thereport24.com
ঢাকা, সোমবার, ২৯ এপ্রিল 24, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১,  ২০ শাওয়াল 1445

নিশ্চিদ্র নিরাপত্তায় আশুরার তাজিয়া মিছিল

২০১৬ অক্টোবর ১২ ১০:৩৭:২৩
নিশ্চিদ্র নিরাপত্তায় আশুরার তাজিয়া মিছিল

মো. শামীম রিজভী, দ্য রিপোর্ট : আজ ১২ অক্টোবর বুধবার মহররম মাসের ১০ তারিখ, অর্থাৎ পবিত্র আশুরা। আশুরায় কারবালার শোকাবহ ঘটনাকে স্মরণ করে শিয়া সম্প্রদায় তাজিয়া মিছিল বের করেছে। নিশ্চিদ্র নিরাপত্তায় সকাল ১০টার দিকে পুরান ঢাকার হোসনী দালান থেকে শুরু হয় মিছিলটি।

পুরো পথেই মিছিল ঘিরে রয়েছে পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবিসহ বিপুল সংখ্যক আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। দালানগুলোর উপর থেকেও পুলিশি নজরদারি রয়েছে। যার গতিবিধি সন্দেহজনক মনে হচ্ছে তাকেই তল্লাশি করা হচ্ছে।

এদিকে শোকের মাতম উঠেছে পুরানা ঢাকার তাজিয়া মিছিলে। সকাল ১০টার দিকে হোসনী দালান থেকে তাজিয়া মিছিল শুরু হয়ে বকশিবাজার-উর্দুরোড-লালবাগ চৌরাস্তা-ঘোড়া শহীদের মাজার-আজিমপুর-নিউমার্কেট-সায়েন্সল্যাব হয়ে ধানমণ্ডির অস্থায়ী কারবালায় (ধানমণ্ডি লেক) গিয়ে শেষ হবে। এরই মধ্যে তাজিয়া মিছিলে অংশগ্রহণের জন্য লক্ষাধিক নারী-পুরুষ জমায়েত হয়েছেন। কালো-লাল-সবুজের নিশান উড়িয়ে, কারবালার শোকের মাতম ওঠেছে লাখো মানুষের মিছিলে। বুক চাপড়ে ‘হায় হোসেন, হায় হোসেন’ মাতম ধ্বনি তুলে নগ্ন পায়ে মিছিলে অংশ নিয়েছেন তারা। মিছিলে রয়েছে ‘বৈল দল (ঘণ্টা পড়া তরুণ)’। কেউ বা এগুচ্ছে নওহা (শোকগীতি) পড়তে পড়তে।হোসনী দালান ও গোয়েন্দা সূত্রে জানা যায়, এবার দালানের ভেতর স্টল নিয়ে কাউকে দোকান করতে দেওয়া হয়নি। দালানের ভেতর-বাহির, মিছিলের সময় অন্য কাউকে ছবি তুলতে অথবা ভিডিও করতে দেওয়া হচ্ছে না। মিছিলটি যে পথে যাবে সেই পথেই আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পর্যাপ্ত সদস্য মোতায়েন রয়েছে। পুরো রাস্তাটি সিসিটিভি ক্যামেরার আওতায় রাখা হয়েছে। এ সব রাস্তায় পুলিশের রুফটপ ও ফুট পেট্রোল রয়েছে, অর্থাৎ মিছিলের দু’পাশে র‌্যাব-পুলিশ সদস্যরা হেঁটে হেঁটে যাবেন। হোসনী দালান থেকে যখন মিছিল শুরু হয় তখন মাঝ রাস্তা থেকে কাউকে মিছিলে প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না। যে সব এলাকা দিয়ে তাজিয়া মিছিল যাবে ওই সব এলাকায় কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। প্রত্যেক গলির মুখেও নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। তাজিয়া মিছিলে ছুরি, কাচি, পোটলা ব্যাগ বহন করতে দেওয়া হয়নি এবং ১২ ফুটের বেশি উচ্চতার নিশানা ব্যবহার করতে দেওয়া হয়নি। নিরাপত্তা ব্যবস্থার পাশাপাশি ফায়ার সার্ভিসের টিম রয়েছে। আতশবাজি, পটকা ফোটানোও নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) জ্যেষ্ঠ সহকারী কমিশনার (চকবাজার জোন) কানিজ ফাতেমা পাপড়ি বলেন, মিছিলের সার্বিক নিরাপত্তায় প্রায় তিন শতাধিক পুলিশ রয়েছে। তা ছাড়া র‌্যাব ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরাও কাজ করছে। মিছিলের আশপাশের ভবনগুলোর ছাদেও রয়েছে পুলিশের অবস্থান।

ন্যায় প্রতিষ্ঠায় হিজরি ৬০ সালের ১০ মহররম হযরত মুহাম্মদ (স.) এর দৌহিত্র ইমাম হোসেন (রা.) ইসলামের তৎকালীন শাসনকর্তা ইয়াজিদের সৈন্য বাহিনীর হাতে কারবালার প্রান্তরে শহীদ হয়েছিলেন। মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে শিয়ারা তাজিয়া মিছিলসহ নানা আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে সে বিয়োগান্তক ঘটনাকে সম্বরণ করে। ঢাকায় হোসেনী দালান ঘিরে শিয়াদের তাজিয়া মিছিলের ঐতিহ্য কয়েকশ’ বছরের। তবে শিয়াদের আয়োজনে এ তাজিয়া মিছিলে অনেক সুন্নী মুসল্লিরাও অংশ নেন।ঢাকায় আশুরার দিনে তাজিয়া মিছিল শুরুর সঠিক ইতিহাস না পাওয়া গেলেও মনে করা হয় ১৬৪২ সালে সুলতান সুজার শাসনামলে মীর মুরাদ হুসেনী দালান প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এ শোক উৎসবের সূচনা করেন। আশুরা উপলক্ষে পুরানা পল্টন, মগবাজার, মোহাম্মদপুর ও মিরপুরে শিয়ারা তাজিয়া মিছিল বের করে। পুরান ঢাকার ফরাশগঞ্জের বিবিকা রওজা (১৬০০ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত সবচেয়ে পুরান ইমামবাড়া) থেকে বের হবে বোলতা গাওয়ার বোলতা গাওয়ারা (ছোটাছুটি বা দৌড়ে মিছিল) মিছিল। একই স্থান থেকে ‘বিবিকা ডোলা’ নামে যে মিছিলটি বের হবে; সেটি বাংলাবাজার, চকবাজার, আজিমপুর, নিউমার্কেট হয়ে ধানমণ্ডি লেকে গিয়ে শেষ হবে।

ইমামবাড়া মিছিল কমিটির আহ্বায়ক মীর জিল্লুর আলি বলেন, সার্বিক নিরাপত্তা ব্যবস্থায় আমরা সন্তুষ্ট। চকবাজার, বংশালসহ আশপাশের এলাকায় ৩৫ হাজারের অধিক শিয়ার বসবাস। বুধবার সকাল ১০টায় ইমামবাড়া থেকে শুরু হচ্ছে তাজিয়া মিছিল।তাজিয়া মিছিলে দেখা যায়, মিছিলের সামনে কালো কাপড়ের ইমাম হোসেন (র.) এর তাজিয়া (প্রতীকি কবর)। মিছিলের শেষের দিকে সুদৃশ্য বড় আরেকটি তাজিয়া। নারী-পুরুষ শিশুদের হাতে অসংখ্য কালো, লাল ও সবুজ নিশান। অনেকে ছড়া (আরবি লেখা ছোট পতাকা) হাতে নিয়ে যাচ্ছেন। তরুণদের (ভেস্তা) হাতে হাতে বিচিত্র আলাম (দীর্ঘ লাঠির মাথায় আরবি লেখা বড় পতাকা)। যারা ছড়া ও আলাম বহন করছেন তাদের ‘ভেস্তা’ বলা হয়। একটি ঘোড়াকে ইমাম হোসেনকে বহনকারী ঘোড়া দুলদুলের প্রতীক হিসেবে সাজানো হয়েছে। মিছিলে যাত্রার আগেই দুধ দিয়ে পা ধোয়ানো হয়েছে ঘোড়ার, খাবার হিসাবে দেওয়া হয়েছে ছোলা, পরানো হয়েছে সুদৃশ্য জিন (বসার আসন) ও মাথার খাপ। পথে পথেই চলে দুধ দিয়ে ঘোড়ার পা ধোয়ানো। শিয়া ধর্মাবলম্বীরা ঘোড়ার পা ধোয়ানো দুধ পবিত্র হিসেবে আরোগ্য কামনায় শরীরে মাখে ও ব্যবহার করে।তাজিয়া মিছিলে মাতমকারী তুষার খান দ্য রিপোর্টকে বলেন, তাজিয়া মিছিল শেষে দোয়া পড়ে নেয়াজ দেওয়া হয়। এরপর আলামের বাঁশগুলো পানিতে রেখে আলামগুলো নিয়ে আসা হয়। মিছিল শেষের মধ্যদিয়ে আমাদের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হবে।

প্রধান মিছিলের পর হয় ফাঁকা শিকানী। সকাল থেকে অনাহারী থাকার পর এর মাধ্যমে শিয়া সম্প্রদায়ের মানুষ খাওয়া-দাওয়া করেছেন। কারবালা প্রান্তরের নারী ও শিশুদের অসহায় অবস্থার স্মৃতিতে সন্ধ্যার পর হোসেনী দালানে হবে শামে গরিবা (অসহায়দের সন্ধ্যা)। শামে গরিবার সময় দালানের সব সাজসজ্জা সরিয়ে ফেলা হয়। নিভিয়ে দেওয়া হয় আলো, মেঝেতে থাকবে না কোন বিছানা বা ফরাশ। এ অবস্থায় চলে বয়ান ও মাতম।

নিরাপত্তার ব্যাপারে দ্য রিপোর্টের সঙ্গে কথা হয় হোসনী দালান ইমামবাড়ার অধীক্ষক (superintendent) এম এম ফিরোজ হোসেনের সঙ্গে। তিনি জানান, হোসনী দালানসহ বিভিন্ন হামলার ঘটনার পর থেকে সরকার যে সকল পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে তা খুবই প্রশংসনীয়। মহররম উপলক্ষেও সরকার যথেষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। আমরা তাদের সহযোগিতা করছি। সব সিদ্ধান্তই নিরাপত্তার স্বার্থে নেওয়া হয়েছে এবং আমরা তাদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছি। আমরা আশা রাখি আর কোন অনাকাক্ষিত ঘটনার সম্মুখিন আমরা হবো না।তিনি আরও বলেন, আমাদের ইন্টারনাল ভলেন্টিয়ার ২০০ জনের মত কাজ করছে এবং মিছিলের সময় ৪০০ ভলেন্টিয়ার দায়িত্ব পালন করছে। জিঞ্জির, দা, ছুরি, ব্লেড ইত্যাদি ধারালো জিনিস দিয়ে যাদের নাশকতা করার ইচ্ছা তারা আড়ালে গিয়ে এ ফায়দা লুটে নেবে। তাই সাময়িকভাবে এ ব্যাপারগুলো নিরাপত্তার জন্য বন্ধ রাখা হয়েছে। মেটাল জাতীয় সবই নিষিদ্ধ করা হয়েছে। মিছিলে লক্ষাধিক লোকের সমাগম হয়েছে।

মিছিল যে সব এলাকা দিয়ে প্রদক্ষিণ করবে সে সব রাস্তা দিয়ে পর্যাপ্ত লাইট ও সিসিটিভি ক্যামেরার ব্যবস্থাও করা হয়েছে।

বিক্ষিপ্ত যে ব্যাপারগুলো ছিল সেগুলো একটি নিয়মনীতির মধ্যে চলে এসেছে। আমাদের সচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমরাও নতুন পদক্ষেপগুলো স্বাগতম জানাচ্ছি বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

সবশেষে তিনি দ্য রিপোর্টকে বলেন, জনগণকে আহ্বান জানাবো যারাই এ অনুষ্ঠান ও মিছিলে অংশগ্রহণ করবেন, তারা যেন আমাদের ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সহযোগিতা করেন। নিরাপত্তা সকলের প্রয়োজন। আমরা চাইবো না কোন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটুক। সকলেই আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নির্দেশনা অনুসরণ করবেন।

(দ্য রিপোর্ট/এমএসআর/এমকে/অক্টোবর ১২, ২০১৬)

পাঠকের মতামত:

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

M

M

SMS Alert

এর সর্বশেষ খবর

- এর সব খবর