thereport24.com
ঢাকা, শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১,  ২১ জমাদিউল আউয়াল 1446

টুকুর বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ

২০১৪ জানুয়ারি ২৭ ২২:০২:০০
টুকুর বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ

সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট মো. শামসুল হক টুকু ও তার পরিবারের সদস্যদের দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) জমা পড়েছে।

রাজধানীর সেগুনবাগিচায় দুদক কার্যালয়ে সোমবার এই অভিযোগ জমা পড়ে। দুদক চেয়ারম্যান মো. বদিউজ্জামান অভিযোগটি বিশেষ অনুসন্ধান ও তদন্তের জন্য মহাপরিচালককে নির্দেশ দিয়েছেন। দুদক সূত্র এ সব তথ্য দ্য রিপোর্টকে নিশ্চিত করেছে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে দুদক চেয়ারম্যান মো. বদিউজ্জামান দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট মো. শামসুল হক টুকুর বিরুদ্ধে অভিযোগ আমরা দেখব। অভিযোগটি এখনও আমি দেখিনি। আমরা ইতোমধ্যেই সাত জনের সম্পদ অনুসন্ধান করছি। পরবর্তী সময়ে আরও অভিযোগ থাকলে সেগুলো আমরা অনুসন্ধান করব।’

এ প্রসঙ্গে অ্যাডভোকেট মো. শামসুল হক টুকু দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘দুদক তদন্ত করতে পারে। আমরা সরকারকে ইনকাম ট্যাক্স দিয়েছি, যেসব অভিযোগ রয়েছে দুদক অবশ্যই সবকিছু খতিয়ে দেখবে।’

দুদক সূত্র জানায়, ২০০৮ সালের হলফনামা অনুসারে টুকুর দুই ছেলে ও বড় ছেলের স্ত্রীর কোনো সম্পদ ছিল না। পাঁচ বছর পর তারা কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। তবে ২০১৩ সালে নির্বাচন কমিশনে প্রদেয় হলফনামায়ও টুকু এ সব সম্পদের তথ্য গোপন করেছেন।

অভিযোগে বলা হয়েছে, সাবেক এই স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ও তার পরিবারের সদস্যরা গত পাঁচ বছরে (২০০৮-২০১৩) ব্যাপক ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে নামে-বেনামে অবৈধ সম্পদ অর্জন করেছেন। গত পাঁচ বছরে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী থাকার সুবাদে ১৫ কোটি পাঁচ লাখ ৬০ হাজার ৫১১ টাকা এবং জ্যেষ্ঠ পুত্র ভিওআইপি ব্যবসায় কর ফাঁকি দিয়ে ১৪৬ কোটি ৪৩ লাখ টাকা অর্জন করেছেন। তবে প্রকৃত হিসাবে তার নিজ নামে-বেনামে, তার স্ত্রী ও দুই পুত্র ও পুত্রবধূর নামে অবৈধ উপায়ে প্রায় ২০০ কোটি টাকার সম্পদ অর্জন করেছেন।

২০০৮ সালে নির্বাচন কমিশনে দাখিলকৃত হলফনামা অনুসারে, অ্যাডভোকেট মো. শামসুল হক টুকু আইন পেশা থেকে দুই লাখ পাঁচ হাজার টাকা আয় করেছেন। ওই সময় তার নগদ ছিল এক লাখ ৫৪ হাজার টাকা। ব্যাংকে জমা অর্থের পরিমাণ ছিল ১৯ হাজার টাকা। এ ছাড়া সোনা ১০ হাজার টাকা, ইলেক্ট্রনিক্স সামগ্রী ৪০ হাজার টাকা, আসবাবপত্র ৫০ হাজার টাকা এবং ৯ লাখ টাকার অকৃষি জমি ছিল। অর্থাৎ ২০০৮ সালে টুকুর মোট ১৩ লাখ ৭৮ হাজার টাকার সম্পদ ছিল।

টুকুর স্ত্রী বেগম লুৎফুন নেছার ২০০৮ সালে মোট ৬১ লাখ ৭২ হাজার টাকার সম্পদ ছিল। এর মধ্যে স্থাবর সম্পদ হিসেবে একটি ফ্ল্যাট যার মূল্য ২০ লাখ টাকা, নগদ আট হাজার টাকা, ব্যাংকে জমাকৃত ৪১ লাখ ৫০ হাজার টাকা ও ১৪ হাজার টাকার সোনা রয়েছে। আর টুকুর বড় ছেলে এস. এম. আসিফ সামস, ছোট ছেলে এসএম নাফিস সামস্ এবং বড় ছেলের স্ত্রী মুসলিমা খাতুনের কোনো সম্পদ ছিল না। অর্থাৎ ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনের কাছে দাখিলকৃত হলফনামায় তিনি ও তার পরিবারের সদস্যদের মোট ৭৫ লাখ ৫০ হাজার টাকার সম্পদের মালিক বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

সূত্র জানায়, ২০০৮ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচিত হওয়ার পর প্রথমে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী এবং পরবর্তী সময়ে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনকালে তিনি বিপুল পরিমাণ অবৈধ অর্থ সম্পদের মালিক হন। ২০১৩ সালে দাখিলকৃত হলফনামায় তিনি অবৈধভাবে অর্জিত অর্থের কিছু অংশ উল্লেখ করেন।

২০১৩ সালে নির্বাচন কমিশনে দাখিলকৃত হলফনামা অনুসারে, টুকু মোট দুই কোটি ৪০ লাখ ৪৯ হাজার ৫১০ টাকার সম্পদ অর্জন করেছেন। এর মধ্যে কৃষি খাতে ৮০ হাজার টাকা, বাড়ি-অ্যাপার্টমেন্ট-দোকান ও অন্যান্য ভাড়া দুই লাখ ৮৩ হাজার টাকা, শেয়ার সঞ্চয়পত্র ব্যাংক আমানত পাঁচ লাখ ৩৯ হাজার ১২১ টাকা, নগদ তিন লাখ ৫০ হাজার টাকা, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমাকৃত তিন লাখ ৫০ হাজার টাকা, ডিপিএস এক লাখ ৭৮ হাজার ৯৬০ টাকা, এফডিআর ৪৫ লাখ ৪১ হাজার ৫৪৬ টাকা, মোটরগাড়ি ৭১ লাখ ৩৯ হাজার ৯৮৫ টাকা, ১০ ভরি সোনা, ১০ হাজার টাকা, ইলেক্ট্রনিক্স সামগ্রী ৪০ হাজার টাকা, আসবাবপত্র ৫০ হাজার টাকা, পিস্তল একটি ৮৬ হাজার ৯০০ টাকা, পাঁচ কাঠা অকৃষি জমি ৪৯ লাখ ৭৭ হাজার ২৯৮ টাকা, পাবনা সদরে একটি দালান ১০ লাখ ৫০ হাজার টাকা, দানসূত্রে প্রাপ্ত বসতভিটা ২৫ লাখ টাকার সম্পদ রয়েছে।

টুকুর মোট দুই কোটি ৪০ লাখ ৪৯ হাজার ৫১০ টাকার অর্জিত সম্পদের বিপরীতে হাউজ বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশন থেকে ৯ লাখ ৮৬ হাজার ৩৪৯ টাকা, জনতা ব্যাংক থেকে ৫১ লাখ ৭৪ হাজার ৫৩৭ টাকা এবং মার্কেন্টাইল ব্যাংক থেকে তিন লাখ ৮৬ হাজার ৫২৩ টাকার দায় প্রদর্শন করেছেন। অর্থাৎ তিনি মোট ৬৫ লাখ ৪৭ হাজার ৪০৯ টাকা দায় দেখিয়েছেন। দায় বাদে হলফনামায় তিনি এক কোটি ৭৫ লাখ দুই হাজার ১০১ টাকার অর্জিত সম্পত্তি ঘোষণা করেছেন। যার বৈধ কোনো উৎস নেই বলে অভিযোগ রয়েছে।

সূত্র জানায়, ২০১৩ সালের হলফনামায় প্রদর্শিত পাবনা সদরে বিদ্যমান বাড়িটি দু’তলা থেকে পাঁচ তলা পর্যন্ত সম্প্রসারণ করা হয়েছে। পাঁচতলা ভবনটির প্রকৃত মূল্য এক কোটি ৫০ লাখ টাকা। যার দাম তিনি হলফনামায় ১০ লাখ ৫০ হাজার টাকা উল্লেখ করেছেন। এ ক্ষেত্রে তিনি এক কোটি ৩৯ লাখ ৫০ হাজার টাকার সম্পদ গোপন করেছেন। এ ছাড়া বেড়ার বৃশালিখায় তার বসত ভিটায় প্রতিমন্ত্রী থাকাকালীন বিলাসবহুল দ্বিতল প্রাসাদ নির্মাণ করেছেন। নির্মিত প্রাসাদের আয়তন প্রতি তলায় ৩৯২৫ বর্গফুট। এ হিসেবে বাড়িটি নির্মাণে ব্যয় হয়েছে এক কোটি ৯৬ লাখ ২৫ হাজার টাকা। এ ক্ষেত্রে তিনি এক কোটি ৭১ লাখ ২৫ হাজার টাকার সম্পদের তথ্য গোপন করেছেন। টুকু স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী থাকাকালীন নিজ নামে প্রদর্শিত ও গোপনকৃত মোট চার কোটি ৮৫ লাখ ৭৭ হাজার ১০১ টাকার সম্পদ অর্জন করেছেন।

দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে জমা দেওয়া হলফনামা অনুসারে টুকুর স্ত্রী বেগম লুৎফুন নেছার মোট এক কোটি ৯৫ লাখ ৬৫ হাজার ৮০ টাকার সম্পদ রয়েছে। এর মধ্যে নগদ ১৫ হাজার টাকা, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমা এক লাখ ২৮ হাজার ৭৪৪ টাকা, কোম্পানি শেয়ার ৯ লাখ ৯০ হাজার টাকা, ডিপিএস এক লাখ ৭৮ হাজার ৯৬০ টাকা, এফডিআর এক কোটি ৩৬ লাখ ৪৭ হাজার ৩৭৬ টাকা, পাঁচ ভরি সোনা পাঁচ হাজার টাকা, ইলেক্ট্রনিক্স সামগ্রী ৫০ হাজার টাকা, আসবাবপত্র ৫০ হাজার টাকা, পাবনা সদরে একটি দালান এক লাখ টাকা, ওয়ারিশ ও হেবাসূত্রে প্রাপ্ত তিনটি ফ্ল্যাট ৪৪ লাখ টাকা রয়েছে। লুৎফুন নেছার মোট এক কোটি ৯৫ লাখ ৬৫ হাজার ৮০ টাকার অর্জিত সম্পদের বিপরীতে দুই লাখ টাকা দায় দেখিয়েছেন। অর্থাৎ হলফনামায় তিনি এক কোটি ৯৩ লাখ ৬৫ হাজার ৮০ টাকার অর্জিত সম্পত্তি ঘোষণা করেছেন।

সূত্র জানায়, লুৎফুন নেছা পাবনা সদরে অবস্থিত ভবনের মূল্য দেখিয়েছেন এক লাখ টাকা। প্রকৃতপক্ষে বাড়িটির মূল ন্যূনতম এক কোটি টাকা। এ ক্ষেত্রে তিনি ৯৯ লাখ টাকার সম্পদের তথ্য গোপন করেছেন। এ ছাড়া ওয়ারিশ ও হেবা সূত্রে প্রাপ্ত ঢাকার উত্তরায় অবস্থিত তিনটি ফ্ল্যাটের মূল্য ৪৪ লাখ টাকা উল্লেখ করেছেন। যার ন্যূনতম মূল্য তিন কোটি টাকা। এ ক্ষেত্রে তিনি দুই কোটি ৫৬ লাখ টাকার সম্পদের মূল্য গোপন করেছেন। অর্থাৎ লুৎফুন নেছা ২০০৮ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত সময়ে নিজ নামে প্রদর্শিত ও গোপনকৃত মোট পাঁচ কোটি ৪৮ লাখ ৬৫ হাজার ৮০ টাকার সম্পদ অর্জন করেছেন।

সূত্র আরও জানায়, টুকুর বড় ছেলে ভয়েস ওভার ইন্টারনেট প্রটোকল (ভিওআইপি) ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এসএম আসিফ সামস্ ভিশন টেল কোম্পানির চেয়ারম্যান। ভিওআইপি’র লাইসেন্স ফি বাবদ তিনি বিটিআরসিকে ১৫ কোটি টাকা অগ্রিম এবং প্রতিবছরে সাত কোটি টাকা হিসেবে তিন বছরে ২১ কোটি টাকা অর্থাৎ মোট ৩৬ কোটি টাকা বিটিআরসিকে তিনি প্রদান করেছেন। বার্ষিক লাইন রেন্ট সাত কোটি টাকা বিটিআরসিকে প্রদান না করে এ ব্যবসা করেছেন। বিটিআরসি রাজস্ব ও নিবন্ধন নবায়ন বাবদ ওই প্রতিষ্ঠানের কাছে ১৪৬ কোটি ৪৩ লাখ টাকা পাবে। ভিওআইপি লাইসেন্স প্রদানের জন্য অর্থ প্রদান কিংবা অর্থের উৎসের বিষয়টি আসিফ সামস্ অথবা তার বাবা টুকু কোথাও উল্লেখ করেননি।

সূত্র জানায়, টুকুর ছোট ছেলে নাসিফ সামস্ সোলার আই লিমিটেডের পরিচালক ও মেসার্স গ্রিন টেকনোলজির মালিক হিসেবে আয়কর বিবরণীতে মোট ৮২ লাখ ৭৫ হাজার টাকার সম্পদের হিসাব দিয়েছে। তবে টুকু তার হলফনামায় তার ছোট ছেলের নামে কোনো সম্পদের হিসাব উল্লেখ করেননি। এ ছাড়া নাফিস সামস্ পাবনা জেলার বেড়া উপজেলার পায়না ও তেঘরী মৌজায় ৪০ বিঘা জমি এক কোটি ৮০ হাজার টাকা ব্যয়ে ক্রয় করেছেন। ক্রয়কৃত ভূমি উন্নয়নে তিনি আরও এক কোটি ৭০ লাখ টাকা ব্যয় করেছেন। অর্থাৎ এ ক্ষেত্রে তিনি তিন কোটি টাকা ব্যয়ের বিষয়টি তার আয়কর বিবরণীতে অথবা তার বাবা টুকু তার হলফনামায় গোপন করেছেন।

টুকুর বড় ছেলের স্ত্রী মুসলিমা খাতুন এএম এন্টারপ্রাইজের মালিক হিসেবে আয়কর বিবরণীতে মোট এক কোটি ১৭ লাখ ৯৩ হাজার ৩৩০ টাকা প্রদর্শন করেছেন। তবে টুকু তার হলফনামায় মুসলিম খাতুনের কোনো সম্পত্তি উল্লেখ করেননি।

সূত্র জানায়, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ২০০৮ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত সময়ে মোট ১৫ কোটি পাঁচ লাখ ৬০ হাজার ৫১১ টাকার সম্পদ অর্জন করেছেন। এ ছাড়া তার পরিবারের সদস্যরা নামে-বেনামে পঞ্চগড় জেলায় ৩৬ বিঘা জমি ক্রয় করেছেন। ডিএসই, ডিএসসি ও বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক অবৈধভাবে অর্জিত বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করেছেন।

(দ্য রিপোর্ট/ এইচবিএস/ এইচএসএম/এনআই/জানুয়ারি ২৭, ২০১৪)

পাঠকের মতামত:

SMS Alert

বিশেষ সংবাদ এর সর্বশেষ খবর

বিশেষ সংবাদ - এর সব খবর