thereport24.com
ঢাকা, রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১,  ২২ জমাদিউল আউয়াল 1446

ইতিহাস পরিক্রমায় শিক্ষার প্রকৃতি ও ‍বিস্তার

২০১৯ সেপ্টেম্বর ২১ ১৩:৫৪:০৮
ইতিহাস পরিক্রমায় শিক্ষার প্রকৃতি ও ‍বিস্তার

ডক্টর মো. মাহমুদুল হাছান

শিক্ষা জাতির মেরুদন্ড, কথাটি সর্বজন স্বিকৃত ও বাস্তবত সত্য। শিক্ষার কারনেই মানুষ সমাজে মাথা উঁচু করে মেরুদন্ড সোজা করে বাঁচতে পারে। মেরুদণ্ডহীন হয়ে বাঁচার শখ বা স্বাদ আমাদের কারও নেই। আমরা জানি মানুষ জ্ঞানের বিকাশ ঘটায় শিক্ষার মাধ্যমে। শিক্ষা ছাড়া কোনো ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ বা রাষ্ট্র অচল। যে জাতি যত শিক্ষিত সে জাতি তত উন্নত ও প্রগতিশীল। শিক্ষা সভ্যতার বিকাশ ঘটায়। শিক্ষাই মানুষকে অসভ্যতার অমানিশা থেকে সভ্যতার আলোয় নিয়ে এসেছে। শিক্ষাই মানুষকে মানুষ হিসেবে তৈরি করে। সকল ধর্মেই শিক্ষাকে সকল উন্নয়নের চাবী-কাঠি মনে করা হয়। আল কুরআন থেকে জানা যায়, নবীগণ শিক্ষা প্রচারের উদ্দেশ্যেই প্রেরিত হয়েছিলেন। তাঁরা শিক্ষার তাৎপর্য এবং লক্ষ্য-উদ্দেশ্য সুস্পষ্টভাবে নিজ নিজ জাতির সামনে পেশ করেছেন এবং জাতিকে উন্নয়নের পথ দেখিয়েছেন। আমরা সকলেই শিক্ষার কথা বলি, আবার আমরা অনেকেই শিক্ষিত বলে গর্ব করি, কিন্তু শিক্ষার আসল রূপ বা প্রকৃতি কি এবং কী বা এর ইতিহাস সে সম্বন্ধে আমরা অনেকেই অবগত নই। পৃথিবীর সৃষ্টি লগ্ন থেকেই যে শিক্ষার সূচনা, তা আমাদের অনেকের অজানা। মানব জাতির বেড়ে ওঠার সাথে সাথে এ শিক্ষার কার্যক্রম শুরু হয়, যা বিস্তৃত হয় কালের বিবর্তনে ও যুগপত সময়ের পরিবর্তনে। নিম্নে শিক্ষার প্রকৃত অর্থ ও এর ইতিহাস সম্পর্কে আলোচনা করা হলো-

শিক্ষার আভিধানিক অর্থ

শিক্ষার ইংরেজি প্রতিশব্দ Education যা ল্যাটিন শব্দ Educare থেকে এসেছে। Educare অর্থ কর্ষণ করা, প্রতিপালন করা, পরিচর্যা করা বা অন্তর্নিহিত চেতনার বিকাশ সাধন করা। ইংরেজিতে এর অর্থ হলো; to bring up and instruct, to teach, to train ইত্যাদি অর্থাৎ প্রতিপালন করা ও শিক্ষিত করিয়া তোলা, শিক্ষা দেওয়া, অভ্যাস করানো।

Joseph T. Shipley তাঁর Dictionary of word Origins এ লিখেছেন, Education শব্দটি এসেছে ল্যাটিন Edex এবং Ducer-Duc শব্দগুলো থেকে। এ শব্দগুলোর শাব্দিক অর্থ হলো যথাক্রমে বের করা, পথ প্রদর্শন করা। আরেকটু ব্যাপক অর্থে তথ্য সংগ্রহ করে দেয়া এবং সুপ্ত প্রতিভা বিকশিত করে দেয়া।

উইকিপিডিয়া এর ভাষ্যমতে, ইংরেজিতে ব্যাকরণগতভাবে, "এডুকেশন" শব্দটি লাতিন ēducātiō যার অর্থ প্রজনন এবং লালন পালন করা, ēducō যার অর্থ আমি শিক্ষাদান করি, আমি প্রশিক্ষণ দেই, যা হোমোনিম ēdūcō এর সাথে সম্পর্কিত, যার অর্থ আমি এগিয়ে নিয়ে যাই, আমি উত্থাপন করি এবং Dōcō যার অর্থ আমি নেতৃত্ব দেই, আমি পরিচালনা করি থেকে উৎপত্তি হয়েছে।

বাংলায় শিক্ষা শব্দের উৎপত্তি সংস্কৃত "শাস" ধাতু থেকে। সাধারণভাবে বলা যায় মানুষের আচরণের কাঙ্ক্ষিত, বাঞ্চিত এবং ইতিবাচক পরির্বতনই হলো শিক্ষা। যুগে যুগে নানা মনীষী নানাভাবে শিক্ষাকে সজ্ঞায়িত করেছেন। আবার সময়ের সাথে সাথে শিক্ষার সংজ্ঞা বা ধারণায়ও পরির্বতন এসেছে।

আরবী ভাষায় শিক্ষা বুঝাতে পাঁচটি পরিভাষা ব্যবহার করা হয়ে থাকে, সেগুলো হলো- ১. তারবীয়াহ (تربية) ২. তালীম (تعليم) ৩. তাদীব (تأديب) ৪. তাদরীব (تدريب) ৫. তাদরীস (تدريس) । আভিধানিক অর্থে এই শব্দগুলো সাধারণত প্রবৃদ্ধি দান করা, বৃদ্ধি করা, বড় করে তোলা, উন্নত করা, অগ্রসর করানো, পূর্ণতা দান করা, মহান করা, প্রস্ফুটিত করা, জাগিয়ে তোলা, উজ্জীবিত করা, গড়ে তোলা, লালন পালন করা, অভ্যাস করানো, চর্চা করানো, নিয়মানুবর্তিতা শেখানো, উদ্বুদ্ধ করা, উদ্দীপ্ত করা, সংস্কার করা, সুসভ্য করা, সংশোধন করা ইত্যাদি অর্থে ব্যবহৃত হয় ।

পারিভাষিক অর্থে বিভিন্ন শিক্ষাবিদ ও শিক্ষা দার্শনিক নিম্নলিখিত ভাবে শিক্ষাকে সংজ্ঞায়িত করেছেন-

১। ম্যাকেঞ্জির মতে: "আমাদের ক্ষমতাকে বিকশিত ও অনুশীলন করার উদ্দেশ্যে সচেতনভাবে পরিচালিত যেকোনো প্রচেষ্ঠাই সংকীর্ণ অর্থে শিক্ষা।"

২। এরিস্টটল 'শিক্ষা' বলতে বুঝিয়েছেন 'শিক্ষার্থীদের দেহ-মনের বিকাশ সাধন এবং তার মাধ্যমে জীবনের মাধুর্য ও সত্য উপলব্দিকরণ।

৩। রুশোর মতে, "শিক্ষা বলতে বুঝায় ব্যক্তির পরিপূর্ণ বিকাশ, যে বিকাশের মাধ্যমে সে সুসামঞ্জস্য স্বাভাবিক জীবনের অধিকারী হবে।

৪। ফ্রেডারিক হার্বাট এর মতে, "শিক্ষা হচ্ছে মানুষের বহুমুখী প্রতিভার ও অনুরাগের সুসম প্রকাশ এবং নৈতিক চরিত্র গঠন।"

৫। ফ্রান্সিস বেকন বলেন, "শিক্ষা মানে চোখ।"শিক্ষা বলতে তিনি মূলত মানুষের অর্ন্তনিহিত পূর্ণতার বিকাশ সাধন।"

৬। স্বামী বিকেকানন্দ বলেন, "শিক্ষা হলো মানুষের অন্তর্নিহিত পূর্ণতার বিকাশ সাধন।"

৭। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাঠ ঠাকুর বলেছেন, তাকেই বলি শ্রেষ্ঠ শিক্ষা, যা কেবল তথ্য পরিবেশন করে না। যা বিশ্বসত্তার সাথে সামঞ্জস্য রেখে আমাদের জীবনকে গড়ে তোলে।

৮। Dr. Restart Kausar বলেন শিক্ষা বলতে চিরাচরিত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাকে বুঝায়, চিরাচরিত প্রতিষ্ঠান তথা পরিবার,

সমাজ, রাষ্ট্র ও বিদ্যালয় বা অন্য কোনো কর্তৃপক্ষ কর্তৃক শিশুকে উপযোগী সদস্য গড়ে তোলার প্রয়াসে যে সচেতনমূলক ও স্বদিচ্ছাপ্রসুত পদক্ষেপ গ্রহন করা হয় তাকে শিক্ষা বলে।

শিক্ষার ইতিহাস

মানব সৃষ্টির পর থেকেই শিক্ষার যাত্রা শুরু। আদি পিতা হযরত আদম (আ.) কে সৃষ্টির পরেই আল্লাহতায়ালা তাকে হাতে কলমে সকল জিনিষের নাম শিক্ষা দিয়েছিলেন এবং তখন থেকেই শিক্ষার প্রকৃত ইতিহাস শুরু হয়েছিলো। পরবর্তিকালের বিবর্তনে শিক্ষার ধরণ ও প্রকৃতি পরিবর্তিত হলেও পৃথিবীতে প্রাগৈতিহাসিককালে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু হয়েছিল বয়স্ক ব্যক্তিদের দ্বারা যুব সমাজের জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞান ও দক্ষতার প্রশিক্ষণ দেয়ার মাধ্যমে। প্রাক-শিক্ষিত সমাজ মূলত মৌখিকভাবে এবং অনুকরণের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। গল্প-বলার মাধ্যমে জ্ঞান, মূল্যবোধ এবং দক্ষতা এক প্রজন্ম থেকে পরের প্রজন্মের কাছে স্থানান্তরিত হয়েছে। সাংস্কৃতিক দক্ষতা প্রসারিত হতে পারে অনুকরণের মাধ্যমে জ্ঞান অর্জন ও আনুষ্ঠানিক শিক্ষা উন্নত করার মধ্যমে। মিশরে মিডল কিংডম এর সময় স্কুল বিদ্যমান ছিল।

প্লেটো এথেন্সে একাডেমী প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যা ছিল ইউরোপের উচ্চতর শিক্ষার প্রথম প্রতিষ্ঠান। ৩৩০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে মিশরে আলেকজান্দ্রিয়া শহরটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল যা এথেন্সের বুদ্ধিবৃত্তিক প্যাড হিসাবে এটি প্রাচীন গ্রিসে বিখ্যাত হয়ে উঠেছিল। সেখানে, আলেকজান্দ্রিয়ার বৃহত্তর গ্রন্থাগারটি খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে নির্মিত হয়েছিল। ৪৭৬ খ্রিস্টাব্দে রোমের পতনের পর ইউরোপীয় সভ্যতায় সাক্ষরতা এবং সংগঠনের পতন ঘটেছিল।

চীনে কনফুসিয়াস (৫৫১-৪৭৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দ), লূ এর রাজ্যের সবচেয়ে প্রভাবশালী প্রাচীন দার্শনিক ছিলেন, যার শিক্ষাগত দৃষ্টিভঙ্গি চীন, কোরিয়া, জাপান ও ভিয়েতনামের মত প্রতিবেশী রাষ্ট্রের উপর প্রভাব বিস্তার করেছিল। কনফুসিয়াস শিষ্যদের একত্রিত করেন এবং একটি শাসককে নিরর্থকভাবে অনুসন্ধান করেন, যিনি সুশাসনের জন্য তাঁর আদর্শগুলি গ্রহণ করবে। তাঁর Analects অনুসরণকারীদের দ্বারা লিখিত হয়েছিল যা পূর্ব এশিয়ায় আধুনিক যুগেও শিক্ষার উপর ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে চলেছে।

রোমের পতনের পর, ক্যাথলিক চার্চ পশ্চিম ইউরোপে সাক্ষরতার ও স্কলারশিপের একমাত্র রক্ষাকর্তা হয়ে উঠেছিল। চার্চ ক্যাথিড্রাল স্কুলকে আধুনিক যুগের শিক্ষা ব্যবস্থার কেন্দ্র হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। এই প্রতিষ্ঠানগুলি শেষ পর্যন্ত মধ্যযুগীয় বিশ্ববিদ্যালয় এবং ইউরোপের বিভিন্ন আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলির অগ্রদূত হিসাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল। উচ্চ মধ্যযুগে সময় চার্টার্স ক্যাথিড্রাল দ্বারা বিখ্যাত এবং প্রভাবশালী Chartres ক্যাথিড্রাল স্কুল পরিচালিত হয়েছিল। পশ্চিম ইউরোপের মধ্যযুগীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলি পশ্চিম ইউরোপ জুড়ে সুসংহত ছিল, যা তদন্তের স্বাধীনতাকে উৎসাহিত করে এবং একদল পণ্ডিত ও প্রাকৃতিক দার্শনিকদের সৃষ্টি করেছিল, যেমন, নেপলস বিশ্ববিদ্যালয়ের টমাস অ্যাকুইনাস , অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির রবার্ট গ্রোসেটেস্ট, বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার পদ্ধতিগত পদ্ধতির প্রারম্ভিক প্রকাশক এবং জৈবিক গবেষণার অগ্রদূত সেন্ট অ্যালবার্ট গ্রেট ছিলেন অন্যতম। ১০৮৮ সালে প্রতিষ্ঠিত বলোনি বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রথম এবং প্রাচীনতম অপারেটিং ইউনিভার্সিটি বলে মনে করা হয়।

মধ্যযুগীয় সময়ে মধ্যপ্রাচ্যে ইসলামিক বিজ্ঞান ও গণিত সমৃদ্ধ হয়েছিল ইসলামিক খলিফার অধীনে, যা পশ্চিম আইবেরিয়ান উপদ্বীপ থেকে পূর্ব সিন্ধু পর্যন্ত এবং দক্ষিণে আলমোরাভিড রাজবংশ ও মালির সাম্রাজ্য পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করেছিল।


ইউরোপে রেনেসাঁ প্রাচীন গ্রিক এবং রোমান সভ্যতার বৈজ্ঞানিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক তদন্ত এবং উপলব্ধির নতুন যুগের সূচনা করেছিল। প্রায় ১৪৫০ সালের দিকে জোহানেস গুটেনবার্গ একটি প্রিন্টিং প্রেস তৈরি করেন, যা সাহিত্যের কাজকে আরও দ্রুত ছড়িয়ে দেওয়ার অনুপ্রেরণা দিয়েছিল। ইউরোপীয় সাম্রাজ্যের যুগে ইউরোপীয় দর্শন, ধর্ম, শিল্প ও বিজ্ঞান বিষয়ক ধারণাগুলি বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল। মিশনারি ও পণ্ডিতরা অন্যান্য সভ্যতা থেকে নতুন ধারণা নিয়ে আসছিল - জেসুইট চীন মিশনের সাথে যারা চীন ও ইউরোপের মধ্যে জ্ঞান, বিজ্ঞান এবং সংস্কৃতি প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। ইউরোপ থেকে কাজগুলি অনুবাদ করে যেমন চীনের পণ্ডিতদের জন্য ইউক্লিডের এলিমেন্টস অনুবাদ এবং ইউরোপীয় শ্রোতাদের জন্য কনফুসিয়াসের চিন্তা চেতনা কথা বলা যায়। আলোকায়নের যুগের মাধ্যমে ইউরোপ আরও নিরপেক্ষ শিক্ষাগত দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেছিল।

বেশিরভাগ দেশে আজ নির্দিষ্ট বয়স পর্যন্ত সব শিশুদের জন্য পূর্ণ-সময়ের শিক্ষা স্কুলে বা অন্যত্র বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এই কারণে বাধ্যতামূলক শিক্ষার বিস্তার ও জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে, ইউনেস্কো গণনা করে লক্ষ্য করেছে যে আগামী ৩০ বছরের মধ্যে আরও মানুষ আনুষ্ঠানিক শিক্ষা লাভ করবে যা মানব ইতিহাসে বিরল ঘটনা হবে এটি।

পাক-ভারত উপমহাদেশে বাংলায় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বিস্তার ও প্রসার ঘটেছিল মূলত আট থেকে এগারো শতকে বৌদ্ধ পাল রাজাদের শাসন যুগে এবং এগারো শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে হিন্দু সেন শাসন যুগে। ১৩ শতকের শুরু থেকে ধীরে ধীরে পুরো বাংলায় মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়ে সুলতানি এবং মোগল যুগ মিলে আঠারো শতকের মাঝপর্ব পর্যন্ত মুসলমানদের শাসনাধীকারে থাকে বাংলা। বাংলার এই মধ্যযুগ কালপর্বে সুলতান, সুবেদার ও সুফিসাধকদের তত্ত্বাবধানে নবগঠিক মুসলিম সমাজে শিক্ষার বিস্তার ঘটতে থাকে। এ সময় হিন্দু সমাজে পাঠশালা ও টোলকেন্দ্রিক পড়াশোনা যে অব্যাহত ছিল তা মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য- বিশেষ করে মঙ্গলকাব্য, চৈতন্য চরিত কাব্য এবং মুসলিম প্রণয় উপাখ্যানে পাওয়া যায়। প্রাচীন বাংলায় ঢাকা অঞ্চলে হিন্দু বসতি থাকায় অনুমান করা যায় এ পর্বে এই শহরে পাঠশালার অস্তিত্ব ছিল।

সুলতানি শাসনযুগে ধর্মীয় প্রণোদনায় এবং শাসক ও সাধক শ্রেণীর পৃষ্ঠপোষকতা ও উদ্যোগে মুসলিম সমাজে শিক্ষার ব্যাপক বিস্তার ঘটে। প্রত্যেক মসজিদ এ সময় মক্তব হিসেবে ব্যবহৃত হতো। মক্তব ছিল মুসলমানদের প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। আর উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হচ্ছে মাদ্রাসা। প্রতি মুসলমান পরিবারের ছেলেমেয়েদের জন্য প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ ছিল বাধ্যতামূলক। তাই আনুষ্ঠানিকভাবে পাঠ শুরু করতে হতো। সন্তানের বয়স চার বছর চার মাস চারদিন হলে মক্তবের শিক্ষক ইমাম সাহেবকে ডেকে এনে প্রথম পাঠ দেওয়া হতো। সেই অনুষ্ঠানে সামর্থ্য অনুযায়ী মিষ্টান্ন রান্না করে খাওয়ানো হতো। অবস্থাপন্ন অনেকে ভূরিভোজেরও আয়োজন করত। এই অনুষ্ঠানের নাম ছিল ‘বিসমিল্লাহখানি’। ঢাকায় ১‌৫ শতকের মাঝপর্বে মুসলিম বসতির বিকাশ ঘটে। মুসলিম বসতির প্রত্নতাত্ত্বিক পরিচয় মসজিদ ও মাদ্রাসার অবস্থিতি। এ সময় ঢাকায় তৈরি অন্তত তিনটি মসজিদের প্রমাণ পাওয়া যায়। প্রথমটি পুরান ঢাকার নারিন্দায়, দ্বিতীয়টি বর্তমান কেন্দ্রীয় কারাগারের পেছনে গিরিদাকিল্লা অঞ্চলে এবং তৃতীয়টি মিরপুরে শাহআলী বোগদাদীর মাজার সংলগ্ন। মোগল যুগে ঢাকাজুড়ে অনেক মসজিদ নির্মিত হয়েছে। ফলে মক্তবকেন্দ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থার কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। চৌদ্দ শতকের শুরুতে ঢাকার কাছে সোনারগাঁওয়ে একটি বিশাল মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সে যুগের বিখ্যাত সাধক শরফউদ্দিন আবু তাওয়ামা।

এসব নানা আনুসাঙ্গিক সূত্রে প্রাচীন ও মধ্যযুগে ঢাকার শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে সামান্য ধারণা করা যায়। তবে ইংরেজ শাসন যুগে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার যে ব্যাপক বিকাশ ঘটেছিল তা আমরা প্রামাণ্যভাবেই জানতে পারি।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বণিক ইংরেজদের মাধ্যমে বাংলায় ঔপনিবেশিক শাসনের যাত্রা শুরু হয়েছিল। ইংরেজ শাসকরা ছিল দূরদর্শী ও কুশলী। বাংলার মধ্যদিয়ে অচিরেই বিশাল ভারতের অধীশ্বর হয় এরা। বুঝতে পারে ভাষা ও সংস্কৃতির দিক থেকে বহু বৈচিত্র্যের দেশ ভারতবর্ষ। তাই শুরুতেই এসে সবার ওপর ইংরেজি ভাষা চাপিয়ে দিলে একটি জনবিক্ষোভ তৈরি হতে পারে। ফলে প্রচলিত ফারসি ভাষাকেই সরকারি ভাষা হিসেবে অব্যাহত রাখা হয়। আর নিজেরা প্রশাসনিক কাজ চালানোর প্রয়োজনে ইংরেজি ও ফারসি জানা দেশীয় শিক্ষিত মানুষদের জন্য একটি কেরানির পদ সৃষ্টি করে। যারা মুন্সি নামে পরিচিত ছিল। উনিশ শতকে বাংলায় শিক্ষিত হিন্দু ও মুসলমান সমাজের ভেতর বেশ কয়েকজন সমাজ সংস্কারক বেরিয়ে আসেন। তাঁরা ইংরেজি শিক্ষার গুরুত্ব অনুভব করেন এবং যাঁর যাঁর সমাজের মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে থাকেন ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণ করতে। এমন একটি অনুকূল অবস্থা তৈরি হওয়ার পর ১৮৩৫ সালে রাজভাষা হিসেবে ইংরেজির যাত্রা শুরু হয়।

প্রকৃত অর্থে ১৮৩৫ সালের আগে ঢাকা নগরীতে আধুনিক শিক্ষার যাত্রা শুরু হয়েছিল তেমন প্রমাণ ইতিহাস সূত্রে পাওয়া যায় না। পূর্ববাংলা একটি পশ্চাদপদ জনপদ ছিল। এই জনপদে শিক্ষার ক্ষেত্রে পরিবর্তনের ছোঁয়া আসে ১৮৩৫ সালে। এ সময় ঢাকায় গভর্নমেন্ট কলেজিয়েট স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়। আর এই স্কুল প্রতিষ্ঠার মধ্যদিয়ে এ অঞ্চলে তৈরি হয় ইংরেজি শিক্ষার পথ। এরপর থেকে শিক্ষা বিস্তারের ধারা অব্যাহত থাকে। ১৮৪১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ঢাকা গভর্নমেন্ট কলেজ। পূর্ববাংলার মুসলমান তরুণরা ইংরেজি শিক্ষার পাশাপাশি ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণের জন্য উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অভাব বোধ করছিল। এই অভাব পূরণের সুযোগ আসে ১৮৭৪ সালে। এ সময় প্রতিষ্ঠিত হয় ঢাকা মাদ্রাসা। মানিকগঞ্জের বালিয়াটির জমিদারদের পৃষ্ঠপোষকতায় ১৮৮৪ সালে প্রথম বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে ঢাকায় জগন্নাথ কলেজ (বর্তমান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়) প্রতিষ্ঠিত হয়। ইংরেজ শাসন যুগে এটি ছিল স্বনামধন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।

এভাবে উনিশ শতকজুড়ে শিক্ষার বিস্তার ঘটতে থাকে ঢাকায়। সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি উনিশ শতকের শেষ দিকে কয়েকটি বিশেষায়িত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়। এগুলোর মধ্যে ১৮৬৩ সালে ঢাকা কলেজে খোলা হয় আইন বিভাগ। বর্তমান মিডফোর্ড হাসপাতালের পাশে ১৮৭৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ঢাকা সার্ভে স্কুল। পরবর্তী সময়ে এগুলো বিশেষায়িত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে পূর্ণাঙ্গ রূপ লাভ করে। নারী শিক্ষার পথে তৈরি অচলায়তন ভেঙে ইডেন গার্লস কলেজ প্রথম যাত্রা শুরু করে ইডেন গার্লস স্কুল হিসেবে। এই স্কুলটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৭৮ সালে।

ঢাকার শিক্ষা বিকাশের এই অব্যাহত ধারায় বিশ শতকের প্রথমার্ধেই একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার সংযোজন ঘটে। তা হচ্ছে ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা। প্রায় ১০০ বছরব্যাপী ঔপনিবেশিক যুগে ঢাকায় যেভাবে শিক্ষার বিস্তার ঘটতে থাকে তারই স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়ায় ঢাকা শহরকে ঘিরে শিক্ষা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য গতি সঞ্চারিত হয়। ঢাকায় প্রকাশিত হতে থাকে বেশ কয়েকটি সাহিত্যসাময়িকী। এরই ধারাবাহিকতায় ঢাকার প্রথম সাহিত্য সাময়িকী কবিতা কুসুমাবলীর নাম করা যেতে পারে। ১৮৬০ সালে সাময়িকীটি প্রকাশিত হয়েছিল। এই পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার। একই বছর ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় মনোরঞ্জিকা নামের একটি মাসিকপত্র। এভাবে এক দুই দশকের মধ্যে ছোটখাটো আরো কয়েকটি মাসিকপত্র প্রকাশিত হয়েছিল। ১৮৬০ সাথে ঢাকায় প্রথম সাপ্তাহিক প্রত্রিকা ঢাকা প্রকাশ প্রকাশিত হয়। পত্রিকাটির সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার অনেক আগে থেকেই শিক্ষা বিস্তারের পাশাপাশি সাহিত্য সংস্কৃতির বিকাশ ঘটতে থাকে। শিক্ষিত সমাজের নানামুখী চাহিদার কারণে ক্রমে ঢাকা থেকে প্রকাশিত হতে থাকে সমাজ সংস্কারবিষয়ক সাময়িকী, ধর্ম ও তত্ত্বজ্ঞানভিত্তিক সাময়িকী, চিকিৎসাবিষয়ক পত্রিকা ইত্যাদি। এভাবে মুসলিম অধিকার প্রতিষ্ঠার পর সুলতানি ও মোগল যুগে ঢাকায় শিক্ষার একটি সুনির্দিষ্ট ধারা রচিত হয়েছিল। ঔপনিবেশিক যুগে কলকাতাকেন্দ্রিক প্রশাসনের দৃষ্টি-গোচরে না থাকায় ঢাকার শিক্ষাচর্চার ধারাবাহিকতায় কিছুটা স্থবরিতা আসে। তবে তা ছিল সাময়িক। উনিশ শতকের তিরিশের দশক থেকে আবার রূপান্তরের ধারা লক্ষ করা যায়। এভাবে ঢাকায় শিক্ষা বিস্তারের যে ধারা রচিত হয়েছিল তা অব্যাহত রয়েছে অদ্যাবধি।

বর্তমান বাংলাদেশে শিক্ষার প্রচার ও প্রসার বেশ ব্যাপক ও বিস্তৃত। দেশের প্রতি শহর-বন্দর ও গ্রাম-গন্জে স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসার সংখ্যা অনেক। দেশে বিশ্ববিদ্যালের সংখ্যাও একেবারে কম নয়। সরকারের নানাবিধ উদ্যোগের পাশাপাশি শিক্ষা বিস্তারের লক্ষ্যে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় অনেক প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছেন যা জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চা ও গবেষণায় বিশেষ ভূমিকা পালন করে চলেছে। এরিস্টটলের ভাষায় শিক্ষার্থীদের দেহ ও মনের বিকাশ সাধন এবং তার মাধ্যমে জীবনের মাধুর্য ও সত্য উপলব্দি করে শিক্ষার যে প্রকৃতি সাধিত হয় তাই মূলত শিক্ষা এবং এ শিক্ষা সৃষ্টির সূচনা লগ্ন থেকে ইতিহাস পরিক্রমায় নানা পরিবর্ধন, পরিমার্জন ও পরিশীলনের মা্ধ্যমে আজ অনেকটাই উন্নত বৈশিষ্টময়। ইতিহাস ঐতিহ্যে শিক্ষার আধুনিকায়ন ও বিশ্বায়ন প্রক্রিয়া বাংলাদেশে শিক্ষার গতি ধারাকে অনেক দুর এগিয়ে নিয়ে যাবে বলে আমরা আশাবাদী।

লেখক: প্রিন্সিপাল, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, ঢাকা

(দ্য রিপোর্ট/একেএমএম/সেপ্টেম্বর ২১,২০১৯)

পাঠকের মতামত:

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

SMS Alert

বিশেষ সংবাদ এর সর্বশেষ খবর

বিশেষ সংবাদ - এর সব খবর