thereport24.com
ঢাকা, মঙ্গলবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০ পৌষ ১৪৩১,  ২২ জমাদিউস সানি 1446

তবুও তারা মন্ত্রী!

২০১৪ জানুয়ারি ১৬ ২০:৫৬:৩৫
তবুও তারা মন্ত্রী!

নানা বিতর্ক, জল্পনা-কল্পনা থাকা সত্ত্বেও নবগঠিত সরকারে মন্ত্রিত্ব পেয়েছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন হেভিওয়েট নেতা। যদিও এ মন্ত্রিসভায় বিতর্কিত কাউকে দায়িত্ব দেওয়া হয়নি বলে দাবি করেছেন দলের সভপতি মণ্ডলীর সদস্য ওবায়দুল কাদের।

গত সরকারের চেয়ে এবার মন্ত্রিসভার কলেবর বাড়ানো হয়েছে। তুলনামূলক ক্লিন ইমেজের নেতারাই বেশি স্থান পেয়েছেন বলে মনে করছেন ক্ষমতাসীন দলের নীতি নির্ধারকরা।

২০০৮ সালে গঠিত মহাজোট সরকারের সমালোচিত মন্ত্রী ও ওই মন্ত্রিসভায় সংস্কারপন্থীর অভিযোগে বাদ পড়াদের অনেকেই স্থান পেয়েছেন নবগঠিত এই মন্ত্রিসভায়।

‘মন্ত্রিত্ব নয় দল চাই। আমি রাজনীতি করতে চাই।’এমন বক্তব্য দিয়ে নিজের হারানো ইমেজ ফিরে পেতে মহাজোট সরকারের সময় মন্ত্রিত্বের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে বেশ আলোচনায় উঠে আসেন তোফায়েল আহমেদ। আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের এই সদস্য ১৯৯৬ সালে শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রী ছিলেন। তিনি নবগঠিত সরকারে আবারও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেয়েছেন।

৯৬-এ সরকারের খাদ্যমন্ত্রী থেকে সফলতার পরও মহাজোট সরকারের চমকের মন্ত্রিসভায় তিনি জায়গা পাননি আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমু। তবে মহাজোট সরকারের সময় মাঠে-ময়দানে বক্তব্য দিয়ে সরব থেকেছেন তিনি। নব গঠিত সরকারে দায়িত্ব পেয়েছেন শিল্প মন্ত্রণালয়ের।

মহাজোট সরকারের শুরুর দিকে তেমন আলোচনায় না থাকলেও ২০১২ সালের সম্মেলনে দলের সভাপতি মণ্ডলীর সদস্য হয়ে আবারও আলোচনায় উঠে আসেন মোহাম্মদ নাসিম। ‘সংস্কারপন্থী’ হওয়ায় ২০০৯ সালের সম্মেলনে দলের উপদেষ্টা পরিষদে নাম উঠলেও মহাজোটের মন্ত্রিসভায় ঠাঁই ছিল না। তবে নতুন সরকারে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেয়েছেন ৯৬-এর সরকারের এই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।

বাম রাজনীতিবিদ ও আন্দোলন সংগ্রামে অগ্রণী ভূমিকা রেখে ‘অগ্নিকন্যা’ ‍উপাধি অর্জন করেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও এক সময়ে বঙ্গবন্ধুর কড়া সমালোচনাকারী বক্তব্য দেওয়া নেত্রী মতিয়া চৌধুরী। ১৯৯৬ সালে ঐকমত্যের সরকারে কৃষি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থেকে অভিজ্ঞতার বলেই মহাজোট সরকারের কৃষিমন্ত্রী হয়েছিলেন। বিরোধী দলের সমালোচনায় সংযত থাকলেও বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে বৃহত্তর জামায়াতের মহিলা আমির আখ্যায়িত করে দলীয় নেতাদের কাছ থেকে বাহবা পেয়েছেন বেশ। তবে প্রার্থীহীন নিরুত্তাপ দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলীয় নেতাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহারের কারণে হারতে বসেছিলেন নিজ আসনের বিদ্রোহী প্রার্থী কৃষিবিদ বদিউজ্জামান বাদশার কাছে। এরপরও নবগঠিত সরকারে নিজ দক্ষতার বলেই আবারও দায়িত্ব পেয়েছেন কৃষি মন্ত্রণালয়ের।

অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত মহাজোট সরকারের পুরো সময়ই আলোচিত সমালোচিত হয়েছেন। কখনো গ্রামীণ ব্যাংক কিংবা ড. ইউনূসের সমালোচনা করে; আবার কখনো পদ্মা সেতুর অর্থায়ন পাওয়া না পাওয়া সম্পর্কে মন্তব্য করে আলোচনা-সমালোচনার মধ্যমণিতে পরিণত হন। এ ছাড়াও শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি, হলমার্কসহ বিভিন্ন ইস্যুতে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়েছে প্রবীণতম এই মন্ত্রীকে। এদিকে শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির সময় ‘আমি শেয়ারবাজার বুঝি না’ এমন মন্তব্য করায় সমালোচনার ঝড় ওঠে। কিন্তু দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে প্রকাশিত হলফনামায় দেখা যায় অর্থমন্ত্রীর আয়ের উৎসের বড় একটি অংশ শেয়ার মার্কেট।

গত ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের পরও ‘সরকার সর্বজনগ্রাহ্য হয়নি’ বলেও মন্তব্য করেন তিনি। নবগঠিত সরকারে আবারও অর্থমন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেয়েছেন মুহিত।

মহাজোট সরকারের সবচেয়ে বড় প্রতিশ্রুতি ছিল পদ্মা সেতু নির্মাণ। পদ্মা সেতু নির্মাণ নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগে মন্ত্রিসভা থেকে বাদ পড়েন সৈয়দ আবুল হোসেন। তারপর এই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নিয়ে রাতারাতি আলোচনায় উঠে আসেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর অন্যতম সদস্য ওবায়দুল কাদের। মন্ত্রিত্ব গ্রহণের কিছুদিন পরেই খোদ ভারতীয় হাইকমিশনার পঙ্কজ শরণের সামনে ভারতের সমালোচনা করে ব্যাপক সাড়া ফেলেন মিডিয়ায়।

মহাজোট সরকারের মন্ত্রিসভা থেকে একাধিকবার পদত্যাগ করার চেষ্টা করেন এক-এগার সরকারের সময় আওয়ামী লীগের প্রয়াত সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিলের অবর্তমানে দলের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পাওয়া সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। ২০০৯ সালে দলটির ১৮তম সম্মেলনে দলের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পাওয়ার পর খেতাব অর্জন করেন আওয়ামী লীগের ইতিহাসে সবচেয়ে নিষ্ক্রিয় সাধারণ সম্পাদক হিসেবেও। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব তার কাঁধে থাকলেও মন্ত্রণালয় মূলত চালিয়েছেন প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক। এমন কথাও রয়েছে বিভিন্ন মহলের আলোচনায়। এ ছাড়াও ‘সীমান্তে আগে হত্যা হয়েছে, এখনও হচ্ছে, ভবিষ্যতেও হবে। তবে কীভাবে তা কমিয়ে আনা যায় সেটাই মুখ্য বিষয়’ সীমান্ত হত্যা বিষয়ে এমন বক্তব্যে সমালোচনারও ঝড় ওঠে। রামুর ঘটনায় সরকার এবং প্রশাসনের ব্যর্থতা রয়েছে বলে স্বীকার করায় সরকার এবং বিরোধী দল উভয় মহলেই তাকে সমালোচনার মুখে পড়তে হয়। মহাজোট সরকারের শেষ সময়ে ৫ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীদের ভরাডুবি ও সাংগঠনিক দুরাবস্থার জন্য নিস্ক্রিয়তার দায়ভার নিয়ে এবারও দায়িত্ব পেয়েছেন স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের।

মহাজোট সরকারের আমলে বিরোধী দলের সমালোচনায় মুখর মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের মধ্যে অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম বরাবরই প্রথম সারিতে ছিলেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, গণজারগণ মঞ্চ কিংবা হেফাজতে ইসলামের সমাবেশ, সব ইস্যুতেই সদা সরব ছিলেন এই প্রতিমন্ত্রী। বিরোধীদলীয় নেতাদের সমালোচনা করতে গিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদকে ‘পলিটিক্যাল প্রোস্টিটিউট’ বলতেও ন্যূনতম লজ্জিত হননি জর্জ কোর্টের এই আইনজীবী। এক-এগারোর সময় আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মামলায় আইনজীবী হয়ে নবম সংসদের মহাজোট সরকারের মন্ত্রিসভায় আইন প্রতিমন্ত্রীর গুডবুকে নাম লেখান নবগঠিত সরকারের খাদ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পাওয়া ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক কামরুল ইসলাম। নগর নেতা হিসেবে দলীয় নেতাকর্মীদের বার বার মাঠে নামার ডাক দিয়ে নগর আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভায় কর্মীদের রোষানলে পড়লেও মহাজোট সরকার থেকে প্রমোশন পেয়ে এবার পূর্ণ মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন।

শ্রমিকের ‘জান’ হিসেবে খ্যাত শ্রমিক নেতা শাজাহান খান দায়িত্ব পেয়েছিলেন মহাজোট সরকারের নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের। তবে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের চেয়ে বেশি মনোযোগ ছিল বাস-চালকদের লাইসেন্সের দিকেই। গরু-ছাগল চিনলেই ড্রাইভিং লাইসেন্স দেওয়া উচিত অবস্থান থেকে এক চুলও না সরে বার বার সমালোচিত হয়েছেন পরিবহন নেতা থেকে রাতারাতি গার্মেন্টস শ্রমিক নেতা বনে যাওয়া শাজাহান খান। এ ছাড়াও হঠাৎ করেই পরিবহন শ্রমিক ও সংসদের প্রতিনিধিত্ব ছেড়ে ইসলামিক ফাউন্ডেশনে কোরআন-সুন্নাহ নিয়ে বক্তব্য দিতে গিয়ে জনরোষে পড়েন। শুধু তাই নয়, কম যান নি টিভি টকশোতেও। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়ার দিকে তেড়ে গিয়ে চোখ তুলে নেওয়ার হুমকিও দেন সরাসরি সম্প্রচারকৃত বেসরকারি টেলিভিশন আরটিভির টকশোতে। বাংলাদেশের নৌ-পরিবহন রুটে ওয়াটার বাস চালুর প্রক্রিয়ার ব্যাপক প্রশংসা কুড়িয়ে নবগঠিত সরকারে আবারও দায়িত্ব পেয়েছেন নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের। পরে বন্ধ হয়ে গেছে।

অসাম্প্রদায়িক ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন নিয়ে নবম সংসদ নির্বাচনে নৌকা প্রতীকে নির্বাচনে অংশ নেওয়াকে কেন্দ্র করে দলের ভাঙনের পরও ক্ষমতার অংশীদার হন ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন। তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করে পঞ্চদশ সংশোধনী বিলের বিরোধিতা করে ফ্লোর ক্রসিং-এর দায়ে সংসদ সদস্য পদ হারানোর ভয়ে অধিবেশনে কণ্ঠ ভোট দিতে বাধ্য হন বাম এই নেতা। নৌকা প্রতীকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ায় অধিবেশনে পঞ্চদশ সংশোধনী বিলের বিরোধী করতে না পারায় নোট অব ডিসেন্ট দেন তিনি। মহাজোট সরকারের মধ্য সময়ে মন্ত্রিত্বের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেলেও নির্বাচনকালীন সরকারের মন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। দলীয় প্রতীক ছেড়ে নৌকা প্রতীকে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্তের কারণে ওয়ার্কার্স পার্টি থেকে পদত্যাগ করেন দুইজন নেতা। দশম নির্বাচনে ৬টি আসন পেয়ে ওয়ার্কার্স পার্টির পলিটব্যুরোর সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রী হিসেবে তিনিও শপথ নিয়েছেন নব গঠিত সরকারে।

মহাজোট সরকারের মধ্য সময় থেকে সরকারের থাকা না থাকা নিয়ে বার বার দ্বিমুখী অবস্থান তুলে ধরে রাজনীতির মাঠে উত্তাপ ছড়ান জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ। নির্বাচনকালীন সরকারে অংশ নিলে মানুষ আমাকে থুতু দেবে বলতেও কুণ্ঠিত হননি নয় বছরের স্বৈরশাসক হিসেবে উপাধি পাওয়া সাবেক এই রাষ্ট্রপতি। সর্বশেষ নির্বাচনকালীন সরকার ও নির্বাচন থেকে প্রার্থিতা প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন এরশাদ। দলে ভাঙন ও এরপর চিকিৎসার নামে সিএমএইচ হাসপাতালে থেকে নানা জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে নির্বাচিত সংসদ সদস্য হিসেবে চুপি চুপি স্পিকারের কাছে শপথ নেন এরশাদ। তার দলের সিনিয়র প্রেসিডিয়াম সদস্য রওশন এরশাদ বিরোধীদলীয় নেতা নির্বাচিত হলেও পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেয়েছেন জাতীয় পার্টির আওয়ামী লীগ সমর্থিত হিসেবে খ্যাত ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ।

(দ্য রিপোর্ট/এইউএ/ এনআই/এইচএসএম/ এনআই/জানুয়ারি ১৬, ২০১৪)

পাঠকের মতামত:

SMS Alert

বিশেষ সংবাদ এর সর্বশেষ খবর

বিশেষ সংবাদ - এর সব খবর