thereport24.com
ঢাকা, রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১,  ২০ জমাদিউস সানি 1446

রাজস্ব নিয়ে ওইমেক্স ইলেকট্রোডসের প্রতারণা

২০১৭ আগস্ট ১৬ ২১:০৮:১৩
রাজস্ব নিয়ে ওইমেক্স ইলেকট্রোডসের প্রতারণা

দ্য রিপোর্ট প্রতিবেদক : সরকারের কোষাগারে রাজস্ব না দিয়েই আর্থিক হিসাবের নগদ প্রবাহ হিসাবে অর্থ প্রদান করা হয়েছে বলে প্রতারণা করেছে ওইম্যাক্স ইলেকট্রোডস কর্তৃপক্ষ। ভুল করে এমন আর্থিক হিসাব দেখানো হয়েছে বলে দাবি কোম্পানির প্রধান অর্থ কর্মকর্তা (সিএফও) মো. ইকরামুল ইসলামের। এ ছাড়াও কোম্পানিটির আর্থিক হিসাবে নানা অসঙ্গতি রয়েছে। এমতাবস্থায় প্রতিষ্ঠানটি আগামি ৫ সেপ্টেম্বর থেকে প্রাথমিক গণপ্রস্তাবে (আইপিও) চাঁদা সংগ্রহ করতে যাচ্ছে।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সাবেক চেয়ারম্যান ড. এ.বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, শেয়ারবাজার থেকে টাকা উত্তোলনের লক্ষ্যে অনেক কোম্পানি প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) এক দুই বছর আগে থেকে কৃত্রিমভাবে মুনাফা বাড়িয়ে দেখায়। এই ধরনের প্রবণতা বন্ধে ৫ থেকে ১০ বছরের আর্থিক হিসাব পরীক্ষা করা প্রয়োজন বলে জানান তিনি।

প্রসপেক্টাস অনুযায়ি, ২০১৪-১৫ অর্থবছরের নগদ প্রবাহ হিসাবে রাজস্ব বা করবাবদ সরকারি কোষাগারে ৪১ লাখ ৭৩ হাজার টাকা প্রদান করা হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু ব্যালেন্স শীটে অগ্রিম কর প্রদানে মাত্র ১৩ লাখ ৫৩ হাজার টাকার হিসাবে পাওয়া গেছে। বাকি ২৮ লাখ ২০ হাজার টাকার কোন হিসাব নাই।

অন্যদিকে নোট ৭.০২ এ অগ্রিম করের সঙ্গে ৪১ লাখ ৭৩ হাজার টাকা সমন্বয় করা হয়েছে বলে উল্লেখ করা হলেও নোট ১৭.০১-এ ৩৬ লাখ ৭৩ হাজার টাকা সমন্বয় দেখানো হয়েছে। আর বাকি ৫ লাখ টাকা নগদ প্রদান বলে উল্লেখ আছে। এ হিসাবে একই বিষয়ে ২ রকম তথ্য প্রকাশ করা বিএএস-১ লংঘন করা হয়েছে।

কোম্পানিটির নগদ প্রবাহের বিক্রয়বাবদ গ্রাহকের কাছ থেকে অর্থ আদায় হিসাবেও রয়েছে গরমিল। ২০১১-১২ অর্থবছরে টাকা আদায় সঠিক থাকলেও পরের বছরগুলোতে রয়েছে গরমিল। ২০১২-১৩ অর্থবছরে ৯ কোটি ৮৫ লাখ টাকার বিক্রয় হয়েছে। এরমধ্যে বাকিতে হয়েছে ৩ কোটি ৮ লাখ টাকার। এ হিসাবে নগদ প্রবাহ হিসাবে গ্রাহকের কাছ থেকে ৬ কোটি ৭৭ লাখ টাকা আদায় হওয়ার কথা থাকলেও ৬ কোটি ৭৯ লাখ টাকা দেখানো হয়েছে। এ ছাড়া ওয়েস্টেজ পণ্য বিক্রয় বিবেচনায় নিলেও নগদ প্রবাহের সাথে গরমিল থাকছে। একইভাবে পরবর্তী অর্থবছরগুলোতেও গরমিল আর্থিক হিসাব দেখানো হয়েছে।

এদিকে বিএএস-৭ অনুযায়ি, ওয়েটেড শেয়ার দিয়ে শেয়ারপ্রতি নগদ প্রবাহ হিসাব করতে হয়। কিন্তু ওইম্যাক্স ইলেকট্রোডস কর্তৃপক্ষ মোট শেয়ার বিবেচনায় এ হিসাব করেছে। যাতে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে শেয়ারপ্রতি নগদ প্রবাহ ১.০৮ টাকার পরিবর্তে ০.৮৭ টাকা ও ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ০.৩১ টাকার পরিবর্তে ০.২৭ টাকা দেখানো হয়েছে।

কোম্পানির প্রধান অর্থ কর্মকর্তা (সিএফও) মো. ইকরামুল ইসলাম বলেন, নগদ প্রবাহ হিসাবে ভুল হয়ে গেছে। নগদ প্রবাহ হিসাবে ওয়েটেড শেয়ার দিয়ে পার শেয়ার ক্যাশ ফ্লো নির্ণয় করার নিয়ম থাকলেও তা করা হয়নি। তবে কমিশন চাইলে এ হিসাব করে দেওয়া হবে। আর ওয়েস্টেজ পণ্য বিক্রয় বিবেচনায় নিলে বিক্রয়বাবদ অর্থ আদায় হিসাব গরমিল থাকবে না বলে জানান।

প্রসপেক্টাসের ৫২ পৃষ্টা অনুযায়ি, ২০১৪-১৫ অর্থবছরের শুরুতে শেয়ার মানি ডিপোজিট ছিল ১১ কোটি টাকা এবং ১২৭ পৃষ্টানুযায়ি, এ অর্থবছরে আরও ১০ কোটি ৮ লাখ টাকা সংগ্রহ করা হয়। কিন্তু নোট ১১তে ২০১৪-১৫ অর্থবছরের শুরুতেই ২১ কোটি ৮ লাখ টাকা ছিল এবং এ অর্থবছরে গ্রহণ করা হয়নি বলে তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। এ হিসাবে শেয়ার মানি ডিপোজিট নিয়ে ২০১৪-১৫ অর্থবছরের হিসাবে দুই রকম তথ্য প্রকাশের মাধ্যমে বিএএস-১ লংঘন করা হয়েছে।

২০১৪ সালের ৩০ জুন কোম্পানির দীর্ঘমেয়াদি ঋণের কারেন্ট পোরশন হিসাবে ছিল ১২ লাখ ১৬ হাজার টাকা। যা ২০১৪-১৫ অর্থবছরে আরও ৯ লাখ ৪৪ হাজার টাকা গ্রহণ করা হয়। এ হিসাবে ২০১৫ সালের ৩০ জুনে দাড়ায় ২১ লাখ ৬০ হাজার টাকা। যা ব্যালেন্স শীটেও দেখানো হয়েছে। একইভাবে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে কারেন্ট পোরশন হিসাবে ১ কোটি ১৮ লাখ টাকা সংগ্রহসহ মোট ঋণের পরিমাণ দাড়ায় ১ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। কিন্তু ব্যালেন্স শীটে ৬৯ লাখ ১৬ হাজার টাকা দেখানো হয়েছে।

ভুল রিটার্ন অন ইক্যুইটি দেখিয়ে আসছে ওইম্যাক্স ইলেকট্রোডস। মুনাফাকে গড় ইক্যুইটি দিয়ে ভাগ করে রিটার্ন অন ইক্যুইটি দেখাতে হয়। কিন্তু ওইম্যাক্স কর্তৃপক্ষ বছর শেষের ইক্যুইটি দিয়ে রিটার্ন অন ইক্যুইটি নির্ণয় করে। যা প্রকৃত চিত্র দেখায় না।

ওইম্যাক্স ইলেকট্রোডসের ইস্যু ম্যানেজার এমটিবি ক্যাপিটাল শেষ ৫ বছরে শুধুমাত্র জাহিন স্পিনিংকে শেয়ারবাজারে এনেছে। যে কোম্পানিটি শেয়ারবাজারে আসার পরে ২ বার লভ্যাংশ ঘোষণা করলেও একবারও নগদ দিতে পারেনি। এ ছাড়া ২০১৪ সালে ১৫ শতাংশ বোনাস শেয়ার দিলেও পরের দেড় বছরে (জানুয়ারি ১৫-জুন ১৬) ১৫ শতাংশ দিয়েছে। এ হিসাবে ৫০ শতাংশ লভ্যাংশ কমে এসেছে।

২০১০ সালের ২১ মার্চ উৎপাদন শুরু করা ওইম্যাক্স ইলেকট্রোডস ব্যবসায় শুরুর ১৫ মাসে (২১ মার্চ ২০১০-জুন ২০১১) ৪৮ লাখ ৯ হাজার টাকা মুনাফা করেছে। মাত্র ৪ লাখ টাকার ইক্যুইটি দিয়ে কোম্পানিটি এই অস্বাভাবিক মুনাফা করেছে। কিন্তু পরবর্তী অর্থবছর ২০১১-১২ তে ৫২ লাখ ৯ হাজার টাকার ইক্যুইটি দিয়ে মুনাফা করেছে ২৪.৪২ লাখ টাকা।

হিসাববিদদের মতে, বিএএস-৩৬ অনুযায়ি যেকোনো প্রতিষ্ঠানের ইমপেয়ারম্যান্ট লস হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু কোম্পানিগুলো তা না করে সম্পদ ও মুনাফা বেশি দেখায়। এ ক্ষেত্রে ওইম্যাক্স ইলেকট্রোডসও এর ব্যতিক্রম না। কোম্পানিটিও সম্পদ এবং মুনাফা বেশি দেখিয়ে আসছে।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) করপোরেট গভর্নেন্স ফাইন্যান্সিয়াল বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, যেকোন কোম্পানির ক্ষেত্রে ইমপেয়ারমেন্ট লস হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু কোম্পানিগুলো গতানুগতিকভাবে তা না করে মুনাফা ও সম্পদ বেশি দেখিয়ে থাকে।

২০১৩-১৪ অর্থবছরের তুলনায় ২০১৪-১৫ অর্থবছরে অস্বাভাবিকভাবে ২০৫ শতাংশ বেড়ে বিক্রয় হয়েছে ৩৮ কোটি ৬৭ লাখ টাকার। তবে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বেড়েছে মাত্র ৬ শতাংশ।

কোম্পানির সিএফও মো. ইকরামুল ইসলাম বলেন, টাইপিং মিসটেকের কারনে শেয়ার মানি ডিপোজিটে এ ভুল হয়েছে। রিস্টেট ইপিএসে ভুল হয়েছে এবং তা পরে সংশোধন করা হয়েছে। তবে প্রসপেক্টাসে এ সংশোধন দেখাতে পারেননি। ব্যাংক কর্তৃপক্ষ যেভাবে বলেছে, সেভাবেই ঋণের কারেন্ট পোরশন দেখানো হয়েছে বলে জানান তিনি। তবে কেনো মিলছে না বা গরমিল রয়েছে তার কোন ব্যাখ্যা তার জানা নাই বলে জানিয়েছেন।

রিটার্ন অন ইক্যুইটি সঠিকভাবে করা হয়নি বলে জানিয়েছেন ইকরামুল হোসেন। এ ছাড়া ইমপেয়ারম্যান্ট টেস্ট করা হয়নি। আর কনস্ট্রাকশন জটিলতায় ২০১১-১২ অর্থবছরে মুনাফা কমে আসে। এ ছাড়া সব সময় পরিশোধ করে দেওয়ায় দেনাদারকে সিকিউরড বলে উল্লেখ করা হয়।

২০০৫ গঠিত কোম্পানিটির উৎপাদন শুরু হয় ২০১০ সালে। যে কোম্পানিটি শেয়ারবাজার থেকে উত্তোলিত টাকা ১২ মাসের মধ্যে ব্যবহার করবে।

(দ্য রিপোর্ট/আরএ/এজে/আগস্ট ১৬, ২০১৭)

পাঠকের মতামত:

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

M

M

SMS Alert

এর সর্বশেষ খবর

- এর সব খবর