thereport24.com
ঢাকা, শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১,  ২১ জমাদিউল আউয়াল 1446

জনপ্রশাসন

চুক্তিতে বহাল আস্থাভাজনরা, বঞ্চিতদের চাপা কষ্ট

২০১৪ ফেব্রুয়ারি ১০ ১৮:৪৬:২৩
চুক্তিতে বহাল আস্থাভাজনরা, বঞ্চিতদের চাপা কষ্ট

চাকরির মেয়াদ শেষ হলেও প্রশাসনে সরকারের আস্থাভাজন কর্মকর্তারা চুক্তির মাধ্যমে বহাল থাকছেন। যদিও খালি না থাকায় প্রশাসনের অনেক কর্মকর্তাকে নিচের পদে কাজ করতে হচ্ছে। গত এক মাসে শীর্ষ পর্যায়ের ৪ কর্মকর্তাকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এ বছর প্রশাসনে সচিব ও সচিব পদমর্যাদার আরও ১৪ কর্মকর্তা অবসরে যাবেন। তাদের অনেকেই চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের মাধ্যমে বহাল থাকতে পারেন বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। অপরদিকে নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়। নতুন সরকারের এ প্রথম পদোন্নতির কারণে বিপুলসংখ্যক যোগ্য কর্মকর্তার বঞ্চিত হওয়ার অভিযোগ ওঠেছে। তারা বঞ্চনার চাপা কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন।

টিআইবি’র (ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ) ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এম হাফিজ উদ্দিন খান দ্য রিপোর্টকে এ বিষয়ে বলেন, বিশেষ অবস্থা ছাড়া প্রশাসনে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ সার্বিকভাবে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। তিনি আরও বলেন, যে কাজের জন্য বিশেষ জ্ঞান, দক্ষতার প্রয়োজন হয় সে ক্ষেত্রে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। এখন যাকে পছন্দ তাকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। রাষ্ট্রের স্বার্থে অপরিহার্য এমন কাউকে চুক্তিভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে না।

দলীয় আনুগত্য ও মুখ দেখে পদোন্নতি দেওয়া হচ্ছে মন্তব্য করে হাফিজ উদ্দিন খান বলেন, এ কারণে প্রশাসনের সর্বনাশ হয়ে গেছে।

জানতে চাইলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব আবদুস সোবহান সিকদার দ্য রিপোর্টকে বলেন, প্রশাসনে চুক্তিতে নিয়োগের বিষয়টি নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। কেউ যদি কোনো কারিগরি সার্ভিস দেন এবং তার কোনো বিকল্প না থাকে তবে সে ক্ষেত্রে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ হতে পারে। ভবিষ্যতে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়ার বিষয়ে আগ্রহ দেখানো হবে না।

সিনিয়র সচিব আরও বলেন, প্রত্যেক পদোন্নতির পরই বঞ্চিত হওয়ার দাবি ওঠে। বঞ্চিতদের আবেদনও করতে বলা হয়। আবার যখন পদোন্নতি হয় তখন বাদ যাওয়া কর্মকর্তাদের বিষয়গুলো বিবেচনায় আনা হয়।

জনপ্রশাসনের এক কর্মকর্তা জানান, বিগত সময়ে পদোন্নতির কারণে এখন প্রশাসনে নির্ধারিত পদের চেয়ে কর্মকর্তার সংখ্যা অনেক বেশি। পর্যাপ্ত পদ না থাকায় পদোন্নতির পর অধিকাংশ কর্মকর্তাকেই আগের জায়গায় কাজ করতে হচ্ছে। ফলে একেক মন্ত্রণালয়ে প্রয়োজনের চেয়েও বেশি উপ-সচিব, যুগ্ম-সচিব ও অতিরিক্ত সচিব রয়ে গেছেন। এতে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে প্রশাসনে। অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থা হিসেবে পদগুলোর পুনর্বিন্যাস করা হয়। আগে উপ-সচিবরা যে পদে দায়িত্ব পালন করতেন, সেটাকে এখন উপ-সচিব বা যুগ্ম-সচিব বলা হচ্ছে। আর যুগ্ম-সচিব পদের বেলায় করা হয়েছে যুগ্ম-সচিব বা অতিরিক্ত সচিব। চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের মাধ্যমে প্রশাসনের এ বিশৃঙ্খলাকে আরও বাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে বলে মনে করছেন এই কর্মকর্তা।

একজন প্রশাসন বিশেষজ্ঞ বলেন, বিশেষায়িত ও কারিগরি পদের ক্ষেত্রে যেখানে দক্ষ লোকের সংখ্যা খুবই কম, সেখানে শুধু চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে।

কিন্তু দেখা গেছে, যাদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে তারা কেউই ওই সব পদে অপরিহার্য নয়।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান মো. গোলাম হোসেনের ৮ জানুয়ারি অবসরোত্তর ছুটিতে (পিআরএল) যাওয়ার কথা। কিন্তু ৭ জানুয়ারি তাকে আরও এক বছরের জন্য একই পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়। তিনি এর আগে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিবের দায়িত্ব পালন করেছেন।

অপরদিকে ৩০ ডিসেম্বর থেকে অবসরে যাওয়া কৃষি সচিব এস এম নাজমুল ইসলামকেও ৭ জানুয়ারি এক বছরের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়। এ কর্মকর্তা গত ১৮ নভেম্বর সচিব পদে পদোন্নতি পান। গত বছরের ২৯ এপ্রিল থেকে তিনি এই মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিবের দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। এর আগে তিনি বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনের (বিএডিসি) চেয়ারম্যান (অতিরিক্ত সচিব) ছিলেন।

গত ১৬ জানুয়ারি প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদায় প্রাইভেটাইজেশন কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে চুক্তিভিত্তিতে নিয়োগ পেয়েছেন মোল্লা ওয়াহেদুজ্জামান। এর আগে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়েও ওয়াহেদুজ্জামান চুক্তিভিত্তিতে সিনিয়র সচিব পদে কাজ করেছেন। সেখানে তার চুক্তির মেয়াদ শেষ হয় ১১ জানুয়ারি।

সংসদ সচিবালয়ের সিনিয়র সচিব আশরাফুল মকবুলের চাকরির মেয়াদ শেষ হয় গত ৩১ ডিসেম্বর। দুই বছরের চুক্তিতে তাকে একই পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। গত বছরের ২২ সেপ্টেম্বর বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় থেকে আশরাফুল মকবুলকে সংসদ সচিবালয়ে বদলি করা হয়।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, চলতি বছরের মধ্যে আরও ১৪ জন সচিব ও সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তার অবসরে যাওয়ার কথা। এর মধ্যে আগামী ১২ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব শেখ মো. ওয়াহিদুজ্জামান, ২৪ ফেব্রুয়ারি লোকপ্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের রেক্টর (সচিব পদমর্যাদার) এজেডএম শফিকুল আলম, ৪ মার্চ ভূমি সচিব মোখলেছুর রহমান, ওএসডি সচিব নুরুল হক ৮ মার্চ, অর্থ সচিব ফজলে কবির ৩ জুলাই, স্বরাষ্ট্র সচিব সি কিউ কে মুসতাক আহমেদ ৮ জুলাই, পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য উজ্জ্বল বিকাশ দত্ত ৯ আগস্ট, বেসরকারিকরণ কমিশনের সদস্য রোকেয়া সুলতানা ২ জুলাই, পরিবেশ ও বন সচিব শফিকুর রহমান পাটোয়ারী ৩১ আগস্ট, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব আবুল কালাম আজাদ ১২ সেপ্টেম্বর, নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সচিব মোহাম্মদ সাদিক ১৮ সেপ্টেম্বর, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সচিব কে এইচ মাসুদ সিদ্দিকী ৩০ অক্টোবর, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের বিকল্প নির্বাহী পরিচালক ইকবাল মাহমুদ ২৯ নভেম্বর ও স্বাস্থ্য সচিব নিয়াজউদ্দিন মিয়া ৩০ ডিসেম্বর অবসরে যাচ্ছেন।

১৯৭৪ সালের গণকর্মচারী অবসর আইনের অধীনে জারি করা এসআরও অনুযায়ী সচিব, অতিরিক্ত সচিব, যুগ্ম-সচিব ও উপ-সচিবদের প্রতিটি পর্যায়ের মূল পদের ১০ শতাংশ চুক্তিতে বা প্রেষণে কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া যায়।

গত বিএনপি সরকারের সময় এ নিয়ম খানিকটা সংশোধন করা হয়। তখন এ সংক্রান্ত গেজেটে বলা হয়, এ সব পদে একজন কর্মকর্তাকে ১০ শতাংশের কোটা উপেক্ষা করে সর্বোচ্চ তিনবার নিয়োগ দেওয়া যাবে।

বুকে চাপা কষ্ট বয়ে বেড়াচ্ছেন তারা

নতুন সরকার গঠনের একদিন পর গত ১৩ জানুয়ারি অতিরিক্ত সচিব পদে ৮০ যুগ্ম-সচিবের পদোন্নতি দেওয়া হয়। এ পদোন্নতির কারণে ১৯৮৪ ব্যাচের প্রায় ৭০ শতাংশ দক্ষ ও মেধাবী এবং গ্রেডেশন তালিকায় জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা পদোন্নতি বঞ্চনার শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ ওঠেছে। পর্যালোচনায় দেখা যায়- মেধা তালিকার উপরের দিকের বেশির ভাগ কর্মকর্তা বাদ পড়েছেন অথচ মেধা তালিকায় ২০০, ৩০০ এমনকি ৪০০ ক্রমিকের কর্মকর্তাও অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতি পেয়েছেন। এ ছাড়া এদের মধ্যে অনেক কর্মকর্তা ২০১২ সালের ৮ জানুয়ারির পদোন্নতিতে বাদ পড়েছিলেন। এবার তারা দ্বিতীয়বারের মত পদোন্নতি বঞ্চিত হলেন। বুকে চাপা কষ্ট নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন তারা।

সচিবালয়ে ৪ নম্বর ভবনের বঞ্চিত একজন যুগ্ম-সচিবের সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, ‘এ সব বলে আর কী হবে? এখন আল্লাহর কাছে বলি। কপালে থাকলে একদিন পদোন্নতি পাব।’

আরেক যুগ্ম-সচিব বলেন, ‘আমরা কীভাবে কাজের উৎসাহ পাব বলেন! অন্যান্য দেশের তুলনায় আমাদের বেতন ও সুযোগ-সুবিধা তো বেশি নয়। পদোন্নতি প্রাপ্য হলেও পাব না, এটা কীভাবে মেনে নেব। আবার অনেকে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়াও ব্যক্ত করেন। ৬ নম্বর ভবনের একজন যুগ্ম-সচিব বলেন, এভাবে পদোন্নতির মাধ্যমে দলবাজিকে উৎসাহিত করা হচ্ছে। বঞ্চিত যুগ্ম-সচিবদের পদোন্নতির বিষয়টি পুনর্বিবেচনার জন্য এসএসবির (সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ড) সভা আহ্বানের অনুরোধ জানান তিনি।

(দ্য রিপোর্ট/আরএমএম/এইচএসএম/শাহ/সা/ফেব্রুয়ারি ১০, ২০১৪)

পাঠকের মতামত:

SMS Alert

বিশেষ সংবাদ এর সর্বশেষ খবর

বিশেষ সংবাদ - এর সব খবর