thereport24.com
ঢাকা, সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১,  ২১ জমাদিউস সানি 1446

যশোরের সাঞ্চাডাঙ্গা গ্রাম

সৌরবিদ্যুতে চলছে সেচযন্ত্র

২০১৪ ফেব্রুয়ারি ০৫ ২০:৫৬:০২
সৌরবিদ্যুতে চলছে সেচযন্ত্র

আহসান কবীর, যশোর : যশোরের গ্রামে সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহার করে জমিতে সেচ দেওয়া যাচ্ছে অনায়াসে। এ বিদ্যুতে চলছে দশ হর্সপাওয়ার শক্তিসম্পন্ন বড় আকারের পাম্পও। এই পাম্পে সারাবছর নিরবচ্ছিন্নভাবে সেচ সুবিধা দেওয়া যায় ৫০ থেকে ১০০ বিঘা জমিতে।

এতদিন ধারণা ছিল, সৌরবিদ্যুতের মাধ্যমে প্রত্যন্ত অঞ্চলের বাড়িতে একটি-দুটি বাতি জ্বালানো বা পাখা চালানো সম্ভব। কিন্তু পরিস্থিতি যে বদলে গেছে তার প্রমাণ যশোরের চৌগাছা উপজেলার সাঞ্চাডাঙ্গা গ্রাম। এ গ্রামে আর্স বাংলাদেশ নামে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের নেওয়া প্রকল্পে সৌরবিদ্যুতের মাধ্যমে সেচযন্ত্র চালানো হচ্ছে।

জানা গেছে, যশোরে এ ধরনের উদ্যোগ এটিই প্রথম। এর আগে ২০০৯ সালে ঢাকার অদূরে একটি গ্রামে পরীক্ষামূলকভাবে (পাইলট) এই প্রকল্প চালু হয়। পাইলট প্রকল্প সফল হওয়ায় পর্যায়ক্রমে তা দেশব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। চৌগাছার সাঞ্চাডাঙ্গায় সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প চালু হওয়ায় চলতি মৌসুমে ওই গ্রামের কয়েক হাজার চাষী তাদের ডিজেলচালিত শ্যালো মেশিন বন্ধ করে দিয়েছেন। নিজেদের ফসলের মাঠ এনেছেন সৌরবিদ্যুতের আওতায়।

আর্স বাংলাদেশ প্রাথমিকভাবে সাঞ্চাডাঙ্গা গ্রামে সাতটি সোলার প্যানেল স্থাপন করেছে। প্রতিটি প্যানেল স্থাপনে গড়ে খরচ হয়েছে প্রায় ২৯ লাখ টাকা। সরকারি সংস্থা ইনফ্রাস্ট্রাচার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি লি. (ইডকল) এই প্রকল্পে অর্থ সহায়তা দিচ্ছে। আর কারিগরি সহায়তা দিচ্ছে ইলেকট্রো সোলার পাওয়ার লি. ও রহিম আফরোজ রিনিউএবল অ্যানার্জি লি.।

আর্স বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক মো. শামছুল আলম জানান, সৌরবিদ্যুতের সুবিধা পাওয়ায় গ্রামের কৃষকদের বিঘাপ্রতি সেচ খরচ বছরে দেড় হাজার থেকে দুই হাজার টাকা কমবে। সঞ্চালন লাইনের মাধ্যমে সরবরাহ করা বিদ্যুৎ এবং বৈদেশিক মুদ্রা দিয়ে বিদেশ থেকে আমদানি করা ডিজেলের ওপর নির্ভরশীলতাও হ্রাস পাবে। পরিবেশবান্ধব ও আর্থিকভাবে সাশ্রয়ী হওয়ায় কৃষকরা সৌরবিদ্যুতের সুবিধা নিতে দ্রুত এগিয়ে এসেছে।

ইলেকট্রো সোলার পাওয়ার লিমিটেডের প্রকৌশলী মুশফিকুর রহমান জানান, এই প্রকল্পে সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে। মাটির গভীরে স্থাপন করা হয়েছে পাম্পগুলো। কিন্তু ভূস্তরের ওপর থেকে ম্যানুয়ালি অথবা স্বয়ংক্রিয়ভাবে তা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। প্রতিটি পাম্পের বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা দিনে ১৩ দশমিক ২৬ কিলোওয়াট। পানি উত্তোলন ক্ষমতা দিনে গড়ে সাড়ে সাত লাখ লিটার, যা দিয়ে ৫০ থেকে ১০০ বিঘা জমিতে সেচসুবিধা দেওয়া সম্ভব। আপৎকালীন সময়ে (মেঘলা আবহাওয়া বা অন্য কোনো কারণে) যাতে কৃষকের জমির ফসল পানির অভাবে শুকিয়ে না যায়, তার জন্য সোলার প্যানেলগুলোতে প্যারালালভাবে স্থাপন করা হয়েছে ডিজেলচালিত শ্যালোও। এক প্রশ্নের জবাবে প্রকৌশলী মুশফিকুর জানান, ভূগর্ভ ছাড়াও ইচ্ছা করলে এই পাম্পের মাধ্যমে ভূউপরিস্থ পানিও ফসলের ক্ষেতে সরবরাহ করা যাবে, যা হবে আরও পরিবেশ অনুকূল।উদ্যোক্তারা বলছেন, সাঞ্চাডাঙ্গার মাঠে বছরে দুটি করে ফসল উৎপন্ন হয়। এখন মাঠটি সৌরবিদ্যুতের আওতায় আসায় চাষীরা ইচ্ছা করলে বছরে তিনটি ফসলও উৎপন্ন করতে পারবেন। ফলে উৎপাদন বেড়ে যাবে অনেক।

কথা হয় সাঞ্চাডাঙ্গা গ্রামের ক্ষুদ্র কৃষক জোনাব আলীর সঙ্গে। তিনি জানান, ডিজেলচালিত শ্যালোমেশিন দিয়ে তিনি এ যাবৎ চাষাবাদ করে এসেছেন। শ্যালোমেশিন মালিকের কাছ থেকে সেচ সুবিধা নিতে তাকে বছরে সাড়ে পাঁচ হাজার থেকে সাড়ে ছয় হাজার টাকা করে দিতে হয়। এবার তার জমি সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পের আওতায় আসায় খরচ কমবে বিঘাপ্রতি কমপক্ষে এক হাজার টাকা।

একই গ্রামের চাষী কওসার আলী বলেন, ‘শুনিছি সৌরবিদ্যুতে খরচ অনেক কম। কিন্তু আমাদের কাছ থেকে বিঘাপ্রতি চার হাজার টাকা করে নিয়া হবে। খরচ আরেকটু কমলি ভালো হতো।

এ প্রসঙ্গে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে আর্স বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক শামছুল আলম বলেন, বিঘাপ্রতি চার হাজার টাকা করে নেওয়ার বিষয়টি এখনও আলোচনার পর্যায়ে রয়েছে। উদ্যোক্তা ও কৃষকদের সমঝোতার ভিত্তিতে টাকার অঙ্ক চূড়ান্ত হবে। সেক্ষেত্রে খরচ আরও কমতে পারে।

সৌরবিদ্যুতের মাধ্যমে সেচ কার্যক্রম পরিদর্শন করতে মঙ্গলবার যশোরের জেলা প্রশাসক মো. মোস্তাফিজুর রহমান চৌগাছার সাঞ্চাডাঙ্গা গ্রামে গিয়েছিলেন। তিনি বলেন, পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপের (পিপিপি) মাধ্যমে এই প্রকল্পটি স্থাপন করা হয়েছে। প্রকল্পটি চালু হওয়ায় সাঞ্চাডাঙ্গার চাষীদের ফসল উৎপাদন খরচ কমে আসবে। ফলে তারা লাভবান হবে। তিনি বলেন, যশোর, ঝিনাইদহ ও চুয়াডাঙ্গা জেলায় আগামী তিন বছরের মধ্যে সৌরবিদ্যুৎ চালিত এ ধরনের ৫০টি পাম্প স্থাপন করা হবে। যত দ্রুত এ ধরনের প্রকল্প ছড়িয়ে দেওয়া যাবে, আর্থিক ও পরিবেশগতভাবে তত বেশি আমরা লাভবান হবো।

উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সঠিক সময়ে চাষীদের যাতে পানি পেতে সমস্যা না হয় এবং অন্যান্য জটিলতা দূর করতে প্রথম থেকেই তৎপর তারা। প্রতিটি পাম্পের আওতাধীন কৃষকদের নিয়ে পাঁচ সদস্যের পানি ব্যবস্থাপনা ও সেচমূল্য আদায় তদারকি কমিটি গঠন করা হয়েছে। সঠিক নিয়মে সেচের পানি ব্যবহার করে অধিক ফসল উৎপাদনের লক্ষ্যে নির্দিষ্ট সময় অন্তর সুবিধাভোগীদের সঙ্গে বৈঠক করা হবে।

সৌরবিদ্যুতের মাধ্যমে সেচ সুবিধা পাওয়ায় সাঞ্চাডাঙ্গার অধিকাংশ কৃষক খুশি হলেও কারো কারো কিছু সমালোচনাও আছে। সাঞ্চাডাঙ্গার মাঠে কৃষকদের মালিকানাধীন ডিজেলচালিত কয়েকশত শ্যালোমেশিন রয়েছে। এসব মেশিন এখন কৃষকরা কী করবেন তা নিয়ে অনেকেই চিন্তিত। এ ছাড়া পাশের মাঠে পল্লী বিদ্যুতের সঞ্চালন লাইনের মাধ্যমে যে কৃষকরা সেচসুবিধা নিচ্ছেন, তাদের চেয়ে সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পের আওতাধীন কৃষকদের বেশি টাকা গুনতে হবে। এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে আর্স বাংলাদেশের কর্মকর্তারা বলেন, সেচ মৌসুমে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির আওতাধীন কৃষকরা দিনের খুবই অল্পসময় বিদ্যুৎ সুবিধা পায়। ফলে অনেক কৃষকের ধানই পানির অভাবে নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু সৌরবিদ্যুৎচালিত এই প্লান্ট সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত একটানা চালু থাকবে। ফলে পানির অভাবে কৃষকের ফসল নষ্ট হবে না কখনও।

পাশের কমলাপুর, খড়িঞ্চা প্রভৃতি গ্রামের কৃষকরা দলে দলে যাচ্ছেন সাঞ্চাডাঙ্গার সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প দেখতে। তাদের আশা, আশপাশের গ্রামগুলোও দ্রুত এ ধরনের প্রকল্পের আওতায় আনা হবে।

(দ্য রিপোর্ট/ একে/ এইচএসএম/ এনআই/ফেব্রুয়ারি ০৫, ২০১৪)

পাঠকের মতামত:

SMS Alert

বিশেষ সংবাদ এর সর্বশেষ খবর

বিশেষ সংবাদ - এর সব খবর