thereport24.com
ঢাকা, মঙ্গলবার, ৪ মার্চ 25, ২০ ফাল্গুন ১৪৩১,  ৪ রমজান 1446

আসাম এনআরসি: তালিকায় থাকছে না বহু শিশুর নাম

২০১৯ আগস্ট ৩১ ১১:২৭:৪০
আসাম এনআরসি: তালিকায় থাকছে না বহু শিশুর নাম

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক: আসামের কাছাড় জেলার শিলচর শহরে কয়েক দশকের পুরনো একটা উদ্বাস্তু কলোনি রয়েছে। সেখানেই থাকে নয়নমণি দাস। তার বয়স ১৪। ৩১ অগাস্টের এনআরসি তালিকায় তার নাম উঠবে না নিশ্চিত। কারণ তার দীর্ঘদিন আগে প্রয়াত ঠাকুর্দা প্রসন্ন দাস রাজ্যের ভোটার তালিকায় এখনও ডিভি (সন্দেহভাজন ভোটার) বলে চিহ্নিত হয়ে রয়েছেন।

এনআরসি হালনাগাদ করার নিয়ম অনুসারে কোনও ব্যক্তি যদি বিদেশি ট্রাইবুনালে ট্রাইবুনাল দ্বারা ঘোষিত বিদেশি (ডিএফ) হন, স্থানীয় নির্বাচনী আধিকারিকরা যদি কাউকে সন্দেহজনক ভোটার (ডিভি) বলে চিহ্নিত করে থাকেন, অথবা যদি কোনও ব্যক্তির মামলা বিদেশি ট্রাইবুনালে বিচারাধীন (পিএফটি) থাকে, তাহলে তাঁর বা তাঁর যে সব উত্তরসূরীরা তাঁর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত হিসেবে নিজেদের দেখিয়েছেন (লিগ্যাসি) তাঁদের নাম এনআরসি তালিকার বাইরে থাকার কথা। এখানেই শেষ নয়। ২০০৪ সালের ৩ ডিসেম্বরের পর যারা জন্মেছে, তাদের বাবা বা মা-র মধ্যে যে কোনও একজনও যদি ডিএফ, ডিভি বা পিএফটি হন, তাহলে তার নাম এনআরসি তালিকায় থাকবে না।

নয়নমণি একা নয়, অল্পবয়সী বহু ছেলেমেয়ের নাম বাদ যাবে এনআরসি থেকে। কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার জানিয়ে দিয়েছে এনআরসি তে নাম না থাকলে কাউকেই ডিটেনশন ক্যাম্পে পাঠানো হবে না। এবং বিদেশি ট্রাইবুনালে আবেদন করার জন্য তাঁরা ১২০ দিন সময় পাবেন। বিদেশি ট্রাইবুনালে আবেদন করার ব্যাপারে নাবালক নাবালিকাদের ছাড় দেওয়ার কোনও ব্যবস্থা নেই বলে জানিয়েছেন এক আইনজীবী।

১৯৯৭ সালে আসামে ডি ভোটার বিভাগ প্রবর্তন করা হয়। যে সব নাগরিকরা তাঁদের নাগরিকত্বের প্রমাণ দিতে পারেননি তাদের ভোটার তালিকায় ডি ভোটার বলে চিহ্নিত করা হয়। বিদেশি ট্রাইবুনাল (এফটি) একটি আধা বিচারবিভাগীয় ব্যবস্থা যাতে ১৯৪৬ সালের বিদেশি আইনানুসারে কোনও ব্যক্তি বিদেশি কিনা সে ব্যাপারে মতামত দেওয়া হয়। ডি ভোটারদের এবং আসাম পুলিশের সীমান্ত বিভাগ যাদের নামোল্লেখ করে, তাদের নোটিস পাঠায় বিদেশি ট্রাইবুনাল।

কিন্তু নয়নমণি নাগরিকত্ব নিয়ে এসব হেঁয়ালি বোঝে না। সে নিজে, তার বাবা সঞ্জিত (৩৭), কাকা মনোজিত (২৮) এবং বোন টিনা (৯)-ও যে এনআরসি তালিকায় থাকবে না, এ ব্যাপারে সে একেবারেই অবহিত নয়। এদের সবাইকেই বিদেশি ট্রাইবুনালের সামনে হাজিরা দিতে হবে শঙ্কিত চিত্তে, দেশহীন হয়ে যাবার ভয় নিয়ে। গত বছর জুলাই মাসে প্রকাশিত খসড়া এনআরসি তালিকায় টিনার নাম ছিল না। কিন্তু সঞ্জিত, মনোজিত ও নয়নমণির নাম ছিল। ২৬ জুন যে অতিরিক্ত এনাআরসি ছুট তালিকা তৈরি হয়েছে, তাতে এদের সবার নাম বাদ গিয়েছে। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, তারা “ডি ভোটারের উত্তরসূরী।”

আগে হাতে টানা গাড়ি চালাতেন, এখন ছোট একটা দোকান চালান সঞ্জিত। “আমার বাবা মারা গিয়েছেন ২০০৫ সালে। তখন পর্যন্ত ভোটার তালিকায় তাঁর নাম ডি ভোটার হিসেবে দেখানো হয়নি। ২০১৩ সালের ভোটার তালিকায় বাবাকে ডি ভোটার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ২০১৯ সালের ভোটার তালিকাতেও বাবাকে ডি ভোটার দেখানো হয়েছে। আমি এখানকার সরকারি অফিসারদের অনেকবার বলেছি কিছু একটা করুন। কেউ কোনও কথা শোনেনি।”

অল্প দূরেই থাকেন রতীশ দাস (৪৫)। তিনি বেকুব বনে রয়েছেন। রতীশ, তাঁর স্ত্রী কল্পনা ও তাদের ছোট ছেলে, ১৪ বছরের রাজীবের নাম নেই খসড়া তালিকায়। তাঁর বড়ছেলে ২৩ বছরের রবীন্দ্র ও ১৮ বছরের মেয়ে পূর্ণিমার নাম এনআরসি-তে রয়েছে। রতীশ তার বাবার ১৯৫৬ সালের নাগরিকত্বের সার্টিফিকেট দাখিল করেছেন, য়াতে তাঁর বাবাকে ভারতে আসা শরণার্থী হিসেবে মেনে নেওয়া হয়েছে। রাজীব চিন্তিত। “আমি ভাবছি যদি আমাদের নাম এনআরসি-তে না থাকে তাহলে কী হবে? আমাদের পরিবার ভেঙে যাবে? আমাদের ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেওয়া হবে?” পূর্ণিমা অবশ্য আশাবাদী। ওরা আমার বাবা-মা-ভাইয়ের নাম বাদ দেবে না। আমরা দুই বাইবোন থাকলে ওরা বাদ যেতে পারে না। চূড়ান্ত খসড়া এনআরসি প্রকাশিত হবার পর এনআরসি থেকে যে চিঠি এসেছে, তাতে বলা হয়েছে রতীশ ও রাজীবের বার্থ সার্টিফিকেট ভুয়ো এবং কল্পনার যে নথি দেওয়া হয়েছে তা থেকে তাঁর পিতৃকুল প্রমাণিত হচ্ছে না।

৪০০ কিলোমিটারের বেশি দূহে নমনি আসামের বরপেটা জেলা। ১০ বছরের মিজানুর হক জানে না তার সামনে কী আছে। মিজানুরের বাবা ৪০ বছর বয়সী মফিজুদ্দিন মিয়া গুয়াহাটিতে সাইকেলে চেপে মাছ বিক্রি করেন। মিজানুরের ঠাকুর্দা ফেদ্দুস মিয়াকে বিদেশি ট্রাইবুনাল বিদেশি ঘোষণা করেছে। তাঁকে রাখা হয়েছে গোয়ালপাড়া জেলার ডিটেনশন ক্যাম্পে। ২০১৭ সালে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। তাঁর নাগরিকত্ব নিয়ে মামলা চলছে গৌহাটি হাইকোর্টে। মফিজুদ্দিন বলছেন, তিনি খাঁটি ভারতীয় এবং সে কথা প্রমাণ করতে কোনও কসুর করবেন না তিনি। “আমার বাবার নাম ১৯৫১ সালের এনআরসি তে ছিল, এক বছর বয়সী হিসেবে। আমার ঠাকুর্দা মধু মিয়ার নামও ছিল, ৩০ বছর বয়সী হিসেবে।”

ফেদ্দুস মিয়া দাবি করছেন তাঁর বাবার নাম মধু মিয়া, কিন্তু পুলিশ তাঁকে বিদেশি বলে সন্দেহ করছে এবং বলছে ফেদ্দুসের বাবার নাম কান্দু মিয়া। হাইকোর্টের নির্দেশের জন্য অপেক্ষা করছেন মফিজুদ্দিন, ভয়ংকর ভয় পাচ্ছেন পরিবারের ভবিষ্যতের কথা ভেবে। মিজানুরের অবশ্য কোনও ধারণাই নেই এই পরিস্থিতি নিয়ে। কামরূপ জেলার ফুলচান আলির বয়স ৪৪, পেশায় মিষ্টি বিক্রেতা। বিদেশি ট্রাইবুনাল তাঁকে বিদেশি বলে চিহ্নিত করে ক্যাম্পে পাঠিয়েছিল। হাইকোর্ট সে নির্দেশকে খারিজ করে দেওয়ার পর তিনি জামিন পান। কোর্ট ফুলচানের মামলা ফের বিচার করতে বলে বিদেশি ট্রাইবুনালকে। ফুলচান বললেন, “ট্রাইবুনাল আবার আমাকে বিদেশি ঘোষণা করেছে, আমি আবার একজন হাইকোর্টের আইনজীবীর কাছে এসেছি আবার আপিল করার জন্য।”

ফুলচানের চার মেয়ে, ফরিদা (১৭), নাফিজা (১৫), মামণি (১২), মাজোনি (৮)। এক ছেলে আরিফুলের বয়স ৪। ফরিদা বললেন, “আমি শুনেছি আমাদের নাম এনআরসি-তে নেই কারণ আমার বাবার নামে বিদেশি ট্রাইবুনালে মামলা আছে। কিন্তু এর মানে কী আমি বুঝি নি।” ফুলচানের প্রশ্ন, “আমি বিদেশি ট্রাইবুনালে গিয়েছি। এখন ওরা বলছে সবাই এনআরসি থেকে বাদ গিয়েছে মানে সবাইকে বিদেশি ট্রাইবুনালে আবেদন করতে হবে। তাহলে ছোট বাচ্চাগুলোকে নিয়ে কি আমি এখন ট্রাইবুনালে যাব?” ডিএফ, ডিভি, পিএফটি ক্যাটিগরিতে যাঁদের নাম রয়েছে তাঁদের সন্তানরা তো বটেই, অনেক শিশুর নাম বাদ যেতে পারে অন্য কারণেও। সে সব কারণের মধ্যে রয়েছে নির্ভরযোগ্যে পূর্বপুরুষের সঙ্গে আত্মীয়তা প্রতিষ্ঠা করতে না পারা এবং এনআরসি আধিকারিকদের কাছে গ্রহণযোগ্য নথি পেশ না করতে পারা।
বরপেটার এক ড্রাইভার আর্শাদ আলি (৩৬)। তাঁর পরিবারের সকলের নাম এনআরসি-তে উঠেছে। শুধু তাঁর ১১ বছরের মেয়ে আমনা খাতুনের নাম বাদ পড়েছে। “মনে হয় ওর বার্থ সার্টিফিকেট অনুমোদন করে নি। ওটা দিল্লির ছিল। ২০০৬ থেকে ২০০৯ পর্যন্ত আমি দিল্লিতে ছিলাম। আমার ভয় ওর নাম এনআরসি থেকে বাদ যাবে। শুনানির সময়ে ওরা আমার কাছে আরও ডকুমেন্ট চায়, আমি বলি, এর চেয়ে বেশি একটা বাচ্চার আর কী ডকুমেন্ট থাকবে?”

১৪ বছরের নিচে যাদের নাম এনআরসি থেকে বাদ যাবে, তাদের জন্য সুপ্রিম কোর্টের নিয়ম অবশ্য রয়েছে। কম্পোজিট ফ্যামিলির ক্ষেত্রে শুনানি সময়ে নাবালক শিশুর বাবা-মায়ের মৌখিক বা লিখিত বয়ান গ্রহণযোগ্য বলে জানানো হয়েছে ওই নিয়মে।

সূত্র: ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস

(দ্য রিপোর্ট/আরজেড/আগস্ট ৩১ ,২০১৯)

পাঠকের মতামত:

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

SMS Alert

বিশ্ব এর সর্বশেষ খবর

বিশ্ব - এর সব খবর