thereport24.com
ঢাকা, বুধবার, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১,  ২৫ জমাদিউল আউয়াল 1446

শত কোটি টাকার ‘গম কেলেঙ্কারি’ ধামাচাপার চেষ্টা!

২০১৭ মে ১৪ ২২:৩৫:৩৭
শত কোটি টাকার ‘গম কেলেঙ্কারি’ ধামাচাপার চেষ্টা!

মুহাম্মদ আবু তৈয়ব, খুলনা ব্যুরো : খাদ্য মন্ত্রণালয়ের জন্য আমদানি করা শত কোটি টাকা মূল্যের ৩৩ হাজার মেট্রিকটন ‘গম কেলেঙ্কারি’র ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টার অভিযোগ পাওয়া গেছে। চট্টগ্রামের একটি গুদাম থেকে সরকারিভাবে আমদানি করা এ গম আত্মসাৎ করা হয়। আর এ ঘটনায় ২০১৫ সালের ৩০ মে চট্টগ্রাম বন্দর থানায় দায়ের করা মামলার তদন্ত করছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। এর আগে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও চট্টগ্রাম বন্দর থানা পুলিশ মামলাটির তদন্ত করেছে। তবে এখনও কেউ-ই এ মামলার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে পারেনি।

মামলার নথি ও দুদক সূত্রে জানা যায়, ২০১৩ সালের ১৬ জানুয়ারি দক্ষিণ কোরিয়ার রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান মেসার্স সামজিন সিএস অ্যান্ড টি কো. লি. (M/S Samjin cs & t co. Ltd) এর সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের খাদ্য বিভাগের গম সরবারাহের একটি চুক্তি হয়। চুক্তিতে প্রতি মেট্রিক টন ৩৪৬ দশমিক ৪৫ মার্কিন ডলার দরে মোট ৫০ হাজার (+ ৫%) মেট্রিক টন গম সরবরাহের কথা বলা হয়। দক্ষিণ কোরিয়ার প্রতিষ্ঠানটি ২০১৪ সালের ৪ জানুয়ারি খুলনার শেখ আশরাফ আলী অ্যান্ড সন্স লিমিটেডকে স্থানীয় বিশেষ প্রতিনিধি (EXCLUSIVE AGENT) নিয়োগ দেয়। এ বিষয়টি তারা খাদ্য বিভাগকেও অভিহিত করে। পরবর্তী সময়ে চুক্তি অনুযায়ী ২০১৪ সালের ২৭ জুলাই ১৯ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন গম বোঝাই প্রথম চালান নিয়ে এমভি ব্রেভ লিডার (M/v Brave leader) জাহাজ মংলা বন্দরে আসে ও খালাস করে। এ গম খাদ্য বিভাগকে বুঝিয়েও দেওয়া হয়।

২০১৪ সালের ৬ আগস্ট চুক্তির দ্বিতীয় চালানে ৩৩ হাজার মেট্রিকটন গম নিয়ে বেলজিয়াম পতাকাবাহী এমভি ভিরিশতা (M/v Vyritsa) জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছে। কিন্তু ড্রাফট জটিলতায় (গভীরতা সংক্রান্ত সমস্যা) জাহাজটি জেটি ভিড়তে পারে না। ওই সময় গম সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ‘মেসার্স সামজিন সিএস অ্যান্ড টি কো. লি.’-এর সঙ্গে স্থানীয় বিশেষ প্রতিনিধি (EXCLUSIVE AGENT) ‘শেখ আশরাফ আলী অ্যান্ড সন্স’ এর কমিশন নিয়ে বিরোধ সৃষ্টি হয়। এর প্রেক্ষিতে ‘শেখ আশরাফ আলী অ্যান্ড সন্স’ উচ্চ আদালতের যায়। হাইকোর্ট দ্বিতীয় চালানের ৩৩ হাজার মেট্রিকটন গমের ওপর স্থিতাবস্থা জারি করেন। এ কারণে গমবাহী জাহাজটি গভীর সমুদ্রে অবস্থান নেয়। তবে পরবর্তীতে উচ্চ আদালত গম নামিয়ে রফতানিকারকের হেফাজতে রেখে জাহাজটি ছেড়ে দেওয়ার অনুমতি দেয়।

উচ্চ আদালতের এই আদেশের ব্যবহার করে কোরিয়ান প্রতিষ্ঠান ‘মেসার্স সামজিন সিএস অ্যান্ড টি কো. লি.’ এর আগে থেকেই নিযোগ করা স্থানীয় প্রতিনিধি (LOCAL AGENT) ‘জে কে শিপিং লাইন’ তাদের অনুমতি না নিয়েই গম গুদামজাত করে। জে কে শিপিং এর পক্ষ থেকে কাগজে-কলমে দেখানো হয় চট্টগ্রামের সদরঘাটস্থ মালেক মাঝির ৫ নং গোডাউনে এ গম গুদামজাত করা হয়েছে।

পরবর্তী সময়ে উচ্চ আদালত মজুতকৃত ৩৩ হাজার টন গম থেকে ৭ হাজার টন গম বিক্রি করে খুলনার হাজী শেখ আশরাফ আলী অ্যান্ড সন্স লিমিটেড এর কমিশনের টাকা পরিশোধের নির্দেশনা দেন।

হাজী শেখ আশরাফ আলী অ্যান্ড সন্স লিমিটেড এর ম্যানেজিং ডিরেক্টর শেখ আজিজুল হক জানিয়েছেন, তিনি মালেক মাঝির গোডাউনে গিয়ে দেখেন সেখানে কোনো গম নেই। এরপর ২০১৫ সালের ৩০ মে তিনি গম আত্মসাতের অভিযোগ এনে জে কে শিপিংয়ের ম্যানেজিং ডিরেক্টর মো. কামরুল ইসলাম, তার পুত্র নূরূল ইসলাম, পার্টনার আখতারুজ্জামান খান মামুন, সাইফুল ইসলাম এবং মালেক মাঝির নামে চট্টগ্রামের বন্দর থানায় মামলা দায়ের করেন।

বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, ২০১৪ সালের ১৫ ডিসেম্বর থেকে ২০১৫ সালের ২৫ এপ্রিলের মধ্যে আদালতের নিষেধাজ্ঞ অমান্য করে ও রফতানিকারক প্রতিষ্ঠানের অনুমতি না নিয়ে জে কে শিপিং শত কোটি টাকা মূল্যর ৩৩ হাজার মেট্রিকটন গম গোপনে একটি সিন্ডিকেটের মাধ্যমে রোকেয়া অটোমেটিক ফ্লাওয়ার মিলের মালিক সাইফুল ইসলামের কাছে বিক্রি করে দিয়েছে।

আরও জানা গেছে, প্রতি মেট্রিক টন ৩৪৬ দশমিক ৪৫ মার্কিন ডলার দরে ৩৩ হাজার মেট্রিকটন গমের মূল্য দাড়ায় ৯২ কোটি ৬০ লাখ টাকা। তবে খোলা বাজারে এর মূল্য একশত কোটি টাকারও বেশি। অথচ খাদ্য মান্ত্রণালয়ের এই গম কখনও কামরুল ইসলাম, কখনও আখতারুজ্জামান খান মামুন, আবার কখনও আব্দুল মালেক মাঝি বাজার মূল্যের কম দামে বিক্রি করছে। যা নিয়ে একে অপরের বিরুদ্ধে মামলাও দায়ের করেছে।

এ প্রসঙ্গে ‘জে কে শিপিং লাইনস’ এর কর্নধার মো. কামরুল ইসলামের সঙ্গে যোগোযোগ করলে তিনি খাদ্য মন্ত্রণালয়ের আমদানি করা ওই ৩৩ মেট্রিকটন গম বিক্রি হয়ে যাওয়ার কথা স্বীকার করেন।

তিনি জানান, স্থানীয় বিশেষ প্রতিনিধি (EXCLUSIVE AGENT) হাজী শেখ আশরাফ আলী অ্যান্ড সন্স লিমিটেড এর ম্যানেজিং ডিরেক্টর শেখ আজিজুল হককে তিনি চার কোটি টাকা দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আজিজুল হক ১২ কোটি টাকা দাবি করায় বিষয়টির সমাধান হয়নি। ভাগের টাকা না পেয়ে তিনি (শেখ আজিজুল হক) মামলা করেছেন।

তিনি আরো জানান, আজিজুল হকের মন্ত্রণালয়ে যে কাজ করার কথা ছিল তিনি তা করতে পারেননি। তবে আখতরুজ্জামান মামুন সেই কাজ করে দিয়েছেন।

খুলনার আদালতে ৩৩ হাজার টন গম বিক্রির টাকা প্রতারণা মামলা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘গম বিক্রির পর সাইফুল ইসলামকে টাকা না দেওয়ায় এই মামলা করা হয়েছে।’

কামরুল ইসলাম দাবি করেন, গমের প্রকৃত মালিক দক্ষিণ কোরিয়ার রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান মেসার্স সামজিন সিএস অ্যান্ড টি কো. লি. বা খাদ্য মন্ত্রণালয়ের এ গমের বিষয়ে কোনো অভিযোগ নেই।

কামরুল ইসলাম আক্ষেপ করে আরও বলেন, ‘আজিজুল হকের মামলার কারণে সব ম্যানেজ করতে তার অতিরিক্ত দুই কোটি টাকা বেশি খরচ হয়ে গেছে। একই কারণে সাইফুল ইসলাম আর আখতারুজ্জামান মামুনের কাছে ১৫/১৬ কোটি টাকা আটকে গেছে। টাকা দিয়ে দুদক, পুলিশ, সিআইডি, আইনজীবী ও প্রভাবশালী নেতাদেরও ম্যানেজ করতে হয়েছে।’

এদিকে স্থানীয় বিশেষ প্রতিনিধি (EXCLUSIVE AGENT) হাজী শেখ আশরাফ আলী অ্যান্ড সন্স লিমিটেড এর ম্যানেজিং ডিরেক্টর শেখ আজিজুল হক জানান, তার দায়ের করা মামলার ৫ আসামি (কামরুল ইসলামসহ অন্যরা) আদালতের নিষেধাজ্ঞা থাকার পরও খাদ্য মন্ত্রণালয়ের জন্য আমদানি করা গম বিক্রি করে শত কোটি টাকা নিজেদের পকেটস্থ করেছে। অথচ খাদ্য মন্ত্রণালয় রহস্যজনকভাবে নিরবতা পালন করছে। এ ঘটনায় বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে।

তিনি আরও জানান, দক্ষিণ কোরিয়ার দুই সদস্যের একটি দল এ বিষয়ে জানতে বাংলাদেশ পরিদর্শন করেছে। তারা বাংলাদেশের কোরিয়ান দূতাবাসের মাধ্যমে অভিযোগ দাখিল করেছে।

শত কোটি টাকার গম আত্মসাতের ঘটনা ধামাচাপা দিতে প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতাদের নাম ব্যবহার করা হচ্ছে বলেও জনান তিনি।

চট্টগ্রাম বন্দর থানায় গম আত্মসাতের ঘটনায় দায়ের করা মামলাটি এ পর্যন্ত তিনবার হাত বদল হয়েছে। প্রথমে মামলাটি তদন্ত করেছে চট্টগ্রাম বন্দর থানা পুলিশ, পরে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), সর্বশেষ মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব পেয়েছে সিআইডি পুলিশ। সিআইডি চট্রগ্রাম পুলিশ পরিদর্শক লিটন দেওয়ান বর্তমানে মামলাটি তদন্ত করছেন।

লিটন দেওয়ান জানান, গত বছরের নভেম্বর মাসে মামলার অন্যতম আসামি মালেক মাঝি উচ্চ আদালতে মামলার তদন্ত ছয় মাসের জন্য স্থগিত করিয়েছেন। আগামী জুন মাসে মামলার তদন্ত স্থগিতাদেশ শেষ হলে তিনি (লিটন দেওয়ান) কার্ষক্রম শুরু করবেন।

মালেক মাঝি ছাড়া অন্য সকল আসামির গ্রেফতারাদেশ ও বিদেশ গমনের নিষেধাজ্ঞা বহল রয়েছে বলেও জানান তিনি।

এদিকে জে কে শিপিং লাইনসের পক্ষে প্রতিষ্ঠানটির ম্যানেজার আব্দুস সালাম খুলনার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে সাইফুল ইসলাম, প্রোপাইটর, রোকেয়া অটো রাইস মিলস লি., ঢাকা ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ এর ঠিকানা দিয়ে চেক প্রতারণার মামলা দায়ের করেছে। এই মামলায় প্রধান সাক্ষী হয়েছে জে কে শিপিং এর কর্ণধার মো. কামরুল ইসলাম।

মামলার আর্জিতে বলা হয়েছে, জে কে শিপিং লাইনস বিদেশ হতে গম, চাল, আমদানি ও খালাস কার্যক্রম করে আসছে। তারা রুমানিয়া থেকে ৩৩ হাজার মেট্রিক টন গম আমদানি করেন এবং চট্রগ্রাম বন্দরে সেই গম খালাস করে চট্রগ্রাম এলাকার পূর্ব মাদারবাড়ী এলাকার ২ নং সাক্ষী আব্দুল মালেক মাঝির গোডাউনে ভাড়া করে সেখানে মজুদ রাখেন। আসামি সাইফুল ইসলাম গম ক্রয়ের জন্য ১ নং সাক্ষীর অথাৎ বাদীর প্রতিষ্ঠানের মালিক কামরুল ইসলামের খুলনা অফিসে আসেন। ২০১৪ সালের ৫ নভেম্বর তারিখে উক্ত গম ১৬ দশমিক ৫০ টাকা প্রতি কেজি দরে ক্রয় করার প্রস্তাব করিলে বাদীর মালিক সেই প্রস্তাবে রাজি হন। সেই হিসাবে ৩৩ হাজার মেট্রিক টন গমের মূল্য দাঁড়ায় ৫৪ কোটি ৪৫ লাখ টাকা । এই গম বিক্রয়ের সময় বাদীর খুলনা অফিসে ১ নং সাক্ষী , ১ নং সাক্ষীর ব্যবসায়িক পার্টনার আক্তারুজ্জামান খান মামুন এবং আসামির সাথে ১০০টাকার ৫টি এবং ৫০ টাকার একটি ননজুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে একটি সমঝোতা পত্র স্বাক্ষরিত হয়। ওই সময় জে কে শিপিং লাইনস এর ইউসিবি ব্যাংকে প্রদান করতে বাদীর প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে ৩ নং সাক্ষী মালেক মাঝির বরাবরে ডেলিভারি অর্ডার প্রদান করেন। সেই হিসাবে আসামি পুরো ৩৩হাজার মেট্রিক টন গম আসামি তার রোকেয়া আটোমেটিক ফ্লাওয়ার লি. চাঁপাইনবাবগঞ্জে নিয়ে যান। কিন্তু সমঝোতা অনুযায়ী প্রতিদিন তিন কোটি টাকা করে প্রদান করার কথা থাকলেও তিনি তা পরিশোধ করেননি। বর্তমানে আসামি ৫২ কোটি ৪৫ লাখ টাকা প্রতারণামূলক বিশ্বাস ভঙ্গের মাধ্যমে আত্মসাৎ করেছেন। এ জন্য প্রতারণা ও বিশ্বাস ভঙ্গের জন্য দণ্ডবিধি আইনের ৪০৬ ও ৪১৭ ধারার শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছে।

এই মামলায় মোট সাতজন সাক্ষী দেখানো হয়। এই মামলায় আসামি সাইফুল ইসলামের বিরুদ্ধে প্রথমে সমন এবং পরে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হলেও আসামি সাইফুল ইসলাম উচ্চ আদালতের মাধ্যমে গ্রেফতারি পরোয়ানা স্থগিত করিয়েছেন।

এদিকে, অভিযোগ আছে গম আত্মসাতের ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার জন্য মামলাটি তদন্তের ভার প্রভাব খাটিয়ে দুদকের কাছ থেকে নিয়ে সিআইডিকে দেওয়া হয়েছে।

তবে এ মামলার তদন্ত করতে গিয়ে ২০১৬ সালের ৩০ জুন প্রস্তুত করা দুদকের পর্যালোচনা প্রতিবেদনটি দ্য রিপোর্ট টুয়েন্টিফোর ডটকমের কাছে আছে। এর আগে দ্য রিপোর্টে গত বছরের ১০ জুলাই ‘জালিয়াতি করে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের শতকোটি টাকার গম আত্মসাৎ’ শিরোনামে এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। দ্য রিপোর্ট টুয়েন্টিফোর ডটকমের পাঠকদের জন্য দুদকের তদন্ত কর্মকর্তা ও সহকারী পরিচালক এইচ এম আক্তারুজ্জামানের প্রস্তুত করা পর্যালোচনা প্রতিবেদনটির বিশেষ অংশ তুলে ধরা হলো।

দুদক কর্মকর্তার পর্যালোচনা প্রতিবেদনে দেখা যায় যে, চট্রগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের পরিচালক [ট্রাফিক ] এর দপ্তরের স্বারক পত্র নং ডিটি /গো/২২৭ [অংশ ] ৩] ১০৯ তাং ২৭.০৮.২০১৬ এবং সংযুক্ত সংলগ্নী পর্যালোচনা দেখা যে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোট ডিভিশনের সিভিল অর্ডার নং ৪৩৭৮/২০১৪ এর আদেশ মোতাবেক M/v Vyritsa জাহাজ হতে সকল পক্ষের উপস্থিতি/মনিটরিং এর ভিত্তিতে যাবতীয় আইনানুগ ব্যবস্থা প্রতিপালন সাপেক্ষ রিভিউ পিটিশনারের হেফাজতে রাখার জন্য কাস্টম হাউস, চট্রগ্রাম কমিশনার অব কাস্টম স্বারক নং এস-৫-৪৯ /স্টাফ/কাম ২০১৪-২০১৫/১৬৪৯ তাং ৩০/১২/২০১৪ মুলে শিপিং এজেন্ট জে, কে শিপিং লাইনসকে অনুমতি প্রদান করেন। উক্ত পত্রে তিনি আরও উল্লেখ করেন যে মাননীয় আদালতের পরবর্তী আদেশ না পাওয়া পযর্ন্ত অবতরনকৃত গম চালানটি যে ভাবে গ্রহণ করা হবে সেই ভাবেই সংরক্ষিত থাকবে এবং সংরক্ষিত অবস্থায় উক্ত গমের কোনরুপ পরিবর্তন/পরিবর্ধন/খালাস/হস্তান্তর এবং বিক্রয় কোনো কিছুই করা যাবে না।

এই বিষয়টি কোরিয়ান কোম্পানিকে অবহিত না করায় ‘মেসার্স সামজিন’ জাহাজের গমের ৯০ শতাংশ বিল মুল্য পরিশোধের জন্য এল সি ওপেনিং ব্যাংক তথা সোনালী ব্যাংক লি: স্থানীয় কার্যালয় ঢাকার মাধ্যমে Correspondent ব্যাংক খাদ্য অধিদপ্তরকে বার বার তাগিদ দিতে থাকে এবং উক্ত জাহাজের বি/এলসহ মুল দলিলাদির অবস্থান জানতে চায়। ফলে ব্যাংকিং জটিলতা এড়াতে খাদ্য অধিদপ্তর উক্ত জাহাজের মূল ডকুমেন্ট সোনালী ব্যাংক লি. স্থানীয় কার্যালয় ঢাকা ফেরত প্রদান করে। শত কোটি টাকার গম বা জাহাজের খবর না পেয়ে কোরিয়ান প্রতিষ্ঠান মেসার্স সামজিন সিএস অ্যান্ড টি কো. লি. এর প্রেসিডেন্টকে (MR Heo Man Woog, President) বাংলাদেশে আসেন। তিনি তার স্থানীয় শিপিং এজেন্ট কামরুল ইসলামের সহযোগিতা না পেয়ে ২০১৫ সালের ১১ মার্চ চট্রগাম বন্দর থানায় একটি সাধারণ ডাইরি করেন। ডাইরি নং ৪৯৭, তাং ১১.৩.২০১৫। তিনি ডাইরিতে উল্লেখ করেন যে, বেলজিয়াম ফ্ল্যাগ সিপ এম ভি ব্যারটিসা সামজিন কোম্পানী কর্তৃক চার্টার করে বাংলাদেশ সরকারের খাদ্য মন্ত্রনালয়ের সরবরাহরে জন্য গম আনা হয়। কিন্তু অন্য পক্ষের সহিত চুক্তি ভঙ্গের কারণে জাহাজটি অবদ্ধ হয়। কিন্তু আশ্চর্যজনক হলেও সত্য যে জে কে শিপিং লাইনস এর কর্ণধর কামরুল ইসলাম খাদ্য মন্ত্রনালয়ের সাথে চুক্তি মোতাবেক আনা ৩৩ হাজার টন তাদের পছন্দের গুদামে রেখেছে – তা তাদেরকে [সামজিন] অবহিত করেনি, যাহা কোম্পানীর জানার অধিকার ও প্রয়োজন রয়েছে। ৩৩হাজার মেট্রেক টন গম কোথায় রাখা হয়েছে তার সম্পর্কে জানার জন্য লিখিত পত্র দিয়ে ৭ দিনের মধ্যে জানানোর কথা বলা হলেও তিনি কোন জবাব দেননি। যে কারণে কোরিয়ান কোম্পানী তার মালামাল সম্পর্কে শঙ্কিত হয়ে পড়েন। কারণ এই জাহাজে আনীত গম বাংলাদেশ সরকারের ফুড ডিপার্টমেন্টে সরবরাহ করার নিমিত্তে আনীত হয়েছিল। এবং ঐ গম আদালত কর্তৃক সামজিনের জিম্মায় রাখার, সরকার এবং আদালতের নিকট বুঝাইয়া দিতে দায়বদ্ধ।

দুদক কর্মকর্তা আরও উল্লেখ করেন, বিবাদী মো. কামরুল ইসলাম তাকে মেসার্স সামজিন সিএস অ্যান্ড টি কো. লি. এর প্রেসিডেন্টকে জীবননাশের হুমকি প্রদান করেছে বিধায় বিষয়টি ভবিষ্যতের জন্য সাধারণ ডাইরি করা প্রয়োজন।

দুদক কর্মকর্তা তার প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন, জে কে শিপিং লাইনস এর মো. কামরুল ইসলাম ও তার পার্টনার মো. সাইফুল ইসলাম নিজ খরচে ১০.১২.২০১৪ তারিখ হতে চট্রগ্রাম বন্দর থেকে ৫০৯১টি ট্রাক যোগে ৪ লাখ ৩২ হাজার ৫৭৪টি ব্যাগে মোট ৩২ হাজার ৪৯৯ দশমিক ৭২০ মেট্রিক টন গম চট্রগামের আসামি আব্দুল মালেক মাঝির গোডাউনে সংরক্ষণ করে।

পরবর্তীতে আসামী কামরুল ইসলাম ৩২ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন ব্যাগিং করা গম আসামী মো. সাইফুল ইসলামের রোকেয়া ফুড প্রসেসিং প্রতিষ্ঠানকে ডেলিভারি দেওয়ার জন্য আসামি আব্দুল মালেক মাঝিকে পত্র প্রেরণ করেন।

জে কে শিপিং লাইনস এর প্রধান আসামি কামরুল ইসলাম তার পুত্র নুরূল ইসলাম জনি, রোকেয়া ফুড প্রসেসিংয়ের মালিক আসামি মো. সাইফুল ইসলাম ও তার গোডাউন কিপার মালেক মাঝি যোগসাজশে এই গম গোপনে বিক্রি করে দেয়।

দুদকের সহকারী পরিচালক এইচ আক্তারুজ্জামান তার তদন্ত পর্যালোচনায় আরও উল্লেখ করেন, গম বিক্রির বিষয়ে আদালতের নিষেধাজ্ঞা থাকার পরও আসামি কামরুল ইসলাম ৩২ হাজার ৫শত মেট্রিক টন ব্যাগিং করা গম রোকেয়া ফুড প্রসেসিংকে ডেলিভারি দেওয়ার জন্য মালেক মাঝিকে নির্দেশনা দেন। মালেক মাঝি ও সাইফুল ইসলাম বিভিন্ন ব্যক্তি/প্রতিষ্ঠানের কাছে এই গম সরবরাহ করে। গম বিক্রির চুক্তি মতো মোট ৪২ কোটি ৯৪ লাখ ৬২ হাজার টাকার কামরুল ইসলাম ও তার পার্টনার আক্তারুজ্জামান মামুনকে ৪টি চেক ও নগতে পরিশোধ করেন। এর মধ্যে একটি ৭ কোটি ৫০ লাখ টাকার চেক মালিক মাঝি পেমেন্ট স্টপ করলে বিষয়টি নিয়ে আখতারুজ্জামান খান ‘এন আই অ্যাক্টে’ আদালতে মামলা করেন।

দুদকের সহকারী পরিচালক এইচ এম আক্তারুজ্জামানক মামলার তদন্তর স্বার্থে প্রথমে আসামিদের নাম ঠিকানা উল্লেখ করে হাজির হবার নির্দেশ, পরে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন। এপর ২০১৬ সালের ২৪ মে তারিখে চট্রগ্রাম শাহ আমানত আর্ন্তজাতিক বিমান বন্দর, বেনাপোল চেক পোস্ট এবং হযরত শাহজালাল আর্ন্তজাতিক বিমান বন্দরের মামলার পলাতক আসামিদের পাসপোর্ট নাম্বার দিয়ে বিদেশ গমনে নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। এই আদেশে তিনি সূত্র ৩৩ হাজার মেট্রিক টন গম আত্মসাৎ ঘটনার তিনটি মামলার কথা উল্লেখ করেন।

২০১৬ সালের ৫ অক্টোবর একটি মামলায় রোকেয়া অটোমেটিক ফ্লাওয়ার মিলের মালিক চট্রগ্রাম মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে আত্নসমর্পণ করে জামিনের আবেদন করলে আদালত জামিন না মঞ্জুর করে জেল হাজতে প্রেরণ করেন। এর আগে গোডাউনের মালিক আব্দুল মালেক মাঝি এই মামলায় গোপনে জামিন গ্রহণ করেন। পরে আসামিরা রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করে মামলাটি তদন্ত দুদকের কাছ থেকে সিআইডি পুলিশের কাছে হস্তান্তর করান।

সিআইডি মামলার তদন্তের ভার দেওয়ার সময় উল্লেখ করা হয় ঘটনাস্থল চট্রগ্রাম কিন্তু আসামিরা ঢাকা, খুলনা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ থাকায় মামলার তদন্ত সিআইডি পুলিশকে হস্তান্তর করা হয়েছে।

(দ্য রিপোর্ট/এস/জেডটি/মে ১৪, ২০১৭)

পাঠকের মতামত:

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

M

M

SMS Alert

এর সর্বশেষ খবর

- এর সব খবর