thereport24.com
ঢাকা, সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১,  ২১ জমাদিউস সানি 1446

নজরুলের ছোটগল্প : কতিপয় বিবেচনা-৩

২০১৮ মে ২৬ ০০:০৬:০৭
নজরুলের ছোটগল্প : কতিপয় বিবেচনা-৩

গাজী মোঃ মাহবুব মুর্শিদ

(পূর্ব প্রকাশের পর)

নজরুল-গবেষক আবদুল মান্নান সৈয়দের প্রাসঙ্গিক বক্তব্য উদ্ধৃতিযোগ্য :

কবিতার মতন ছোটগল্পেও নজরুল এনেছিলেন যুদ্ধের আবহ। ফলে বাঙালি গল্পপাঠক নজরুল ইসলামের ব্যাথার দান গল্পগ্রন্থে একটি আশ্চর্য নতুনত্বের সন্ধান পেয়েছিল। এই বই অসম্ভব লোকপ্রিয়ও হয়েছিল। হয়তো তার বিদেশী আবহের জন্য, হয়তো রোমান্টিকতার জন্য। (মান্নান ২০০৭ : ৪৭)

‘ব্যাথার দান’ গল্পে প্রতিফলিত নজরুল-মানসের একটি বিশেষ দিকের প্রতি দৃষ্টিপাত করে আমরা এই পর্যায়ের আলোচনা শেষ করতে চাই। গল্পটির অন্যতম চরিত্র সয়ফুল্-মুল্ক ত্রিভুজ প্রেমের এক জটিল পরিস্থিতিতে যুদ্ধে যোগ দিতে মনস্থির করে। যোগদানের পরে গল্পটির আরেকটি চরিত্র দারার সঙ্গে তার একই সৈন্যদলে দেখা হয়। এই সেনাবাহিনী সম্পর্কে সয়ফুল্-মুল্‌কের নিম্নরূপ স্মৃতিকথনটি তাৎপর্যবহ :

ঘুরতে ঘুরতে শেষে এই মুক্তিসেবক সৈন্যদের দলে যোগ দিলুম। এ পরদেশীকে তাদের দলে আসতে দেখে এই সৈন্যদল খুব উৎফুল্ল হয়েছে। এরা মনে করেছে, এদের এই মহান নিঃস্বার্থ ইচ্ছা বিশ্বের অন্তরে অন্তরে শক্তি সঞ্চয় করছে। আমায় আদর করে এদের দলে নিয়ে এরা বুঝিয়ে দিলে যে, কত মহাপ্রাণতা আর পবিত্র নিঃস্বার্থপরতা-প্রণোদিত হয়ে তারা উৎপীড়িত বিশ্ববাসীর পক্ষ নিয়ে অত্যাচারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে এবং আমিও সেই মহান ব্যক্তিসঙ্ঘের একজন। (ন. র. ১ : ১৯৬)

নজরুল-সুহৃদ কমরেড মুজাফ্‌ফর আহম্মদ তাঁর কাজী নজরুল ইসলাম : স্মৃতিকথা গ্রন্থে বলেছেন, নজরুল তাদের কাছে প্রেরিত গল্পে ‘লালফৌজ’ নামে সৈন্যদলের নামকরণ করেছিলেন। ১৯১৭ সালে সংঘটিত রুশ ‘বিপ্লবকে বাঁচাবার জন্যে রুশ দেশের ভিতরে মজুর শ্রেণীর পার্টি ও সোবিয়েৎ রাষ্ট্রের নেতৃত্বে জনগণ যে-সৈন্যদল গঠন করেছিল তার নাম দেওয়া হলো ‘লালফৌজ’। (মুজাফ্‌ফর ১৯৯৫ : ১০৫) গল্পটির এই রূপান্তর-প্রক্রিয়া প্রসঙ্গে মুজাফ্ফর আহ্মদের বক্তব্য :

নজরুল ইসলাম যখন ‘ব্যাথার দান’ গল্পটি আমাদের নিকটে পাঠিয়েছিল তখন তাতে এই দুজনের লালফৌজে যোগ দেওয়ার কথাই ... ছিল। আমিই তা থেকে ‘লালফৌজ কেটে দিয়ে তার জায়গায় ‘মুক্তিসেবক সৈন্যদের দল’ বসিয়ে দিয়েছিলেম। ১৯১৯ সালে ব্রিটিশ ভারতে ‘লালফৌজ’ কথা উচ্চারণ করাও দোষের ছিল। সেই ‘লালফৌজে’ ব্রিটিশ ভারতের লোকেরা যে যোগ দেবে, তা যদি গল্পেও হয়, তা পুলিশের পক্ষে হজম করা মোটেই সহজ হতো না। ... তাই আমি নজরুলকে জিজ্ঞাসা না করেও তার ‘লালফৌজ’ কথা কেটে দিয়েছিলেম। তার জায়গায় ‘মুক্তিসেবক সৈনদের দল’ এই ভেবে লিখে দিয়েছিলেম যে যার যা খুশী তিনি তাই বুঝে নিবেন। কিন্তু এখন ব্যাথার দান পুস্তকের ‘ব্যথার দান’ গল্পে ‘মুক্তিসেবক সৈন্যদের দল’ কথাটার জায়গায় নজরুলের গোড়ায় লেখা ‘লালফৌজ’ কথাটা বসিয়ে দেওয়া একান্ত কর্তব্য। এ কথা মনে রাখতে হবে যে নজরুলের লেখা ‘ব্যথার দান’ আমার হাত দিয়েই ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা’য় ছাপা হয়েছিল। (মুজাফ্‌ফর ১৯৯৫ : ১০৪-১০৫)

উল্লেখ্য, মুজাফ্‌ফর আহম্মদ তখন পত্রিকাটির সহকারী সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলেন। নজরুল-চরিতমানস রচয়িতা ডক্টর সুশীলকুমার গুপ্ত অবশ্য এ বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করেন। (দ্র. সুশীলকুমার ২০০৭ : ৪১-৪৩) এখানে এ দুজন নজরুল-বিশেষজ্ঞের দৃষ্টিভঙ্গির চুলচেরা বিশ্লেষণের সুযোগ নেই। তবে আমরা এটুকু বলতে পারি, নজরুল ইসলামের স্কুল-জীবনে বিপ্লবী আন্দোলনের সংযোগ সহ তাঁর অপরাপর সাহিত্যকর্ম ও জীবনদর্শন মুজাফ্‌ফর আহম্মদের বক্তব্যকেই সমর্থন করে। পাশাপাশি এ কথাও বলতে হয়, নজরুলের জীবদ্দশায় অপরিবর্তিত রচনাকে সংশোধনের নামে কাঁটাছেড়া করাকেও আমরা অনুমোদনযোগ্য মনে করি না।

ব্যথার দান অপেক্ষা রিক্তের বেদন তুলনামূলক পরিণত সৃষ্টিকর্ম। ব্যক্তির অন্তর্গত হৃদয়াবেগের পাশাপাশি সমষ্টি তথা সমাজমানসের প্রতিচ্ছবিও এখানে লক্ষ করা যায়। ‘স্বামীহারা’ ও ‘রাক্ষুসী’ এই গ্রন্থের দুটি বিশিষ্ট গল্প। বাঙালি মুসলমান সমাজকে নিয়ে ‘স্বামীহারা’ রচিত এবং বীরভূমের বাগদী সমাজকে কেন্দ্র করে রাক্ষুসী সৃষ্ট।

বাংলা সাহিত্যে বিচিত্র বিধবা নারীর সংকট মূলত হিন্দুসমাজ কেন্দ্রিক। নজরুল ‘স্বামীহারা’ গল্পে তুলে ধরলেন বিধবা মুসলিম রমণীর জীবন-যন্ত্রণার স্বরূপ। প্রকৃতপক্ষে, বলতে গেলে বাংলা সাহিত্যে এই প্রথম ‘নজরুলের গল্পের বাতাবরণে গ্রামবাংলা, দরিদ্র-মুসলমান চরিত্র সরাসরি হাজির হয়েছে।’ (কৃষ্ণরূপ ২০১৪ : ২৩৯) গ্রামের বেগম নামের এক নিম্নবিত্ত বিধবা নারীর মুখে গল্পটি ভাষারূপ পেয়েছে। অভিজাত সৈয়দ বংশের শিক্ষিত উদার মনের যুবক আজিজের সঙ্গে বেগমের বিয়ে হয়েছিল। আজিজের মা তার সইয়ের মেয়েকে সানন্দে ঘরে এনেছিলেন বংশ দেখে নয়, বরং গুণাবলি বিচার করে। কিন্তু তথাকথিত সমাজপতিরা বিষয়টি ভালোভাবে নেননি যদিও প্রভাবশালী সৈয়দ পরিবারের বিরুদ্ধে খুব বেশি প্রতিক্রিয়া দেখানোর সাহস তাদের ছিল না। নজরুল সমাজ-মানসের এই প্রবণতার স্বরূপকে যথার্থই চিহ্নিত করেছেন এ গল্পে :

সমাজ শুধু চোখ রাঙাতেই জানে। যে যত দুর্বল তার তত জোরে টুটি চেপে ধরতেই সমাজ ওস্তাদ। সেখানে উল্টো সমাজকেই চোখ রাঙিয়ে চলবার মতো শক্তিসামর্থ্যওয়ালা লোক বুক ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, সেখানে সমাজ নিতান্ত শান্তশিষ্টের মতোই তার সকল অনাচার আবদার বলে সয়ে নিয়ে থাকে। (ন. র. ২ : ২৯০)

ভারতীয় হিন্দু-সমাজ কাঠামোর প্রচলিত জাতিভেদ-প্রথা মুসলিম সমাজকেও অল্পবিস্তর স্পর্শ করেছিল। ‘আশরাফ-আতরাফ’ - বিবেচনা ইসলামের সাম্যবাদী ধ্যানধারণার বিপ্রতীপে হলেও বাঙালি মুসলমান এই সীমাবদ্ধতা থেকে একেবারে মুক্ত ছিল না। নজরুল ‘স্বামীহারা’ গল্পে সমাজ ব্যবস্থার এই ত্রুটিটিকেও তুলে ধরতে চেয়েছেন। বেগম-এর মতো ‘নিম্নজাতের আতরাফ’ মেয়ে সৈয়দবাড়ির বৌ হলে সমাজ এ জন্যই রক্তচক্ষু হানতে চায়। আর এ জন্যই ‘জাতের নামে বজ্জাতি সব জাত - জালিয়াৎ খেলছে জুয়া’র লেখকের প্রতিবাদ এই গল্পে বেগম এর শ্বশ্রুমাতার উচ্চারণে এভাবেই উপস্থাপিত হয়েছে :

জাত নিয়ে কি ধুয়ে খাব? আর জাত লোকের গায়ে লেখা থাকে ? যার চালচলন শরিফের মতো সেই তো আশরাফ। খোদা কিয়ামতের দিনে কখখনো এমন বলবেন না যে, তুমি সৈয়দ সাহেব, তোমার সব ‘সওয়াব’ (পুণ্য) বাজেয়াপ্ত হয়ে গেছে, কাজেই তোমার কপালে তো জাহান্নাম ধরাবাঁধা ! আমি চাই শুধু গুণ, তা সে যে জাতই হোক না কেন। (ন. র. ২ : ২৯৩)

কাহিনির ধারাবাহিকতায় দেখা যায়, গ্রামে কলেরা আর বসন্তের যৌথ আক্রমণে মহামারী শুরু হলে পরোপকারী আজিজের মৃত্যুতে বেগম স্বামীহারা হয়ে বিধবা হয়। আর স্বামীর মৃত্যুর জন্য সংকীর্ণ-হৃদয়ের কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষেরা বেগমকে ও তার নীচু জাতকেই দায়ী করে, তাকে স্বামীগৃহ ত্যাগে বাধ্য করে। ‘স্বামীহারা’ গল্পে এক হতভাগ্য বিধবার জবানীতে বাংলার শত-সহস্র বিধবার ট্রাজেডী রূপায়িত হয়েছে।’ (রফিকুল ২০১২ : ৮২৪) স্বামী-সংসার-গৃহ সব হারিয়ে এই নারী তাই মৃত্যু মুখে আর এক নারী সলিমার কাছে ক্ষুব্ধ ফরিয়াদ জানায় - ‘খোদা যেন মেয়েদের বিধবা করবার আগে মরণ দেন, তা নইলে তাদের বে’ হবার আগেই যেন তারা ‘গোরে’ যায় ! (ন. র. ২ : ২৮৫) আবেগের বাহুল্য, কিছুটা অতিকথন সত্ত্বেও ‘স্বামীহারা’ নজরুলের অন্যতম শ্রেষ্ঠ গল্প। এই গল্প সম্পর্কে সমালোচকদের উদ্ধৃত মন্তব্যটি যথার্থ বলেই মনে করি :

গল্পকার নজরুল সুকৌশলে স্বামীহারা এক মুসলিম বিধবার অন্তর্বেদনাকে পাঠকচিত্তে সঞ্চার, সমবেদনা ও সহানুভূতির উদ্রেক করেছেন। বেগম কোনো এক বিশেষ নারী নয় - সর্বযুগের সর্বকালের অসহায় লাঞ্ছিতা স্বামীহারা নারীর প্রতিভূ। ... এই গল্পের প্লট সুসংহত ও সুবিন্যস্ত। চরিত্র সৃষ্টির ক্ষেত্রেও লেখকের দক্ষতার স্বাক্ষর মুদ্রিত। (সিরাজ ১৯৯০ : ৮৯)

(ক্রমশ)

লেখক: অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।

(দ্য রিপোর্ট/একেএমএম/মে ২৫,২০১৮)

পাঠকের মতামত:

SMS Alert

সাহিত্য এর সর্বশেষ খবর

সাহিত্য - এর সব খবর