thereport24.com
ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১,  ২৬ জমাদিউল আউয়াল 1446

তদন্তেই সীমাবদ্ধ রেলওয়ে থানার গণধর্ষণ মামলা!

২০২০ জানুয়ারি ২৫ ১১:৩২:৫০
তদন্তেই সীমাবদ্ধ রেলওয়ে থানার গণধর্ষণ মামলা!

দ্য রিপোর্ট প্রতিবেদক: খুলনা রেলওয়ে (জিআরপি) থানার ভিতরে আলোচিত গৃহবধূ গণধর্ষণ মামলটি তদন্তেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে।

তবে, থানা হেফাজতে নির্যাতনের মামলাটির তদন্ত রিপোর্ট সম্প্রতি আদালতে দাখিল হলেও ধর্ষণের মূল অভিযোগের তদন্ত রিপোর্ট এখনও আলোর মুখ দেখেনি। ফলে দীর্ঘ প্রায় পাঁচ মাসেও চাঞ্চল্যকর এ ঘটনার বিচার শুরু হয়নি।

অপরদিকে, ঘটনার মূল নায়ক থানার তৎকালীন ওসি ওছমান গনি পাঠানসহ অভিযুক্ত পাঁচ পুলিশ সদস্যের মধ্যে কোন আসামিকেই গ্রেপ্তার করা হয়নি। শুধুমাত্র ওসি উছমান ও এসআই নাজমুলকে ক্লোজড করা হয়েছে। এতে করে চরম হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন ধর্ষণ ও নির্যাতনের শিকার ওই নারী ও তার পরিবারের সদস্যরা।

ফ্লাশব্যাক : গত বছরের ২ আগস্ট যশোর থেকে ট্রেনে খুলনায় আসার পথে গৃহবধূকে মোবাইল চুরির অভিযোগে আটক করে খুলনা রেল স্টেশনের জিআরপি পুলিশের সদস্যরা। পরে রাতে জিআরপি থানায় আনার পর ওসি উছমান গনি পাঠানসহ পাঁচ পুলিশ সদস্য ধর্ষণ করে তাকে।

পরদিন ২ আগস্ট তাকে পাঁচ বোতল ফেনসিডিলসহ এক মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে খুলনার সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আমলী আদালত ফুলতলায় পাঠানো হয়। ৪ আগস্ট আদালতে জামিন শুনানিকালে জিআরপি থানায় ধর্ষণের বিষয়টি আদালতের সামনে তুলে ধরেন তিনি। এরপর আদালতের নির্দেশে ৫ আগস্ট খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ওই গৃহবধূর ডাক্তারি পরীক্ষা করানো হয়।

আদালতে গণধর্ষণ ও নির্যাতনের লোমহর্ষক বর্ননা : গণধর্ষণের শিকার গৃহবধূ থানায় দায়েরকৃত এজাহারে উল্লেখ করেন, ‘আটকের পর খুলনা জিআরপি থানার ডিউটি অফিসারের সহায়তায় আমার ওপর ব্যাপক নির্যাতন করেন ওসি ওসমান গনি পাঠান। ঘটনার দিন রাত দেড়টার দিকে আমাকে অপর এক কক্ষে নিয়ে যান ডিউটি অফিসার। ওসি ওই কক্ষে প্রবেশ করে ভেতর থেকে দরজা আটকে দেন। এরপর মুখে কাপড় গুঁজে দিয়ে পরপর তিনবার আমাকে ধর্ষণ করেন ওসি। ধর্ষণের সময় জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবহার করেন ওসি। ওসির পর আমাকে ধর্ষণ করেন মুখে দাগওয়ালা ডিউটি অফিসার। এরপর বাকি তিনজন পুলিশ সদস্য আমাকে ধর্ষণ করেন। তারা সবাই ধর্ষণের সময় জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী ব্যবহার করেছেন। ধর্ষণের সময় বাঁধা দিলে আমাকে মারপিট করা হয়।’

এজাহারে গৃহবধূ আরও উল্লেখ করেন, ‘পরদিন পাঁচ বোতল ফেনসিডিলসহ আমার বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে আদালতে সোপর্দ করে রেল পুলিশ। আদালত আমাকে কারাগারে পাঠায়। পরে আইনজীবীর মাধ্যমে আমাকে আদালতে আনা হয়। তখন আদালতে বিচারকের সামনে নেয়ার পর জিআরপি থানায় গণধর্ষণের বর্ণনা দেই আমি।’

তদন্ত কমিটি গঠন : ঘটনা তদন্তে পাকশী রেলওয়ে জেলা পুলিশ সুপার মোহাম্মদ নজরুল ইসলামের নির্দেশে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। তদন্ত কমিটির প্রধান করা হয় কুষ্টিয়া রেলওয়ে সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার ফিরোজ আহমেদকে। কমিটিতে সদস্য ছিলেন কুষ্টিয়া রেলওয়ে সার্কেলের ডিআইও-১ পুলিশ পরিদর্শক (নিরস্ত্র) শ. ম. কামাল হোসেইন ও দর্শনা রেলওয়ে ইমিগ্রেশন ক্যাম্পের পুলিশ পরিদর্শক (নিরস্ত্র) মো. বাহারুল ইসলাম। এ কমিটি ৬ আগস্ট থেকে তদন্ত শুরু করে। ৭ আগস্ট ওসি উছমান গনি পাঠান ও এসআই নাজমুলকে ক্লোজড করে পাকশী রেলওয়ে পুলিশলাইনে প্রত্যাহার করা হয়। ৮ আগস্ট পাকশী ও ঢাকা থেকে গঠিত পৃথক দুটি তদন্ত টিমের সদস্যরা আদালতের অনুমতি নিয়ে জেল গেটে ভিকটিমের জবানবন্দি গ্রহণ করেন। ইতোমধ্যে পুলিশ সদর দপ্তর থেকেও গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান এসপি সেহেলা পারভীন ওই থানার পুলিশ সদস্য ও ধর্ষণের শিকার গৃহবধূ এবং তার পরিবারের সঙ্গে কথা বলেন।

তদন্ত কমিটির প্রধান এসপি সেহেলা পারভীন ওই সময় বলেছিলেন, ওই গৃহবধূর কাছে জানতে চাওয়া হয়, তাকে কোথা থেকে কীভাবে আটক করা হয়েছিল, থানায় কি ঘটেছিল। সে বিষয়সহ আরও বেশকিছু বিষয় জানতে চাওয়া হয় তার কাছে। এছাড়া ওই দিন রাতে থানায় যাদের ডিউটি ছিল তাদের সবাইকেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।

পৃথক আইনে দু’টি মামলা দায়ের : খুলনা জিআরপি থানায় গৃহবধূকে গণধর্ষণ এবং নির্যাতনের ঘটনায় সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিষ্টেট সাইফুজ্জামান ‘নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারন) আইন ২০১৩ এর ১৫ ধারা মোতাবেক অভিযুক্ত পাঁচ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে মামলা গ্রহণের জন্য খুলনা জি.আর.পি থানাকে নির্দেশ দেন। তার পরিপ্রেক্ষিতে কারাবন্দী ভিকটিমের জবানবন্দীটি ৯ আগস্ট খুলনা রেলওয়ে থানায় এজাহার হিসাবে গ্রহণ করা হয়। এই মামলার তদন্তকারী অফিসার হিসেবে কুষ্টিয়া রেলওয়ে সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার ফিরোজ আহমেদকে দায়িত্ব দেওয়া হয়।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ভিকটিমকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ১৪ আগস্ট আদালতে আবেদন করেন। আদালতে ১৯ আগস্ট শুনানি শেষে ১০ দিনের মধ্যে ভিকটিমকে জেল গেটে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য অনুমতি দেন। ১৫ আগস্ট তার মেডিক্যাল প্রতিবেদন আদালতে জমা হয়।

অন্যদিকে, ওই গৃহবধূ মাদক মামলায় ২৬ দিন কারাভোগের পর ২৮ আগস্ট জামিনে মুক্ত হয়ে ২২ সেপ্টেম্বর খুলনার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৩ খুলনার আদালতে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ (সংশোধিত ২০০৩) এর ১০/৯(৩)/৩০ ধারায় একটি মামলা দাখিল করেন।

২৩ সেপ্টেম্বর আদালত অভিযোগটি এজাহার হিসাবে গ্রহণ করার জন্য খুলনা জি.আর.পি থানাকে নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে এবং গণধর্ষণের অভিযোগে দায়েরকৃত মামলাটি তদন্ত করার জন্য পুলিশ সুপার, পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন-পিবিআই, খুলনার কাছে পাঠান। মামলাটি তদন্ত করছেন পিবিআই পরিদর্শক আবু বকর।

ভুক্তভোগীর পরিবারের ক্ষোভ :ভুক্তভোগীর বোন হোসনে আরা বেগম ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘আসামিরা সকলেই পুলিশ, তাদেরতো পালিয়ে থাকার কথা না। কিন্তু তাদের কেন গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না। অপরাধ করেও পুলিশ সদস্যরা বাইরের হাওয়া খাচ্ছে।’ দ্রুত মামলার তদন্ত সম্পন্ন করে অভিযুক্তদের কঠোর শাস্তির দাবি জানান তিনি।

বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থা খুলনার সমন্বয়কারী ও বাদির আইনজীবী এ্যাডভোকেট মো. মোমিনুল ইসলাম বলেন, ‘মামলা নথিভূক্ত হওয়ার পর তদন্ত কার্যক্রমের পাশাপাশি আসামিদের গ্রেপ্তার করারও বিধান রয়েছে। কিন্তু দীর্ঘ প্রায় পাঁচ মাসেও আসামিদের গ্রেপ্তার না করা দুঃখজনক।

তবে, মাদক মামলায় জামিনে মুক্তিলাভের পর থেকে ওই নারীর মোবাইল বন্ধ থাকায় তার সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হচ্ছে না বলেও জানান তিনি।

তদন্ত কর্মকর্তাদের ভাষ্য : নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারন) আইনে দায়েরকৃত মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা কুষ্টিয়া রেলওয়ে সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার ফিরোজ আহমেদ এ প্রতিবেদককে বলেন, তদন্ত কার্যক্রম সম্পন্ন করে জানুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে প্রতিবেদনও আদালতে দাখিল করা হয়েছে। তবে, কোন আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। তারা ক্লোজ অবস্থায় রয়েছে। এখন আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

ধর্ষণ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআই খুলনার পরিদর্শক আবু বকর বলেন, তদন্ত শেষ পর্যায়ে রয়েছে। আগামী মাসে রিপোর্ট দাখিলের সম্ভাবনা রয়েছে। তবে, তদন্ত শেষ না করা পর্যন্ত এ বিষয়ে বিস্তারিত কিছু বলতে রাজি হননি তিনি।

(দ্য রিপোর্ট/আরজেড/জানুয়ারি ২৫,২০২০)

পাঠকের মতামত:

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

SMS Alert

অপরাধ ও আইন এর সর্বশেষ খবর

অপরাধ ও আইন - এর সব খবর