thereport24.com
ঢাকা, সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১,  ২১ জমাদিউস সানি 1446

মাইকেল : এক উপেক্ষিত সিপাহসালার

২০১৪ জানুয়ারি ২৫ ০০:১১:৩৪
মাইকেল : এক উপেক্ষিত সিপাহসালার

ফকির শওকত

সাগরদাঁড়ী। যশোর জেলার একটি গ্রাম। এই গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে একটি স্রোতস্বিনী, যার নাম কপোতাক্ষ। এই গ্রামে জন্ম নেওয়া, এই স্রোতস্বিনীতে সাঁতার কাটা এক শিশু, নাম শ্রীমধুসূদন দত্ত। ছোটবেলায় পাশের গ্রামের মক্তবে মৌলভী সাহেবের কাছে ফার্সী শিক্ষা নেওয়া এই শিশুটি কলকাতায় গিয়েছিলেন ভারতবর্ষের নতুন শাসকের ভাষা ইংরেজি শিখতে।

ইংরেজি তিনি শিখেছিলেন ভৃত্য হওয়ার জন্য নয়। ইংরেজ ও ইংরেজি ভাষাকে তিনি নিয়েছিলেন নতুন জমানার ফরমান হিসেবে। নিজের চিন্তা ও জীবনবোধকে মূল্য দিয়ে তিনি স্ব-ধর্মও ছেড়েছিলেন। শ্রীমধুসূদন দত্ত হয়ে গিয়েছিলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত।

ব্যক্তি মধুসূদন তাই সমালোচিত, উপেক্ষিত, নির্যাতিতও বটে। যেমন পরিবারে, তেমন সমাজেও। আর এখানেই মাইকেল মধুসূদন দত্ত অনন্য, অসাধারণ। তিনি তার বিশ্বাসকে মর্যাদা দিয়েছেন। আত্মপ্রবঞ্চনা করেননি। এমনিতে পাওয়া বা জন্মসূত্রে পাওয়া কোনো কিছুই তিনি নিতে চাননি। যেমন বাপের জমিদারী, তেমনি পিতৃধর্মকেও। মানুষ হিসেবে তিনি সবকিছুকে গ্রহণ করতে চেয়েছেন নিজের চোখ দিয়ে। তাই বলা যায়, ব্যক্তি মধুসূদন সাহসের সাথে নতুন একটি জমানার দরজা খুলে দিয়েছেন।

মাইকেল মধুসূদন ইউরোপে গিয়েছিলেন ইউরোপীয় শিক্ষায় শিক্ষিত হতে। তিনি সেখানে থেকেছেন, গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন অগ্রসর ইউরোপের নতুন চিন্তা চেতনাকে। তার (ইউরোপের) রেনেসাঁ তিনি আত্মস্থ করেছেন। তিনি মনে করেছিলেন, ভারতবর্ষেও তা (রেনেসাঁ) ছড়িয়ে দেওয়া দরকার। তিনি ইংরেজিতে কাব্য রচনা করেছেন। সনেট রচনা করেছেন। ইউরোপীয়ান মেয়েকে বিয়ে করেছেন আবার দেশে ফিরে এসেছেন। অর্থাৎ, ইউরোপের চিন্তা, ইউরোপের সভ্যতা, ইউরোপের জীবনসঙ্গিনী তিনি গ্রহণ করেছেন। তবে ইউরোপীয় হয়ে উঠতে নয়। একজন ইন্ডিয়ানও যে ইউরোপের মতো আধুনিক আলোকিত হতে পারেন ব্যক্তিজীবন দিয়ে মাইকেল সেটি প্রতিষ্ঠা করে গেছেন।

মাইকেল মধুসূদনের কাব্য, নাটক, মহাকাব্য নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে। ‘মেঘনাদবধ’ কাব্য রচনা করে তিনি মহাকবি হয়েছেন। সেখানে রামায়ণের রামকে তিনি পরিত্যাগ করেছেন। আর রামের হাতে পরাজিত রাবণকেই তিনি তার মহাকাব্যের নায়ক বানিয়েছেন। রাবণের ট্রাজেডি যেন মনে করিয়ে দেয়, বিদেশাগত নতুন শাসক কীভাবে ছলচাতুরিতে স্বর্ণপুরী লঙ্কাকে ধ্বংস করে দিয়েছে। এ যেন নতুন শাসক ইংরেজের হাতে ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামীদের পরাজয়ের মতোই। তাঁর বিরুদ্ধে ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহ সম্পর্কে কোনো কিছু না লেখার, কোনো কিছু না বলার যে অভিযোগ রয়েছে, ‘মেঘনাদবধ’ মহাকাব্য যেন তারই জবাব।

পরিশেষে বলা যায়, মাইকেল মধুসূদন দত্ত এমন একটি এভিনিউ রচনা করেছেন, যে এভিনিউ দিয়ে আধুনিক ইউরোপীয় সভ্যতা, তার সংস্কৃতি, তার কবিতা ভারতবর্ষে এসে মিশেছে। ভারতীয়রাও মাইকেল নির্মিত সেই এভিনিউ দিয়ে ইউরোপের আধুনিক জমানার সাথে এক মেলবন্ধন রচনা করেছে। বাংলা ভাষা সাহিত্যের আধুনিক যে রূপ পরবর্তী সময়ে আমাদের সামনে হাজির হয়েছে মাইকেল মধুসূদন দত্ত তারই এক উপেক্ষিত সিপাহসালার।

ফকির শওকত : সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক।

পাঠকের মতামত:

SMS Alert

সাহিত্য এর সর্বশেষ খবর

সাহিত্য - এর সব খবর