thereport24.com
ঢাকা, সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১,  ২১ জমাদিউস সানি 1446
মো:জিহাদুজ্জামান

ব্যাংকার ও এমফিল গবেষক

রমজানে জিহ্বার সংযম

২০২০ মে ০৭ ২০:৫৪:৩৪
রমজানে জিহ্বার সংযম

পবিত্র রমজান মাস মুসলমানদের জন্য এক অপার রহমতের বার্তা নিয়ে আগমন করে। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন পবিত্র কুরআনে এবং আল্লাহ্‌র রাসুল (সা.) তার বাণীতে অসংখ্যবার এ মাসের গুরুত্ব ও ফজিলত বর্ণনা করেছেন। রহমত, বরকত ও মাগফিরাতের এ মাসে মানুষের দৈনন্দিন অভ্যাস ও কার্যকলাপেরও ব্যাপক পরিবর্তন আসে। পরিবর্তন আসে ইবাদত বন্দেগীতেও। এসময়ে মানুষ যদি একটি সহজ কাজ তথা শুধুমাত্র জিহবাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে তাহলে অনায়াসেই অনেক বড় বড় পাপ থেকে মুক্ত থাকতে পারে।

জিহ্বা অতি ছোট অথচ মানব দেহের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অঙ্গ। এটিকে সচল রাখার জন্য মহান আল্লাহ্‌ এক বিশেষ ব্যবস্থায় সবসময় আর্দ্র রাখেন। ওই ব্যবস্থা না থাকলে মানুষ জিহ্বাকে কোনো কাজেই লাগাতে পারত না। আর এই ছোট্ট অঙ্গদ্বারা অনেক বড় বড় পাপ কাজ হয়ে যায় যা আমরা চিন্তাও করি না। রমজান মাসেই এই কাজগুলি না করার অভ্যাস গড়ে তোলা খুবই সম্ভব, আর এ অভ্যাস যদি বাকী এগারো মাস চালু রাখা যায় তবেই বড় বড় সেই পাপগুলি চিরতরে দূরীভূত হয়ে যাবে।

এবার আসুন, দেখা যাক জিহ্বা দ্বারা কত ধরনের পাপ হতে পারে –
১.গীবত- পরনিন্দা করা, ২. বোহতান- মিথ্যা অপবাদ ৩. মিথ্যা কথা বলা, ৪. ঝগড়া করা, বিশেষ করে ঝগড়ার সময় অশ্লীল ভাষায় গালাগালি করা, ৫. হারাম খাবার খাওয়া, ৬. সাক্ষাতে মানুষকে অপমান করা, ৭.মিথ্যা সাক্ষী দেয়া, ৮. অত্যাধিক খাওয়া (অর্থাৎ হালাল খাবার হলেও তা অত্যাধিক খাওয়া), ৯.মাতা-পিতাকে কষ্ট দেয়া, ১০.বেহুদা কথাবার্তা বলা।

একদিকে যেমন আমরা সাওম পালন করি অপরদিকে সালাত অনাদায়, গীবত, মিথ্যা, কামাচার, পাপাচার ইত্যাদির মত জঘন্যতম অপরাধেও কেউ কেউ লিপ্ত হই। কিছু লোক আছে, যাদের রোজা শুধুমাত্র অনাহারে দিনযাপন বা উপোস থাকাই হয়। কিন্তু রাসুল (সা.) এমাসে অশ্লীল কথা ও কাজ থেকে বিরত থাকতে নির্দেশ দিয়েছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: কত সাওম পালনকারী রয়েছে যারা অনাহার ছাড়া আর কিছুই পায় না। (মুসনাদ আহমাদ)।

অন্যত্র তিনি বলেছেন : ‘‘যে ব্যক্তি অশ্লীল কথা ও কাজ পরিত্যাগ করতে না পারে তার পানাহার থেকে বিরত থাকা আল্লাহ্‌র দরকার হবে না।।” (সহীহ বুখারি)।

আলোচ্য হাদিসে দুটি বিষয়ে অর্থাৎ দুটি কাজ থেকে বিরত থাকার প্রতি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে, যথা: ১. অশ্লীল কথা ২. অশ্লীল/খারাপ কাজ। বিষয়বস্তুর কাছাকাছি আরেকটি হাদিস প্রণিধানযোগ্য। হযরত সাহাল ইবনে ইবনে সাআদ (রা.) বলেন, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি নিজের দুই চোয়ালের মাঝের অঙ্গ এবং দুই রানের মাঝের অঙ্গ হেফাজত করবে আমি তার জান্নাতের জিম্মাদার।’ (সহিহ বুখারি)

হাকিমুল উম্মত হজরত মাওলনা আশরাফ আলী থানভি (রহ.) বলেন, “মানুষ ত্রিশ প্রকারেরও বেশি গোনাহ নিজের জবান দিয়ে করে থাকে। কত সময়ের অপচয় করে থাকে। চলার পথে কিংবা যানজটে নগরবাসীর অগণিত শ্রমঘণ্টা অবলিলায় ক্ষয়ে যায়। অথচ ইচ্ছা করলেই নষ্ট সময়গুলো মূল্যবান থেকে মহামূল্যবান করে তোলা যায়। শুধু জিহ্বা নেড়ে পরকালের সঞ্চয় বাড়ানো যায়।’’

জিহ্বা দ্বারা সংঘটিত পাপগুলির ব্যাপারে কুরআন ও হাদিসের নির্দেশনা এভাবে পাই:

১.গীবত বা পরনিন্দা: কোন মানুষের অসাক্ষাতে তার দোষত্রুটি বলা, যা মানুষের নিকৃষ্টতম অভ্যাস। পবিত্র কুরআনের বাণী; “এবং গোপনীয় বিষয় অনুসন্ধান কর না, তোমাদের কেউ যেন পশ্চাতে নিন্দা না করে, কেউ কি তার মৃত ভাইয়ের গোশত ভক্ষণ করতে পছন্দ কর, বস্তুত তা ঘৃণাই করবে, সুতরাং তোমরা আল্লাহ্‌কে ভয় কর, নিশ্চয়ই আল্লাহ্‌ তাওবা কবুলকারী ও পরম দয়ালু।” (সুরা হুজরাত, আয়াত-১২)।

হাদিসে এসেছে, হযরত জাবের বিন আব্দুল্লাহ এবং আবু সাইদ খুদরী রা. হতে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ্‌ (সা.) বলেছেন: ‘পরনিন্দা যিনার চেয়েও নিকৃষ্ট।’(মেশকাত)

পবিত্র রমজান মাসে এই মহাব্যাধি থেকে মুক্ত থাকতে হবে। গীবত শুধু মুখে বলার দ্বারা হয় তা নয়, বরং ইশারা-ইঙ্গিত ও অঙ্গভঙ্গির দ্বারাও গীবত হয়। গীবত করা ও শোনা দুটিই সমান অপরাধ। জীবিত ও মৃত উভয় ধরনের মানুষের গীবত করা হারাম।

২. বোহতান- মিথ্যা অপবাদ: যার মধ্যে যে দোষ-ত্রুটি নাই, তাই মিথ্যাভাবে অপরকে বলে বেড়ানো। এটা গীবতের চেয়েও জঘন্য কাজ। এব্যাপারে আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন বলেন, ‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌’আর যারা সতী নারীকে অপবাদ দেয়, অতঃপর চারজন সাক্ষী উপস্থিত না করে, তাদেরকে আশিটি বেত্রাঘাত কর, আর তাদের সাক্ষ্য কক্ষণো গ্রহণ কর না, এরাই না-ফরমান।’(সুরা আন নূর, আয়াত-৪)

৩. মিথ্যা কথা বলা: আরবিতে দু’টি প্রবাদ আছে; মিথ্যা সকল পাপের মা-উৎস এবং সত্য মুক্তি দেয় আর মিথ্যা মানুষকে ধ্বংস করে। হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি মিথ্যা-প্রতারণা ও গুনাহের কাজ ত্যাগ করে না, আল্লাহ তা'আলার কাছে তার পানাহার থেকে বিরত থাকার কোনো মূল্য নেই।’ (আবু দাউদ)

হযরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত রাসুল (সা.) বলেন; ‘মুনাফিকের লক্ষণ তিনটি: কথায় কথায় মিথ্যা কথা বলে, ওয়াদা করলে ওয়াদা ভংগ করে আর আমানতের খেয়ানত করে।’ তাই পবিত্র রমজানের পবিত্রতা রক্ষার্থে এ মাসে কোনো ধরনের মিথ্যা কথা বলা ও কোনো মিথ্যার আশ্রয় নেওয়া থেকে বিরত থাকা জরুরি।

৪. ঝগড়া করা : বিশেষ করে ঝগড়ার সময় অশ্লীল ভাষায় গালাগালি করা। কেউ কেউ মুনাফিকের চারটি লক্ষণের কথা বলেছেন-উপরের তিনটি সহ চতুর্থটি হলো পরষ্পর ঝগড়া করলে অশ্লীল ভাষা ব্যবহার করে। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) হতে বর্ণিত তিনি বলেন; ‘মুসলমানকে গালাগালী করা কবিরাহ গুনাহ এবং তার সঙ্গে মারামারী করা কুফরি’। হযরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণীত তিনি বলেন, রাসুল সা. বলেছেন, ‘এমন দুটি স্বভাব মানুষের মধ্যে রয়েছে যা কুফরির অন্তর্ভূক্ত -১, কারো বংশ তুলে তিরষ্কার করা ২. মৃতের জন্য বিলাপ করে কান্নাকাটি করা।’ হযরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে অন্য একটি হাদিসে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘রোজা ঢাল স্বরূপ, সুতরাং অশ্লীলতা করবেনা ও মূর্খের মত কাজ করবে না। যদি কেউ তার সাথে ঝগড়া করতে চায়, তাকে গালি দেয়, তবে সে যেন দুইবার বলে, আমি রোজাদার’। (সহিহ বুখারি)

৫. হারাম খাবার খাওয়া: রমজানে অশ্লীলকাজ থেকে বিরত থাকা যেমন জরুরি, তেমনি ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সব ক্ষেত্রে মিথ্যার আশ্রয় নেওয়া থেকে বিরত থাকাও জরুরি। ওজনে কম দেয়া, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি ও অতীব জঘন্য কাজ, যা রোজা থেকে করলে রোজাকে ধ্বংস করে দেবে। মহান আল্লাহ্‌ বলেন; ‘হে ইমানদারগণ, পরস্পরের সম্মতিতে ব্যবসার মাধ্যমে ছাড়া তোমরা একে অপরের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভক্ষণ করো না’। (সুরা- নিসা, আয়াত-২৯)

মহানবী (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘ওই গোশত (দেহ) জান্নাতে যাবে না, যা হারাম (খাবার) থেকে উৎপন্ন। জাহান্নামই এর উপযোগী।’ (সহিহ ইবনে হিব্বান ও তিরমিজি)

৬. সাক্ষাতে মানুষকে অপমান করা: অনেকে এমন আছেন যে, সামান্য ভুল-ত্রুটি পেলেই মানুষকে অপমান করেন এবং দম্ভ করে বলেন আমি তো তোমার পেছনে বলছি না। এব্যাপারে আল কুরআনের বাণী; ‘প্রত্যেক পশ্চাতে ও সম্মুখে পরনিন্দাকারীর দুর্ভোগ’ (সূরা হুমাঝাহ্, আয়াত-১)

৭. মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া: রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন-‘তোমরা কি বলতে পার কোনগুলো সব গুনাহের বড় গুনাহ। সাহাবীরা বলেন, আল্লাহ্‌র রাসুলই ভাল জানেন। রাসুল বলেন; সেগুলো হলো; ক. আল্লাহ্‌র সাথে শরীক করা, খ. পিতা মাতার অবাধ্য হওয়া, গ. মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া।

৮. অত্যাধিক খাওয়া: হালাল খাবার হলেও তা পরিমিত না খেয়ে অত্যাধিক খাওয়া ইসলামী শিষ্টাচারবিরোধী। রমজান মাসে ইফতারি ও সাহরীতে অধিক পরিমাণে খাবার গ্রহণ এবং নষ্ট করা মুসলিমদের একটি সাধারণ অভ্যাস তথা কথিত আভিজাত্যে পরিণত হয়েছে, যা অপব্যবহার বা অপচয়েরই নামান্তর। অথচ কুরআনে অপচয় করা শয়তানী স্বভাবের কথা বলা হয়েছে । আল্লাহ বলেন; ‘নিশ্চয়ই অপচয়কারী শয়তানের ভাই’। (সূরা বনি ইসরাইল, আয়াত-২৭)

মহানবী (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘সে পরিপূর্ণ মুমিন নয়, যে পেট পুরে আহার করে আর তার প্রতিবেশী অভুক্ত অবস্থায় থাকে’। (মেশকাত ও আদাবুল মুফরাদাত)

৯. মাতা-পিতার সাথে অসদাচরণ: শুধু রমজান নয়, কখনো কোনো বিষয়ে মাতা-পিতার সঙ্গে অসদাচরণ করা যাবে না। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ বলেন, ‘‘তোমার পালনকর্তা আদেশ করেছেন যে আল্লাহ্‌ ছাড়া অন্য কারো ইবাদাত করো না এবং মাতা-পিতার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করো। তাদের মধ্যে কোনো একজন অথবা উভয়েই যদি তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হয়, তাহলে তাদের ‘উফ’ শব্দটিও বলো না এবং ধমক দিয়ো না এবং তাদের সঙ্গে শিষ্টাচারপূর্ণ কথা বলো।’ (সুরা বনি ইসরাইল, আয়াত : ২৩)

১০.অহেতুক কথাবার্তা বলা: রমজানে রোজা রেখে অশালীন কথা বলা, গালি দেওয়া নিষেধ। তাই রোজা রেখে এ ধরনের কাজে লিপ্ত হওয়া উচিত নয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘তোমাদের কেউ যখন রোজা রাখে তখন সে যেন অশালীন কথাবার্তা না বলে ও হৈচৈ না করে।’ ( সহীহ বুখারি)

রমজানে রোজা রেখে কেউ এ ধরনের কাজে লিপ্ত হলে তার রোজার বরকত নষ্ট হয়ে যায়। অবসর সময় আল্লাহ্‌র স্মরণে কাটিয়ে দেয়াই শ্রেয়। কারণ আল্লাহ্‌র স্মরণেই রয়েছে সফলতা। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহকে অধিক পরিমাণে স্মরণ কর, যাতে তোমরা সফলতা অর্জন কর।’ (সুরা আনফাল, আয়াত : ৪৫)

সুতরাং আমরা যদি আমাদের জিহ্বার নিয়ন্ত্রিত ব্যবহার করতে পারি তবে অনেক কবিরাহ গুনাহ থেকে দূরে থাকতে পারবো। পক্ষান্তরে উপর্যুক্ত গর্হিত পাপাচার অভ্যাসের পরিবর্তে বিপরীত ভাল কাজ অর্থাৎ সত্য কথা বলা, গীবত ও চোগলখোরীর পরিবর্তে সংশোধনের জন্য গঠনমূলক সমালোচনা করা, হালাল খাবার খাওয়া, অহেতুক ও অশ্লীল কথার পরিবর্তে কল্যাণ ও নসীহতমূলক কথা বলা মাতা-পিতার সাথে সুন্দর ব্যবহার করে জিহ্বাকে সবসময় মহান রবের জিকিরে মশগুল রেখে মাহে রমজান অতিবাহিত করলে আশা করা যায় আল্লাহ্‌র নেয়ামতপ্রাপ্ত বান্দাদের গুণে গুণান্বিত হওয়ার পথ সুগম হয়ে যাবে। যে গুণে বছরের বাকী এগারোটি মাসও চলতে সহজ হয়ে যাবে।

(দ্য রিপোর্ট/একেএমএম/ মে ০৭,২০২০)

পাঠকের মতামত:

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

SMS Alert

ধর্ম এর সর্বশেষ খবর

ধর্ম - এর সব খবর