thereport24.com
ঢাকা, মঙ্গলবার, ১০ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১,  ৮ জমাদিউস সানি 1446

দুর্নীতি স্বীকারকারী প্রতিষ্ঠানের নিরীক্ষা প্রতিবেদনও স্বচ্ছ!

২০১৪ জানুয়ারি ২৫ ১৮:০৫:৫০
দুর্নীতি স্বীকারকারী প্রতিষ্ঠানের নিরীক্ষা প্রতিবেদনও স্বচ্ছ!

পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলো নিজেদের আর্থিক প্রতিবেদনে অনিয়মের কথা স্বীকার করলেও নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো তাকে স্বচ্ছ প্রতিবেদন বা ‘ফেয়ার বুক’ বলে স্বীকৃতি দিচ্ছে। এতে করে দুর্নীতির পরও পার পেয়ে যাচ্ছে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত অধিকাংশ কোম্পানি। কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদনে নানা অনিয়মের বিরুদ্ধে আপত্তি তোলার কথা থাকলেও ‘ফেয়ার বুক’ মন্তব্য করে দুর্নীতিকে আড়াল করছে নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো।

প্রাপ্ত তথ্যে দেখা গেছে, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত অধিকাংশ কোম্পানি দেশি ও আন্তর্জাতিক অ্যাকাউন্টিং স্ট্যান্ডার্ড, করপোরেট গভর্নেন্স গাইডলাইনস (সিজিজি), কোম্পানি আইন, কস্ট অডিট এবং শ্রম আইন পরিপালন করে না।

কিন্তু আর্থিক প্রতিবেদন বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং স্ট্যান্ডার্ড (বিএফআরএস) অনুযায়ী তৈরি করা হয়েছে বলে নিরীক্ষকরা মন্তব্য করেছেন। একই সঙ্গে কোম্পানি আইন, সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) আইনসহ প্রযোজ্য অন্যান্য আইন ও নীতিমালার আলোকে প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে বলে প্রতিবেদনকে ‘ফেয়ার বুক’ বলে স্বীকৃতি দিয়েছে। অথচ কোম্পানি কর্তৃপক্ষ তাদের আর্থিক প্রতিবেদনে আইন পরিপালনে ব্যর্থতার কথা স্বীকার করেছে।

জেএমআই সিরিঞ্জ অ্যান্ড মেডিকেল ডিভাইসেস : বাংলাদেশ অ্যাকাউন্টিং স্ট্যান্ডার্ড (বিএএস)-৮ অনুযায়ী কোনো কোম্পানি বর্তমান অ্যাকাউন্টিং পলিসি পরিবর্তন করলে তার কারণ ও প্রভাব উল্লেখ করতে হবে। জেএমআই সিরিঞ্জ কর্তৃপক্ষ অবচয়নীতি পরিবর্তন করলেও আর্থিক প্রতিবেদনে কোনো ব্যাখ্যা কিংবা এর প্রভাব সম্পর্কে কিছুই উল্লেখ করেনি। আর প্রতিবেদন তৈরিতে বিএএস পরিপালিত হয়নি এমন অভিযোগ চিঠির মাধ্যমে স্টক এক্সচেঞ্জের কাছে স্বীকার করেছে কোম্পানি কর্তৃপক্ষ। কিন্তু নিরীক্ষক রহমান মুস্তাফিজ হক অ্যান্ড কোং. আর্থিক প্রতিবেদনকে ‘ফেয়ার বুক’ বলে মন্তব্য করেছে।

রূপালী ইন্স্যুরেন্স : সিজিজি অনুযায়ী কোনো উদ্যোক্তা ও কোনো পরিচালকের সঙ্গে সর্ম্পক আছে এমন কেউ কোম্পানির স্বতন্ত্র পরিচালক হতে পারবেন না। কিন্তু তারপরও রূপালী ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে উদ্যোক্তা মো. জিনাত আলী মিয়া ও পরিচালক তাসনিয়া কামরুন আনিকার বোন ফৌজিয়া কামরুন তানিয়াকে স্বতন্ত্র পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে কোম্পানি সচিব মি. রাশেদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি অনিয়মের কথা স্বীকার করে পরবর্তীকালে তা সংশোধনের আশ্বাস দেন। এত অনিয়ম সত্ত্বেও এ কোম্পানির নিরীক্ষক এ. ওহাব অ্যান্ড কোং. আর্থিক প্রতিবেদনকে ‘ফেয়ার বুক’ বলে মন্তব্য করেছে।

একটিভ ফাইন কেমিক্যালস : শ্রম আইন অনুযায়ী বছর শেষে কোম্পানির নিট আয়ের ৫ শতাংশ অর্থে শ্রমিক ফান্ড গঠন বাধ্যতামূলক। একটিভ ফাইন ফান্ড গঠন করলেও শ্রমিকদের মধ্যে তা বিতরণ করে না। ফান্ডের দুই-তৃতীয়াংশ শ্রমিকদের মধ্যে বিতরণ এবং বাকি অর্থ মুনাফাযোগ্য খাতে বিনিয়োগের বাধ্যবাধকতা রেখে ২০০৬ সালে শ্রম আইন প্রণয়ন করা হলেও তা মূলত পরিপালন করে না একটিভ ফাইন।

এ ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে পরবর্তী বছর থেকে শ্রম আইন পরিপালন করা হবে বলে কোম্পানির প্রধান অর্থ কর্মকর্তা (সিএফও) প্রদীপ কুমার জানান। কিন্তু নিরীক্ষক খান ওহাব শফিক অ্যান্ড কোং অনিয়ম এড়িয়ে এ কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদনকে ‘ফেয়ার বুক’ বলে মন্তব্য করেছে।

আরগন ডেনিমস : বিএএস-১২ এর অনুচ্ছেদ ২০ অনুযায়ী পুনর্মূল্যায়িত সম্পদের উপর ডেফার্ড ট্যাক্স (বিলম্বিত কর) গণনা করা বাধ্যতামূলক। ডেফার্ড ট্যাক্স গণনা করা হলে সম্পদের পরিমাণ কমে যায় বিধায় আরগন ডেনিমস এ আইন পরিপালন করেনি। এ কোম্পানির বিষয়েও নিরীক্ষক পিনাকি অ্যান্ড কোং. আর্থিক প্রতিবেদনকে ‘ফেয়ার বুক’ বলে মন্তব্য করেছে। অপরদিকে কোম্পানি কর্তৃপক্ষ পরবর্তী বছর থেকে ডেফার্ড ট্যাক্স গণনা করবে বলে স্টক এক্সচেঞ্জকে লিখিতভাবে জানিয়েছে।

জেনারেশন নেক্সট ফ্যাশন : ১৯৯৪ সালের কোম্পানি আইনের ২২০ ধারা ও প্রকাশিত গেজেট অনুযায়ী বস্ত্র খাতের কোম্পানির জন্য কস্ট অডিট করানো বাধ্যতামূলক। বস্ত্র খাতের কোম্পানি হয়েও জেনারেশন নেক্সট কস্ট অডিট করায়নি। আর্থিক প্রতিবেদনে সিজিজি পরিপালনের প্রমাণপত্র এবং পরিচালকদের সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ না করলেও নিরীক্ষক আতা খান অ্যান্ড কোং. তা ‘ফেয়ার বুক’ বলে চালিয়ে দিয়েছে। অপরদিকে আগামী বছর থেকে ডেফার্ড ট্যাক্স গণনার আশ্বাস দিয়েছেন কোম্পানির শেয়ার বিভাগের কর্মকর্তা শম্ভু পাল।

তাল্লু স্পিনিং, বঙ্গজ ও মিথুন নিটিং : ১৯৯৪ সালের কোম্পানি আইনের ১০৯ ধারা অনুযায়ী কোনো কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) অন্য কোনো পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি এমনকি তার সাবসিডিয়ারি কোম্পানিতে (অঙ্গ প্রতিষ্ঠান) একই পদে নিয়োগযোগ্য হবে না। বিগত ২০১১-১২ অর্থবছরে আলোচ্য তিন কোম্পানিতে এমডি হিসেবে অবৈধভাবে দায়িত্ব পালন করেন মোজাম্মেল হক। অথচ এ. মতিন অ্যান্ড কোং. এ অনিয়ম সত্ত্বেও এই তিন কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদনকে ‘ফেয়ার বুক’ বলে মন্তব্য করেছে। তবে এ ব্যাপারে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশের পর কোম্পানিগুলো ওই অনিয়ম সংশোধন করে নেয়।

অস্বচ্ছ আর্থিক প্রতিবেদনকে ফেয়ার বলে মন্তব্য করা হলে অডিট প্রতিষ্ঠানকে আইনের আওতায় আনার কথা জানান পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির দায়িত্বপ্রাপ্ত মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো. সাইফুর রহমান।

কোম্পানি কর্তৃপক্ষ ভুল স্বীকার করার পরও নিরীক্ষকের ‘ফেয়ার’ মন্তব্য করাকে দুর্ভাগ্যজনক বলে মন্তব্য করেছেন চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) সৈয়দ সাজিদ হোসেন।

তিনি বলেন, কোনো নিরীক্ষক এ ধরনের অনৈতিক কাজ করলে পুঁজিবাজার ও বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে ওই অডিট প্রতিষ্ঠানকে অবশ্যই আইনের আওতায় আনা দরকার। আর এক্ষেত্রে নিরীক্ষকদের সংগঠন ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্টস অব বাংলাদেশকে (আইসিএবি) পদক্ষেপ নিতে হবে। পাশাপাশি পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসিকে এ বিষয়ে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি।

(দ্য রিপোর্ট/আরএ/ডব্লিউএন/আরকে/সা/জানুয়ারি ২৫, ২০১৪)

পাঠকের মতামত:

SMS Alert

বিশেষ সংবাদ এর সর্বশেষ খবর

বিশেষ সংবাদ - এর সব খবর