thereport24.com
ঢাকা, বুধবার, ২৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১ পৌষ ১৪৩১,  ২৩ জমাদিউস সানি 1446

অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রবণতা

২০১৪ জানুয়ারি ০৮ ২২:৩৩:৪১
অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রবণতা

সোহেল রহমান, দ্য রিপোর্ট : আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের পাঁচ বছরে দেশের অর্থনীতি অনেক চড়াই-উতরাই অতিক্রম করেছে। অর্থনৈতিক পরিমণ্ডলে জন্ম হয়েছে অনেক আলোচিত-সমালোচিত ঘটনার। বর্তমান সরকার যেমন বিশ্ব মন্দার জের মোকাবেলা করেছে, তেমনি শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি ও ব্যাংকিং খাতে ঋণ কেলেঙ্কারির ন্যক্কারজনক ঘটনাও ঘটেছে এই আমলে।

অর্থনীতির আকার গত পাঁচ বছরে অনেকটা প্রসারিত হয়েছে, উৎপাদন বেড়েছে, মাথাপিছু আয় বেড়েছে, রফতানি, রিজার্ভ ও রেমিট্যান্স বেড়েছে। কিন্তু সরকারের শেষ বছরে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে দু-একটি ছাড়া অর্থনীতির অধিকাংশ সূচকে নেতিবাচক লক্ষণ সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে স্থানীয় ও বৈদেশিক বিনিয়োগে দেখা দিয়েছে স্থবিরতা। সার্বিকভাবে গত পাঁচ বছরে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সরকারের সাফল্য ও ব্যর্থতা পর্যালোচনায় বলা যায়, এটা যেন তীরে এসে তরী ডুবে যাওয়ার মতো।

এদিকে চলমান পরিস্থিতি দীর্ঘায়িত হলে দেশ একটি মধ্যমেয়াদী অর্থনৈতিক সংকটে নিপতিত হতে পারে বলে আশংকা করছেন অর্থনীতিবিদরা।

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের মতে, দেশের বর্তমান অস্থিতিশীল ও সহিংস রাজনীতি সার্বিক অর্থনীতিকে ক্রমান্বয়ে দুর্বল করে দিচ্ছে। সারাবিশ্বে বাংলাদেশ যেখানে একটি সম্ভাবনার দেশ হিসেবে পরিচিতি পাচ্ছিল, এখন ক্রমেই তা একটি ঝুঁকিপূর্ণ দেশ হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। রাজনৈতিক সহিংসতা ও সামাজিক অস্থিতিশীলতা এখন যে পর্যায়ে রয়েছে, সেটা দীর্ঘায়িত হলে দেশ একটি মধ্যমেয়াদী অর্থনৈতিক সংকটে নিপতিত হবে।

তার মতে, রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে প্রবৃদ্ধিতে বড় ধরনের পতন ঘটলে তা পুনরুদ্ধার করতে চার থেকে ছয় বছর লেগে যেতে পারে।

প্রায় একই ধরনের আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন স্বয়ং অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। কয়েকদিন আগে সচিবালয়ে তিনি সাংবাদিকদের বলেছেন, অবরোধ-হরতালের এই ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব নাও হতে পারে। এটা কঠিন হবে।

জিডিপি : মহাজোট সরকারের গত পাঁচ বছরে অর্থনীতির প্রধান প্রধান সূচক পর্যালোচনায় দেখা গেছে, মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি। যদিও ২০১৪ সাল নাগাদ জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৮ শতাংশে উন্নীত হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছিল বর্তমান সরকার। সরকারের চার বছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির গড় হার ৬ দশমিক ২ শতাংশ বলে অর্থমন্ত্রী তার সর্বশেষ বাজেট বক্তৃতায় উল্লেখ করেছেন এবং চলতি অর্থবছরে (২০১৩-১৪) জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৭ দশমিক ২ শতাংশ। ইতোমধ্যেই এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন নিয়েও বিভিন্ন মহল থেকে আশঙ্কা ব্যক্ত করা হয়েছে।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) মতে, বর্তমান অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি সাড়ে ৫ শতাংশের বেশি হবে না। চলমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ব্যাহত হচ্ছে মন্তব্য করে সংস্থাটি আরও বলেছে, বেসরকারি বিনিয়োগ চাহিদা কমে যাওয়ায় ঋণ প্রবাহ কমেছে, আমদানি ও অভ্যন্তরীণ পণ্য সরবরাহে বিঘœ ঘটছে।

রিজার্ভ : মহাজোট সরকারের শেষ সময়ে দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৮শ’ কোটি মার্কিন ডলার, যা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। এর আগে ২০০৮-০৯ অর্থবছরে দেশে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৭৪৭ কোটি মার্কিন ডলার। রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ার পাশাপাশি আমদানি ও বিনিয়োগ চাহিদা কমে যাওয়ার কারণে রিজার্ভ বাড়ছে বলে অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন।

রেমিট্যান্স : বর্তমান সরকারের আমলে সার্বিকভাবে রেমিট্যান্স প্রবাহ আগের চেয়ে অনেক বাড়লেও সম্প্রতি এ খাতে ধীরগতি লক্ষ্য করা গেছে। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে দেশে মোট রেমিট্যান্স এসেছিল প্রায় ৯৬৯ কোটি মার্কিন ডলার। গত ২০১২-১৩ অর্থবছরে তা ১ হাজার ৪৫০ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে।তবে চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর’১৩) রেমিট্যান্স প্রবাহ গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ১০ শতাংশ কমেছে। আলোচ্য সময়ে জনশক্তি রফতানি হ্রাস (২১ শতাংশ কমেছে), রাজনৈতিক অস্থিরতা ও ডলারের বিপরীতে টাকার মান শক্তিশালী হওয়ায় রেমিট্যান্স প্রবাহে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে বলে অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন।

রাজস্ব পরিস্থিতি : সার্বিক অর্থনীতি ও বাজেটের আকার বাড়ার পাশাপাশি সরকারের পাঁচ বছরে রাজস্ব আদায়ের পরিধিও বেড়েছে। তবে চলমান পরিস্থিতির কারণে চলতি ২০১৩-১৪ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে রাজস্ব ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা। রাজস্ব ঘাটতির কারণ হিসেবে আমদানি প্রবৃদ্ধি হ্রাস ও শুল্ক কমে যাওয়াকে দায়ী করেছেন অর্থমন্ত্রী।

রাজস্ব আয় বাড়াতে গত পাঁচ বছরে রাজস্ব আইন সংস্কার, রাজস্ব প্রশাসন আধুনিকায়ন, নতুন ভ্যাট আইন প্রণয়ন, কাস্টমস পদ্ধতি অটোমেশন, নতুন করদাতা শনাক্তকরণ ও রাজস্ব বিভাগে নতুন জনবল নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

আমদানি-রফতানি : মহাজোট সরকারের শেষ সময়ে রফতানি আয় বেড়েছে। এমনকি চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসেও ১৮ শতাংশ রফতানি আয় বেড়েছে। অন্যদিকে আমদানি প্রবৃদ্ধির হার কমে দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ৪৯ শতাংশ। আমদানি প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ায় ২০১২-১৩ অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় বাণিজ্য ঘাটতি কমেছে প্রায় ২৩ শতাংশ।

বিনিয়োগ : মহাজোট সরকারের আমলে দেশে সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ(এফডিআই) প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। ২০০৮ সালে দেশে সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগের পরিমাণ যেখানে ছিল ১০৮ কোটি ডলার, সেখানে ২০১২ সালে তা নেমে এসেছে ৪৯ কোটি ডলারে। পাশাপাশি স্থানীয় বিনিয়োগও কমেছে। এ ছাড়া গত দু’বছর ধরে বেসরকারি বিনিয়োগ খাতে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধিও বিদ্যমান রয়েছে।

বিনিয়োগ ও ঋণ প্রবাহ কমে যাওয়ায় বর্তমানে দেশের ব্যাংকিং খাতে উদ্বৃত্ত তারল্যের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮৪ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে, চলতি বছর জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছিল ১৫ দশমিক ৫০ শতাংশ। এর বিপরীতে গত নভেম্বর পর্যন্ত বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে প্রায় ৯ শতাংশ।

বৈদেশিক ঋণ সহায়তা : চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে চলতি অর্থবছর বৈদেশিক ঋণ ও সহায়তা কমেছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর’১৩) বৈদেশিক মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদী ঋণপ্রবাহ ২৯ দশমিক ১৩ শতাংশ কমেছে। গত অর্থবছরের একই সময়ে যেখানে ৬১ কোটি ১০ লাখ ডলারের ঋণ পাওয়া গিয়েছিল, চলতি অর্থবছর সেখানে পাওয়া গেছে ৪৩ কোটি ৩০ লাখ ডলার।

পাশাপাশি চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই- সেপ্টেম্বর’১৩) বৈদেশিক সাহায্য এসেছে মাত্র ৬ কোটি ডলার। গত অর্থবছরের একই সময়ে যার পরিমাণ ছিল ৩৬ কোটি ডলার।

(দ্য রিপোর্ট /এসআর/ডব্লিউএন/এনআই/জানুয়ারি ০৮, ২০১৪)

পাঠকের মতামত:

SMS Alert

বিশেষ সংবাদ এর সর্বশেষ খবর

বিশেষ সংবাদ - এর সব খবর