংসতা মৃত্যুর মিছিল : বিরোধী দলবিহীন এ নির্বাচনে এ পর্যন্ত সহিংসতায় ১৯ জন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এ সব ঘটনার মধ্যে যশোরে একজন, নওগাঁয় ১ বিএনপিকর্মী, চট্টগ্রামে বিজিবির গুলিতে ১ জামায়াতকর্মী, লক্ষ্মীপুরে পুলিশের গুলিতে শিবিরের এককর্মী, নীলফামারীতে যৌথবাহিনীর গুলিতে ২ জন, ফেনীতে পুলিশের গুলিতে ২ জন, রংপুরে পুলিশের গুলিতে ২ জন, দিনাজপুরে ১ আনসার সদস্যসহ ৩ জন, ঠাকুরগাঁওয়ে প্রিসাইডিং অফিসারসহ ৪ জন, লালমনিরহাটে ১ বিএনপিকর্মী এবং গাজীপুরে পেট্রোলবোমায় ১ ট্রাকচালক নিহত হয়েছেন।


যশোরের মণিরামপুরে ভোট চলাকালে রবিবার দুপুরে মতিয়ার রহমান নামে এক যুবক নিহত হয়েছেন। পুলিশের গুলিতে তার মৃত্যু হয়েছে বলে স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়। নওগাঁর মান্দা উপজেলার চকদেবিরাম গ্রামে ভোটদানে বাধা প্রদানকে কেন্দ্র করে র‌্যাব-পুলিশের সঙ্গে বিএনপির নেতাকর্মীদের সংঘর্ষে বাবুল হোসেন (৩৫) নামে এক বিএনপিকর্মী নিহত হয়েছেন।


চট্টগ্রামের লোহাগাড়া বরহাতিয়া কেন্দ্রে জামায়াত-শিবিরের সঙ্গে বিজিবির (বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ) সংঘর্ষে লালু নামের এক জামায়াতকর্মী নিহত হয়েছেন। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, জামায়াতকর্মীরা ওই কেন্দ্রে ব্যাপক ককটেল ফাটিয়ে হামলা চালালে বিজিবি সদস্যরা তাদের লক্ষ্য করে গুলি করে। এতে লালু নামের জামায়াতকর্মী মারা যায়।
লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জ উপজেলার চণ্ডিপুর ইউনিয়নের মাছিমপুর উচ্চবিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রে ব্যালট বাক্স ও পেপার ছিনতাইকালে পুলিশের গুলিতে শিবিরকর্মী মো. রুবেল (২২) নিহত হয়েছে।


নীলফামারীতে রবিবার ভোরে অর্ধশত কেন্দ্রে হামলা ও ব্যালট পেপারে আগুন দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। এ সময় যৌথবাহিনীর গুলিতে ২ জন নিহত হন। নিহতরা হলেন- ডিমলা উপজেলার খালিশা চাপানী ইউনিয়নের জাহাঙ্গীর আলম (৩৫) ও জলঢাকা উপজেলার কৈমারী বালাপাড়া গ্রামের মমতাজ উদ্দীন (৫০)।


ফেনী-৩ আসন (সোনাগাজী-দাগনভূঁইয়া) উত্তর চরচান্দ্রিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ব্যালট পেপার ছিনতাইকালে ৬ যুবদলকর্মী যৌথবাহিনীর গুলিতে আহত হয়েছেন। পরে আহত আরীফ মো. আবু মুসা (৩৩) ও শহীদুল্লাহ (২৫) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।


রংপুর মহানগরের ৩৩নং ওয়ার্ডের মেকুরা আলিয়া মাদ্রাসা ভোটকেন্দ্রে পুলিশের গুলিতে ২ জন নিহত হয়েছেন। নিহতরা হলেন- জামায়াতকর্মী মিরাজুল ইসলাম ও শিবিরকর্মী হাদি-উজ-জামান।


দিনাজপুরের পার্বতীপুরে নির্বাচনী সহিংসতায় আব্দুল ওয়াহিদ (৩৫) নামের এক আনসার সদস্য এবং মিছিল করার সময় যৌথবাহিনীর গুলিতে মাসুদ রায়হান (৩২) নামের এক জাগপা (জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি) নেতা নিহত হয়েছেন।


এর আগে সদর উপজেলার নশিপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রে শনিবার রাত ১টায় হামলা চালায় জেলা বিএনপির সমর্থকরা। এ সময় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে বাবুল হোসেন (৩৮) নামে এক বিএনপি নেতা নিহত হন।
ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার বাসুদেবপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে রবিবার দুপুরে পুলিশের গুলিতে দুই বিএনপিকর্মী নিহত হয়েছেন। তারা হলেন- জয়নাল আবেদীন (২৫), হারুন অর রশিদ (৩৫) ও হানিফ। এর আগে, সদর উপজেলায় অতর্কিত হামলা চালিয়ে এক সহকারী প্রিসাইডিং অফিসারকে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। শনিবার রাত ১১টার দিকে ঠাকুরগাঁও-১ আসনের ছেপড়িকুড়া ভোটকেন্দ্রে এ ঘটনা ঘটে। নিহত প্রিসাইডিং অফিসার জুবায়দুল হক সালন্দর কলেজে শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।


লালমনিরহাটে নির্বাচন সহিংসতায় পাটগ্রাম উপজেলার বাউরা ইউনিয়নের শফিরহাট গ্রামের বিএনপিকর্মী ফারুক হোসেন (২৬) মারা গেছেন। রবিবার সকালে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান।


গাজিপুরের কালিয়াকৈরে গরুভর্তি ট্রাকে পেট্রোলবোমা নিক্ষেপ করে দুর্বৃত্তরা। এতে ট্রাকচালক নুরুজ্জামান (২৮) অগ্নিদগ্ধ হয়ে নিহত হয়েছেন। রবিবার ভোর সোয়া ৫টার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তিনি মারা যান।


স্থগিত কেন্দ্রের সংখ্যাও ভারি : সারাদেশে ৩১টি আসনে ৪৪১টি কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ স্থগিত করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। ব্যালট পেপার ছিনতাই ও কেন্দ্র আগুনে পুড়িয়ে দেওয়ার কারণে রবিবার এ সব কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ স্থগিত করা হয়েছে।


ইসি সূত্রে জানা যায়, ভোটগ্রহণ স্থগিত করা কেন্দ্রগুলো হলো- ঠাকুরগাঁও-১ এর ৩টি, দিনাপজপুর-৪ এর ১৪টি, দিনাজপুর-৫ এর ১টি, নীলফামারী-১ এর ৫টি, নীলফামারী- ৩ এর ৪টি, লালমনিরহাট-১ এর ১টি, রংপুর-৩ এর ৩টি, রংপুর-৪ এর ৪১টি, গাইবান্ধা-১ এর ২টি, গাইবান্ধা-৩ এর ২১টি, গাইবান্ধা-৪ এর ২০টি, হবিগঞ্জ-২ এর ২টি, কুমিল্লা-৯ এর ৪টি, ফেনী-৩ এর ১টি, লক্ষ্মীপুর-১ এর ৩টি, চট্টগ্রাম-১৫ এর ২টি, বগুড়া-৭ এর ৯টি, জামালপুর-৪ এর ২টি, শেরপুর-৩ এর ১টিসহ মোট ৪৪১টি।


কারচুপি ও জালিয়াতের অভিযোগ ভোট বর্জন : বিরোধী দল বর্জিত ‘ভোটারবিহীন’ নির্বাচনে কারচুপি ও ভোট জালিয়াতির অভিযোগ এ পর্যন্ত ২৫ প্রার্থী ভোট বর্জন করেছেন। এদের মধ্যে আওয়ামী লীগ মনোনীত ঢাকা-৬ আসনে সাহিদুর রহমান সহিদ (শহীদ কমিশনার)। এ ছাড়া ঢাকা ১৫ আসনের এখলাস উদ্দিন মোল্লাও ভোট জালিয়াতির অভিযোগ এনে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেন।


ভোট বর্জনকারী প্রার্থীরা হলেন- লক্ষ্মীপুর-৪ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী আজাদ উদ্দিন চৌধুরী (হরিণ) ও অ্যাডভোকেট শরিফ (ফুটবল), জামালপুর-১ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী আজিজ আহম্মদ হাসান, জামালপুর-২ আসনে আতিকুর রহমান, সিরাজগঞ্জ-৫ আসনে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী আতাউর রহমান রতন, নারায়ণগঞ্জ-১ আসনের ড. শওকত আলী, ঝিনাইদহ-১ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী নায়েব আলী, বরগুনা-২ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী আবুল হোসেন সিকদার, ব্রাহ্মণবাড়ীয়া-৩ আসনের জাতীয় পার্টির প্রার্থী ডা. মো. ফরিদ আহমেদ, ব্রাহ্মণবাড়ীয়া-৫ আসনের জাতীয় পার্টির কাজী মামুনুর রশিদ, ফেনী-৩ আসনের জাতীয় পার্টির রিন্টু আনোয়ার, মুন্সীগঞ্জ ১ আসনে জাসদের অ্যাডভোকেট নাছিরুজ্জামান, মুন্সীগঞ্জ-২ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী মাহবুবুদ্দিন আহমেদ বীরবিক্রম, ময়মনসিংহ-১১ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী শাহাদাত হোসেন চৌধুরী, ঢাকা-৫ আসনের আরজু শাহ সায়েদাবাদী স্বতন্ত্র প্রার্থী, লালমনিরহাট-১ আসনের জাসদ প্রার্থী সাদেকুল ইসলাম, মানিকগঞ্জ-১ আসনের জাসদ প্রার্থী আফজাল হোসেন খান জকি, বরিশাল-২ আসন স্বতন্ত্র প্রার্থী সাবিনা আক্তার, নোয়াখালী-৬ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী আমিরুল ইসলাম আমির এবং চট্টগ্রাম-১২ আসনের জাতীয় পার্টির সিরাজুল ইসলাম।

ইতিহাসের একতরফা যত নির্বাচন : স্বাধীনতার পর ১৯৭৩, ১৯৭৯, ১৯৮৬ ও ১৯৯৬ সালের একতরফা নির্বাচনগুলোকে ভোটারবিহীন, কারচুপি ও জালিয়াতির নির্বাচন বলে অভিহিত করা হয়।


প্রথম জাতীয় নির্বাচন-১৯৭৩ : স্বাধীনতা অর্জনের পর দেশের প্রথম জাতীয় নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি ও ভোট জালিয়াতির অভিযোগ উঠে। ১৯৭৩ সালের এ নির্বাচনে জাসদের ইঞ্জিনিয়ার আব্দুর রশিদের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের খন্দকার মোশতাক আহমেদের পরাজয় সুনিশ্চিত জেনে খন্দকার মোশতাক নিজে হেলিকপ্টারে করে ব্যালট বাক্স উড়িয়ে নিয়ে আসেন ঢাকায়। এরপর ফলাফল পাল্টে দিয়ে জয়ী প্রার্থী রশিদ ইঞ্জিনিয়ারকে হারিয়ে দিয়ে খন্দকার মোশতাককে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। এ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ জয়ী হয় ২৯৩টি আসনে। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) জয়ী হয় ৫টি আসনে এ ছাড়া বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির একজন ও একজন স্বতন্ত্র প্রার্থী নির্বাচিত হন।


দ্বিতীয় জাতীয় নির্বাচন-১৯৭৯ : ১৯৭৩ সালে প্রথম জাতীয় নির্বাচনের ৬ বছর পর অনুষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন। ১৯৭৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত এই নির্বাচনে সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের সরকারের বিরুদ্ধে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ উঠে। এ নির্বাচনে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) জয়লাভ করে। তারা জাতীয় সংসদের ৩০০টি আসনের মধ্যে ২০৭টি আসন লাভ করে। এ নির্বাচনে মোট ৫১ দশমিক ৩০ শতাংশ ভোট সংগৃহীত হয়েছিল। দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৫৪টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) ৮টি ও বাংলাদেশ মুসলিম লীগ ৫টি আসনে জয়ী হয়।


তৃতীয় জাতীয় নির্বাচন-১৯৮৬ : দ্বিতীয় নির্বাচনের ৭ বছরের মাথায় অনুষ্ঠিত হয় তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন। ১৯৮৬ সালের ৭ মের ওই নির্বাচন বর্জন করে দ্বিতীয় সংসদের বিজয়ী দল বিএনপি। আওয়ামী লীগকে সঙ্গে নিয়ে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে জাতীয় পার্টি ৩০০টি আসনের মধ্যে ১৫৩টি আসন নিয়ে জয়লাভ করে। মোট ভোটারের ৬১ দশমিক ১০ শতাংশ ভোটার উপস্থিতি দেখানো হয় ওই নির্বাচনে। নির্বাচনে অংশ নিয়ে আওয়ামী লীগ ৭৬টি আসনে জয়ী হয়ে প্রধান বিরোধী দল হিসেবে সংসদে যায়। অন্যান্য দলের মধ্যে জামায়াত জয়ী হয় ১০টি আসনে।


ষষ্ঠ জাতীয় নির্বাচন ফেব্রুয়ারি-১৯৯৬ : অতীতের সব একতরফা নির্বাচনের গ্লানি ও অপবাদ মুছে দিয়ে সবচেয়ে সমালোচিত নির্বাচন ছিল ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৬ সালের ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। বিএনপি সরকারের অধীনে ভোটারবিহীন এ নির্বাচন আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামীসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দল বর্জন করে। মোট ৩০০টি আসনের মধ্যে বিএনপি ২৭৮টি আসনে জয়ী হয়। কারচুপি ও ভোট জালিয়াতির অভিযোগে অভিযুক্ত ওই ভোটারবিহীন নির্বাচনে মোট ভোট সংগৃহীত হয় মাত্র ২৬ শতাংশ। বিএনপি ছাড়া ফ্রিডম পার্টি ১টি ও স্বতন্ত্র প্রার্থী ১০ জন নির্বাচনে জয়ী হয়। এ ছাড়া ১০টি আসনের ফলাফল অসমাপ্ত থাকে ও আদালতের রায়ে একটি আসনের নির্বাচন স্থগিত করা হয়েছিল। ষষ্ঠ জাতীয় সংসদে প্রধান বিরোধীদলীয় নেতা ছিলেন কর্নেল (অব.) ফারুক।


দেশীয় ও আন্তর্জাতিক মহলে ওই নির্বাচনটি গ্রহণযোগ্যতা অর্জনে ব্যর্থ হয়। এ যাবতকালে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি নির্বাচনটি ছিল সর্বাধিক সমালোচিত এবং শুধু ওই নির্বাচনের জন্য বিএনপির ওপর নেমে আসে একটি অগ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের গ্লানি ও অপবাদ।


(দ্য রিপোর্ট/এইচআর/এসবি/শাহ/জানুয়ারি ৬, ২০১৪)

পাঠকের মতামত:

SMS Alert

বিশেষ আয়োজন এর সর্বশেষ খবর

বিশেষ আয়োজন - এর সব খবর