thereport24.com
ঢাকা, বুধবার, ২৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১ পৌষ ১৪৩১,  ২৩ জমাদিউস সানি 1446

অস্তিত্বহীন নোমান নিটকে ৫০০ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে অগ্রণী ব্যাংক 

২০২৩ মার্চ ১১ ১৯:১২:০৭
অস্তিত্বহীন নোমান নিটকে ৫০০ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে অগ্রণী ব্যাংক 

তৌহিদুল ইসলাম মিন্টু: অস্তিত্বহীন এক প্রতিষ্ঠানকে ৫শ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত্ব অগ্রণী ব্যাংক। রাজাধানীর দৈনিক বাংলা মোড়ে অবস্থিত ব্যাংকটির ফরেন একচেঞ্জ শাখা থেকে এই ঋণ দেওয়া হয়েছে নোমান নিট কম্পোজিট লিমিটেড নামধারী একটি প্রতিষ্ঠানকে। বিশদ অনুসন্ধান ও রেকর্ডপত্রের ভিত্তিতে উদঘাটিত তথ্যে জানা গেছে প্রতিষ্ঠানটি কোনো অস্তিত্ব নেই।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, ২০১৮ সালে নেওয়া এ ঋণের যে বন্ধকী দলিল (নং-৮৩০০/২০১৮) করা হয়েছে তাতে ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে স্বাক্ষর করেছেন মো: নূরুল ইসলাম। কিন্ত রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টকে (আরজেসি)তে নিবন্ধিত ২ লাখ ২০ হাজার প্রতিষ্ঠানের মধ্যে নোমান নিট কম্পোজিট মিলস লিমিটেড নামে কোনো প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। ব্যাংক কোম্পানি আইনে অনিবন্ধিত কোন কোম্পানিকে ব্যাংক ঋণ দেওয়ার নিয়ম নেই।

আরজেসি সূত্র জানায়, ২০২০ সালে সারাদেশে নিবন্ধিত কোম্পানি ছিলো ২ লাখ ১৩ হাজার পাচশ'। গত দুই বছরে এ সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ২০ হাজারের বেশি। এর মধ্যে কিছু রয়েছে বিভিন্ন ধরণের সংগঠন। একক মালিকানাধীন কোম্পানি হিসেবে নিবন্ধিত রয়েছে ১ লাখ ৬৫ হাজার পাচশ' প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে সরকারি কোম্পানি ৩ হাজার পাচশ’। বেসরকারি কোম্পানি ১ লাখ ৬২ হাজার। এর মধ্যে আয়কর রিটার্ন দাখিল করে নিবন্ধন নবায়ন করেছে মাত্র ৫৫ হাজার কোম্পানি। এসব কোম্পানির কোনো শ্রেণীতেই নাম নেই নোমান নিট কম্পোজি মিলস লিমিটেড নামক প্রতিষ্ঠানের। তবে নোমান গ্রুপ নামে একটি গ্রুপ অব কোম্পানি রয়েছে-মর্মে বিভিন্ন রেকর্ডপত্রে পাওয়া গেছে। এই শিল্পপরিবারভুক্ত অন্তত: ৩৫টি প্রতিষ্ঠান রয়েছে বলে দাবি করা হয়। কিন্তু এই পরিবারে নোমান নিট কম্পোজিট মিলস লিমিটেড নামক কোনো প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব খুজে পাওয়া যায়নি।




নোমান শিল্প পরিবারভুক্ত বিভিন্ন কোম্পানি এবং ইউনিটের বেতন পরিশোধের নথি থেকে জানা গেছে ,শিল্পপরিবারটি ৩৫টি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারিদের বেতন পরিশোধ করছে। প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে, নাইস ফেব্রিকস প্রসেসিং লি:, নোমান ওয়েভিং মিলস লি:, নাইস স্প্যান মিলস লিমিটেড , ইয়াসমিন স্পিনিং মিলস লিমিটেড, নাইস মাইক্রোফেব লিমিটেড, জাবের অ্যান্ড জুবায়ের ফেব্রিকস লি: ফ্যাশন, নোমান কম্পোজিট টেক্সটাইল লিমিটেড, জাবের স্পিনিং মিলস লি:, নোমান ফ্যাশন ফেব্রিকস লি:, তালহা এক্সপ্রো লি:, নোমান স্পিনিং মিলস লি:, নোমান টেক্সটাইল মিলস লি:, নাইস সিন্থেটিক ইয়ার্ন মিলস লি:, জুবায়ের স্পিনিং মিলস লি:, জাবের টেক্সটাইল মিলস লি:, ইসমাইল আঞ্জুমান আরা ফেব্রিকস লি:, সাদ-সান টেক্সটাইল মিলস লি:, তালহা স্পিনিং মিলস লি:,ইসমাইল টেক্সটাইল মিলস লি:, নোমান টেরিটাওয়েল মিলস লি:, তালহা ফেব্রিকস লি:, আরটেক্স ফেব্রিকস লি:, আরটেক্স নিট লি:,মরিয়ম টেক্সটাইল মিলস লি:, সুফিয়া ফেব্রিকস লি:, নোমান ফেব্রিকস লি:-১, নোমান ফেব্রিকস লি:-২, জাবের অ্যান্ড জুবায়ের এক্সেসরিজ লি:, নাইস স্পিনিং মিলস লি:, ইসমাইল স্পিনিং মিলস লি:, সুফিয়া কটন মিলস লি:, সাদ টেক্সটাইল প্রসেসিং লি:, নোমান হোম টেক্সটাইল মিলস লি:, ইয়াসমিন টেক্সটাইল মিলস লি:, সান কম্পোজিট টেক্সটাইল লি: এবং নাইস ডেনিম মিলস লি:।লক্ষ্যনীয় বিষয় হচ্ছে, এখানে শুনতে আপাত একই ধরণের একাধিক প্রতিষ্ঠানের নাম রয়েছে। কিন্তু নোমান নিট কম্পোজিট লিমিটেড নামে কোনো প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব নেই।

শিল্প পরিবারটি যেসব প্রতিষ্ঠানের ঋণের বিপরীতে মাস মাস সুদ গুণছে, সেখানেও নেই নোমান কম্পোজিট লিমিটেডর নাম। এছাড়া যেসব প্রতিষ্ঠানের গ্যাস বিল পরিশোধ করা হচ্ছে, আয়কর রিটার্ন দেওয়া হচ্ছে, ভ্যাট পরিশোধ করছে- সেখানেও নেই এই প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব। নোমান নিট কম্পোজিট লি: নামের কোনো প্রতিষ্ঠানের বিপরীতে ইন্স্যুরেন্স প্রিমিয়ামও দেওয়া হয় না। সর্বোপরি শিল্প গ্রুপটি যেসব প্রতিষ্ঠান পরিচালনার মাধ্যমে বছরে ১ দশমিক ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বৈদেশিক মুদ্রা দেশে আনছে-মর্মে দাবি করছে, সেখানেও নেই নোমান নিট কম্পোজিট লিমিটেড। বিভিন্ন মামলায় আদালতে এফিডেভিটের মাধ্যমে দাখিলকৃত নথিতেও এমন প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব মেলেনি। প্রাপ্ত নথিপত্রের সূত্র ধরে এ প্রতিবেদক সরেজমিন পরিদর্শনে যান।

অগ্রণী ব্যাংকের ফরেন এক্সচেঞ্জ শাখায় ২টি মৌজার জমি বন্ধক রাখা হয়।



বন্ধক রাখা জমি

এর মধ্যে গাজীপুর মির্জাপুর মৌজায় জমির পরিমাণ উল্লেখ করা হয় ৫১৫.৭৫ শতাংশ। বাহাদুরপুর মৌজায় দেখানো হয় ৫১৪.২৫ শতাংশ। ২টি জমি মিলিয়ে মোট জমির পরিমাণ ১ হাজার ৩০ শতাংশ। দলিলে বলা হয় তৎসহ নির্মিতব্য স্থাপনা, মেশিনারিজসহ যা কিছু আছে অত্র দলিল দ্বারা বন্ধককৃত বটে। চৌহদ্দি-রাজেন্দ্রপুর টু মির্জাপুর রাস্তা। দক্ষিণে জলিল মুন্সি গং। পূর্বে কফিলউদ্দিন গং। পশ্চিমে রাস্তা। অস্তিত্বহীন নোমান নিট কোম্পোজিটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে বন্ধকী দলিলে স্বাক্ষর করেন মোহাম্মদ নুরুল ইসলাম। দলিলে উল্লেখিত জমির মৌজা দর অনুযায়ী মির্জাপুর মৌজার বর্তমান সর্বোচ্চ বাজার দর (২০২৩-২০২৪) শতাংশ প্রতি ৩ লাখ ১৭ হাজার ৭০৬ টাকা। এ হিসেবে ওই মৌজার জমির মোট মূল্য দাঁড়ায় ১৬ কোটি ৩৬ লাখ ১৮ হাজার ৫৯০ টাকা। বাহাদুরপুর মৌজার শতাংশ প্রতি সর্বোচ্চ বাজার দর ২ লাখ ৮৮ হাজার ৮৯৩ টাকা। এ হিসেবে এ মৌজার ৫১৪ শতাংশ জমির মূল্য হয় ১৪ কোটি ৮৪ লাখ ৯১ হাজার ২ টাকা। অর্থাৎ ২টি পৃথক মৌজার ১ হাজার ৩০ শতাংশ সম্পত্তির মোট মূল্য ৩১ কোটি টাকার মতো। কিন্তু অগ্রণী ব্যাংকের বন্ধকী সম্পত্তির দলিলে (নং-৮৩০/২০১৮) মূল্য কৌশলে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। ২০১৮ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর দলিলটি সম্পাদিত হয়। ৩১ কোটি টাকার সম্পত্তির বিপরীতে ব্যাংক ঋণ বাবদ তুলে নেয়া হয়েছে ৫শ’ কোটি টাকা। দলিলে এই সম্পত্তির ওপর নির্মিতব্য স্থাপনা, মেশিনারীজ এবং যা কিছু আছে মর্মে উল্লেখ করা হয়।

কিন্তু এই জায়গা সরেজমিন পরিদর্শনে মিলেছে বাউন্ডারি ঘেরা একটি মাঠ। মাঠের এক কোণে রয়েছে সান কম্পোজিট টেক্সটাইল মিল নামক প্রতিষ্ঠানের ছোট একটি স্থাপনা। ‘নোমান নিট কম্পোজিট লিমিটেড’ নামক প্রতিষ্ঠানের কোনো স্থাপনাও নেই, নেই মেশিনারীজও। রাস্তার পাশেই টিনের গেট। বাউন্ডারি ঘেরা খালি জায়গা। লাল মাটির উঁচু-নিচু টিলা, কোথাও বা গর্ত। বিস্তৃত শন ক্ষেত। বুনো ঘাস আর লতাপাতায় আচ্ছাদিত। দুই-একটা টিনের ঘর। দূরে স্থাপনা সদৃশ্য কিছু টিনশেডের দেখা মিললেও এটিতে ঝুলছে অন্য প্রতিষ্ঠানের সাইন বোর্ড। এই সাইনবোর্ড যেকোনো মুহূর্তে পাল্টে ফেলা সম্ভব। এসব টিনশেডের ভেতর পুরনো কিছু মেশিন। তবে এ থেকে নিশ্চিত হওয়া যায় যে, এটি অন্তত: ৫শ কোটি টাকা ব্যাংক ঋণ নেয়া নোমান নিট কম্পোজিট লিমিটেড নয়।

তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, অগ্রণী ব্যাংকের দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তা অবসর-পূর্ব ছুটিতে যাওয়া আব্দুস সালাম মোল্লা অস্তিত্বহীন নোমান কম্পোজিটকেই ৫শ’কোটি টাকা ঋণ পাওয়ার ব্যবস্থা করেন। আব্দুস সালাম মোল্লার বাড়ি গোপালগঞ্জ। অবৈধভাবে প্রভাব খাটিয়ে তিনি শত শত কোটি টাকা ঋণ পাইয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। নিগ্রহের শিকার কয়েকজন নারী ব্যাংক কর্মকর্তা-কর্মচারি সালাম মোল্লার অবৈধ সম্পদ অর্জনের তথ্য তুলে ধরে দুর্নীতি দমন কমিশনে অভিযোগ দাখিল করেন। তাতে দুর্নীতির বিবরণ রয়েছে।

প্রতিষ্ঠানটির অস্তিত্ব রয়েছে কি না, থাকলে আর্টিকেল অব মেমোরেন্ডাম কোথায়-জানতে নোমান নিট কম্পোজিট লিমিটেড’র কথিত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ নূরুল ইসলামের সঙ্গে দ্য রিপোর্ট টুয়েন্টিফোরের পক্ষ থেকে তার হোয়াটাস অ্যাপে যোগাযোগ করা হয়। তিনি ম্যাসেজ দেখলে তার কোনো উত্তর দেওয়া থেকে বিরত থাকেন।

অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানকে কোন্ মানদন্ডে ৫শ’কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয়েছে জানতে অগ্রণী ব্যাংক লিমিটেড’র প্রধান নির্বাহী মো: মুরশেদুল কবীর দ্য রিপোর্ট টুয়েন্টফোরের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয়। তাকে কয়েক দফা ফোন করা হয়। তিনি একবারও ফোন ধরেন নি।

(দ্য রিপোর্ট/ টিআইএম/ মাহা/১১ মার্চ,২০২৩)

পাঠকের মতামত:

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

SMS Alert

শেয়ারবাজার এর সর্বশেষ খবর

শেয়ারবাজার - এর সব খবর