thereport24.com
ঢাকা, রবিবার, ৫ মে 24, ২২ বৈশাখ ১৪৩১,  ২৬ শাওয়াল 1445

সাগরদাঁড়ীর মহাসাগর

২০১৪ জানুয়ারি ২৫ ১১:০৫:২৩
সাগরদাঁড়ীর মহাসাগর











শাহাদত হোসেন কাবিল

‘দাঁড়াও পথিকবর, জন্ম যদি তব

বঙ্গে! তিষ্ঠ ক্ষণকাল। এ সমাধিস্থলে

(জননীর কোলে শিশু লভয়ে যেমতি

বিরাম) মহীর-পদের মহানিদ্রাবৃত

দত্ত কুলোদ্ভব কবি শ্রী মধুসূদন।’

মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত রচিত এ সমাধিলিপি খোদিত আছে কবির জন্মভূমি যশোরের কেশবপুর উপজেলার সাগরদাঁড়ীর মধুপল্লীতে, কলকাতার ব্রাউন এন্ড কোম্পানী নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভে, যার উপরিভাগে স্থাপিত হয়েছে শিল্পী বিমানেশ চন্দ্র বিশ্বাসের তৈরী কবির ভাস্কর্য।

অনেকে ভুল করে বসেন ওখানেই বুঝি মধুকবির সমাধি; কিন্তু না। তার সমাধি কলকাতায়। সাগরদাঁড়ীতে ১৯৪৪ সালে যশোর সমবায় ব্যাংকের উদ্যোগে আর একটি আবক্ষমূর্তি নির্মাণ করা হয়। দত্তকুলোদ্ভব মহাকবির জন্মদিন ২৫ জানুয়ারি। ১৮২৪ সালের এ দিনে তিনি সাগরদাঁড়ীতে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি আধুনিক বাংলা কাব্যেরও প্রবর্তক। বাংলা কবিতাকে পুঁথি সাহিত্যের গণ্ডি থেকে টেনে এনে তিনিই আধুনিক রূপ দেন। তিনি সর্বপ্রথম বাংলায় সনেট লেখেন। বাংলা কাব্যে অমিত্রাক্ষর ছন্দেরও তিনিই প্রবর্তক। নিভৃত পল্লী সাগরদাঁড়ীর মধুসূদন বাংলা কাব্যের মহাসাগর।

বাংলা সাহিত্যের যুগান্তকারী প্রতিভা মাইকেল মধুসূদন দত্তের একদিন বাংলা ভাষার প্রতি অবজ্ঞা ছিল। এ ভাষায় কিছু লিখতে-পড়তে অথবা বলতে তিনি ইতস্তত বোধ করতেন। তাঁর উচ্চাভিলাষ ছিল ‘ইংরেজ’ হওয়ার। ইংরেজিতে মহাকাব্য লেখারও স্বপ্ন ছিল তার। এ জন্য তিনি ধর্মান্তরিত হয়ে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করে পাড়ি জমান বিদেশ-বিভূঁয়ে। তাঁর স্বপ্নসাধ ইংরেজি কাব্য ‘কেপটিভ লেডি’ প্রকাশিত হয়। কিন্তু সাহিত্য মানে ও কাব্যগুণে সেটি একটি বিখ্যাত কবিতা হলেও বিদগ্ধ ইংরেজ-সমাজে সমাদর লাভে বঞ্চিত হয়। তিনি এতে চরমভাবে ব্যথিত হন, তাঁর উপলব্ধি ঘটে। আর তাই তিনি ‘বঙ্গভাষা’ নামক কবিতায় মাতৃভাষার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে লেখেন-

‘হে বঙ্গ ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন
তা সবে (অবোধ আমি) অবহেলা করি
পরধন লোভে মত্ত, করিনু ভ্রমণ’

এরপর থেকে তিনি মাতৃভাষায় কাব্যচর্চার মাধ্যমে মনোনিবেশ করেন। যে মাতৃভূমি ও মাতৃভাষাকে অবজ্ঞা করে পিছে ফেলে দূরে চলে যান, ফ্রান্সের ভার্সাই নগরে বসে সেই স্মৃতিময় জন্মভূমির এক ছোট্ট নদ কপোতাক্ষের উদ্দেশে তাঁর ‘কপোতাক্ষ নদ’ কবিতায় লেখেন-

‘সতত হে নদ তুমি পড় মোর মনে
সতত তোমার কথা ভাবি এ বিরলে’

তিনি নদের উদ্দেশে কবিতায় আরও লেখেন-

‘আর কি হবে দেখা? যতদিন যাবে
প্রজারূপে রাজরূপ, সাগরে দিতে
বারিরূপ কর তুমি, এ মিনতি গাবে
বঙ্গজ জনের কানে, সখে সখারিতে
নাম তার এ প্রবাসে মজি প্রেমভাবে
লইছে যে তব নাম বঙ্গের সঙ্গীতে’

কবিতায় কবি করুণ ও মর্মস্পর্শী ভাষায় যা বলেন তা হল- ভুল বুঝে একদিন যে কপোতাক্ষকে ফেলে গিয়েছিলেন তার সাথে আর দেখা নাও হতে পারে। কিন্তু যতদিন ধরে সাগর-রাজকে প্রজারূপে তার পানির কর দিতে থাকবে অর্থাৎ কপোতাক্ষ জীবিত বা প্রবাহমান থাকবে ততদিন ধরে কলধ্বনির মাধ্যমে তাকে (কবিকে) যেন বাঙালীর কাছে সখা হিসেবে স্মরণ রাখে, স্তব স্তুতি করে। বিনিময়ে তিনি বিদেশ-বিভূঁয়ে আনন্দ-কোলাহলে মত্ত থেকেও তাকে নিয়ে কাব্য রচনা করে বাংলা সাহিত্যে একটি গৌরবের স্থান দান করেছেন।

মধুকবি আত্মোপলব্ধির কারণে কবির ভাষায় ‘মাতৃকোষে রতনের রাজি খুঁজে পূর্ণ মণিজালে মাতৃভাষারূপে খনি’ পেয়ে তিনি বরেণ্য হয়েছেন। তাই তার নাম সাগরদাঁড়ীর প্রান্তবাহী, কপোতের অক্ষির মতো স্বচ্ছ সলিলা সেই ছোট্ট নদ কপোতাক্ষের কথকতা বাঙালির কাছে স্মরণ রেখে কবির মিনতি রক্ষা করে চলেছে। কবির নাম আজ বাংলার সাহিত্যাকাশে স্বর্ণাক্ষরে লিখিত। বাঙালীর হৃদয়াসনে তাঁর স্থান।

যশোরবাসী তথা দেশবাসী যথাযোগ্য মর্যাদায় মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের জন্মবার্ষিকী পালন করে থাকেন। এ উপলক্ষে সাগরদাঁড়ীতে সপ্তাহব্যাপী অনুষ্ঠিত হয় মধুমেলা। এ মেলার প্রতিদিনের কর্মসূচিতে থাকে বরেণ্য ব্যক্তিত্ব ও খ্যাতিমান কবি-সাহিত্যিক ও শিল্পীদের আলোচনা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, কবিতা পাঠের আসর, যাত্রা, সার্কাস, পুতুল নাচ প্রভৃতি। আর হাজার রকম পশরায় মেলার বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে স্টল সাজায় মালিকরা।

দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা লাখ লাখ মাইকেলভক্তের পদচারণায় নিভৃত পল্লী সাগরদাঁড়ী সাত দিন ধরে উচ্ছ্বল থাকে। ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত এ মেলার আয়োজন করা হতো বেসরকারি পর্যায়ে, স্থানীয় উদ্যোগে। ১৯৯৪ সাল থেকে রাষ্ট্রীয়ভাবে সাগরদাঁড়ীতে মাইকেল জন্মোৎসব পালিত হচ্ছে। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় এর তত্ত্বাবধান করে।

কেমন আছে মধুস্মৃতি

কবির জন্মভূমি সাগরদাঁড়ী, কপোতাক্ষ নদ, তাঁর বাড়ি, স্মৃতিস্তম্ভ, আবক্ষমূর্তি, বিদায় ঘাট, মিউজিয়াম, দেবালয়, মধুসূদন একাডেমী, লাইব্রেরি, পর্যটন কেন্দ্র, ডাকবাংলো সব মিলে মধুস্মৃতি। যারা সাগরদাঁড়ী গ্রামে কোনো দিন যাননি, গ্রামটিকে যারা দেখেননি কোনো দিন, তাদের মনের কোণে একটি প্রশ্ন উঁকি দেয় মহাকবির জন্মভূমি গ্রামটি কেমন?

সাগরদাঁড়ী একটি নিভৃত পল্লী। দেশের ৬৮ হাজার গ্রামের মতোই আম-কাঁঠালের ছায়াঘেরা, পাখ-পাখালির ডাকে ভোর হওয়া একটি গ্রাম। জেলা শহর যশোর থেকে ৪৫ কিলোমিটার পথ যার মধ্যে উপজেলা সদর কেশবপুর পর্যন্ত সোজা ৩২ কিলোমিটার এবং কেশবপুর থেকে আঁকা-বাঁকা ১৩ কিলোমিটার সাগরদাঁড়ী। এ ১৩ কিলোমিটার পথ মধু সড়ক নামে পরিচিত। পুরো পথটাই পাকা। গ্রামের বাসিন্দাদের মধ্যে মুসলমান-হিন্দু প্রায় সমান। কৃষিনির্ভর এ গ্রামটিতে পানচাষীর সংখ্যা বেশি। গ্রামবাসীর অবস্থা মোটামুটি সচ্ছল। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিও ভালো। শিক্ষিতের হার ৫০ শতাংশের ওপরে। গ্রামে আছে ডাকঘর, সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্র, কলেজ, হাইস্কুল, প্রাইমারি স্কুল, মাদ্রাসা আর মধুস্মৃতির সব কিছু।

মধুকবির পৈত্রিক বাড়িঘর সংরক্ষণের সুব্যবস্থা করা হয়েছে। ১৯৬৫ সালের ২৬ অক্টোবর সরকারিভাবে এ বাড়ি পুরাকীর্তি হিসেবে ঘোষণা করা হয়। কবি যে ঘরটিতে জন্মগ্রহণ করেন সে ঘরের অস্তিত্ব নেই। তবে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ স্থানটি চিহ্ণিত করে রেখেছে। মিউজিয়ামে সংরক্ষণ করা হয়েছে কবির ব্যবহার্য অনেক দুর্লভ জিনিস। মধুস্মৃতিসহ প্রায় ছয় একর জমির ওপর ‘মধুপল্লী’ নামে পর্যটন কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে। প্রায় এক একর জমির ওপর পর্যটন কর্পোরেশন নির্মাণ করেছে একটি কমপ্লেক্স। এখানকার লাইব্রেরি পরিচালনা করে যশোর জেলা পরিষদ। মধুভক্তদের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত মধুসূদন একাডেমী কবির জীবন ও কর্মের ওপর গবেষণা পরিচালনা করে। সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করে মধুস্মৃতির সব দুর্লভ তথ্য-উপাত্ত ও জিনিসপত্র।

কবির শৈশবের স্মৃতিবাহী দুগ্ধ স্রোতরূপী কপোতাক্ষ তীরে কবির বিয়োগান্তক ঘটনার সাক্ষী ‘বিদায় ঘাট’ সংরক্ষিত আছে। ১৮৬২ সালে কবি তাঁর বিদেশিনী স্ত্রী হেনরিয়েটা ও সন্তান মিল্টনকে নিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু ধর্মান্তরিত হওয়ায় তাকে বাবা রাজনারায়ণ দত্তের বাড়িতে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। শেষবারের মতো মা জাহ্নবী দেবীর মুখ দেখার আশায় ওই ঘাটে ১৪ দিন তাঁবু খাটিয়ে অপেক্ষা করার পর ব্যর্থ হয়ে সাগরদাঁড়ীকে শেষবারের মতো বিদায় জানিয়ে চলে যান। পরবর্তীকালে মধুভক্তরা বিদায়ঘাটে স্মৃতিফলক স্থাপন করে তাতে খোদাই করে রেখেছেন কপোতাক্ষ নদ নামে কবির অমর কবিতা।

ভিন্ন পরিচয়ে মাইকেল মধুসূদন দত্ত

মাইকেল মধুসূদন দত্ত যশোর জেলার প্রথম সাংবাদিক। তবে তাকে দেশ-বিদেশের সবাই কবি হিসেবে চেনেন। তিনি মহাকবি।

মধুসূদন দত্ত জন্মগ্রহণ করেন যশোরের কেশবপুর উপজেলার সাগরদাঁড়ী গ্রামে। ১৮২৪ সালের ২৫ জানুয়ারি তার জন্ম। তার বাবার নাম রাজনারায়ন দত্ত। মাতা জাহ্নবী দেবী। বাবা কলকাতায় আইন ব্যবসা করতেন। সেই সূত্রে মধুসূদন সেখানে পড়াশোনা করতেন। ১৮৩৭ সালে মাত্র ১৩ বছর বয়সে তিনি হাতে লিখে পত্রিকা প্রকাশ করতেন। তার হাতে লেখা পত্রিকা ছিল সাপ্তাহিক। তবে কী নাম দিয়েছিলেন, তা জানা যায়নি। পত্রিকাটি চার মাস টিকেছিল।

মধুসূদন দত্ত লেখাপড়া শেষে কর্মজীবনের এক পর্যায়ে কলকাতা থেকে প্রকাশিত ‘মাদ্রাজ সার্কুলেটর’ পত্রিকার সহ-সম্পাদকের চাকরি নেন। এর প্রেক্ষাপটটা এমন যে, তিনি ১৯ বছর বয়সে কলকাতা হিন্দু কলেজের ছাত্র থাকা অবস্থায় ১৮৪৩ সালে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেন। এতে তার পরিবারসহ গোটা হিন্দু সমাজ তার ওপর ক্ষেপে যায়। অবস্থা এমন এক পর্যায়ে পৌঁছে যে, শেষমেশ তিনি হিন্দু কলেজ ছাড়তে বাধ্য হন। ওই বছর নভেম্বর মাসে তিনি বিশপস কলেজে ভর্তি হন।

১৮৪৭ সাল অর্থ কষ্টে পড়ে তিনি কলেজ ত্যাগ করে চাকরির সন্ধান করতে থাকেন। ১৮৪৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মাইকেল মধুসূদন দত্ত ‘এসাইলাম’-এ ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক হিসেবে চাকরি গ্রহণ করেন। তিনি ওই সময় বাস করতেন পপহ্যাম ব্রডওয়েতে। স্কুলে যাওয়া-আসার পথে ছিল ‘মাদ্রাজ সার্কুলেটর’ পত্রিকার অফিস। পত্রিকার প্রকাশক ও সম্পাদকের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। এ সুবাদে তিনি পত্রিকায় লেখা দিতেন। এক পর্যায়ে তিনি নিয়মিত লেখক হয়ে উঠেন। পরে ওই পত্রিকার সহ-সম্পাদকের চাকরি পান।

তিনি পত্রিকায় নিজ নামে লিখতেন না। তার লেখা ছাপা হতো Timothy Pen Poem ছদ্মনামে। এরপর তিনি ‘জেনারেল ক্রনিকাল’ ও ‘এথেনিয়াম’ পত্রিকায় সাংবাদিকতা করেন। ১৮৫২ সালের মার্চ মাসে মাইকেল মধুসূদন দত্ত ‘হিন্দু ক্রনিকল’ পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। সম্পাদক হিসেবে তার প্রশংসা ছিল যথেষ্ট। ১৮৫৩ সালের ২৯ জুলাই মাদ্রাজ সার্কুলেটর পত্রিকায় ইংরেজ শাসন ব্যবস্থার সঙ্গে মুসলিম শাসনের তুলনা করে মুসলমানদের পক্ষে একটি প্রবন্ধ লেখেন। ‘মুসলমানস ইন ইন্ডিয়া’ শীর্ষক এ প্রবন্ধ প্রকাশের পর শাসক মহলে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। এথেনিয়াম পত্রিকাসহ অন্যান্য পত্রিকায় তার বিরুদ্ধে সমালোচনার ঝড় ওঠে। এই সমালোচনা তাকে অল্পদিনের মধ্যে পরিচিতির শীর্ষে তুলে দেয়। ১৮৫৪ সালে মাদ্রাজ থেকে প্রথম দৈনিক পত্রিকা ‘স্পেকটেটর’ প্রকাশ হয়। মধুসূদন এই পত্রিকার সহ-সম্পাদক পদে যোগ দেন। ১৮৬২ সালে তিনি কলকাতায় ফিরে এসে কিছুদিন ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’ পত্রিকা সম্পাদনা করেন।

সাংবাদিকতায় মাইকেল মধুসূদন দত্ত খ্যাতি অর্জন করলেও তার পরিচিতি কবি হিসেবে। তিনি মহাকবি। আধুনিক বাংলা কাব্যের প্রবর্তক। তিনি বাংলা কবিতাকে পুঁথি সাহিত্যের গণ্ডি থেকে টেনে এনে আধুনিক রূপ দেন। বাংলা কাব্যে অমিত্রাক্ষর ছন্দের তিনিই প্রবর্তক।

মাইকেল মধুসূদন দত্ত ১৮৭৩ সালের ২৯ জুন কলকাতায় মারা যান।

পাঠকের মতামত:

SMS Alert

সাহিত্য এর সর্বশেষ খবর

সাহিত্য - এর সব খবর