thereport24.com
ঢাকা, সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১,  ২১ জমাদিউস সানি 1446

ভারতবর্ষ বিভাজনের ৭০ বছর

২০১৭ আগস্ট ১৪ ১২:৫৬:৪১
ভারতবর্ষ বিভাজনের ৭০ বছর

ভারত বিভক্তির ৭০ বছর পূর্তি আজ। এই ৭০ বছরে ভারত বিভক্ত হয়ে জন্ম নেওয়া পাকিস্তানও বিভক্ত হয়েছে। কিন্তু ভারত কেন ভাঙলো? এই রহস্য নিয়ে এখনো বিস্তর গবেষণা হচ্ছে। বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণও করছেন অনেকে। তবে মুসলমানদের ভারত থেকে আলাদা হওয়ার কারণটা কি ছিলো? কারণটা বোঝা যাবে ‘ইতিহাসের উত্তরাধিকার’ নামে পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের একটি প্রবন্ধ থেকে।

উদ্ধৃতিটি তারাকৃষ্ণের ‘রাজভক্তিবিষয়ক’ প্রবন্ধ থেকে। ‘পূর্ব্বকালে যখন এই দেশ হিন্দু জাতির শাসনাধীনে ছিল তখন রাজাগণের পক্ষপাতিতা দোষে জাতি বিশেষ অপর সমস্ত জাতির উপর সম্পূর্ণ প্রভুত্ব করতেন। ঐ সকল জাতিকে স্বর্গ বা নরকগামীকরণের কর্তা ছিলেন। যখন এই রাজ্য যবনদিগের হস্তে ছিল, তখন তারা হিন্দু বর্গকে নাস্তিক ও অধার্মিকের শেষ বলিয়া নির্দেশ করেছিলেন।

স্বজাতি প্রজাবর্গের প্রতি যাবতীয় বিষয়ে অনুগ্রহ, হিন্দু প্রজাদিগের প্রতি সর্বতোভাবে নিগ্রহ করতেন। ব্রিটিশ জাতির রাজনিয়মাবলিতে এই সব দোষের লেশও নাই, তারা আপন জাতীয় এবং এদেশস্থ ডোম প্রভৃতি যৎপরোনাস্তি নীচ ব্যক্তিকে বিচারকালে সমান দেখতেন। ঐ জাতির পক্ষপাতশূন্যতা গুণের অধিক প্রশংসা কি করব?’

এ সব উদ্ধৃতি থেকে স্পষ্টত উপলদ্ধি করতে পারা যায়, ইতিহাসের ঘাতপ্রতিঘাতে এ দেশে হিন্দু জনগোষ্ঠীর চেতনা এবং মুসলিম জনগোষ্ঠীর চেতনার মধ্যে একটি বিরাট পার্থক্য ও ভেদ রেখার সৃষ্টি হয়েছিল। পার্থক্যের চেতনাবোধ এমন ভয়ানক অবস্থায় পৌঁছে গেল। হিন্দুদের মনের কথা জ্ঞানেন্দ্র পান্ডে তার বইতে তুলে ধরতে গিয়ে লিখলেন, ‘যদি মুসলিমরা এই দেশে থাকতে চায়, তাহলে আমাদের মত করে থাকতে হবে।’

এসব থেকে প্রমাণিত হয় যে, হিন্দু মানসের মধ্যে একটা চিন্তা কাজ করছিল, সেই চিন্তাটা হচ্ছে- যদি মুসলমানরা ভারতবর্ষে থাকতে চায় তাহলে তাদের নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি, আচার-আচরণ ত্যাগ করে তাদের সঙ্গে মিলে মিশে থাকতে হবে, তাদেরকে বন্দে মাতরম বলতে হবে। এ চিন্তা মুসলমানদের কাছে কখনই গ্রহণযোগ্য ছিল না। সে কারণে মুহম্মদ আলী জিন্নাহ স্পষ্ট বলেছিলেন, ‘Our outlook is not only Fundamentally different but often radically antagonistic to the Hindus. We are different beings, There is nothing in life which links us together.’

মুসলমানদেরকে তাদের নিজস্ব বিশ্বাস ও জীবন বোধসহ ভাষা, সংস্কৃতি, আচার-আচরণ নিয়ে অখণ্ড ভারত ভূমিতে বাস করা অসম্ভব হবে ভেবে মুসলমানদের মনে স্বতন্ত্র আবাসভূমির চিন্তা জাগ্রত হয়। এ সত্যের আভাস দিয়েছিলেন আল্লামা ইকবাল ১৯৩০ সালে লক্ষ্মৌতে অনুষ্ঠিত সর্ব ভারতীয় মুসলিম লীগ অধিবেশনে।

এসব ছাড়াও ভারত ভাঙ্গার দৃশ্যমান বড় কারণ বঙ্গভঙ্গ রদের জন্য উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদী আন্দোলন। ১৯০৫ সালে বঙ্গ বিভাগের প্রায় অর্ধ শতাব্দী আগে বাঙ্গালা প্রদেশটি বিভক্তিকরণের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়েছিল। লর্ড কার্জনের দায়িত্বভার গ্রহণের পূর্বে বঙ্গ বিভাগের প্রস্তাবাবলী পেশ করা হয়। ১৯০৩ সালে সরকারি গেজেটে বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাব প্রকাশিত হয়। বঙ্গ বিভাগ কার্যকরী করা হয় ১৩ই অক্টোবর ১৯০৫ সালে। বঙ্গভঙ্গের ফলে বাংলার মুসলমানদের মধ্যে আনন্দের বান ডেকেছিল। কিন্তু বর্ণ হিন্দু সম্প্রদায় এ ব্যবস্থাকে তাদের কায়েমী স্বার্থের মূলে কুঠারাঘাত বিবেচনা করে বঙ্গ বিভাগের বিরুদ্ধে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে। স্বার্থবাদী বর্ণ হিন্দু সম্প্রদায় বঙ্গভঙ্গ রদের জন্য দেশব্যাপী প্রবল আন্দোলন শুরু করে। এমন কি হিংসাত্মক কার্যক্রমের আশ্রয় গ্রহণ করে। ১৯১২ সালের ২ ডিসেম্বর বাংলা বিভাগ রদ ঘোষিত হলে মুসলমান মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় ব্রিটিশ বিদ্বেষী হয়ে ওঠে।

প্রচলিত একটি ধারণা হচ্ছে, পাকিস্তান সৃষ্টি হয়েছিল কায়েদ-ই-আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ও তৎকালীন সংখ্যালঘু মুসলিমদের রাজনৈতিক দল অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ নেতাদের সাম্প্রদায়িক চিন্তা-চেতনার ফলে। অথচ গভীরভাবে ইতিহাস অধ্যয়ন করলে দেখা যায় ঘটনার উল্টো, সংখ্যাগুরু হিন্দুদের সাম্প্রদায়িক ও বর্ণবৈষম্যের কারণেই সংখ্যালঘু মুসলমানদের মধ্যে আলাদা বসতের চিন্তা জেগে উঠে। তবে তারও একটা ধারাবাহিক ইতিহাস রয়েছে।

নেতা হিসেবে জিন্নাহ ছিলেন আগাগোড়া একজন অসাম্প্রদায়িক মানুষ। যার মাতৃভাষা কোনকালেই উর্দু ছিল না, ছিল গুজরাটি। তার অধিকাংশ বক্তৃতাই ছিল ইংরেজিতে। জিন্নাহ ১৯৪৬ সালের মে পর্যন্ত ঐক্যবদ্ধ ভারতের পক্ষে ছিলেন। তার দাবি ছিল সংখ্যালঘু মুসলমানদের সাংবিধানিক সুরক্ষা ও সমতা। কিন্তু নেহেরু ও কংগ্রেস সাংবিধানিকভাবে সেটা দিতে অস্বীকার করলেন। ফলে সংখ্যালঘু মুসলমানদের নিরাপত্তা, সুরক্ষা ও আত্মনিয়ন্ত্রণের জন্য পাকিস্তান সৃষ্টি অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠল।

২০০৫ সালে ভারতীয় হাইকোর্টের বিচারক Rajinder Sachar এর নেতৃত্ব ‘Sachar Commission’ এর রিপোর্টে ভারতের সংখ্যালঘু-বিশেষ করে মুসলমানদের করুণ ও দূরবস্থার চিত্র ফুটে উঠেছে। যা থেকে যে কোন সুস্থ বিবেকের মানুষ সীদ্ধান্তে আসতে বাধ্য হবে মুসলমানদের আলাদা বসত ১৯৪৭ সালে কত দরকারী ছিল।এই পোস্টে আমরা দেখব কখন থেকে পাকিস্তান সৃষ্টি অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠল।

১৯৪৬ সালের মার্চে ব্রিটিশ সরকারের উদ্যোগে ব্রিটিশ কেবিনেটের ৩ জন সদস্য ভারতে এসে পৌঁছালেন তারা হলেন ভারত সচিব লর্ড পেথিক লরেন্স, মি. এ ভি আলেকজান্ডার এবং স্যার স্টেফোর্ড ক্রিপ্স। সিমলা কনফারেন্স ব্যর্থ হওয়ার পর ৩ সদস্যের কেবিনেট মিশন একটি প্লান ঘোষণা করলো যাকে কেবিনেট মিশন প্লান বলা হয়।

কি ছিল কেবিনেট মিশন প্লানে?

ব্রিটিশ ভারতে যাতে মুসলিম স্বার্থ রক্ষিত হয় আবার হিন্দুদের ইচ্ছা অনুযায়ী ভারতকে ঐক্যবদ্ধ রাখা যায় এই দুটি বিষয়কে সমন্বয়ের চেষ্টা করা হয়েছে কেবিনেট মিশন প্লানে। এই প্লানে প্রদেশগুলোকে গ্রুপিং সিস্টেম নামে একটি বিশেষ ব্যবস্থাধীন করার পরিকল্পনা নেওয়া হল।

গ্রুপ ‘এ’ : মাদ্রাজ, বোম্বে, সংযুক্ত প্রদেশ, বিহার, মধ্য প্রদেশ এবং উড়িষ্যা অর্থাৎ হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকাসমূহ।

গ্রুপ ‘বি’ : পাঞ্জাব, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, সিন্ধু এবং বেলুচিস্তান অর্থাৎ পশ্চিমাঞ্চলের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকাসমূহ।

গ্রুপ ‘সি’ : বাংলা এবং আসাম অর্থাৎ পূর্বাঞ্চলীয় মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকাসমূহ। (উল্লেখ্য, বর্তমান আসামের তুলনায় তৎকালীন আসাম অনেক বড় ছিল, সেভেন সিস্টারের সাতটি প্রদেশের ৫টি আসাম ভেঙ্গে করা হয়েছে ৪৭ পরবর্তী সময়ে, এসব অঞ্চল জনসংখ্যার দিক থেকে খুব কম হলেও বনজ সম্পদের দিক থেকে অনেক সমৃদ্ধ)।

প্রত্যেক গ্রুপের তার নিজের সংবিধান রচনা করার অধিকার থাকবে এবং প্রত্যেক গ্রুপ দেশরক্ষা, বৈদেশিক সম্পর্ক এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা ছাড়া বাকি বিষয়গুলোর উপর পূর্ণ কতৃত্ব থাকবে। দেশরক্ষা, বৈদেশিক বিষয় এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা ‘ভারত ইউনিয়ন’ নামে একটি কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণাধীন থাকবে।কেবিনেট মিশন আরও ঘোষণা করলো যে, ভারতীয় সংবিধান সভা গঠিত না হওয়া পর্যন্ত একটি অন্তর্বর্তীকালীন পার্লামেন্ট হবে, সেখানে মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসকে ৫টি আসন দেওয়া হবে, শিখ ও অচ্ছুৎরা পাবে ১টি করে আসন।

যদিও মুসলমানরা পাকিস্তান আন্দোলনে অনেকদূর এগিয়ে গিয়েছে যেখান থেকে পিছনে আসা কষ্টকর তারপরও জিন্নাহর চাপে মুসলিম লীগ কেবিনেট মিশন প্লান গ্রহণ করতে রাজি হলো। কেবিনেট মিশন প্লান গ্রহণ করার ফলে অনেকে মনে করেন মুসলমানদের জন্য স্বাধীন ভূখণ্ড আদায় করে নেওয়াটা জিন্নাহর মূল উদ্দেশ্য ছিল না। কিছু অঞ্চলে মুসলমানরা মেজরিটি হলেও সামগ্রিকভাবে মুসলমানরা ছিল মাইনরিটি ফলে জিন্নাহ চেয়েছিল মেজরিটির চাপে মুসলমানরা যেন কোণঠাসা হয়ে না থাকে, সুবিধাবঞ্চিত না হয় সেটা যেন নিশ্চিত হয়, হোক সেটা ভারতীয় ইউনিয়নের অধীনে, হোক সেটা স্বাধীনতার মাধ্যমে।

এখানে উল্লেখযোগ্য যে, কেবিনেট মিশন প্লান রচনার ব্যাপারে মাওলানা আজাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। তিনি চেয়েছিলেন গ্রুপ সিস্টেমের মাধ্যমে পাকিস্তানের দাবি আংশিক মিটিয়ে ভারতকে ঐক্যবদ্ধ রাখা। কিন্তু জওহরলাল নেহেরু ঘোষণা করলেন কোনো ধরনের চুক্তিতে আবদ্ধ না হয়ে কংগ্রেস সাংবিধানিক সভায় যোগ দিবে এবং কংগ্রেস চাইলে কেবিনেট মিশন প্লান পরিবর্তন-পরিবর্ধন করতে পারবে। নেহেরুর এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে কেবিনেট মিশন প্লান ব্যর্থ হয়ে গেল।

কেবিনেট মিশন প্লান ভারতকে ঐক্যবদ্ধ রাখলেও অনেক বেশি ভূমিতে মুসলমানদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়ে যেত। ভৌগোলিকভাবে মুসলমানরা অনেক বেশি লাভবান হতো-পশ্চিম পাকিস্তান সমগ্র পাঞ্জাব পেত, পূর্ব পাকিস্তান সমগ্র বাংলা এবং সমগ্র আসাম পেত। ফলে নেহেরু এবং তার কংগ্রেস এটা মেনে নিতে পারল না। নেহেরুর এবং কংগ্রেসের সংকীর্ণ মানসিকতার ফলে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট জন্ম নিল পাকিস্তান নামক মুসলমানদের আলাদা ভূখণ্ড।

মাওলানা আজাদ তার ‘ইন্ডিয়া উইনস ফ্রিডম’ এ লিখেছেন ‘আরও কিছুদিন কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট না থেকে নেহেরুকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করা তার জীবনে বোধহয় সবচাইতে বড় ভুল হয়েছে।’

গান্ধী মুসলমানদের কিছুটা ছাড় দিতে রাজি হলেও নেহেরু ছিল উগ্র হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িক নেতা। নেহেরু মুসলমানদের বঞ্চিত করে রাখার নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন আর জিন্নাহ চেয়েছিল মুসলমানদের জন্য সম মর্যাদা ও সম অধিকার আদায় করে নেওয়া। সেটা না পাওয়াতে মুসলমানরা পাকিস্তান আন্দোলনের মাধ্যমে স্বাধীন ভূখণ্ড আদায় করে নেয় ১৪ আগস্ট ১৯৪৭। পাকিস্তান আন্দোলনের সফলতার মাধ্যমে জমিদারদের নানা অত্যাচার এবং ধর্মীয় বৈষম্যের অবসান ঘটে।

আবুল মনসুর আহমদের ভাষায়

যথাক্রমে ১৪ই ও ১৫ই আগস্ট পাকিস্তান ও ভারত রাষ্ট্রদ্বয়ের জন্ম হইল। ভারতবাসীর স্বাধীনতা সংগ্রামের ফসল ভারত হইল বিভক্ত, পাঞ্জাব বিভক্ত হইল, বঙ্গদেশ বিভক্ত হইল, আসাম বিভক্ত হইল। লক্ষ লোকের কাফেলা বাস্তুভিটা ত্যাগ করিয়া ভিন দেশ পানে যাত্রা করিল। যাত্রাপথে কেউ প্রাণ হারাইল, কেউ স্বদেশেই পলকের মধ্যে বিদেশী হইল ও রাষ্ট্রদ্রোহী আখ্যায় ভূষিত হইল, কেউ মুহূর্তের মধ্যে কাঙ্গাল ভিক্ষুকেও পরিণত হইল, কেউ গৃহহারা ও বাস্তুহারা হইল। সমৃদ্ধশালী অতীত যেন অট্টহাসি হাসিতে লাগিল। একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শীই ইহার নিদারুণ মর্মব্যথা হৃদয়ঙ্গম করিতে পারে, অন্য কেউ নয়। স্বচক্ষে দেখিয়াছি, ব্যথায় জর্জরিত হইয়াছি, কিন্তু প্রতিকার করার ক্ষমতা ছিল না, বিষাক্ত পারিপার্শ্বিকতা অসহায় করিয়া রাখিয়াছিল, মনুষ্যত্ববোধ, বিবেক, শিক্ষাদীক্ষা বিফল ছিল। নারকীয় আচার বাহবা কুড়াইত, পশুত্ব প্রদর্শনই ছিল বীরত্ব।

পাকিস্তানোত্তর রাজনৈতিক সূচনা

১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাব নয়, ১৯৪৬ সালের দিল্লী প্রস্তাব মোতাবেক ভারত খণ্ডিত হইয়া একটি পাকিস্তান রাষ্ট্র কায়েম হইল। ২৭ শে জুন (১৯৪৭) বঙ্গীয় মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটি ঢাকাকে পূর্ববঙ্গের রাজধানী করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ৫ই আগস্ট (১৯৪৭) পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারি পার্টির বৈঠকে খাজা নাজিমুদ্দিন ৭৫-৩৯ ভোটে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে পরাজিত করিয়া পার্লামেন্টারি পার্টির নেতা নির্বাচিত হইলেন। অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও অবিভক্ত বঙ্গীয় মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক আবুল হাশিম ভারতীয় নাগরিকত্ব গ্রহণ করায় আমরা (শহীদ হাশিম গ্রুপ কর্মীবৃন্দ) পূর্ব পাকিস্তান রাজনীতিতে নেতৃত্বহীন হইয়া পড়িলাম।

বিভাগোত্তর সাম্প্রদায়িক কলহ

দেশ বিভাগোত্তরকালে সাম্প্রদায়িক কলহ ভারত ও পাকিস্তানের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার উপর চরম আঘাত হানিল। পূর্ববঙ্গ ও পশ্চিম পাঞ্জাব হইতে হিন্দু জনতা এবং পশ্চিমবঙ্গ ও পূর্ব পাঞ্জাব হইতে মুসলিম জনতা বাস্তুভিটা ত্যাগ করিয়া সর্বস্ব হারাইয়া ভিনদেশে আশ্রয় গ্রহণ করিল। মহাত্মা গান্ধী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গারোধে ব্রতী হইলেন এবং মহানগরী কলিকাতাকে কেন্দ্র করিয়া পাক-ভারত উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িক শান্তি স্থাপন মিশনে আত্মনিয়োগ করিলেন। জনাব হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীও মহাত্মাজীর সহচর হিসাবে যোগদান করিলেন। বিভাগোত্তর কালে হিন্দু মুসলিম সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠায় মহাত্মাজীর প্রচেষ্টাকে উগ্র সাম্প্রদায়িক ভারতীয় রাষ্ট্রীয় সেবক সংঘ অত্যন্ত বিষ নজরে দেখিত। অবশেষে সেবক সংঘেরই অন্যতম সদস্য নাথুরাম গডসের পিস্তলের গুলিতে ৩০শে জানুয়ারি ১৯৪৮ মহাত্মাজী দিল্লীর প্রার্থনা সভায় প্রাণ হারাইলেন। সাম্প্রদায়িক শান্তি প্রতিষ্ঠায় মহাত্মাজীর নৈতিক দায়িত্ববোধ কর্মদ্যোগ মানবকুলে স্মরণীয় হইয়া থাকিবে। গান্ধীজীর নির্মম হত্যাকাণ্ডের অব্যবহিত পর কায়েদ-ই-আজমের উক্তি‘A great Hindu Leader’ বা ‘এক মহান হিন্দু নেতা’ কার্যত, সত্য হইলেও অনেককেই মর্মাহত করিয়াছিল। কলিকাতা ও পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন এলাকায় সংঘটিত মুসলিম নিধনযজ্ঞ বন্ধ করার দাবিতে মহাত্মা গান্ধীর অনশন ব্রত পালনের ফলেই দাঙ্গা প্রশমিত হয় এবং উল্লেখ্য যে, গান্ধীজী ৪ঠা সেপ্টেম্বর জনাব সোহরাওয়ার্দীর হস্তে কমলালেবুর রস গ্রহণ করিয়া অনশন ভঙ্গ করেন।

গান্ধীজী তাঁহার সহজাত শুভবুদ্ধিতে উপলব্ধি করিয়াছিলেন যে, পাক-ভারত সরকারদ্বয়ের মধ্যে সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা নিশ্চিত হইলেই হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িক সৌহার্দ্য প্রতিষ্ঠা সম্ভব। তাই ভারতীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেলের নির্দেশক্রমে ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাংক পাকিস্তানকে দেয় ৫৫ কোটি টাকা পরিশোধ করিতে অস্বীকৃতি জানাইলে মহাত্মা গান্ধী পাকিস্তানকে দেয় টাকা পরিশোধের দাবিতে ও দিল্লীতে মুসলিম নিধনযজ্ঞের প্রতিবাদে পুনঃঅনশন ধর্মঘট ঘোষণা করেন। ধর্মান্ধ উগ্র সাম্প্রদায়িক হিন্দুরা নির্মমভাবে গান্ধীজীর প্রাণ সংহার করিয়া এই মহান প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে ঘৃণ্য প্রতিশোধ গ্রহণ করেন।

বর্ণ হিন্দু সম্প্রদায় সে সময় ব্রিটিশের বিরোধিতার পরিবর্তে চরম তোষণ নীতি বেছে নিয়েছিল। এ ব্যাপারে বহু প্রমাণ রয়েছে। প্রমাণ হিসাবে উদাহরণস্বরূপ ঈশ্বরচন্দ্রগুপ্ত কর্তৃক সম্পাদিত সংবাদ প্রভাকর পত্রিকার ২-৭-১৮৫৮ খ্রিঃ হিন্দুদের রাজভক্তি শিরোনামে সম্পাদকীয়টির কিছু অংশ নিচে তুলে ধরা হল- ‘শ্রীযুক্ত কেদার নাথবাবু বিদ্যোৎসাহী নব যুবক ব্যক্তি। তিনি ‘হিন্দু জাতির রাজভক্তি’ নামক একখানি অভিনব গ্রন্থ প্রকাশ করিয়াছেন। আমরা উক্ত গ্রন্থ পাঠ করিয়া অতিশয় সন্তুষ্ট হইয়াছি। যেহেতু যথার্থ পক্ষে এই পুস্তক নিজ নামের অর্থ প্রকাশ করিতেছে। রাজভক্ত প্রজাগণ এই গ্রন্থ পাঠ করিলে পর তাহাদিগের অন্তরে স্বরূপ রাজভক্তি উদ্দীপিত হইবে সন্দেহ কি? অনুরোধ করি এই পুস্তক ক্রয় করতঃ আপনারা রাজভক্তি বিষয়ে সদুপদেশ গ্রহণ করুন এবং গ্রন্থ কর্তাকে সমুচিত উৎসাহ দিন। অধিকন্তু উক্ত গ্রন্থ সমগ্ররূপে প্রচারিত হইলে পর প্রজাগণের প্রতি ও সবিশেষ রাজানুগ্রহ প্রকাশ পাইবে তাহাতে সন্দেহ নাই।”

এখানেই শেষ নয়, বর্ণহিন্দুদের দাবির নিকট নতি স্বীকার করে ১৯১১ সালের ১১ই ডিসেম্বর গুজরাট পঞ্চম জর্জ ও রাণী মেরীর দিল্লীর দরবারে বঙ্গভঙ্গ রদ করেন। এতে আনন্দে উল্লসিত হয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পঞ্চম জর্জের প্রশংসায় রচনা করেন ‘জনগণ মন অধিনায়ক হে ভারত ভাগ্য বিধাতা’.. গানটি। প্রভুদের এমন স্তুতিতে তারা কি খুশি না হয়ে পারে?

বৃটিশ শাসকগোষ্ঠী হিন্দুদের কল্যাণে এগিয়ে এসেছিল গোড়া থেকেই। হিন্দুদের পক্ষে কল্যাণের প্রথম পদক্ষেপ ছিল তাদের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত। ১৭৯৩ সালে লর্ড কর্নওয়ালিশ চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রথা প্রবর্তন করেন। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ব্যবস্থার মৌল উদ্দেশ্যই ছিল অধস্তন হিন্দু অফিসারদের জমির মালিক হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করা। এই বন্দোবস্ত প্রথা চালু হওয়ার ফলে ‘যে সব হিন্দু কর আদায়কারী ওই সময় পর্যন্ত নিম্ন পদের চাকরিতে নিযুক্ত ছিল, নয়া ব্যবস্থার বদৌলতে তারা জমিদার শ্রেণীতে উন্নীত হয়। নয়া ব্যবস্থা তাদেরকে জমির উপর মালিকানার অধিকার এবং সম্পদ আহরণের সুযোগ সুবিধা প্রদান করে, অথচ মুসলমানরা নিজেদের শাসনামলে এই সুযোগ সুবিধাগুলোই একচেটিয়া ভাবে ভোগ করছে।’

বৃটিশদের এমন চক্রান্তই ভারত ভাঙ্গার পেছনে পরবর্তীতে অন্যতম চালিকা শক্তি হিসাবে কাজ করেছে।

চাকরির ক্ষেত্রে বাংলায় মুসলমানদের অবস্থা ছিল বড়ই করুণ। কয়েকটি বিভাগে ১৯৬৯ সালে চাকরির আনুপাতিক হার দেখলেই অনুভব করা সম্ভব কিভাবে মুসলমানদের সব জায়গায় কোণঠাসা করে রাখা হয়েছিল। অ্যাসিস্ট্যান্ট গভর্নমেন্ট ইঞ্জিনিয়ারের তিনটি গ্রেডে হিন্দুর সংখ্যা ছিল ১৪ জন, মুসলমান একজনও নয়, শিক্ষানবিশী পর্যায়ে হিন্দু চার ও ইংরেজ দুই জন, কিন্তু মুসলমান একজনও নয়। সাব ইঞ্জিনিয়ার গণপূর্ত বিভাগের সুপার ভাইজার পদে হিন্দু ২৪ জন আর মুসলমান একজন, ওভারসিয়ার পদে মুসলমান ২ জন আর হিন্দু ৬৩ জন। অ্যাকাউন্টস অফিসার পদে হিন্দু ৫০ জন কিন্তু মুসলমান এক জনও নয় এবং আপার সাবর্ডিনেট ডিপার্টমেন্টে হিন্দু ২২ জন, কিন্তু মুসলমানের সংখ্যা শূন্যের কোঠায়। (দি ইন্ডিয়ান মুসলমান)

এ রকম হওয়ার কারণ এটা ছিল না যে, মুসলমানদের চাইতে হিন্দুরা অধিকতর যোগ্য ছিল। বরং অন্যায়ভাবে উচ্চস্তরের বা নিম্নস্তরের সমস্ত চাকরি ক্রমান্বয়ে মুসলমানদের হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে অন্যান্য সম্প্রদায়ের মধ্যে, বিশেষ করে হিন্দুদের মধ্যে বিতরণ করা হয়েছে। এভাবে পূর্ব বাংলার মুসলমানদের উপরে যে উপেক্ষা ও অপমানজনক ব্যবহার প্রদর্শিত হয়েছিল, আধুনিক ভারতীয় সাহিত্যে তার যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে। মুসলমানদের প্রতি এই অপমানজনক আচরণ হিন্দু থেকে আলাদা হবার অন্যতম প্রধান কারণ ছিল।

ভারতীয়দের আগাগোড়া চক্রান্ত ছিল ভারতে বসবাসকারী মুসলমানদেরকে তাদের নিজস্ব জীবনবোধ ও জীবনাচার থেকে দূরে রাখা। ১৮৮৭ সালের মাদ্রাজে যে কংগ্রেস অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয় সে সভাতে লালা লাজপত রায় বলেছিলেন, মুসলমানরা এখানে বহিরাগত। তারা যদি হিন্দুদের আচার বিধি পালন না করে তবে ভারতে তাদের বসবাস করতে দেওয়া উচিত নয়। বৈদিক ধর্মের প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠাই ছিল আর্য সমাজের উদ্দেশ্য।

আমরা দেখি ১৯৩৮ সালের ৪ঠা এপ্রিল যুক্ত প্রদেশের আইন সভায় প্রদত্ত ভাষণে প্রাদেশিক শিক্ষামন্ত্রী মি. সম্পরনানন্দ বলেন, ‘হিন্দু কিংবা মুসলিম সভ্যতাকে কায়েম রাখা এবং তা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে চালু করার জন্য যিনিই পীড়াপীড়ি করেন, তিনি নিশ্চিতভাবে ভারতের ক্ষতি সাধনে লিপ্ত।

আমরা বলতে চাই যে, আজকের ভারতে এ উপসর্গটা না থাকাই বাঞ্ছনীয়। আমরা এমন একটা ভারতীয় সভ্যতা চাই, যা হিন্দু, মুসলমান, অন্য ধর্মাবলম্বী এবং যে কোন বহিরাগতরা যে ভারতকে নিজের আবাস ভূমি করে নিয়েছে-এ সকলের জন্যই এক ও অভিন্ন।’ হিন্দু মুসলমান সবইকে এক দেহে লীন করার হিন্দু ষড়যন্ত্র ছিল ভারত ভঙ্গের আর একটি কারণ।

ইতিহাস সত্যিই বিচিত্র। যে হিন্দুরা লর্ড কার্জনের বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা করেছিল তারাই আবার নিজ স্বার্থে বাংলা বিভক্তি সম্পন্ন করল। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ১৯৪৭ সালের ২৭শে এপ্রিল অখণ্ড স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব উত্থাপন করেন। বাংলার কংগ্রেসের অন্যতম অসাম্প্রদায়িক নেতা মিঃ বসু, কিরণ শঙ্কর রায়সহ আরও অনেকে এ প্রস্তাবের প্রতি সম্মতি জানান। সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক সংগঠন ‘হিন্দু মহাসভা’ এবং কংগ্রেসের প্রতিক্রিয়াশীল অবাঙালী নেতাগণ এর বিরোধিতা শুরু করেন। ফলে পরিকল্পনাটি বেশি দূর অগ্রসর হতে পারেনি। ১৯৪৭ সালের ৩রা জুন লর্ড মাউন্ট ব্যাটেন ভারত বিভাগের নীতি ঘোষণা করেন। এক দিকে কংগ্রেস হাইকমান্ডের বিরোধিতা এবং অন্যদিকে কংগ্রেস লীগের পাকিস্তান দাবি মেনে না নেয়ায় পরিস্থিতি পাল্টে যায়। এ ভাবে বসু -সোহরাওয়ার্দীর অখণ্ড স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলা রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যাত হয়। ভাইসরয়ের পক্ষে লর্ড ইজমে জিন্নাহকে জানিয়ে দিলেন,“ If India was to be divided, Bengal and Panjab would also have to be split in two,`according to the will of the people. এ সব অবস্থার প্রেক্ষপটে জিন্নাহ বলতে বাধ্য হলেন- ‘Better a month- eaten Pakistan that no Pakistan at all.’

এ ভাবেই ইতিহাসের অনেক চড়াই উৎরাই পার হয়ে ১৯৪৭ সালের ১৪ ও ১৫ই আগস্ট বৃটিশ ভারত বিভক্ত হয়ে পাকিস্তান ও ভারত নামক দু’টি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয়।

(দ্য রিপোর্ট/সাআ/কেএনইউ/এনআই/আগস্ট ১৪, ২০১৭)

পাঠকের মতামত:

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

M

M

SMS Alert

এর সর্বশেষ খবর

- এর সব খবর