thereport24.com
ঢাকা, মঙ্গলবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০ পৌষ ১৪৩১,  ২২ জমাদিউস সানি 1446

ধসের মুখে আবাসন খাত

জমির দাম কমলেও গ্রাহক মিলছে না

২০১৪ জানুয়ারি ২১ ১৬:৪১:৫৫
জমির দাম কমলেও গ্রাহক মিলছে না

নানামুখী প্রতিকূলতায় ধসের মুখে দেশের আবাসন খাত। আবাসন খাতে ব্যাংক ঋণের ওপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কড়াকড়ি আরোপের পর এই খাতে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। এ ছাড়া দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা, দীর্ঘদিন আবাসন খাতে গ্যাস-বিদ্যুতের সংযোগ দেওয়া বন্ধ থাকায় এ খাতে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে বলে দাবি সংশ্লিষ্টদের।

অর্থনীতিবিদদের মতে, অতিরিক্ত মুদ্রা সরবরাহ ও ঋণ প্রাপ্তির কারণে শেয়ার বাজারের মতো বড় ধরনের ধসের প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে খাতটি।

জানা গেছে, নানা প্রতিকূলতা ও প্রতিবন্ধকতার কারণে আবাসন ব্যবসায়ীরা পাচ্ছে না কাঙ্ক্ষিত সংখ্যক ক্রেতা। বিভিন্ন শতাংশের ছাড় দিয়েও ক্রেতা আগ্রহ বাড়াতে পারছে না কোম্পানিগুলো। ফলে কমেছে প্লট ও ফ্ল্যাট বিক্রির হার। বেশকিছু কোম্পানির ক্ষেত্রে ফ্ল্যাট বুকিং বাতিলের ঘটনাও ঘটেছে।

এ দিকে ব্যাংক ঋণনির্ভর এই খাতটিতে ক্রেতার সংখ্যা কমে যাওয়ায় নতুন করে বিনিয়োগে আগ্রহ হারাচ্ছে কোম্পানিগুলো। আগের ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হওয়া কোম্পানিগুলো নতুন করে কোনো ঋণ পাচ্ছে না। প্লট ও ফ্ল্যাট বিক্রি না হওয়ায় বসে বসেই ব্যাংকের চড়া সুদ গুনতে বাধ্য হচ্ছে তারা। অনুৎপাদনশীল খাত চিহ্নিত করে আবাসন খাতে ঋণ সরবরাহ কমানোর কড়াকড়ি আদেশ রয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। আর বিদ্যমান মুদ্রা নীতির জন্য সরকারি ও বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো ঋণের অর্থ ফেরত পেতে আবাসন কোম্পানিকে দিচ্ছে ধারাবাহিক তাগাদা। ঋণের কিস্তি সময় মতো পরিশোধ করতে না পারায় আবাসন খাতে শ্রেণীভুক্ত ঋণের পরিমাণ ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলেছে।

কমেছে ফ্ল্যাটের দাম ও বিক্রি : আবাসন খাতে বিনিয়োগ করা বড় কোম্পানিগুলোর মধ্যে শেলটেক অন্যতম। গত বছর কোম্পানির শেষ হওয়া ৩৩টি আবাসন প্রকল্পে মোট ৩২৯টি ফ্ল্যাট অবিক্রীত রয়েছে। গত ডিসেম্বর মাসে কোম্পানির কার্যালয়ে আয়োজন করা হয় বিশেষ আবাসন মেলার। আর এই মেলার মাধ্যমে ক্রেতা আকর্ষণের চেষ্টা চালায় আবাসন কোম্পানিটি। শেলটেকের এই নিজস্ব মেলায় কিছু ফ্ল্যাট বিক্রি হলেও তা উল্লেখযোগ্য নয়।

শেলটেকের মার্কেটিং ও বিক্রয় বিভাগের ব্যবস্থাপক নাসেউর রহমান দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘গত বছরের পুরোটাই আবাসন খাতের জন্য ছিল একটা মন্দার বছর। ফ্ল্যাট ও প্লট বিক্রির হার বিগত বছরগুলোর তুলনায় ছিল নগণ্য। সর্বশেষ আবাসন মেলায় বেশ কিছু ফ্ল্যাট বিক্রি হলেও তা ১০ শতাংশও হবে না। এখনও বেশকিছু রেডি ফ্ল্যাট আনসোলড (অবিক্রীত) রয়েছে। তা ছাড়া বেশ কয়েকটি চলমান প্রজেক্টও রয়েছে। যেগুলোর নির্মাণ কাজ চলতি বছরের মাঝামাঝি শেষ হয়ে যাবে। সব মিলিয়ে ক্রেতার সংখ্যা না বাড়লে প্রায় হাজারের কাছাকাছি ফ্ল্যাট আমাদের অবিক্রীত থাকবে।’

শেলটেকের মতো দেশের আরেকটি বড় আবাসন কোম্পানি ওরিয়েন্টাল ডেভেলপমেন্টেরও অবস্থা একই রকম। কোম্পানিটির বিপণন বিভাগের প্রধান নির্বাহী রাসেল হোসেন দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘গত বছরে আমাদের কোম্পানির বিক্রি ছিল খুবই কম। বিশেষ বিশেষ প্রকল্পে ৩০ ভাগ ছাড় দিয়েও ক্রেতা পাওয়া যায়নি। আমাদের কোম্পানি ফ্ল্যাট ছাড়া প্লটও সেল করে থাকে। গত তিন মাসে আমাদের প্লট বিক্রি ছিল জিরো (শূন্য)। সব মিলিয়ে নতুন কোনো প্রজেক্টে ইনভেস্ট করতে কোম্পানি আগ্রহী নয়। অনগোয়িং (চলমান) প্রকল্পগুলোর নির্মাণ কাজও ধীরে ধীরে চলছে। ফ্ল্যাট বুকিংয়ের হার ২০১২ সালের তুলনায় গত বছর প্রায় অর্ধেকেরও নিচে নেমে আসে।’

রাসেল হোসেন বলেন, ‘এখন পর্যন্ত কোম্পানি লোকসানের মুখে পড়েনি। তবে আমাদের বিক্রির হার বাড়াতে না পারলে লোকসান অনিবার্য।’

ফ্ল্যাটের দাম ও বিক্রি কমার পাশাপাশি ফ্ল্যাট বুকিংয়ের চুক্তি বাতিলেরও ঘটনা ঘটেছে আবাসন কোম্পানিগুলোর ক্ষেত্রে। যুক্তরাজ্য প্রবাসী শাকিল রেজা দারুল মাকান ডেভেলপমেন্ট কোম্পানির ঝিগাতলার ‘মাকান রোজ ভ্যালি’ অ্যাপার্টমেন্টের একটি ফ্ল্যাট বুকিং দেন ২০১২ সালের রিহ্যাব গ্রীষ্মকালীন আবাসন মেলায়। ২০১৩ সালের জুন মাসে ফ্ল্যাটটির অর্ধেক কিস্তি পরিশোধের পর চুক্তি বাতিল করেন শাকিল। কারণ হিসেবে কোম্পানির ধীরগতিতে নির্মাণ কাজ, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও আর্থিক নিরাপত্তার বিষয়টিকে প্রধান্য দিয়েছেন তিনি।

শাকিল রেজা দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘মাকান ডেভেলপমেন্টের ফ্ল্যাট কেনার জন্য চুক্তি করেছিলাম। কিন্তু দেশের রাজনৈতিক যে অবস্থা তাতে ফ্ল্যাট কেনার চাইতে সঞ্চয় করাটাকে আমি বেটার মনে করেছি। তাই কিছু অর্থ ছাড় দিয়ে আমি চুক্তি বাতিল করেছি।’

বিষয়টি নিয়ে দারুল মাকান ডেভেলপমেন্ট কোম্পানির পরিচালক (মার্কেটিং) মো. হুসাইন দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘মাকান রোজ ভ্যালি প্রকল্পটি ব্যাংক ঋণনির্ভর হওয়ায় ঋণের একটি বড় অংশ ছাড় করা সম্ভব হয়নি। এতে করে প্রকল্পটির কাজ বেশ কয়েক মাস বন্ধ ছিল। এই প্রকল্পটির আরও সাতজন গ্রাহক চুক্তি বাতিল করেছে। এতে করে আমাদের আয় হওয়ার বদলে ব্যয় বেশি হয়েছে।’

কমেছে জমির মূল্য, নতুন প্রকল্পে অনাগ্রহী কোম্পানিগুলো : ইনডেক্স ডেভেলপমেন্ট লিমিটেডের চেয়ারম্যান ড. আবদুর রহিম খান পিপিএম, প্রায় ১২ বছর ধরে আবাসন ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। আবাসন ব্যবসার হালচাল নিয়ে কথা হয় দ্য রিপোর্টের সঙ্গে।

আবদুর রহিম জানান, ব্যবসার শুরুতে ডেভেলপমেন্ট করার জন্য জমি পেতেন না তিনি। যদিও কোনো একটি প্লট পেতেন তাও বিভিন্ন কোম্পানির দৌড়-ঝাঁপের কারণে কেনা বা জয়েন্ট ভেঞ্চারে (যৌথ উদ্যোগে) অ্যাপার্টমেন্ট নির্মাণ করাটা ছিল দুরূহ। জমি প্রকৃত দামের চাইতে কয়েকগুণ বেশি দাম দিয়েও কেনা সম্ভব ছিল না।

আবদুর রহিম বলেন, ‘২০১১ সালে বারিধারা ৯ নম্বর রোডে একটি প্লটের মালিকের সঙ্গে আমার কোম্পানির চুক্তি হয়। পাঁচ কাঠার প্লটটিতে জয়েন্ট ভেঞ্চারে অ্যাপার্টমেন্ট নির্মাণের জন্য চুক্তিমূল্য দিতে হয়েছে প্রায় ১০ কোটি টাকা, আর প্রজেক্টের ৪০ ভাগ শেয়ার। প্রকল্পটির কাজ এখনও শেষ হয়নি। শঙ্কায় আছি এই প্রকল্প থেকে লাভ হবে কিনা। ২০১০-১১ সালে আবাসন খাতে ঋণের সরবরাহ ভালোই ছিল কিন্তু ২০১২ সাল থেকে অবস্থা অন্য রকম হতে থাকে। যা এখনও ইতিবাচক হয়নি।’

এই আবাসন ব্যবসায়ী বলেন, ‘আগে আমরা জমির মালিকের পেছন পেছন দৌড়েছি। তখন ব্যাংক আমাদের টাকা দিয়েছে, জমি কিনতে পেরেছি। প্রজেক্টও শেষ করেছি। কিন্তু এখন ঋণ পাওয়া দুরূহ ব্যাপার। গত বছর ডিসেম্বর মাসে একটি জমির মালিক আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে। ৩০ তোপখানা রোডে ২০ কাঠার একটি পুরাতন বাড়ি বিক্রি করতে চেয়েছিল। কিন্তু ওই মুহূর্তে জমি কেনার অবস্থা কোনো কোম্পানিরই ছিল না। জমির মালিক এক শ কোটি টাকা থেকে নামতে নামতে সর্বশেষ আমাকে ৬০ কোটি টাকায় অফার করেছে। কিন্তু এত টাকা ইনভেস্ট করার ক্ষমতা আমার কোম্পানির নেই। আবার ইনভেস্ট করাটাও রিস্কের।’

ধানমন্ডি ১১/এ’র ৬৮ নম্বর প্লটের পাওয়ার অব অ্যাটর্নি বেসরকারি ব্যাংকের উর্ধতন কর্মকর্তা ফারুক হোসেন। প্লটটির আয়তন সাড়ে ১৯ কাঠা। ২০১২ সালে রূপায়ন ডেভেলপমেন্ট জমিটিতে জয়েন্ট ভেঞ্চারে অ্যাপার্টমেন্ট প্রকল্পের জন্য আগ্রহ প্রকাশ করে। এ সময় কোম্পানি জমির মালিককে ২০ কোটি টাকা সাইনিং মানি (চুক্তি মূল্য) ও প্রকল্পের ৪০ শতাংশ দেওয়ার প্রস্তাব করে। কিন্তু চুক্তিমূল্য পছন্দ না হওয়ায় ফারুক হোসেন রূপায়নের সঙ্গে চুক্তিতে যাননি। পরবর্তী সময়ে তিনি ২০১৩ সালের জুন মাসে ৩০ কোটি টাকা সাইনিং মানি ও প্রকল্পের ৫০ শতাংশ দাবি করেন ওরিয়েন্টাল ডেভেলপমেন্টের কাছে। জমির লোকেশন পছন্দ হলেও কোম্পানি প্রস্তাবিত মূল্যে চুক্তি করতে অনাগ্রহ প্রকাশ করে। ওরিয়েন্টাল ডেভেলপমেন্টের পক্ষ থেকে ১২ কোটি টাকা সাইনিং মানি ও প্রকল্পের ৫০ ভাগ জমির মালিককে দেওয়ার প্রস্তাব দেয়। এতে হতাশ হন ফারুক হোসেন।

ফারুক হোসেন দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘জমিটির প্রকৃত মালিক কানাডায় বসবাস করেন। আমার নিকট আত্মীয় হওয়ায় এই জমিটির পাওয়ার অব অ্যাটর্নি আমাকে করা হয়। কিন্তু ২০১২ সালে যে দামের অফার পেয়েছি, এখন তার অর্ধেকও পাচ্ছি না।’

(দ্য রিপোর্ট/এইচআর/এইচএসএম/সা/এনআই/জানুয়ারি ২১, ২০১৪)

পাঠকের মতামত:

SMS Alert

বিশেষ সংবাদ এর সর্বশেষ খবর

বিশেষ সংবাদ - এর সব খবর