thereport24.com
ঢাকা, সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১,  ২১ জমাদিউস সানি 1446

ক্যালিফোরনিয়ার চিঠি

২০১৮ অক্টোবর ২৬ ০১:৫০:০৬
ক্যালিফোরনিয়ার চিঠি

মাহবুব আহমেদ

১.
ক্যালিফোরনিয়ার বাতাসে শীতের আমেজ।
আকাশ চকচকে নীল । আজ রাতে শীত জমিয়ে বসবে।
শীতে এলে কেন যেন খুব শৈশবের কথা মনে পড়ে । কেন জানি না । কিছু ভুলে যাওয়া পরিচিত মুখ মনের সামনে এসে হোঁচট খায় । দুনিয়ার অন্যপ্রান্তে এসেও রক্ষা নেই তাদের হাত থেকে।
আমার এখান থেকে প্রশান্ত মহাসাগরের দূরত্ব ৩০ মিনিটের ড্রাইভ । কিন্তু গত একবছর ধরে সময় বের করতে পারছি না-সারাদিন বিচের কাছে কাটানোর । শীতের সময় অন্য রকম রূপ এ নীল বিশালতার । বিশালতার কাছে গেলে নিজেকে ক্ষুদ্রতর ভাবতে ভুলে যাই । এটাই বিশালতার মহিমা । কবিতা বা সাহিত্য আমার কাছে তাই ।
বিশালতার কাছে থমকে দাঁড়ানো ।

মনটা ভাল নেই । অনেক কারণে । কিছু বলা যায় । কিছু বলা যায় না। এই না বলা কথাগুলোই আসলে সত্য । প্রবাস জীবনে মন নামক বিষয়টির কথা ভুলে যাওয়া না গেলে বিপদ । তাই মূল আলোচনায় চলে আসা যাক ।
দ্য রিপোর্টের সম্পাদক তৌহিদুল ইসলাম মিন্টু ভাইয়ের সাথে বেশ কদিন আগে ফোনে কথা হলো । বললেন, 'খুবই ব্যস্ত আছি। তোমার বইটা পড়তে পারি নাই । তোমার বইটা কভার করার কথা ভাবছি । কিছু একটা লিখে দিওতো আমরা ঠিকঠাক করে নেব।'


তাই লেখাটি এমনভাবেই লিখছি যাতে ঠিক করে নিতে কষ্ট হয় । মিন্টু ভাই আমার জীবনের অনেক ঠিক ও বেঠিক ঘটনার সাথে পরিচিত এবং আমার ধারণা তিনি বিরক্তও বটে ! তবে ভালবাসেন বলে কিছু বলেন না বা বলতে পারেন না । আমি চিরকাল এই সুযোগটা নেই । আমি জানি তিনি তার অতি বিখ্যাত নীরব মুচকি হাসিটি এখন হাসছেন অথবা একটু পরে হাসবেন । আমার বিয়েতে তাকে সঠিক সময়ে জানাতে পারিনি বলে তিনি তার বিয়েতে আমাকে বলেননি । আমি খুশি যে তিনি বিয়ে করেছেন। আশা করি এখন আমার প্রতি কোন অভিযোগ নেই ।

২.
গত ক'দিন একটি মানুষ আমাকে গভীরভাবে ব্যথিত করে রেখেছেন তিনি আর কেউ নন শিল্পী আইয়ুব বাচ্চু । খুব অল্প সময়ে গভীর মমতার বন্ধুত্ব হতে পারে তিনি তার ঊদাহরণ ।
তখন আমি ও সোহেল মাহবুব একটি অ্যাড এজেন্সি শুরু করেছি । আফজাল ভাই (আফজাল হোসেন), আসাদুজ্জামান নূর-এনারা হচ্ছেন কমপিটিটর ।

সময়টা কুড়ি বছর আগে । একটি কসমেটিক প্রডাক্টের বিজ্ঞাপন তৈরি করতে তার স্টুডিওতে হাজির হলাম ।
বাচ্চু ভাইয়ের সুর কম্পোজ-এ জিঙ্গেল গাইলেন মনির খান । আমার কেন যেন মনে হল এ কাজটা আমরা পাবো না। কারণ জিঙ্গেলটার ভিতর প্রাণ নেই । তার পরদিন আসার পথে ট্যাক্সিতে বসে লিখলাম মাতাল হাওয়া নামের জিঙ্গেলটি । আমি যখন তার স্টুডিয়োও পৌঁছালাম তখন সকাল । আমার রাতে ঘুম হয়নি ।

তিনি আর আমি একা স্টুডিওতে । তাকে দেখালাম লেখাটি । বললেন, 'কে লিখেছে?' বললাম, 'এই অধম ।' 'কম্পোজ করতে হবে আজই এবং এখন । সুরটা রক ধাঁচের হলে ভাল হয়।'-বললাম তাকে।
তিনি সুর করলেন।
'কে গাইবে?' তিনি প্রশ্ন করলেন ।
আমি বললাম, 'আপনি গাইবেন !'
'আমি জিঙ্গেলে কন্ঠ দেই না ।'
'আপনাকে করতে হবে ভাই, না হলে কাজটা হারাবো!'
'তাই নাকি! বিপদে ফেললেন!'
অনেকক্ষণ চুপচাপ । আমি তার জন্য আনা সিগারেট প্যাকেটটা দিলাম।
'ঘুষ দিচ্ছেন?'


'জী আমি ভাল ঘুষ দিতে জানি । এবং আমি বিপদে ফেলার জন্য এসেছি । কারণ আমি বিপদে আছি।'
আমার দিকে তাকালেন । মুচকি হাসলেন । রেকর্ডিং রুমে প্রবেশ করলেন ।
খুবই অল্প সময়ে তৈরী হল ‘মাতাল হাওয়ায় ঊড়িয়েছো চুল, মেঘ ভেবে হই ব্যাকুল ‘...। তার কন্ঠে।
আমরা কাজটা পেলাম । বাচ্চু ভাই জিঙ্গেলটা না গাইলে কাজটা পেতাম না । এটা সেই সময়ে দেশে বহু প্রচারিত একটি সফল জিঙ্গেল । তার এই উপকার ও ভালবাসার কথা ভুলে যাওয়া মানে পাপ । আমি পাপী হতে চাই না । তার একটি গান অনেক গভীর রাতে আমি শুনি । এখন অনেক রাত খোলা আকাশের নীচে....।

গভীর কৃতজ্ঞতা আপনার জন্য বাচ্চু ভাই। ব্যাপারটি ব্যবসায়িক কারণে নয়, বিষয়টি ভালবাসার জন্য। এই ভালবাসার দাম বিধাতা আপনাকে দেবেন আমার বিশ্বাস । আমরা মানুষেরা কিবা দিতে পারি !

৩.

নিজের বই নিয়ে কিছু লিখতে হবে । গত একমাস দিনরাত কাজের চাপ । আজ না লিখতে পারলে সামনের দুমাসে সময় হবে না । আজ মুড আছে । কাল মুড থাকবে বলে মনে হয় না । সময় ৬০ মিনিট । যাতে কিছু না বলা কথা বলা হয় । না বলা গল্প । আমার প্রথম কবিতার বই । ব্যপারটি ইমোশনাল করে তোলে আমাকে ।
কিন্তু পাকা অভিনেতাদের মত নিজেকে বলা এ সব পাগলামীর বয়স নেই । কিন্তু রবি ঠাকুরের শেষ জীবনের গান গুলোতে যে প্রেম প্রকাশ পেয়েছে সেই তুলনায় আমি এখনও যুবক ।

তাই সাহস পেলাম লিখতে । জনপ্রিয় হবার জন্য এই লেখা নয় । চেতনার দায় চেতনার দায় শোধ করা বলা যেতে পারে । আমার আমেরিকান কবি বান্ধবী ও তার কবিতার বই আমাকে
অনুপ্রাণিতকরেছে । ছোট খণ্ড খণ্ড চিন্তাগুলোকে এককরে কবিতা লেখায় । আমার মনে হয় নিজের খুব কাছে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখার সুযোগ সবাই পায় না ।

কিংবা বলা যায় নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে নিজেকে অতিক্রম করার চেষ্টা । কেন এখন কবিতার বই ? এই প্রশ্নের জবাবে আমি এই কথাগুলি বলে আসছি । লেখার ধারাটি নিজের । এবং জীবনে যাদের লেখা যাদের সৃষ্টির আলোয় নিজেকে মানুষ মনে হয়েছে, তাদের কয়েকজনকে কবিতা ঊৎসর্গ করে কিছুটা দায় শোধ করার সুযোগটা হাত ছাড়া করিনি। আমি নিজেও কবিতা বিমুখ বহুদিন । বাংলায় কবিতার বই প্রকাশ করার ইচ্ছা কোনকালেই ছিল না । হঠাৎ সিদ্ধান্ত । আয়োজনটা ইংরেজি ভাষার জন্য । বাংলায় বহু মহান লেখক লিখছেন । এখানে আমার দরকার নেই ।
তবে বলতেই হয় প্রকাশক শরিফুল ইসলাম সেলিম-এর সহায়তা ও আকুলতায় বলা যায় এই বই বাংলায় আয়োজন।

আমার কবিতাগুলো মানুষের জন্য । মানুষ বলতে শুধু আমাদের দেশের মানুষ নয় । সারা দুনিয়ার মানুষ । তাদের জীবনচিন্তা বেদনা-স্বপ্ন-প্রশ্ন হাহাকার অপেক্ষা কষ্টের অধিকারের কথা বলতে চেয়েছি । ব্যাপারটি অনেকটা কবিতার পিঠে চড়ে কিছু বলার চেষ্টা করা । আর ইংরেজি ভাষায় প্রকাশ করার ইচছা তাই লেখাগুলোকে ইংরেজী মননের সময় ধারণ করার অবারিত চেষ্টা । অনুবাদের কাজ শেষ, যে কোন সময় প্রকাশিত হবে । মাধ্যম অনেকটাই সুরিয়ালিজম ভেতরে ও বাইরে । অনেক আধুনিক পাঠকের কাছে পৌঁছে দেবার বারতা নিয়েই । আমি কঠিন ভাষায় লেখা কবিতার বিরোধী । সময়টা এখন অন্যরকম । মানুষ পড়তে চায় না, দেখতে চায়। যার কারণে বইও ডিজিটালাইজ হয়ে যাচ্ছে। গান কবিতার অন্যরূপ । কিন্তু মানুষ গান শোনার চাইতে দেখতে চাইছে । আমি কবিতাবোদ্ধাদের বিরোধী। তারা কবিতাকে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে । পচা রাজনীতি- যা বাতিল তাও কবি ও কবিতাকে কিনে ফেলেছে। কবি সাহিত্যিকরা নিজেদের অজান্তেই নিজেদের বিক্রি করে ফেলেছেন । উন্নত বিশ্বের সাহিত্য কবি ও কবিতা এখনও মুক্ত । একজন মানবাধিকারকর্মী হিসেবে মানবিক মানুষ হিসেববে সারা দুনিয়ার মানুষের চেতনা ও হাহাকারকে ধারণ করার চেষ্টা আমার কবিতায় । তাদেরকে ভালবসার চেষ্টা তাদের পক্ষে নিজেকে গলিয়ে ফেলার চেষ্টা।

আমার বইয়ের শেষ পাতায় লেখক পরিচিতি অংশে একটি লাইন লেখা হয়েছে- তিনি নিজেকে মানবতাবাদী ভাবতে ভালবাসেন । ব্যপারটি খুবসাহসী এই অমানবিক দুনিয়ায় বাস করে । তবে আমি ভাবতে ভালবাসি আমি মানবতাবাদী কিনা ব্যপারটি প্রমাণ দাবি রাখে। সবাই ব্যস্ত। সবাই ছুটছে । আমিও ছুটছি । অপেক্ষা করতে করতে নিজেকে গাছ করে ফেলার ইচছা নেই । কী লাভ বলুন ? তবে কখনো কখনো থামতে হয়। সকল বাস্তবতার বাইরে হারাতে হয় । আমার বই কিংবা গান নিজেকে হারাবার নয় যুক্ত করার চেষ্টা মানুষের মননে ।

'Come back
this time is for blooming roses
never be afraid of bonfire
that is too far to burn yourself.
Bohemian sky
hang like a capricious bed
where moon refused to sleep
the music of no return
only in sharp tone.'

আমার এই কবিতাটি শুনে আমার আমেরিকান বান্ধবীটি আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো। আমার মনে হলো- আমি এই প্রথম তার মনের সাথে যুক্ত হতে পেরেছি। কবিতার এমনি প্রভাব । যা আমার নেই ।
তাই যুক্ত কর বন্ধু কেটে বাদ দিও না- আমাকে তোমার ঊদার সহজ মন থেকে । আমি তোমার চেতনায় বাস করি । তুমি মহান বলে আমাকে অন্ধ রাখবে কেন ?

লেখক : আমেরিকা প্রবাসী


পাঠকের মতামত:

SMS Alert

সাহিত্য এর সর্বশেষ খবর

সাহিত্য - এর সব খবর