thereport24.com
ঢাকা, শনিবার, ২৭ এপ্রিল 24, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১,  ১৮ শাওয়াল 1445

গুন্ডে : মুক্তিযুদ্ধের অবমাননা ও বিতর্কের ডালপালা

২০১৪ ফেব্রুয়ারি ২২ ১৫:২৭:৫৫
গুন্ডে : মুক্তিযুদ্ধের অবমাননা ও বিতর্কের ডালপালা

আদিত্য রুপু, দ্য রিপোর্ট : বলিউডের প্রথমসারির প্রযোজনা সংস্থা যশরাজ ফিল্মস তাদের ‘গুন্ডে’ ছবিটি মুক্তি দিয়েছে ১৪ ফেব্রুয়ারি। একই দিন কলকাতায়ও বাংলা ভাষায় ছবিটি মুক্তি পায়। এর পর পরই অভিযোগ ওঠে ছবিটিতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে অবমাননা ও ইতিহাস বিকৃতির চেষ্টা করা হয়েছে। শুরু হয় ফেসবুকসহ নানা সামাজিক সাইটগুলোতে বাঙালি দর্শকদের প্রতিবাদ-প্রতিক্রিয়া। অমর একুশে ও ভাষার মাস ফেব্রুয়ারিতে গুন্ডের মুক্তি ও মুক্তিযুদ্ধকে অবমাননার চেষ্টায় তরুণ-তরুণীরা হয়ে ওঠেন আরও বেশি ক্ষিপ্ত। পরিচালক আলী আব্বাস জাফর পরিচালিত গুন্ডে নিয়ে চলমান ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সম্প্রতি যশরাজ ফিল্মস ক্ষমা চেয়েছে তাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজে। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও বইছে সমালোচনা। চলচ্চিত্র হিসেবে গুন্ডের মান নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন কেউ কেউ। ৮ দিনে কতই বা আয় করল ছবিটি।

ঘটনার সূত্রপাত, ছবির চিত্রনাট্য

গুন্ডের কাহিনীতে শুরুর দিকে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন ভিডিও চিত্র দেখানো হয়। ভিডিওর পাশাপাশি হিন্দি ভাষায় বলা হয়- ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ হিন্দুস্তান ও পাকিস্তানের মধ্যে তৃতীয় যুদ্ধ শেষ হয়। ৯০ হাজার পাকিস্তানি সেনা হিন্দুস্তানের সেনাদের সামনে আত্মসমর্পণ করেন। জন্ম হয় এক নতুন দেশ, বাংলাদেশ।

হিন্দিতে ওই সময় আরও বলা হয়, যখন হিন্দুস্তানের সেনারা ঢাকা ছেড়ে যাচ্ছিল, তখন কাঁটাতারের পেছনে দাঁড়িয়েছিল ১১-১২ বছরের দুই অনাথ বন্ধু বিক্রম ও বালা। তারা বুঝতে পারছিল না, তাদের সঙ্গে যা হলো তা কি ঠিক ছিল না ভুল। তাদের মাথায় তখন প্রশ্ন ঘুরছিল, নতুন দেশ কি তাদের নতুন জীবন দেবে?

ছবিটিতে আরও দেখানো হয়, ভারতীয় যোদ্ধাদের সামনে আত্মসমর্পণ করছে পাকিস্তানি সেনারা। আর জন্ম হচ্ছে বাংলাদেশের। সেই ফ্রেমেই একটু পেছনে খেয়াল করলে চোখে পড়বে বঙ্গবন্ধুর পোস্টার। ত্রাণের গাড়ি রুটি ছুড়তে ছুড়তে ছুটে চলেছে সহায়-সম্বলহীন মানুষের সামনে দিয়ে। আর কাদামাটি থেকে তা কুড়িয়ে খাচ্ছে ক্ষুধার্ত মানুষ।

ছবির অনেকাংশে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের ফুটেজ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে দেখানো হলেও কোথাও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের কথা উল্লেখ করা হয়নি। এর পরিপ্রেক্ষিতে ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ও ব্লগে সমালোচনার ঝড় ওঠে। ছবিটির মাধ্যমে বাংলাদেশের গৌরবোজ্জ্বল মহান মুক্তিযুদ্ধকে হেয় করা হয়েছে। ঝড় সিডরে রূপ নেওয়ার আগেই ক্ষমা চান যশরাজ ফিল্মস।

যশরাজ ফিল্মসের ক্ষমা চাওয়া বা আত্মপক্ষ সমর্থন

প্রথমে যখন খবর ছড়িয়ে পড়ে, যশরাজ ফিল্মস তাদের ওয়েবসাইটে ক্ষমা চেয়েছে, আনন্দ ও হুল্লোড়ে ফেসবুক-এ স্ট্যাটাস দেয় কেউ কেউ। যদিও সে সময় তাদের সাইটে যশরাজ ফিল্মস তেমন কিছুই করেনি। তবে পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশি নাগরিকদের উদ্দেশে যশরাজ ফিল্মসের অফিসিয়াল ফেসবুক পাতায় লেখা এক বার্তায় তারা ক্ষমা চেয়ে নিজেদের বক্তব্য উপস্থাপন করে।

যশরাজ ফিল্মস সেই বার্তায় বলে, ‘প্রিয় বন্ধুরা, আমাদের ছবিতে যেভাবে গল্প তুলে ধরা হয়েছে তাতে বাংলাদেশের অনেক দর্শক তাদের আপত্তির কথা জানিয়েছেন। গুন্ডের কাহিনী ও গল্প পুরোপুরি কাল্পনিক। কোনো জাতি, সমাজের বিশেষ কোনো গোত্র কিংবা কোনো ব্যক্তির প্রতি অশ্রদ্ধা-অসম্মান প্রদর্শনের অভিপ্রায় আমাদের ছিল না। তারপরও বাংলাদেশি বন্ধুরা যদি আমাদের কাজ দেখে আহত হন কিংবা অশ্রদ্ধা প্রকাশ করা হয়েছে বলে মনে করেন তাহলে আন্তরিকভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করছি আমরা। মুক্তিযোদ্ধা এবং শহীদদের আত্মত্যাগের বিনিময়েই একটি স্বাধীন দেশের জন্ম হয়। এটা কখনোই ভোলার নয়। স্বাধীনতা অর্জনের জন্য বাংলাদেশের মানুষকে অনেক মূল্য দিতে হয়েছে। বাংলাদেশের মানুষের স্বাধীনতা সংগ্রামের কথা ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে। যাই হোক, গুন্ডে ছবিতে কোনোভাবেই বাংলাদেশিদের মহান আত্মত্যাগের বিষয়টিকে খাটো করে দেখানোর চেষ্টা করা হয়নি। আর ইতিহাস বিকৃতির তো প্রশ্নই ওঠে না। এর কাহিনীতে কেবল দেখানো হয়েছে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে অনেক পরিবার ও মানুষকে দেশত্যাগে বাধ্য হয়েছিল। ছবিতে এমনই একটি পরিবারের দুর্দশার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।

চলচ্চিত্র হিসেবে গুন্ডের মান ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সমালোচনা

গুন্ডে ছবিতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে অবমাননা করা ও ইতিহাস বিকৃতির অভিযোগে সমালোচনার ঝড় শুধু ফেসবুক বা ব্লগেই সীমাবদ্ধ নয়, অন্তর্জাতিক অঙ্গনেও ছড়িয়ে পড়েছে এর উত্তাপ।

জানা গেছে, আইএমডিবি সাইটে কড়া মন্তব্য করে সমালোচনা লিখেছেন অসংখ্য মানুষ। ছবিটির মান নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয় সেখানে। শুধু তা-ই নয়, এই মুহূর্তে আইএমডিবি রেটিংয়ে সর্বনিম্ন পয়েন্ট যশরাজের ‘গুন্ডে’ ছবির ঝুলিতে। মাত্র ১.৪ পয়েন্ট পেয়ে আইএমডিবি বটম হান্ড্রেড চার্টের এক নম্বরে অবস্থান করছে ‘গুন্ডে’। ২ ও ৩ নম্বরে আছে হলিউডের দুটি ছবি। একটি ১৯৮৫ সালে মুক্তি পাওয়া ‘ফাইনাল জাস্টিস’। অন্যটি ২০০৮ সালের ‘দ্য হটি অ্যান্ড দ্য নটি’।

আইএমডিবি সাইটে কানাডা থেকে তানভীর লিখেছেন ‘ছবিটির মাধ্যমে মিথ্যা ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে। এটি নিঃসন্দেহে দর্শককে ভুল পথে পরিচালনা করবে। এমন বড় বাজেটের একটি ছবিতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে যেভাবে বিকৃত করা হয়েছে, তা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। ছবিটির পরিচালকের প্রতি আমার অনুরোধ, ভবিষ্যতে কোনো ছবি নির্মাণের আগে সতর্কতার সঙ্গে ইতিহাস পড়ে নেবেন। আর তা সম্ভব না হলে কমেডি ঘরানার ছবি তৈরি করবেন।’

যুক্তরাজ্য থেকে আকাশ শ্রীবাস্তব লিখেছেন, ‘রোমান্স ব্রোমান্স আর চটুল গানের মিশেলে এক জগাখিচুড়ি তৈরি করেছেন গুন্ডে ছবির পরিচালক। ছবিটির প্রথম আধা ঘণ্টা দেখার পর যেকোনো দর্শকই ধরতে পারবেন যে এর চিত্রনাট্য খুবই দুর্বল। সংলাপগুলোও জঘন্য। প্রিয়াঙ্কা চোপড়া ছাড়া ছবিটিতে দেখার মতো আর কিছুই নেই। ছবিটি দেখার মানে সময় এবং অর্থের অপচয় ছাড়া আর কিছুই না।’

নিউইয়র্ক থেকে ভিকি লিখেছেন, ‘ছবিটির গল্প খুবই অশোভনভাবে তুলে ধরা হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের মানুষদের এক অর্থে আক্রমণই করা হয়েছে। ১৯৭১ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ হয়েছিল। কোনোভাবেই সেটাকে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ বলা যাবে না। যুদ্ধে ভারতীয় সেনাবাহিনী সহায়তা করেছিল মাত্র। এর বাইরে আর কিছুই না। নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করে বাংলাদেশের জন্ম দিয়েছিল এ দেশের মুক্তিযোদ্ধারা। স্বাধীন দেশের অভ্যুদয়ের পুরো কৃতিত্বটাই তাদের। অথচ গুন্ডে ছবির মাধ্যমে ভারতীয় সেনাবাহিনীকেই পুরো কৃতিত্ব দেওয়ার হীন চেষ্টা চালিয়েছে যশরাজ ফিল্মস। এমন অসত্য তথ্যের ওপর ভিত্তি করে ছবি তৈরির বিষয়টি খুবই অপ্রত্যাশিত। ছবির নির্মাতাদের ধিক্কার জানানোর ভাষাও হারিয়ে ফেলেছি আমি।’

আইএমডিবি সাইটে এ বিষয়ে সবচেয়ে আকর্ষণীয় লেখাটি লিখেছেন অনীক। ঢাকা থেকে সে তার ‘বাংলাদেশের ইতিহাস পরিবর্তনের পাঁয়তারা’ শিরোনামের সমালোচনায় লিখেছেন, ‘এটা খুবই নিম্নমানের একটি চলচ্চিত্র যেখানে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে ভুলভাবে তুলে ধরা হয়েছে। ১৯৭১ সালে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ হয়নি। পাকিস্তান থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য স্বাধীনতা যুদ্ধ করেছিল বাংলাদেশের আপামর জনগণ। এই যুদ্ধে ভারতীয় সেনাবাহিনী সাহায্য করেছিল। কিন্তু মূল যুদ্ধটা করেছিল বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ ও মুক্তিযোদ্ধারা। আমি ভেবে পাই না, বলিউডে কীভাবে এমন জঘন্য একটি ছবি নির্মিত হল! এমন বাজে একটি ছবি দেখে সবাইকে সময় নষ্ট না করার পরামর্শ রইল আমার পক্ষ থেকে।’

আইএমডিবি সাইটটি ঘাটলেই এমন আরও অসংখ্য নেতিবাচক মন্তব্য মিলবে ক্ষুব্ধ দর্শকদের। বলা যায়, এর মধ্য দিয়ে অসত্যের বিরুদ্ধে এক অভিনব প্রতিবাদের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তারা। চলচ্চিত্র বিশ্লেষকরা মনে করেন, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যশরাজ ফিল্মসের দীর্ঘদিনের ভাবমূর্তি দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে গুন্ডে।

অষ্টম দিনের আয়

যশরাজ ফিল্মস প্রযোজিত গুন্ডের সবশেষ খবর পর্যন্ত গত ৮ দিনের আয় দাঁড়িয়েছে ৭৩ কোটি। আলী আব্বাস জাফর পরিচালিত ছবিটির বাজেট ছিল ৫০ কোটি রুপি। ছবিটির বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছেন প্রিয়াংকা চোপড়া, রণবীর সিং, অর্জুন কাপুর, ইরফান খান প্রমুখ।

ছবির সাফল্য এসেছে সমালোচনা আর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হওয়ার মধ্য দিয়ে। যশরাজ এর আগেও তাদের ব্যানারে নির্মিত নানা ছবিতে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতীয় ভাবমূর্তিকে উজ্জ্বল করেছে। তবে সতীর্থ বাংলাদেশকে খাটো করে ভারতীয় ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে যাওয়ার চেষ্টা তাদের কোনো দূরভিসন্ধি কিনা কে জানে! বিভিন্ন ভাষার ছবি যুগে যুগে ইতিহাসকে যেমন সমুন্নত রেখেছে, তেমনি ইতিহাসের বিকৃতিও ঘটিয়েছে প্রচুর। ভুল ইতিহাস উপস্থাপন ও টেকনিক্যালি ক্ষমা চাওয়া যশরাজ ফিল্মস তাদের ইচ্ছা বা অনিচ্ছাকৃত এই ভুলের জন্য খেসারত দেবে কিনা সেটা ভবিষ্যৎই বলে দেবে।

(দ্য রিপোর্ট/এআর/এইচএসএম/এএইচ/ফেব্রুয়ারি ২২, ২০১৪)

পাঠকের মতামত:

SMS Alert

জলসা ঘর এর সর্বশেষ খবর

জলসা ঘর - এর সব খবর