thereport24.com
ঢাকা, রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১,  ২২ জমাদিউল আউয়াল 1446

শেয়ারবাজার নিয়ে সবাই কী সব কথা বলতে পারেন?

২০২১ অক্টোবর ০৯ ১০:৪৯:৪৪
শেয়ারবাজার নিয়ে সবাই কী সব কথা বলতে পারেন?

তৌহিদুল ইসলাম মিন্টু : বাংলাদেশে সপ্তাহব্যাপি পালিত হচ্ছে “ বিশ্ব বিনিয়োগকারী সপ্তাহ, ২০২১।” সারা সপ্তাহ জুড়ে
শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো নানা কর্মশালা,সেমিনার ওয়েবনিয়ার মিটিং করছে। এরই অংশ হিসেবে গত ৭ অক্টোবর শেয়ার তথ্য সংরক্ষণকারী রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি বাংলাদেশ লিমিটেডের (সিডিবিএল) উদ্যোগে এক ওয়েবনিয়ার মিটিং অনুষ্ঠিত হয়।

সিডিবিএলের চেয়ারম্যান এ কে এম নুরুল ফজল বুলবুলের সভাপতিত্বে ওয়েবিনারটি সঞ্চালনা করেন সংস্থাটির প্রধান প্রযুক্তি কর্মকর্তা মোহাম্মদ আব্দুল মোতালেব।

এ মিটিং থেকে জানানো হয় দেশের পুঁজিবাজারে নিয়মিত শেয়ার কারসাজি হচ্ছে। কৃত্রিমভাবে শেয়ারদর বাড়ানো, সংঘবদ্ধ শেয়ার কেনাবেচা, একই ব্যক্তির ভিন্ন ভিন্ন একাউন্ট থেকে শেয়ার কেনাবেচা হচ্ছে। ছড়ানো হচ্ছে ভুয়া তথ্য । আর এ কাজে সবচেয়ে বেশি জড়িত হচ্ছে সিকিউরিটিজ প্রতিষ্ঠানের অনুমোদিত ট্রেডাররা। বর্তমান প্রযুক্তিতে তাদের তাৎক্ষণিকভাবে শনাক্ত করা সহজ নয়।

মিটিং এ মুল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের নির্বাহী পরিচালক রেজাউল করিম।“ মার্কেট ম্যালপ্রাকটিস আ্যান্ড ইনভেস্টর্স আ্যাওয়ারনেস’ শীর্ষক ওয়েবিনারটিতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করতে গিয়ে রেজাউল করিম বলেন “পূজিবাজারে বিভিন্ন পদ্ধতি ও উপায়ে নীতিমালার বাইরে গিয়ে কৃত্রিমভাবে শেয়ার দর বাড়িয়ে কারসাজি করা হচ্ছে। এর মধ্যে উল্লেখ যোগ্য হচ্ছে স্ফুপিং, পাম্প আ্যন্ড ডাম্প, ওয়াশ ট্রেড, ইনসাইডার ট্রেডিং ও চার্নিং। এসবের সঙ্গে ট্রেডাররা জড়িত। তারাই শেয়ারের কৃত্রিম সংকট তৈরি করে কেনাবেচার অস্বাভাবিক চাপ তৈরি করে । কারণ হচ্ছে, শেয়ার কারসাজি করে অর্থ হাতিয়ে নিতে তারাই একাধিক বিও একাউন্ট নিয়ন্ত্রন করে।” (শেয়ারবিজ কড়চা,৮ অক্টোবর ) । এই ওয়েবিনারের অন্যান্য বক্তাদের ও প্রায় একই ধরনের বক্তব্য এসেছে। এখানে বিএসইসির কমিশনার আব্দুল হামিদ প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন। আইডিএলসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মনিরুজ্জামান বলেন, মূল্য সংবেদনশীল তথ্য অনেক আগেই প্রকাশিত হয়ে যাচ্ছে। এর সঙ্গে কোম্পানির পরিচালক ও কর্মকর্তারা জড়িত।

এই ওয়েবিনারটিতে যেসব তথ্য জানা গেলো তা রীতিমতো শিউরে উঠার মতো। একজন সাংবাদিক দুই তিন মাস ধরে অনুসন্ধান করেও হয়তো এ তথ্য উদ্ধার করতে পারতেন না। একটি অনুসন্ধানী রিপোর্টের খোরাক পাওয়া গেলো বাজার সংশ্লিষ্ঠ ব্যাক্তিদের কাছ থেকে। জানা গেলো এখনো কতসবকারসাজি হচ্ছে। তা নিয়ন্ত্রন করার ক্ষমতা কারো নেই। কী ভয়ংকর কথা।

খোলামেলা এ ধরণের সতর্কবার্তায় বাজারের প্রতি সংশয় তৈরি হতে পারে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আতংক ছড়িয়ে পড়ার মতো তথ্য এসব। যদি বিনিয়োগকারদের মনে এ সংশয় দেখা দেয় যে তাদের বিনিয়োগ আবার ঝুকিতে পড়ে গেছে তবে তাতে কী তাদের দোষ দেওয়া যাবে?

বেশ কিছ দিন ধরেই শেয়ারবাজার উর্ব্ধমুখী। সেটাকে কেউ কেউ এখনই ঝুকি পূর্ণ বলতে চাচ্ছেন। আবার অনেকে বলছেন এটা স্বাভাবিক। এখনো অনেক কোম্পানির শেয়ার মূল্য কম। কোম্পানির শেয়ারের মূল্য অনুপাতে আয় বা পিই রেশিও এখনো অনেক কম। বাজার সংশিষ্টরা বলছেন বাজার যখন বাড়তে থাকে তখন বাড়তে থাকে কারসাজির সুযোগ। অনেক সময় বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনার উদ্দেশ্যে নিয়ন্ত্রক সংস্থা জেনে বুঝে বাজারকে বাড়তে দেয়. আবার কারেকশনের মাধ্যমে বাজারকে ঝুকিমুক্ত হওয়ার ব্যবস্থা করে দেন।


তবে এবারের বাজারের উল্লম্ফনকে অনেকেই দুই হাজার দশ সালের ধস পূর্ববর্তী অবস্থার সঙ্গে তুলনা করেছেন। কিন্তু বিএসইসির কর্মকর্তারা বলে আসছেন বাজার ঠিক আছে। দেশের অর্থনীতির অন্যান্য সূচকের সঙ্গে তাল রেখেই শেয়ারবাজার ঠিক গতিতেই এগুচ্ছে। ৭ অক্টোবরের এই মিটিং থেকে যেসব তথ্য বেরিয়ে এসেছে তাতে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে বিএসইসির কর্মকর্তাদের আগের বক্তব্য ঠিক নয়। শেয়ারবাজারে রোগ বাসা বেধেছে। তাই খোলা মেলা ভাবেই বিনিয়োগকারীদের জানিয়ে দিতে শুরু করেছে সংশ্লিষ্টরা।

আমাদের বক্তব্য হচ্ছে শেয়ারবাজার নিয়ে সবাই কী সব তথ্য প্রকাশ করতে পারেন? আপনি যখন আপনার শরীরের গোপন কোনো রোগের খবর প্রকাশ করে দেবেন তখন কিন্তু খুব নিকটজনও আপনার কাছে ভিড়তে চাইবে না। শেয়ারবাজারের এমন ধরনেরই এক রোগের কথা ফাঁস করে দিয়েছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা।

আগে রোগ সারিয়ে তুলুন। তারপর বলুন আপনার শরীরে এক কঠিন রোগ বাসা বেধেছিলো। ভালো চিকিৎসকের চিকিৎসায় আপনি সুস্থ হয়ে উঠেছেন। গোপনে রোগ না সেরে তা এতটা খোলা মেলা ভাবে প্রকাশ করার উদ্দেশ্য কী? আপনার কাছে ঘেষতে না দেওয়া ?

শতভাগ নিশ্চিত না হয়ে কোনো তথ্য প্রকাশ করা ঠিক নয় । আবার সেটা নিশ্চিত হওয়ার পর সংশ্লিষ্ট অপরাধীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। তা না নিয়ে আগেই তথ্য প্রকাশ করে বাজারকে অস্থিতিশীল করে তোলার পরিবেশ তৈরি করা হচ্ছে। বিএসইসি, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ, চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ সিকিউরিটিজ হাউজগুলো, মার্চেন্ট ব্যাংক বা যে কোনো অংশীজনদের শেয়ারবাজার নিয়ে কথা বলার আগে ভাবতে হবে তা বাজারে কি ধরণের প্রভাব তৈরি হয়। কেননা তাদের কথা সাধারণ বিনিয়োগকারীরা প্রভাবিত হন।

রেজাউল করিমের মূল প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় ট্রেডারদের ম্যালপ্রাকটিস তাৎক্ষণিকভাবে শনাক্ত করার প্রযুক্তির সক্ষমতা বর্তমান ডিএসই বা সিডিবিএলের নেই। তাদের কার্যকলাপ চিহ্নিত করা হচ্ছে। একটি ডেটাবেজ তৈরি করা হচ্ছে। তারপর এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে। উদাহরণ দিয়ে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ক্রয়াদেশ এলে তা একসঙ্গে কেনা হয় না, বা অনেক ক্ষেত্রেই সম্ভবও হয় না।

তখন ট্রেডাররা ওই শেয়ারটি ভিন্ন কোনো বিও অ্যাকাউন্ট দিয়েও কিনতে শুরু করে। এভাবে শেয়ারের দর বাড়িয়ে তা আবার বিক্রি করে দেওয়া হয়। ট্রেডারদের পরিচিতজনরা ওইসব বিও অ্যাকাউন্ট পরিচালনা করে। আবার তারাই বিনিয়োগকারীদের বিভিন্ন শেয়ার কেনায় উদ্বুদ্ধ করে। এভাবে তারাই সবচেয়ে বেশি জড়িয়ে পড়ছে শেয়ার কারসাজিতে। এজন্য শেয়ার কেনায় বিনিয়োগকারীদের বেশি সচেতন হওয়া উচিত।

আলোচনায় অংশ নিয়ে লংকা-বাংলা সিকিউরিটিজের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও পরিচালক মো. খন্দকার সাফ্ফাত রেজা বলেন, বর্তমানেও কিছুটা কারসাজি করার সুযোগ রয়েছে, ক্ষেত্রবিশেষে যে হচ্ছে না, তাও না।

বিএসইসির কমিশনার মো. আব্দুল হালিম বলেন, ‘শেয়ার কারসাজি বন্ধ হলে বিনিয়োগকারীরা আকৃষ্ট হবেন। এজন্য প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদেরও সচেতন হতে হবে ‘। আমরা লক্ষ্য করছি বক্তারা সব দায় চাপিয়েছেন নিয়োগকারীদের ওপর । যেন বিনিয়োগকারীরা সচেতন হলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। সব কারসাজি বন্ধ হয়ে যাবে।

নিয়ন্ত্রক সংস্থার কর্মকর্তারই যেখানে বলছেন তারা নিয়ন্ত্রন করতে পারছেন না। সেখানে বিনিয়োগকারীর সচেতনার ওপর ভর করে দায় মুক্তি পাওয়ার এক অদ্ভুত চেষ্টা যেন এটা। এ যেন চোরকে বল চুরি করো গৃহস্থকে বলো ধরো ধরো অবস্থা। চোর গৃহস্থের ঘর খালি করে দিচ্ছে পুলিশ তা দাড়িয়ে দাড়িয়ে দেখছে।

শেযারবাজার একটি অতিসংবেদনশীল জায়গা। এখানে মনস্তাত্তিক খেলাটা জটিল। এই বাজারের মনস্তত্ব বোঝা খুবই কঠিন একটা বিষয়। এর উঠানামা অনেকটাই নির্ভর করে বিনিয়োগকারীদের মনস্তাত্বিক গঠনের ওপর। বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে পুরোটাই নির্ভর করে বিনিয়োগকারীদের মনোজগতের ওপর। এখানে মুল অর্থনীতির সঙ্গে শেয়ারবাজরের সম্পর্ক অনেক কম। তাই বিনিয়োগকারীদের যেমন অতি আশাবাদি করে তোলা ঝুকি পুর্ণ, তেমনি ভয় দেখানোটাও বিপদজনক।

তাই যারা নিজেদের প্রয়োজনে বিনিয়োগকারীদের আশা দেখান আবার প্রয়োজন মতো হতাশা ছড়ান করেন তাদের দায় সবচেয়ে বেশী।
(টিআইএম/৯ অক্টোবর, ২০২১)

পাঠকের মতামত:

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

SMS Alert

শেয়ারবাজার এর সর্বশেষ খবর

শেয়ারবাজার - এর সব খবর