thereport24.com
ঢাকা, শনিবার, ১১ মে 24, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১,  ৩ জিলকদ  1445

অগ্নিঝরা মার্চের এইদিনে

২০১৬ মার্চ ০১ ০০:০৬:০৪
অগ্নিঝরা মার্চের এইদিনে

একটি স্বাধীন দেশ প্রতিষ্ঠার জন্য তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান তথা এ অঞ্চলের জনগণের সুদীর্ঘ ২৩ বছরের আন্দোলন-সংগ্রামের চূড়ান্ত বিস্ফোরণ ও পরিণতি ঘটে ১৯৭১ সালের মার্চে। ঘটনাবহুল মার্চ তাই বাংলাদেশের ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ। প্রতি বছর মার্চ এলেই আমরা ফিরে যাই ’৭১-এর সেই অগ্নিঝরা ও রক্তঝরা দিনগুলোতে। নিছক স্মৃতিকাতরতা নয়, মার্চ হোক আমাদের নতুন করে শপথ নেওয়ার দিন। এ লক্ষ্যকে সামনে রেখে ’৭১-এর মার্চের উত্তাল দিনগুলোর একটি সংক্ষিপ্ত দিনলিপি নতুন প্রজন্মের পাঠকদের জন্য ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরা হচ্ছে।

পটভূমি : ভাষা আন্দোলন ছিল তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান তথা পূর্ব বাংলার জনগণের নিজস্ব পৃথক জাতিসত্তা ও অধিকার চেতনার প্রথম উন্মেষ। ১৯৪৮ সালে শুরু হওয়া এ ভাষা আন্দোলন চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করেছিল ১৯৫২ সালে। এ চার বছরের আন্দোলন বাংলার মানুষকে তাদের অধিকারের বিষয়ে আরও শাণিত করে তুলেছিল। পাকিস্তান একটি দেশ হলেও শাসকগোষ্ঠী পশ্চিম পাকিস্তানী হওয়ায় সকল ক্ষেত্রে এ অঞ্চলের জনগোষ্ঠী ছিল অবহেলিত এবং শোষণ-বঞ্চনার শিকার। একই সঙ্গে দেশ পরিচালনার নামে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর অগণতান্ত্রিক কর্তৃত্বপরায়ণতা ও স্বার্থপরতা এ অঞ্চলের জনগণের মন বিষিয়ে তুলেছিল এবং এ অঞ্চলের মানুষ ক্রমশ ধাবিত হয়েছিল স্বাধীন দেশ গড়ার আন্দোলনে। ১৯৬০ সালে রবীন্দ্র সংগীত নিষিদ্ধের বিরুদ্ধে আন্দোলন, ’৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৬ সালে শেখ মুজিব কর্তৃক ছয় দফা ঘোষণা, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা ও ’৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান এবং সর্বশেষ ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয় এ অঞ্চলের মুক্তিকামী জনগণকে ধাপে ধাপে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। অন্যদিকে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী কিছুতেই এ নির্বাচনের ফলাফল মেনে নিতে পারেনি। এ কারণে নির্বাচনের পর গণপরিষদের অধিবেশন ডাকতে ও নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে তারা নানা টালবাহানা করতে থাকে। অবশেষে ৩ মার্চ গণপরিষদের অধিবেশন ডাকা হলেও পরে তা বাতিল করা হয়। পরবর্তীতে ক্ষমতা হস্তান্তরে ঢাকায় আলোচনার নামে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী অযথা কালক্ষেপণ করতে থাকে। সর্বশেষ ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য এ অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর ওপর ২৫ মার্চ রাতে তারা নির্বিচারে হামলা চালায় এবং স্বাধীন বাংলাদেশ-এর জন্ম তখন অনিবার্য হয়ে ওঠে।

০১ মার্চ, ১৯৭১

১৯৭১ সালের এই দিনে পাকিস্তানের তদানীন্তন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান দুপুর ১টা ০৫ মিনিটে এক বেতার ভাষণে ৩ মার্চের গণপরিষদ অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করেন।

প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান তার ভাষণে বলেন, “পাকিস্তান আজ চরম রাজনৈতিক সঙ্কটের সম্মুখীন। ... বিগত কয়েক সপ্তাহে অবশ্য আমাদের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মধ্যে কয়েকটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু আমাকে দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে যে, ঐকমত্যে পৌঁছবার পরিবর্তে আমাদের কোন কোন নেতা অ-নমনীয় মনোভাব প্রদর্শন করেছেন। পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দের মধ্যে রাজনৈতিক মোকাবেলা একটি দুঃখজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। সংক্ষেপে বলতে গেলে পরিস্থিতি এই দাঁড়িয়েছে যে, পশ্চিম পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল অর্থাৎ ‘পাকিস্তান পিপলস পার্টি’ এবং আরও কয়েকটি রাজনৈতিক দল ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগদান না করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে। এছাড়া ভারত কর্তৃক সৃষ্ট সাধারণ উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতি সার্বিক অবস্থাকে আরও জটিল করে তুলেছে। অতএব, আমি জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান পরবর্তী কোন তারিখের জন্য স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”

উল্লেখ্য, সত্তুরের নির্বাচনে পরাজিত জুলফিকার আলী ভুট্টো’র নেতৃত্বাধীন ‘পাকিস্তান পিপলস পার্টি’ (পিপিপি) এবং খান আবদুল কাইয়ুম-এর ‘পাকিস্তান মুসলিম লীগ’ ৩ মার্চের গণপরিষদের অধিবেশনের বিরোধীতা করে আসছিল। গণপরিষদের অধিবেশনের প্রতিবাদে ‘পাকিস্তান পিপলস পার্টি’ ২ মার্চ পশ্চিম পাকিস্তানে সাধারণ ধর্মঘট আহবান করেছিল। তবে পিপিপি ও মুসলিম লীগ ছাড়া পশ্চিম পাকিস্তানের অন্যান্য রাজনৈতিক দল গণপরিষদের অধিবেশনে যোগ দেওয়ার পক্ষে ছিল এবং গণপরিষদের অধিবেশনে যোগদানের লক্ষ্যে ইতোমধ্যেই পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ৩৫জন নির্বাচিত গণপরিষদ সদস্য ঢাকায় এসে পৌঁছেছিলেন। ইয়াহিয়া খান গণপরিষদ অধিবেশন বাতিল করায় ‘পাকিস্তান পিপলস পার্টি’ ১ মার্চ সন্ধ্যায় ধর্মঘট প্রত্যাহার করে এবং ‘পাকিস্তান মুসলিম লীগ’ প্রধান খান আবদুল কাইয়ুম ইয়াহিয়ার ঘোষণাকে ‘একমাত্র সঠিক সিদ্ধান্ত’ বলে আখ্যায়িত করেন। আবদুল কাইয়ুমের এ ধরনের বক্তব্যের প্রতিবাদে দলের মহাসচিব খান এ সবুর মুসলিম লীগের সদস্য ও সম্পাদক পদ থেকে পদত্যাগের ঘোষণা দেন।

ওইদিনই সংবাদপত্রে দেশের অখন্ডতার বিরুদ্ধে কোন খবর প্রকাশ করা যাবে না বলে পাকিস্তান সরকারের পক্ষ থেকে আদেশ জারি করা হয়।

এদিকে ইয়াহিয়া খান কর্তৃক গণপরিষদ অধিবেশন বাতিলের এ ঘোষণার খবর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে মূহুর্তের মধ্যে সারাদেশে গণ-বিক্ষোভ শুরু হয়ে যায়। ঢাকার পল্টন-গুলিস্তান এলাকায় উপস্থিত ছাত্র-জনতা বিক্ষোভ শুরু করে দেয়। এ সময় ঢাকা স্টেডিয়ামে (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম) পাকিস্তান ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ড এবং কমওয়েলথ একাদশের মধ্যে দ্বিতীয় ইনিংসের ক্রিকেট খেলা চলছিল। ইয়াহিয়ার ঘোষণার পরপরই খেলা ভন্ডুল হয়ে যায়। সকল দর্শক স্টেডিয়াম থেকে বেরিয়ে এসে বিক্ষোভে যোগ দেয়। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, অফিস-আদালত, কল-কারখানা, দোকানপাট, যানবাহন চলাচল সব বন্ধ হয়ে যায়। সারা ঢাকা শহর পরিণত হয় মিছিলের নগরীতে। বিক্ষুদ্ধ জনতা ঢাকার পুরাতন বিমান বন্দর সড়কে ব্যারিকেডও সৃষ্টি করে এদিন।

গণপরিষদের অধিবেশকে সামনে রেখে এদিন ঢাকার পূর্বাণী হোটেলে আওয়ামী লীগের নির্বাচিত সংসদীয় দলের বৈঠক হওয়ার কথা ছিল। সে মোতাবেক বৈঠকও চলছিল। বিকাল ৩টার বিপুল সংখ্যক বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা পূর্বাণী হোটেলের সামনে জড়ো হয়ে ‘জয় বাংলা’; ‘জাগো জাগো বাঙালি জাগো’; ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’; ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা-মেঘনা-যমুনা’ –এ জাতীয় শ্লোগান তুলে পুরো এলাকা মুখরিত করে তোলে।

পূর্বাণী হোটেলে আওয়ামী লীগের নির্বাচিত সংসদীয় দলের বৈঠক শেষে গণপরিষদের অধিবেশন স্থগিত করার প্রতিবাদে ২ মার্চ ঢাকায় ও ৩ মার্চ সারাদেশে সর্বাত্মক হরতাল পালন এবং ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) জনসভার কর্মসূচী ঘোষণা করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

এদিন পূর্বাণী হোটেলে সমবেত সাংবাদিকদের উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘একটি সংখ্যালঘু দলের একগুঁয়ে দাবির ফলে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন মুলতবি ঘোষিত হয়েছে এবং গণতান্ত্রিক পদ্ধতি ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। এটা আমাদের জন্য খুবই দুর্ভাগ্যজনক। জনগণের প্রতি যেহেতু আমাদের দায়িত্ব রয়েছে, তাই আমরা একে বিনা চ্যালেঞ্জে ছেড়ে দিতে পারি না।’

তিনি বলেন, ‘এর প্রতিবাদে কাল মঙ্গলবার রাজধানী ঢাকায় এবং পরশু সারাদেশে সাধারণ হরতাল পালিত হবে। বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে আমি শিগগিরই মওলানা ভাসানী, নূরুল আমিন, প্রফেসর মুজাফফর আহমদ এবং আতাউর রহমান খানের সাথে আলোচনা করব। আগামী ৭ই মার্চ রেসকোর্সে এক গণসমাবেশে বাংলার মানুষের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার অর্জনের কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা নিয়মতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে অসহযোগ আন্দোলন চালিয়ে যাব। তবে আমরা যে কোন পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য প্রস্তুত। জনগণ ও আমার দল আমাকে যে কোন কর্মসূচী ঘোষণার ক্ষমতা দিয়েছে। ... আপনারা যে কোন ত্যাগ স্বীকারের জন্য প্রস্তুত থাকুন।’

বিকেলে পল্টন ময়দানে এক স্বতঃস্ফুর্ত বিশাল জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। ছাত্রলীগের তদাণীন্তন সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকী, ডাকসু সহ-সভাপতি আ স ম আবদুর রব, সিরাজুল আলম খান, তোফায়েল আহমেদ, আবদুল মান্নান প্রমুখ ওই জনসভায় বক্তব্য রাখেন।

ওইদিন-ই বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ছাত্রলীগ সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকী, সাধারণ সম্পাদকশাহজাহান সিরাজ,ডাকসু সহ-সভাপতি আ স ম আবদুর রব ওসাধারণ সম্পাদক আবদুল কুদ্দুস মাখনের নেতৃত্বে ‘স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করা হয়।

এদিন সন্ধ্যায় ঢাকার দৈনিকগুলো বিশেষ ‘বুলেটিন’ বের করে।

গ্রন্থনা : সোহেল রহমান

(দ্য রিপোর্ট/এসআর/এনআই/মার্চ ০১, ২০১৬)

পাঠকের মতামত:

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

M

M

SMS Alert

এর সর্বশেষ খবর

- এর সব খবর