thereport24.com
ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ১ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১,  ১৩ জমাদিউল আউয়াল 1446

নির্মল সেন

২০১৪ জানুয়ারি ০৮ ০০:৫৯:৫২
নির্মল সেন

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক : প্রখ্যাত সাংবাদিক, কলামিস্ট, লেখক, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও মুক্তিযোদ্ধা নির্মল সেন ২০১৩ সালের ৮ জানুয়ারি ঢাকার ল্যাবএইড হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন।

নির্মল সেন ১৯৩০ সালের ৩ আগস্ট গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া উপজেলার দিঘিরপাড় গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। সুরেন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত ও লাবণ্যপ্রভা সেনগুপ্তার ৬ ছেলে ৩ মেয়ের মধ্যে তিনি চতুর্থ।

শিক্ষা জীবনের সূচনা বাড়ির পাঠশালায়। কোটালীপাড়া ইউনিয়ন ইন্সটিটিউশনে পড়েন চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত। টুঙ্গিপাড়া উপজেলার পাটগাতি এম ই স্কুলে ৬ষ্ঠ শ্রেণি প্রর্যন্ত পড়েন। ১৯৪৪ সালে বরিশালের কলসকাঠি বিএম একাডেমি থেকে প্রবেশিকা (এসএসসি) পাশ করেন। বিএম কলেজ থেকে ১৯৪৬ সালে আইএসসি পাশ করেন। একই কলেজে বিএসসি পড়াকালে ছাত্র আন্দোলন করতে গিয়ে গ্রেফতার হন। জেলখানা থেকে বিএসসি পরীক্ষা দিয়ে অকৃতকার্য হন। পরবর্তীতে ১৯৬১ সালে জেলখানা থেকে বিএ পাশ করেন। ১৯৬৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে মাস্টার্স করেন।

শৈশবেই লেখালেখিতে তার হাতেখড়ি। ৮ম শ্রেণিতে পড়াকালে হাতে লেখা ‘কমরেড’ পত্রিকায় তিনি লিখতেন। ১৯৬১ সালে দৈনিক ইত্তেফাকে সহকারী সম্পাদক হিসেবে সাংবাদিকতায় তার কর্মজীবন শুরু হয়। ১৯৬২ সালে দৈনিক জেহাদে যোগ দেন। ১৯৬৪ সালে দৈনিক পাকিস্তান এবং পরবর্তীতে দৈনিক বাংলায় সহকারী সম্পাদক হিসেবে কাজ করেন। প্রেস ট্রাস্টের পত্রিকাটি ১৯৯৭ সালে বন্ধ হওয়া পর্যন্ত তিনি এই পত্রিকায় কর্মরত ছিলেন। ১৯৭২-৭৩ সালে নির্মল সেন ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি ও ১৯৭৩-৭৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি ছিলেন। তিনি জাতীয় প্রেস ক্লাবের আজীবন সদস্য।

৯ম শ্রেণিতে পড়াকালে ১৯৪২ সালে নির্মল সেন রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হন। মহাত্মা গান্ধীর ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলনে সাড়া দিয়ে তিনি ১৬দিন স্কুল গেটে ধর্মঘট করেন। ১৯৪৪ সালে তিনি আরএসপি’তে (বিপ্লবী সমাজতন্ত্রী দল) যোগ দেন। ১৯৫২ সালে জেলে থাকা অবস্থায় পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এমএ আউয়ালের অনুরোধে ছাত্রলীগে যোগ দেন। তখন নির্মল সেন এমএ আউয়ালের কাছে দাবি করেছিলেন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ থেকে মুসলিম শব্দটি বাদ দিলে তিনি ছাত্রলীগে যোগ দেবেন। এমএ আউয়াল নির্মল সেনের এই দাবিটি মেনে নিয়েছিলেন। ১৯৫৩ সালে নির্মল সেন বরিশাল জেলা পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৫৪ সালে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির দপ্তর সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৬০ সালে নির্মল সেন আবার আরএসপিতে ফিরে আসেন। ১৯৬৯ সালে আদমজী জুট মিলে রুহুল আমিন কায়সার, খান সাইফুর রহমান, নির্মল সেন ও সিদ্দিকুর রহমানের নেতৃত্বে ‘শ্রমিক কৃষক সমাজবাদী দল’ গঠিত হয়। ১৯৮৮ সালে নির্মল সেন দলটির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৮৪ সাল থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত তিনি ‘সংযুক্ত শ্রমিক ফেডারেশন’-র সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। এরশাদবিরোধী আন্দোলনে ৫ দলীয় নেতা হিসেবে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

১৯৭১ সালে স্বাধীনতা আন্দোলনে নির্মল সেন আগরতলা ক্যাম্পসহ বিভিন্ন ক্যাম্পে সংগঠকের দায়িত্ব পালন করেন। যুদ্ধ চলাকালে তিনি একাধিকবার আগরতলা থেকে ঢাকায় এসে তরুণদের সংগঠিত করেন। আগরতলায় আরএসপির সহযোগিতায় তরুণদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন।

দীর্ঘ রাজনৈতিক ও সাংবাদিকতা জীবনে নির্মল সেন একাধিকবার জেল খেটেছেন। বিভিন্ন দাবি দাওয়া নিয়ে অনশন করেছেন। ১৯৪৮ সালের আগস্ট মাসে নির্মল সেন প্রথম জেলে যান। জেলে থাকা অবস্থায় ১৯৪৯ সালে বন্দিদের বিভিন্ন দাবি নিয়ে ৬দিন এবং মে মাসে রাজবন্দিদের দুই ভাগে বিভক্ত করার প্রতিবাদে ২৪ দিন অনশন করেন। সে অনশন ভাঙিয়েছিলেন ফকির আব্দুল মান্নান। কিন্তু তার পড়েও নির্মল সেনের দাবি না মানার কারণে তিনি একই বছরের আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে ৪০দিন অনশন করেন। সে অনশন ভাঙান রাজনীতিবিদ মনোরঞ্জন ধর ও ফকির আব্দুল মান্নান। এরপরেও দাবি না মানার কারণে ১৯৫০ সালে নির্মল সেনসহ আরও অনেক রাজবন্দি ৫২ দিন অনশন করেন। এ সময় তাদের কিছু দাবি মানা হয়।

ষাটের দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ঠিক করে ঢাকা হলকে মুসলিম হল করে জগন্নাথ হলকে অন্যান্য ধর্মারলম্বীদের জন্য ছেড়ে দেওয়া হবে। এর প্রতিবাদে ঢাকা হলে নির্মল সেন অনশন করেন। এ সময় ঢাকা হল ছিল একমাত্র কসমোপলিটন হল। নির্মল সেনের দাবি ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের সব হলকে কসমোপলিটন হল করতে হবে। তাতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ রাজি হলো না। কারণ সব হল কসমোপলিটন করতে হলে সলিমুল্লাহ মুসলিম হল, ফজলুল হক মুসলিম হলের নাম পরিবর্তন করতে হবে। কর্তৃপক্ষ এটা চাইলো না। নির্মল সেন অনশন শুরু করলেন। সে অনশন ৭দিন পর্যন্ত চলে। ৭দিন পরে ডাক্তার বললেন নির্মল সেনের অবস্থা সংকটাপন্ন। এরপর ভাইস চ্যাঞ্চেলর বিচারপতি ইব্রাহীম নির্মল সেনের অনশন ভাঙিয়ে বলেন- আমি বেঁচে থাকলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব হল কসমোপলিটন করা হবে।

১৯৯৭ সালে সরকার প্রেস ট্রাস্টের ৪টি পত্রিকা বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। সংসদে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়া বলেন ৪টি পত্রিকার সাংবাদিক কর্মচারিদের দেনা-পাওনা মিটিয়ে দিয়ে পত্রিকাগুলো বন্ধ করা হবে। বাস্তবে সরকার গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের নামে যেমন খুশি টাকা দিয়ে সাংবাদিক কর্মচারিদের বিদায় করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিল। এতে নির্মল সেন রাজি হলেন না। প্রতিবাদে জাতীয় প্রেস ক্লাবে অনশন শুরু করলেন। এক পর্যায়ে আর্মিরা তাকে পিজি হাসপাতালে নিয়ে যায়। ৯দিন অনশনের পর সাবেক রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহম্মেদ তার অনশন ভাঙান।

সাংবাদিক নেতা হিসেবে নির্মল সেন ভারত, জার্মান, রাশিয়া, হাঙ্গেরি, নেপাল, যুগস্লাভাকিয়া, চেকস্লাভাকিয়া ভ্রমণ করেন। রাজনৈতিক নেতা হিসেবে লন্ডন, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, লুক্সেমবার্গ, সুইজারল্যান্ড, ফিলিপাইন, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, চীনসহ বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেন।

তার লেখা বইয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- মানুষ সমাজ রাষ্ট্র, বার্লিন থেকে মস্কো, পূর্ববঙ্গ পূর্বপাকিস্তান বাংলাদেশ, মা জন্মভূমি, লেনিন থেকে গর্ভাচেভ, আমার জবানবন্দি, স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই, আমার জীবনে ৭১ এর যুদ্ধ।

তার ইচ্ছা ছিল নিজ বাড়িতে একটি মহিলা কলেজ করা। এ কলেজটির জন্য তিনি বাড়ির ১ একর ৫০ শতক জায়গা রেজিস্ট্রেশন করে দিয়ে গেছেন।

ব্যক্তিগত জীবনে তিনি চিরকুমার ছিলেন।

(দ্য রিপোর্ট/ডব্লিউএস/এপি/জানুয়ারি ০৮, ২০১৪)

পাঠকের মতামত:

SMS Alert

এই দিনে এর সর্বশেষ খবর

এই দিনে - এর সব খবর