thereport24.com
ঢাকা, বুধবার, ১ মে 24, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১,  ২২ শাওয়াল 1445

মা-বাবার বিচ্ছেদে বিকারগ্রস্ত হচ্ছে সন্তানেরা

২০১৪ ফেব্রুয়ারি ০১ ১৩:০২:৫৭
মা-বাবার বিচ্ছেদে বিকারগ্রস্ত হচ্ছে সন্তানেরা

মো. শামীম রিজভী ও মৌমিতা মাসিয়াত, দ্য রিপোর্ট : নায়লা নাজনীন আজও ঘুমের ঘোরে ডুকরে কেঁদে ওঠে। ঘুম ভেঙে যায়, দুই চোখের পাতা আর এক হয় না। রাতের পর রাত না ঘুমিয়ে কাটানোর মানসিক যন্ত্রণা যেন বিকারগ্রস্ততায় রূপ নিয়েছে। দুই বছর হলো তার বাবা-মা আলাদা হয়ে গেছেন। এরপর থেকেই ৮ বছরের কিশোরী নায়লার আনন্দ-আহ্লাদ ফিকে হয়ে গেছে। হৃদয়-মনজুড়ে থাকে রাজ্যের বিষণ্নতা।

বাবা-মার সঙ্গের সেই আনন্দের দিনগুলোর কথা ভেবেই এখন সময় কাটে নায়লার। বাবা-মার সেই হাস্যোজ্জ্বল মুখ মনে করে নিজেও ক্ষণিকের পুলক অনুভব করে। কিন্তু যেই বাস্তবে ফেরে সবকিছুই ধোঁয়াশা। যেন শীতের সকালের ঘন কুয়াশা। কুয়াশা ভেদ করে যেমন কাছের মানুষকে দেখা যায় না, তেমনি মনের অ্যালবাম ঘেঁটে নায়লা তার মানসপটে বাবা-মার সেই মুখচ্ছবিটা পুরোপুরি দেখতে পায় না।

ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন নায়লার বাবা-মা। সুখের সংসারে একসময় তাদের কোল আলো করে আসে একটি কন্যাসন্তান। বাবা-মা নাম রেখেছিলেন নায়লা। কিন্তু সামান্য ভুল বোঝাবুঝি ও ব্যক্তিত্বের দ্বন্দ্বের কারণে একসময় তারা আলাদা থাকতে শুরু করেন। পরে দুইজনই বিবাহ বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নেন।

এরপর থেকে নায়লা অনেকটা একা। যদিও সে এখন তার বাবার সঙ্গে থাকে। কিন্তু তাকে দেওয়ার মতো সময় বাবার নেই। অফিসের ব্যস্ততার সঙ্গে অন্যকিছুও যেন যোগ হয়েছে, যা তার ভালো লাগে না। দাদিমাই তাকে দেখভাল করেন।

এ যন্ত্রণা শুধু নায়লার একার নয়, স্বামী-স্ত্রীর বিবাহ বিচ্ছেদে যে সন্তানরা একা হয়ে পড়ছেন তাদের সবারই দুঃখ, কষ্ট এই নায়লার মতোই। বাবা-মার স্নেহভরা শাসন, ভালোবাসা না পেয়ে এদের অনেকেই বিপথগামী হচ্ছে। মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছে। এমন কী সন্ত্রাসী কার্যকলাপেও জড়িয়ে পড়ছে। সমাজের কাছে আজ তারা কেউ অপরাধী, অবাঞ্ছিত।

সমাজের চোখে আজ তারা অপরাধী, অবহেলিত! কিন্তু এর দায়ভার নেয় কে? এ প্রশ্নের জবাব আজও অমীমাংসিত।

সমাজ বিশ্লেষকরা বলছেন, বিবাহ একটি সামাজিক বন্ধন। এ বন্ধনের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে নতুন একটি পরিবার। কিন্তু সামাজিক অবক্ষয়, নৈতিক স্খলন, মূল্যবোধ ও পারস্পরিক বিশ্বস্ততার অভাব ও ব্যক্তিত্বের সংঘাতের কারণে বিবাহ বিচ্ছেদের মতো ঘটনা ঘটছে।

এতে করে ছেলে-মেয়েরা হয়ে পড়ে অসহায়। তারা না পায় বাবা-মার ভালোবাসা, স্নেহশাসন ও সান্নিধ্য। এ জন্য তারা একসময় একাকীত্ব অনুভব করে। এ থেকে হতাশাগ্রস্ত ও বিপথগামী হয়ে পড়ে তারা। হতাশা থেকে কেউ কেউ উচ্ছৃঙ্খল জীবনও বেছে নেয়।

রাব্বিও চেয়েছিলেন বাবা-মার সঙ্গে থাকতে

‘ছোট থাকতেই বাবা ও মা আলাদা হয়ে যান। খেয়াল নেই হয়তো দ্বিতীয় অথবা তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ি। আমার ছোট বোনটি তখন আরও ছোট। আমি রয়ে গেলাম বাবার কাছে। ছোট বোন ইশিকে মা নিজের সঙ্গে নিয়ে গেলেন। হয়তো আমাকেও নিয়ে যেতেন কিন্তু বাবার জন্য পারলেন না।’

নিজের বাবা-মার বিচ্ছেদের কথা অনেকটা এভাবেই বললেন ২৫ বছর বয়সী আসিফ হোসেন রাব্বি। দেলোয়ার হোসেন ও শিরিন আক্তারের বড় সন্তান রাব্বি পুরান ঢাকার (বাংলাবাজার এলাকা) বাসিন্দা।

ওষুধ ব্যবসায়ী দেলোয়ার হোসেন ও ব্যাংক কর্মকর্তা শিরিন আক্তার কেন আলাদা হয়ে গিয়েছিলেন তা এখনও রাব্বির অজানা। একটি মানসিক যন্ত্রণা তাকে সারাদিন তাড়া করে ফেরে।

ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের তথ্যানুযায়ী, ২০১৩ সালের জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত ৪ হাজার ২৬ জনের বিবাহ বিচ্ছেদ হয়েছে। এর মধ্যে শতকরা ৭০ শতাংশ বিবাহ বিচ্ছেদের প্রথম উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে নারীদের পক্ষ থেকে।

১৩ বছর পর ওয়াহিদুজ্জামান ও সালমার বিচ্ছেদ

প্রেম করে বিয়ে করেছিলেন ব্যবসায়ী ওয়াহিদুজ্জামান ও ডাক্তার সালমা আখতার। সেই ১৩ বছর আগের কথা। সুখস্বর্গে হাবুডুবু খাচ্ছিলেন তারা। কিন্তু কখন যে কীভাবে তাদের সেই সংসারে ঘুণপোকা ঢুকেছিল তা প্রথমে বুঝতেই পারেননি সালমা।

হঠাৎ করেই তিনি জানতে পারলেন তার ভালোবাসার মানুষটি এখন পরনারীতে আসক্ত। তখনই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন এই অবিশ্বাসী মানুষটির সঙ্গে আর এক ছাদের নিচে নয়।

সেই সিদ্ধান্ত থেকেই বিচ্ছেদ। এরপর তিন সন্তানকে নিয়ে সালমা বর্তমানে রাজধানীর রায়েরবাজারে মায়ের কাছেই রয়েছেন।মূলত কী কারণে স্বামী-স্ত্রী বিবাহ বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নেন- এমন প্রশ্নের জবাবে সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট প্রকাশ রঞ্জন বিশ্বাস দ্য রিপোর্টকে বলেন, সাধারণত মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তদের মধ্যে বিবাহ বিচ্ছেদের মূল কারণ হয় পরিবারের অসচ্ছলতা। অন্যদিকে পরকীয়ার জন্য উচ্চবিত্ত ও উচ্চমধ্যবিত্ত পরিবারে বিবাহ বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটে। আসলে পরিবার যেমনই হোক, পরিবারের সদস্যদের মধ্যে যখন মূল্যবোধ ও বিশ্বস্ততার অভাব হয় তখন বিবাহ বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত চলে আসে।

আপন কেউ নেই ফয়সালের

ফয়সাল ছোটবেলা থেকেই মাকে দেখেননি। কিছুদিন পর দেখেন বাবা আরেকজন নারীকে নিয়ে এসেছেন। তিনি বলেন, ‘আশপাশে সবাই বলতেন তিনি নাকি আমার সৎমা। সেই থেকে একা আমি আরও একা হয়ে গেলাম। আর সঙ্গী হিসেবে বেছে নিলাম মাদককে।’

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোরোগ বিদ্যার সহযোগী অধ্যাপক ও মানসিক রোগের চিকিৎসক ডা. মো. মহসিন আলী শাহ দ্য রিপোর্টকে বলেন, বাবা-মার মধ্যে বিবাহ বিচ্ছেদ, আলাদা বসবাস করা, তাদের মধ্যে সুসম্পর্ক না থাকা ইত্যাদি কারণে ওই পরিবারের সন্তানদের মধ্যে মানসিক সমস্যা দেখা দেয়। সাধারণত শৈশবে এতটা সমস্যা দেখা না দিলেও বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের মধ্যে মানসিক সমস্যা দেখা দেয়। বিশেষ করে এ ধরনের পরিবারের সন্তানদের মধ্যে হতাশা খুব বেশি পরিমাণে দেখা যায়। হতাশার কারণে তারা মাদকাসক্তও হয়ে পড়ে।

নতুন জীবনে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছেন পারভিন

সুন্দর সংসার ছিল পারভিন আক্তার ও সায়েম খানের। বিয়ের পরের বছরই সংসার আলো করে এলো একটি মেয়ে। স্বামী-স্ত্রী তার নাম রাখলেন সারা খান। সারার বয়স যখন ৩ বছর তখন পারভিন ও সায়েম বিবাহ বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নেন। মানবাধিকারকর্মী পারভিন ও সুইডেন প্রবাসী সায়েমের বিয়ে পারিবারিকভাবেই হয়।

বিচ্ছেদের পর সারাকে পারভিন তার নিজের কাছেই নিয়ে যান। বর্তমানে সারা নার্সারির শিক্ষার্থী। পারভিন যতক্ষণ কাজে থাকেন ততক্ষণ সারাকে তার নানির বাড়ি শাহজাহানপুরে রেখে আসেন। কর্মক্ষেত্র থেকে ফিরে তিনি তার পুরো সময়টাই মেয়ের জন্য উজাড় করে দেন।

নিজের এই জীবনের জন্য একদমই আফসোস নেই পারভিনের, বরং নতুন জীবনকে নিয়ে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছেন। মেয়েকে নিজে মানুষ করলেও সায়েম সারার জন্য খরচ পাঠান। কিন্তু বাবাকে কতখানি অনুভব করে তা কীভাবে মাকে বোঝাবে সারা।

সন্দেহকে কেন্দ্র করে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে দূরত্ব বাড়তে থাকে

২০০৯ সালের ১১ নভেম্বর বিয়ে হয় মো. মামুন ও মিসেস সাদিয়ার। বিয়ের পর গ্রামেই ছিলেন নব দম্পতি। কিন্তু মামুন চাকরি করতেন ঢাকায় তীর কোম্পানিতে। তাই বিয়ের কিছুদিনের মধ্যে সাদিয়াকে নিয়ে তিনি মিরপুর-২ এ চলে আসেন। দিন যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সাদিয়ার মনে মামুনকে নিয়ে সন্দেহের জন্ম নেয়। এই সন্দেহকে কেন্দ্র করে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে দূরত্ব বাড়তে থাকে। দূরত্বের একপর্যায়ে ২০১৩ সালের মে মাসে সাদিয়া মামলা করে বিবাহ বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু ছেলে আনিসের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে স্ত্রীর সঙ্গে সমঝোতা করার সিদ্ধান্ত নেন মামুন। বর্তমানে তারা একসঙ্গে সংসার করছেন।

সমাজ থেকে বিবাহ বিচ্ছেদ কীভাবে রোধ করা যায়?- এ প্রশ্নের জবাবে অ্যাডভোকেট প্রকাশ বিশ্বাস বলেন, এ ব্যাধি রোধ করতে হলে সমাজের শিকড় থেকে পরিবর্তন করতে হবে। সমাজের স্তম্ভ হচ্ছে অর্থনীতি, সংস্কৃতি, সুশিক্ষা ও রাজনীতি। যতদিন তীব্রমাত্রার অর্থনৈতিক শোষণ ও সামাজিক বৈষম্য দূর করা না যাবে, ততদিন এই ব্যাধি রোধ করা সম্ভব নয়।

পরিবারের সমস্যা সন্তানদের সামনে প্রকাশ করা উচিৎ নয়

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোরোগ বিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও মানসিক রোগের চিকিৎসক ডা. মো. মহসিন আলী শাহ দ্য রিপোর্টকে বলেন, পরিবারে বাবা-মার মধ্যে যতই সমস্যা থাকুক না কেন সন্তানদের সামনে কখনও তা প্রকাশ করা উচিৎ নয়। সন্তানের সামনে বাবা-মার ঝগড়া করা তো উচিৎ নয়ই, এমনকি নিজেদের মধ্যে কোনো ছোট ব্যাপার নিয়ে যেন মনোমালিন্য না হয় সেদিকেও সতর্ক থাকা উচিৎ। কারণ সন্তানরা সবই বোঝে। হয়ত বয়স অল্প থাকার জন্য তারা এ ব্যাপারগুলো প্রকাশ করে না। কিন্তু সন্তানদের মনে এ ঘটনাগুলোর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।

(দ্য রিপোর্ট/এসআর/এসবি/এনআই/আরকে/জামান/ফেব্রুয়ারি ১, ২০১৪)

পাঠকের মতামত:

SMS Alert

বিশেষ সংবাদ এর সর্বশেষ খবর

বিশেষ সংবাদ - এর সব খবর