thereport24.com
ঢাকা, শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১,  ২১ জমাদিউল আউয়াল 1446

আশুরা : তাৎপর্য, করণীয় ও বর্জনীয়

২০১৮ সেপ্টেম্বর ২১ ১৫:২৪:৫০
আশুরা : তাৎপর্য, করণীয় ও বর্জনীয়

মাহফূজ আল-হামিদ

হিজরী চান্দ্রবর্ষের প্রথম মাস মুহাররাম। ‘মুহাররাম’ শব্দের অর্থ- অলঙ্ঘনীয় পবিত্র। ইসলামে এ মাসটি চার সম্মানিত মাসের অন্যতম। আর মুহাররাম মাসের ১০ তারিখ আশুরা নামে সু-পরিচিত। আরবীতে ‘আশারা’ মানে ১০, আর সে কারণে দিনটিকে ‘আশুরা’ বলে অভিহিত করা হয়। ইসলামে আশুরা একটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় দিবস। মুহাররামের ৯ তারিখ দিবাগত রাত থেকে আশুরা উদযাপন শুরু হয়। ইসলামের ইতিহাসে এই দিনটি বিভিন্ন কারণে বিশেষ তাৎপর্যমণ্ডিত, মর্যাদাময় ও শোকাবহ। বহু ঐতিহাসিক ঘটনা এই তারিখে সংঘটিত হয়েছিল। পৃথিবী সৃষ্টির শুরু থেকেই ১০ই মুহাররাম বা আশুরা দিবসের একটি বিশেষ গুরুত্ত্ব পরিলক্ষিত হয়ে আসছে। মুহাররামে রয়েছে অনেক বিজয় আর গৌরবমাখা ঐতিহ্যের স্মৃতি।

আশুরা ও মুহাররমে সংঘটিত উল্লেখযোগ্য গঠনাবলি:

১. আশুরার দিনে মহান আল্লাহ বিশ্বজগত সৃষ্টির সূচনা করেন।
২. এই দিনে পৃথিবীর প্রথম মানব হযরত আদম (আ.)-এর দেহে প্রাণ সঞ্চারিত হয়।
৩. এই দিনে পৃথিবীর বুকে প্রথম বৃষ্টিপাত হয়।
৪. এই দিনে আল্লাহ পাক তাঁর অনেক নবীকে স্ব-স্ব শত্রুর হাত থেকে আশ্রয় প্রদান করেছেন।
৫. এই দিনে নূহ (আ.)-এর কিস্তি ঝড়ের কবল হতে রক্ষা পেয়েছিলো এবং মহাপ্লাবন শেষে তিনি জুদী পর্বতশৃংগে নোঙ্গর ফেলেছিলেন। (আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া ১/১৩২)
৬. এই দিনে নীল নদে ফেরআউনের ভরাডুবি হয় এবং বনী ইসরাঈলরা ফের’আউনের কবল থেকে রক্ষা পায়। (আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া ১/১৩২)
৭. এই দিনে হযরত ইব্রাহিম (আ.) নমরূদের অগ্নিকুণ্ড থেকে মুক্তি লাভ করেন।
৮. এই দিনে হযরত ইউনুস (আ.) দজলা নদীতে মাছের পেট থেকে মুক্তি লাভ করেন। (আল-কামিল ফিত-তারীখ ১/১২২)
৯. এই দিনে দাউদ (আ.)-এর তাওবা কবুল হয়েছিলো।
১০. এই দিনে হযরত সুলায়মান (আ.) তাঁর হারানো আংটি ও রাজ্য ফিরে পান।
১১. এই দিনে দীর্ঘ ১৮ বছর মারাত্মক রোগে ভোগার পর হযরত আইয়্যূব (আ.) দূরারোগ্য ব্যাধি থেকে সুস্থতা লাভ করেছিলেন।
১২. এই দিনে সুদীর্ঘ ৪০ বছর পর হযরত ইয়াকুব (আ.) ও তাঁর হারিয়ে যাওয়া পুত্র হযরত ইউসূফ (আ.) আবার মিলিত হন।
১৩. এই দিনে আল্লাহ তা'আলা ঈসা (আ:)-কে উর্ধ্বাকাশে উঠিয়ে নিয়েছেন।
১৪. কাফেরদের অবর্ণনীয় অত্যাচার আর নিপীড়িনের কারণে আল্লাহ তা'আলা আমাদের প্রিয়নবী (সা.)-কে মক্কা ছেড়ে মদীনায় হিজরত করার অনুমতি দিয়েছিলেন এই মুহাররাম মাসেই। তিনি সেখানে আনসারদের অপূর্ব আপ্যায়ণ পেয়ে কাফেরদের যন্ত্রনা থেকে রক্ষা পেয়েছেন।
১৫. ৭ম হিজরীর মুহাররাম মাসেই মুসলমানরা গাজওয়ায়ে খাইবারে বিজয় লাভ করে। (উসদুল গাবাহ ১/২১)
১৬. মাদায়েন এবং কাদিসিয়ার যুদ্ধে মুসলমানরা বিজয় লাভ করে মুহাররাম মাসে।
১৭. অধিকাংশ ঐতিহাসিকদের মতে বিশ্বনবী মুহাম্মদ (সা.)-এর দৌহিত্র ইমাম হুসাইন (রা.) শহীদ হয়েছিলেন এই আশুরার দিনে।
১৮, বর্ণিত আছে যে আশুরার দিবসেই কেয়ামত সংঘটিত হবে।

আশুরায় হুসাইন (রা.)-এর শাহাদাত বিষয়ে ঐতিহাসিক ভিন্নমত:

আশুরাতে হুসাইন (রা.) কারবালার প্রান্তরে নির্মমভাবে শাহাদত বরণ করেন –এটিই বহুল প্রচলিত মত। তবে এর ঐতিহাসিক যথার্থতার ব্যপারে মতানৈক্য রয়েছে। কারণ কারবালার ইতিহাস গভীরভারে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, অধিকাংশ কিতাবে আছে হযরত হুসাইন (রা.) ৮ অথবা ১০ ই জ্বিলহজ্জ তারিখে মক্কা থেকে রওনা করেন, আর ২রা মহারম কারবালার ময়দানে পৌঁছেন। মধ্যখানে তাঁদের যাত্রাকালের সময় হল মাত্র বাইশ বা তেইশ দিন। দ্বিমত পোষণকারীদের বক্তব্য হলো, ভৌগলিক হিসাবে মক্কা থেকে কারবালার দুরত্ব প্রায় সাড়ে নয়শত মাইল। তখনকার যুগে প্লেন বা জাহাজের কোন ব্যবস্থা ছিল না। উটের সফরে ৭২ জন (মতান্তরে আরো কিছু কম -বেশি) ছোট, বড়, বৃদ্ধ, বিবি-বাচ্চা সহ একটি কাফেলার সফর। খাওয়া-দাওয়া, উজু-এস্তেঞ্জা, নামাজ এবাদত বন্দেগী ও প্রয়োজনীয় বিশ্রাম ইত্যাদির চুলচেরা বিশ্লেষণ করলে এটা প্রমাণিত হয় যে, বাইশ বা তেইশ দিনে কোন ক্রমেই উল্লিখিত কাফেলা মরুভুমিতে সাড়ে নয় শত মাইল সেই যুগে পাড়ি দিতে সক্ষম নয়! এই রকম একটি কাফেলা এক দিনে সর্বোচ্চ ২৫/৩০ মাইল মাইল পাড়ি দিতে পারে এটাই স্বাভাবিক। যার ফলে ইবনে জরির সাআ’ (রা.)-এর বর্ণনা নকল করে বলেন, হুসাইন (রা.) -এর শাহাদাত ১০ই মুহাররাম নয়, বরং ২২ শে সফর। কারবালা সম্পর্কে যতগুলো কিতাব রচয়িত হয়েছে, তার অধিকাংশ গুলোতেই ১০ই মহাররমের কথা উল্লেখিত হয়েছে। এর পিছনে নাটের গুরু ছিল ইয়াহুদী ও ইরানী মাজুসিরা। কারণ, যদিও মূসা (আ.) থেকে শুরু করে আমাদের রাসুল (সা.)-এর জমানা পর্যন্ত ইয়াহুদিরা এই দিনে খুশিতে রোজা রাখতেন। কিন্তু এই মাসেই হযরত আলি (রা.)-এর হাতে তাদের বিখ্যাত সিপাহসালার মারহাবের মৃত্যু হওয়ায় তাদের কাছে খুশির মাসটা হয়ে ওঠে বেদনাবিঁধুর। অপর দিকে সা‘দ ইবনে আবী ওয়াক্বাস (রা.) এর নেতৃত্বে মাদায়েন ও কাদিসিয়ার যুদ্ধে ইরানী মাজুসীদের বিখ্যাত রুস্তুমের পরাজয় হওয়ায় ইরানী মাজুসীদের কাছেও মাসটি হয়ে ওঠে বেদনাবিঁধুর। এরপর থেকে উভয় সম্প্রদায় এই মাসে শোক পালন করা শুরু করে। এইভাবে বেশ কিছু কাল অতিবাহিত হয়ে যাওয়ার পর তারা ভাবল আমরা এই মাসে শোক পালন করি আর মুসলমানরা এই মাসে নববর্ষের আমেজে মেতে থাকে এটা কী করে হতে পারে? তখন তারা আবূ মিখনাফ লুত ইবনে ইয়াহইয়া সহ তাদের আরো কিছু লেখক এজেন্টের মাধ্যমে ইতিহাসকে বিকৃত করার সুচনা করে। আর বলে আমরা এই মাসে আমাদের নেতার কথা স্বরণ করে তাদের নামে শোক পালন করি, তোমরা তোমাদের মহান নেতা হুসাইন (রা.) –এর শাহাদাতের শোক পালন না করে নববর্ষের আনন্দে মেতে থাক এটা কেমন কথা হল? মিখনাফ কারবালা বিষয়ে প্রায় পাঁচ শতাধিক কিতাব রচনা করেছেন। তা থেকেই পরবর্তিতে আরো অনেক কিতাব রচয়িত হয়েছে। তারপর থেকে সময়ের পরিবর্তনে মুসলমানরাও মহাররম মাসে আনন্দের পরিবর্তে বিকৃত ইতিহাসকে অনুসরণ করে ১০ই মহাররম শোক পালন করা শুরু করে, যা আজ অবদি চলে আসছে। আবু মিখনাফ ছিল শিয়া সম্প্রদায়ের অন্যতম একজন। মুহাদ্দিসগণের কাছে তার বর্ণিত হাদীসগুলো জঈফ ও মাউজু হিসাবে বিবেচিত। (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া ৮/২২০) আর কারবালার ইতিহাস বর্ণনাকারীদের মাঝে মূলে হলেন আবু মিখনাফ। (চলবে)

লেখক:প্রিন্সিপাল, আল-ইত্তেহাদ আন্তর্জাতিক মাদরাসা,বনশ্রী আবাসিক এলাকা, মৌলভীবাজার

(দ্য রিপোর্ট/একেএমএম/সেপ্টেম্বর ২১,২০১৮)

পাঠকের মতামত:

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

SMS Alert

ধর্ম এর সর্বশেষ খবর

ধর্ম - এর সব খবর