thereport24.com
ঢাকা, সোমবার, ২০ মে 24, ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১,  ১২ জিলকদ  1445

শ্রমিক ফান্ড নিয়ে লুকোচুরি

বঞ্চিতদের পাশে নেই কেউ

২০১৪ জানুয়ারি ২১ ১৭:৩৯:০৯
বঞ্চিতদের পাশে নেই কেউ

কল-কারখানায় কর্মরতদের নিরাপত্তার স্বার্থে ২০০৬ সালে শ্রম আইন প্রণয়ন করা হলেও কার্যত এর সুফল পাচ্ছেন না শ্রমিকরা। উল্টো শ্রমিকদের নাম ব্যবহার করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে বিভিন্ন কোম্পানি। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত অধিকাংশ কোম্পানি শ্রমিক ফান্ডের অর্থ নয়-ছয় করলেও নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) কিংবা স্টক এক্সচেঞ্জগুলো এ অনিয়ম রোধের দায়িত্ব নেয় না।

শ্রমআইন : সর্বনিম্ন এক কোটি টাকা মূলধনের কোম্পানির ক্ষেত্রে নিট আয়ের ৫ শতাংশ ওয়ার্কার্স প্রফিট পার্টিসিপেশন ফান্ড (ডব্লিউপিপিএফ) আকারে সংরক্ষণের বাধ্যবাধকতা রেখে ২০০৬ সালে শ্রম আইন প্রণয়ন করা হয়। ফান্ডের দুই-তৃতীয়াংশ শ্রমিকদের মধ্যে সমানহারে বিতরণ ও বাকি অংশ মুনাফাযোগ্য খাতে বিনিয়োগের কথা বলা হয়েছে প্রণীত আইনে। একইসঙ্গে বিনিয়োগকৃত অর্থের মুনাফাও শ্রমিকরা সমান হারে পাবেন বলে আইনে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত অধিকাংশ কোম্পানি এই আইন পরিপালন করে না বলে দ্য রিপোর্টের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে।

এএমসিএল (প্রাণ) : নিট আয়ের ৫ শতাংশ হারে নিয়মিত ফান্ড গঠন করছে কোম্পানি কর্তৃপক্ষ। ২০১১-১২ অর্থবছর শেষে এ কোম্পানিতে শ্রমিক ফান্ডের আকার দাঁড়ায় ১ কোটি ৫৮ লাখ টাকা। কিন্তু ফান্ডের অর্থ শ্রমিকদের মধ্যে বিতরণ করেনি এএমসিএল (প্রাণ)। এ ছাড়া নিয়মানুযায়ী কোনো মুনাফাযোগ্য খাতে শ্রমিক ফান্ডের অর্থ বিনিয়োগ করা হয়নি। কোম্পানির ডিজিএম শাহাজালাল জানিয়েছেন, গঠিত ফান্ডের টাকা বিতরণ করা হয় না। কিন্তু কেন হয় না এর জবাব তিনি দিতে পারেননি।

তাল্লু স্পিনিং মিলস : এ কোম্পানিতে শ্রমিকদের জন্য ২০১০-১১ অর্থবছরে ১১ লাখ ৭ হাজার টাকা এবং ২০১১-১২ অর্থবছরে ৩৮ লাখ ৮৫ হাজার টাকার ফান্ড গঠন করা হয়। ২০১০-১১ অর্থবছরের আর্থিক প্রতিবেদনে এ কোম্পানির শ্রমিক ফান্ডে মোট ১ কোটি ১৯ লাখ ৯৪ হাজার এবং ২০১১-১২ অর্থবছরে ১ কোটি ৫৮ লাখ ৭৯ হাজার টাকা সংরক্ষণের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু ফান্ড বিতরণ কিংবা বিনিয়োগ কোনোটাই করেনি কোম্পানি কর্তৃপক্ষ।

বঙ্গজ : এ কোম্পানিতে শ্রমিকদের জন্য ২০১০-১১ অর্থবছরে ১ লাখ ৪৪ হাজার এবং ২০১১-১২ অর্থবছরে ৪ লাখ ৫২ হাজার টাকার ফান্ড গঠন করা হয়েছে। কিন্তু ফান্ডের অর্থ শ্রমিকদের মাঝে বিতরণ করেনি বঙ্গজ কর্তৃপক্ষ। তাল্লু ও বঙ্গজ কোম্পানির ফাইন্যান্স বিভাগের এজিএম ফিরোজ ইফতেখার মাসুদ জানিয়েছেন, পরবর্তী সময়ে শ্রমিক ফান্ডের টাকা বিতরণ করা হবে।

রংপুর ডেইরী অ্যান্ড ফুড প্রোডাক্টস : কোম্পানি কর্তৃপক্ষ ২০১০ সালের জন্য ২৩ লাখ ৭৮ হাজার ৩০৭ টাকা, ২০১১ সালের জন্য ৩৪ লাখ ৬ হাজার ৯১৭ টাকা এবং ২০১২ সালের জন্য ২৬ লাখ ৩০ হাজার ৩৪৪ টাকা মিলিয়ে মোট ৮৪ লাখ ১৫ হাজার ৫৬৮ টাকার শ্রমিক ফান্ড গঠন করেছে। কিন্তু ফান্ডের অর্থ বিতরণ কিংবা মুনাফাযোগ্য খাতে বিনিয়োগ করা হয়নি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে কোম্পানির সিএফও ইয়াসিন আরাফাত বলেন, তারা তালিকাভুক্তির পরে ফান্ড গঠন শুরু করেছেন এর আগে করেননি। বিতরণ করেন না কেন এমন প্রশ্নে ভবিষ্যতে করবেন বলে জানিয়েছেন।

আরগন ডেনিমস : শ্রম আইন ২০০৬ সালে প্রণয়ন করা হলেও আরগন ডেনিমস ফান্ড গঠন করছে ২০১১ সাল থেকে। ফান্ড গঠন করা হলেও তা বিতরণ করে না কর্তৃপক্ষ। ইতোমধ্যে গঠিত ১ কোটি ৬৭ লাখ টাকার শ্রমিক ফান্ড মুনাফাযোগ্য খাতেও বিনিয়োগ করেনি আরগন ডেনিমস।

এইচআর টেক্সটাইল : শ্রম আইন অনুযায়ী ২০১২ সাল পর্যন্ত ২ কোটি ২৪ লাখ টাকার ফান্ড গঠন করেছে এইচআর টেক্সটাইল। কিন্তু গঠিত ফান্ডের অর্থ বিতরণ এবং মুনাফাযোগ্য খাতে বিনিয়োগ করা হয়নি।

লিবরা ইনফিউশন : আইন অনুযায়ী মুনাফার ওপর ৫ শতাংশ হারে শ্রমিক ফান্ড গঠন বাধ্যতামূলক হলেও লিবরা ইনফিউশন তা করেনি। বছরের পর বছর ফান্ডের আকার বড় করা হলেও শ্রমিকদের ভাগ্যে কিছুই জোটেনি। এ কোম্পানিতে ২০১১-১২ অর্থবছর শেষে শ্রমিক ফান্ডে ৩১ লাখ ৬১ হাজার টাকা জমা হয়েছে। প্রতিবছর ১ থেকে ৩ লাখ টাকা করে ফান্ড জমা হয়। সে হিসাবে নিয়মিত অর্থ বিতরণ করা হলেও ৩১ লাখ টাকা জমা হওয়ার কথা নয়।

এদিকে, ২০১১-১২ অর্থবছরে কোম্পানিটি করপূর্ব ৬৭ লাখ ৬৫ হাজার টাকা আয় করেছে। যার ওপর ৫ শতাংশ হারে ফান্ড গঠন করলে হয় ৩ লাখ ৪৬ হাজার টাকা। কিন্তু কর্তৃপক্ষ শ্রমিক ফান্ডে জমা করেছে দেড় লাখ টাকা। এ বিষয়ে কোম্পানির সচিব জাহাঙ্গীর আলমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোনো জবাব দেননি।

ফু-ওয়াং ফুড : এ কোম্পানি শ্রমিক ফান্ডের অর্থ ইচ্ছামতো বিতরণ করে। বিধান অনুযায়ী ফান্ডের ২-৩ অংশ বিতরণের নির্দেশনা থাকলেও কর্তৃপক্ষ ২০১১ সালে ৯ কোটি ও ২০১২ সালে ৮৮ লাখ টাকা নিয়মবহির্ভূতভাবে বিতরণ করেছে। এ ছাড়া শ্রমিক ফান্ডে কোটি টাকার বেশি থাকলেও তা থেকে অর্জিত মুনাফার বিষয়ে আর্থিক প্রতিবেদনে কিছু উল্লেখ করা হয়নি।

প্যারামাউন্ট টেক্সটাইল : প্যারামাউন্ট টেক্সটাইল ২০০৬ সালের পরিবর্তে ২০১১ সাল থেকে শ্রমিক ফান্ড গঠন শুরু করে। শ্রমিকদের স্বার্থে আনুষ্ঠানিকতা রক্ষা করলেও শ্রমিকদের এক টাকাও দেয়নি এ কোম্পানি। এ ছাড়া মুনাফাযোগ্য কোনো খাতেও অর্থ বিনিয়োগ করা হয়নি। যোগাযোগ করেও এ ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।

জাহিনটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজ : বস্ত্র খাতের জাহিনটেক্স শ্রমিক ফান্ড নিয়ে মিথ্যাচার করেছে আর্থিক প্রতিবেদনে। এ কোম্পানি ২০১০-১১ অর্থবছরের চূড়ান্ত হিসাবে মোট মুনাফার ওপর শ্রমিকদের জন্য ৫ শতাংশ হারে ৫১ লাখ ৬৬ হাজার টাকার ফান্ড গঠন করলেও অর্থবছর শেষে ফান্ডে ২৬ লাখ ৬৬ হাজার টাকা রয়েছে বলে আর্থিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। নিয়মানুযায়ী বছর শেষে মোট আয়ের ওপর ফান্ড গঠন করা হলেও ওই বছরে বিতরণ সম্ভব হয় না। ফলে একই অর্থবছরের আর্থিক প্রতিবেদনে ফান্ডের আকার ছোট হওয়ার বিষয়টি সত্য নয়। কোম্পানি কর্তৃপক্ষ ফান্ডের টাকা বিতরণ করেছে এমন দাবি করলেও তার কোন ব্যাখ্যা তারা আর্থিক প্রতিবেদনে তুলে ধরতে পারেনি।

এসআলম কোল্ড রোল্ড স্টিলস : কোম্পানি কর্তৃপক্ষ ২ কোটি ২০ লাখ টাকার ফান্ড গঠন করলেও সঠিকভাবে বিতরণ করেনি। আইনানুযায়ী দুই-তৃতীয়াংশ অর্থাৎ ১ কোটি ৪৩ লাখ টাকা বিতরণ করার কথা থাকলেও বিতরণ করা হয়েছে ১ কোটি ৩০ লাখ টাকা। এ ছাড়া বাকি অংশ কোনো মুনাফাযোগ্য খাতে বিনিয়োগ করা হয়নি।

একটিভ ফাইন কেমিক্যালস : এ কোম্পানি শ্রমিক ফান্ডের অর্থ কোন খাতে ব্যয় করে তা পরিষ্কার করেনি আর্থিক প্রতিবেদনে। তবে শ্রমিকদের জন্য ফান্ড গঠনের কথা উল্লেখ রয়েছে প্রতিবেদনে। আর কোটি কোটি টাকার ফান্ড অলস পড়ে আছে বলে কোম্পানি কর্তৃপক্ষ স্বীকার করেছে। এ বিষয়ে কোম্পানি সিএফও প্রদীপ রায় জানিয়েছেন, সামনে শ্রমিকদের মধ্যে ফান্ড বিতরণ করবেন।

ম্যাকসন্স স্পিনিং : এ কোম্পানি শ্রমিক ফান্ড গঠন করে তা সঠিকভাবে বিতরণ করে না। নিয়মানুযায়ী ফান্ডের একটি অংশ মুনাফাযোগ্য খাতেও বিনিয়োগ করা হয় না বলে আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে জানা গেছে।

অধিকাংশ কোম্পানি শ্রমিক স্বার্থ রক্ষা না করলেও তা দেখভালের দায়িত্ব নিতে চায় না কোনো নীতি নির্ধারক প্রতিষ্ঠান। শ্রমিক ফান্ডের অর্থ নিয়ে প্রতারণা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) তদারকির মধ্যে পড়ে না বলে জানান সংস্থাটির মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো. সাইফুর রহমান।

পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলো শ্রম আইন অমান্য করছে বলে জানান চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) করপোরেট ফাইন্যান্স বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা। তাদের মতে, যে কোম্পানিতে শ্রমিক ফান্ডের টাকা বিতরণ ও বিনিয়োগ হয় না সেখানে প্রতারণা ঘটতে পারে। প্রতারণা রোধে কোম্পানি কর্তৃপক্ষকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া শ্রম আইন পরিপূর্ণ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে শ্রম অধিদফতরকে অবহিত করা হবে বলে জানান তারা।

দ্য রিপোর্ট/আরএ/ডব্লিউএন/এইচএসএম/সা/এনআই/জানুয়ারি ২১, ২০১৪)

পাঠকের মতামত:

SMS Alert

বিশেষ সংবাদ এর সর্বশেষ খবর

বিশেষ সংবাদ - এর সব খবর