thereport24.com
ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৬ ফেব্রুয়ারি 25, ২৩ মাঘ ১৪৩১,  ৭ শাবান 1446

এমপি আবুল হাসনাত আবদুল্লাহ’র স্ত্রী মারা গেছেন

২০২০ জুন ০৮ ১০:২০:২১
এমপি আবুল হাসনাত আবদুল্লাহ’র স্ত্রী মারা গেছেন

দ্য রিপোর্ট প্রতিবেদক: দক্ষিন বাংলার সিংহ পুরুষ,পার্বত্য শান্তি চুক্তির রুপকার জনাব আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর সহধর্মিণী ও বরিশাল সিটি মেয়র সাদেক আবদুল্লাহর মা শাহানারা আবদুল্লাহ আজ রাত ১টার দিকে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ইন্তেকাল করেছেন। বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতিও ছিলেন তিনি।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাতে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে হামলার পাশাপাশি তার ভগ্নিপতি ও তৎকালীন পানিসম্পদমন্ত্রী আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের ২৭ নম্বর মিন্টো রোডের বাড়িতেও হামলা করে ঘাতকেরা। সেখানে আব্দুর রব সেরনিয়াবাতসহ ছয়জনকে হত্যা করা হয়। তারা হলেন-সাবেক মন্ত্রী ও বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি আব্দুর রব সেরনিয়াবাত, তার ভাইয়ের ছেলে সাংবাদিক শহীদ সেরনিয়াবাত, মেয়ে বেবী সেরনিয়াবাত, ছেলে আরিফ সেরনিয়াবাত, নাতি সুকান্ত বাবু সেরনিয়াবাত এবং বরিশালের ক্রিডেন্স শিল্পগোষ্ঠীর সদস্য আব্দুর নঈম খান রিন্টু। আর আহত হয়েছিলেন ৯ জন। তারা হলেন-আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের স্ত্রী আমেনা বেগম, বেগম শাহানারা আব্দুল্লাহ, বিউটি সেরনিয়াবাত, হেনা সেরনিয়াবাত, আবুল খায়ের আব্দুল্লাহ, রফিকুল ইসলাম, খ ম জিল্লুর রহমান, ললিত দাস ও সৈয়দ মাহমুদ।

গুলিবিদ্ধ হয়ে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে কাতরাচ্ছিলেন পরিবারের আরও ৯ সদস্য। এদের মধ্যে একজন ছিলেন আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের পুত্রবধূ, আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর স্ত্রী শাহানারা আবদুল্লাহ। সেদিনের মর্মন্তুদ ঘটনা প্রসঙ্গে তিনি বিভিন্ন সময় গণমাধ্যমে কথা বলেছেন।

তার সেই বর্ণনা আজ পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো:

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের ভোর, সবে ফজরের নামাজের সময় হয়েছে। চারদিক থেকে আজানের ধ্বনি ভেসে আসছিল। এমন সময় অতর্কিত হামলায় কেঁপে উঠলো মিন্টো রোডের বাড়িটি। ঘাতকদের আগমনে ভয় পেয়েছিল আমার চার বছরের ছেলে সুকান্ত বাবু সেরনিয়াবাত। সে আমার কোলে আশ্রয় নিতে চেয়েছিল। কিন্তু তার আগেই ঘাতকরা চোখের সামনে গুলি চালিয়ে হত্যা করে সুকান্ত বাবুকে। সেদিন (১৫ আগস্ট) ফজরের আজানের পর আমরা প্রচণ্ড গুলির শব্দ পাচ্ছিলাম। শব্দ আমাদের বাসার দিকেই আসছিল। গুলির শব্দে হঠাৎ করে আমাদের ঘুম ভেঙে যায়। আমার শাশুড়ি (বঙ্গবন্ধুর বোন আমেনা বেগম) বললেন-বাড়িতে ডাকাত পড়েছে, আমার ভাইকে (বঙ্গবন্ধু) ফোন দাও। এরপর আমার শ্বশুর আব্দুর রব সেরনিয়াবাত বঙ্গবন্ধুকে একটা ফোনও করেছিলেন। কিন্তু কী কথা হয়েছিল, বলতে পারবো না। এরইমধ্যে আমি শেখ ফজলুল হক মনি ভাইকে ফোন করলাম। ফোনে তাকে বললাম, আমাদের বাড়ির দিকে কারা যেন গুলি করতে করতে আসছে, বুঝতে পারছি না।’ মনি ভাই বললেন, ‘কারা গুলি করছে দেখো।’ বললাম, ‘বৃষ্টির মতো গুলি হচ্ছে, দেখা যাচ্ছে না।’ মনি ভাই বললেন-‘তারপরেও দেখো, কারা আসছে।’ এরমধ্যেই ফোনটি আমার হাত থেকে টেনে নিয়ে আমার শাশুড়ি মনি ভাইকে বলেন-‘বাবা বাড়িতে ডাকাত পড়েছে, আমাদের বাঁচাও।’ একথা বলেই ফোন রেখে দিয়ে আমার শাশুড়ি আমার শ্বশুরকে বললেন-‘কী ব্যাপার, তুমি আমার ভাইকে (বঙ্গবন্ধু) ফোন দিলা না?’ আমার শ্বশুর বলেন-‘তোমার ভাইও মনে হয় রেহাই পায়নি।’

এদিকে ততক্ষণে আমাদের দরজা ভাঙার শব্দ পাচ্ছিলাম। এমন সময় একটা চিৎকার শুনলাম-তোমরা সামনে এগোবে না, ভালো হবে না। এ সময় ওরা (ঘাতকেরা) থমকে দাঁড়ায়। ওই চিৎকারটি দিয়েছিলেন আমার স্বামী আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ। এরপর উনি দোতলায় চলে যান। কাজের বুয়া দরজাটা বন্ধ করে দেয়। দরজা বন্ধ করে দেওয়ার পর উনি আমাদের ঘরে না ঢুকে ডান পাশের রুমে ঢুকে যান। পরে আমরা জানতে পারি, সে সময় একটা ফোন আসে। ফোনটি রিসিভ করেন হাসানাত। খবর ছিল- মনি ভাই মারা গেছেন। এরমধ্যে ঘাতকেরা বাড়ির দরজা ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে। তারা রুমে ঢুকে ‘হ্যান্ডস আপ, হ্যান্ডস আপ’ বলে আমাদের সবাইকে কর্ডন করে নিচতলার ড্রইং রুমে সারিবদ্ধ করে দাঁড় করিয়ে রাখে। সিঁড়ির অর্ধেক নেমেই বাবু (সুকান্ত বাবু) বলে, ‘মা আমি তোমার কোলে উঠবো।’ কিন্তু আমি ওকে কোলে নিতে পারলাম না। পাশে আমার ভাসুর (শহীদ সেরনিয়াবাত) ওকে কোলে নিলো। নিচে নামার পর ভারী অস্ত্র ঠেকিয়ে ওরা (ঘাতকেরা) আমাকে জিজ্ঞাসা করে-‘উপরে আর কে কে আছে?’ এমন সময় আমার শ্বশুর আমার দিকে এমনভাবে তাকালেন যে তার চোখের ইশারায় আমি বললাম-ওপরে আর কেউ নেই। তাই উপরের রুমগুলো তল্লাশি না হওয়ায় আমার স্বামী আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহকে ওরা খুঁজে পায়নি।’’

তখনও আমরা বুঝতে পারছিলাম না, ওরা আমাদের মারতে এসেছে, নাকি গ্রেফতার করে নিয়ে যাবে। আমার শ্বশুর ওদের বললো—‘তোমরা কী চাও। তোমাদের কমান্ডিং অফিসার কে।’ ওদের মধ্যে থেকে একজন বলে-‘আমরা কিছুই চাই না। আমাদের কোনও কমান্ডিং অফিসার নেই।’ এই কথা বলার সঙ্গে সঙ্গেই ঘাতকেরা ব্রাশফায়ার করে। আমরা মাটিতে পড়ে যাই।’’

শহীদ ভাইকে ঠেকিয়ে ওরা গুলি করে। উনি সঙ্গে সঙ্গে উপুড় হয়ে পড়ে যান। আমার শ্বশুরের শরীর দিয়ে রক্ত বের হচ্ছিলো। আমার শরীরের পেছনের অংশে হাত দিয়ে দেখি রক্ত বের হচ্ছে। ওরা চলে যেতে লাগলো। তখনও আমার জ্ঞান ছিল। এরমধ্যেই কে যেন কান্না করে ওঠে। এরপর ঘাতকরা আবারও দৌড়ে এসে ব্রাশফায়ার করে। এবার ওরা নিচ দিয়ে ব্রাশফায়ার করে। আমার শ্বশুর সঙ্গে সঙ্গে মারা যান। আমি আমার শ্বশুরের পেছনে ছিলাম, আমার কোমরে গুলি লাগে। সে সময় ব্রাশফায়ারে ছয়জন মারা যান। আমরা গুলিবিদ্ধ হয়ে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে ৯ জন কাতরাচ্ছিলাম।

এরমধ্যে আবারও একদল লোক গাড়ি নিয়ে আসে। তখন ভাবলাম-এই বুঝি শেষ। কিন্তু পরে দেখি রমনা থানার পুলিশ এসেছে। তারা আমার শ্বশুরের পালস দেখে বলে, বাড়ির কেউ আহত আর কেউ মারা গেছে।

পুলিশ আসার পর বাবুকে শহীদ ভাইয়ের বুকের নিচ থেকে উঠানো হল। দেখলাম ওর নাক দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। কিছু সময় আগে যে সন্তান আমার কোলে উঠতে চেয়েছিল, তাকে কোলে নিতে পারি নাই, সেই সন্তানের নিথর দেহ আমার চোখের সামনে।

আমার বাবু ছিল অসম্ভব মা-ভক্ত। আমি যখন যা বলতাম, তাই শুনতো। ও মাঝে মধ্যে বলতো-মা তোমাকে ছেড়ে অনেক দূরে ঘাসের মধ্যে গিয়ে শুয়ে থাকবো।

ওর জন্ম ১৯৭১ সালের ২২ জুন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ওকে বুকে নিয়ে গ্রামে গ্রামে দৌড়িয়েছি। একদিকে আর্মি অন্যদিকে রাজাকার। আমার স্বামী বরিশাল অঞ্চলের মুজিব বাহিনীর প্রধান ছিলেন। রাজাকাররা পেলেই আমাদের মেরে ফেলবে এমন আতঙ্কে ছিলাম। যুদ্ধ চলাকালে দীর্ঘদিন হাসানাতের সঙ্গে দেখা হয়নি। পরে একটি চিরকুট পেলাম। তিনি পয়সারহাট এসেছেন। সেখানে গিয়ে দেখা করি। সেই সময়ে বাবুকে বুকে নিয়ে আজকে এই বাড়ি কালকে ওই বাড়িতে দিন পার করেছি।

ওই সময় গ্রামে দুধ তো দূরের কথা ভাতও ঠিকমতো পাওয়া যায়নি। ভাত টিপে টিপে নরম করে বাবুকে খাইয়েছি। বাবু রাজত্ব নিয়ে জন্ম গ্রহণ করেছিল। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল। আবার ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ও চলে গেল।

(দ্য রিপোর্ট/আরজেড/০৮জুন, ২০২০)

পাঠকের মতামত:

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

SMS Alert

জাতীয় এর সর্বশেষ খবর

জাতীয় - এর সব খবর