thereport24.com
ঢাকা, শুক্রবার, ৩ মে 24, ২০ বৈশাখ ১৪৩১,  ২৪ শাওয়াল 1445

অধরা সমুদ্র সম্পদ: দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ প্রায় শূন্যের কোঠায়  

২০২৩ অক্টোবর ২৬ ১৮:৫৩:৩৭
অধরা সমুদ্র সম্পদ: দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ প্রায় শূন্যের কোঠায়
 

হাসান আরিফ,দ্য রিপোর্ট:সমুদ্র সম্পদকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির নতুন সম্ভাবনা দেখা দিলেও এখন পর্যন্ত এই খাতে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ প্রায় শূন্যের কোঠায়। চীন ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব পাওয়া গেছে বেশ আগে, তবে তাতে সরকারের তেমন ইতিবাচক সাড়া মেলেনি। উল্লেখ করার মত অর্জন কেবলমাত্র চীন ও ভারত কর্তৃক ব্লু-ইকোনমি বা সুনিল অর্থনীতি নিয়ে গবেষণা এবং এ খাতে বিনিয়োগের জন্য বাংলাদেশের সাথে সমঝোতা স্বারক স্বাক্ষর।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর এবং অর্থনীতিবিদ ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন দ্য রিপোর্টকে বলেন, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ও ভিশন-২০৪১ অর্জনে ব্লু-ইকোনমি ব্যাপক ভূমিকা পালন করবে। কারণ সমুদ্রের বিশাল সম্পদকে কাজে লাগিয়ে দেশের অর্থনীতিকে এগিয়ে নেওয়ার নতুন দিগন্ত উন্মোচন হয়েছে ব্লু-ইকোনমির মাধ্যমে। ধারণা করা হয় বঙ্গোপসাগরের তলদেশে যে খনিজ সম্পদ রয়েছে তা পৃথিবীর অন্য কোনো সাগর-উপসাগরে নেই। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, নিয়ম অনুযায়ী সমুদ্রসীমা নির্ধারণের প্রথম পাঁচ বছরে সামুদ্রিক সম্পদ আহরণের জন্য ইন্টারন্যাশনাল সি-বেড অথরিটিকে কোনো অর্থ দিতে হয় না। আর এ সময় পেরিয়ে গেলে ইন্টার-গভর্ণমেন্টাল এ এ সংস্থাকে সমুদ্র সম্পদ আহরণের বিপরীতে অর্থ প্রদান করতে হবে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ এই সুযোগ হাতছাড়া করেছে।
বিশ্বব্যাংকের মতে ব্লু-ইকোনমি বা সুনীল অর্থনীতি হচ্ছে অর্থনৈতিক বৃদ্ধি, উন্নত জীবিকা এবং কর্মসংস্থানের জন্য সমুদ্র সম্পদের টেকসই ব্যবহার এবং একইসাথে সমুদ্রের বাস্তুতন্ত্রের যথাযথ সংরক্ষণ। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ বর্তমান ও ভবিষ্যৎ চাহিদা মেটাতে সমুদ্রবক্ষে সঞ্চিত সম্পদকেই অন্যতম উৎস হিসেবে বিবেচনা করছে। বর্তমান পেক্ষাপটে টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে ব্লু-ইকোনমির বিকল্প নেই। তাই দেশকে অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে নিতে সরকারের যেসব খাত রয়েছে এর মধ্যে ব্লু-ইকোনমি অন্যতম বলে মনে করছেন এ খাতে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। বলা হয়ে থাকে, এ অর্থনীতি সম্ভাবনার নতুন দুয়ার খুলে দেবে।
মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে সমুদ্র-সীমানা নির্ধারিত হওয়ার পর দেশের অর্থনৈতিক অঞ্চলের পরিধি মূলখন্ডের ৮১ ভাগের সমান বেড়েছে। এই সম্পদকে কাজে লাগানোর জন্য প্রয়োজন বিপুল বৈদেশিক বিনিয়োগ। বিশ্বের প্রভাবশালী বিভিন্ন দেশও বাংলাদেশের বৈদেশিক বিনিয়োগের প্রয়োজনকে সম্ভাবনা হিসেবে দেখছে।
এসডিজির ১৪ নম্বর ধারায় টেকসই উন্নয়নের জন্য সামুদ্রিক সম্পদের অনুসন্ধান ও সংরক্ষণের কথা বলা হয়েছে। আর তাই ২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজি পূরণের জন্য সামুদ্রিক সম্পদ আহরণে সরকার গুরুত্ব দিচ্ছে। বঙ্গোপসাগর হচ্ছে বিশ্বের ৬৪ উপসাগরের মধ্যে অন্যতম বৃহৎ উপসাগর। এই সাগর তীরে বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার ও থাইল্যান্ড উপকূলে বাস করে কয়েক কোটি মানুষ। তবে বাংলাদেশের অবস্থান বঙ্গোপসাগরের মূল কেন্দ্রে।
রাষ্ট্রীয় কাঠামোর বাইরে বঙ্গোপসাগরের বিপুল সম্পদ আহরণে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স কর্পোরেশন (আইএফসি) বেসরকারিখাতের বন্ডে আগামী ১০ বছরে ন্যূনতম ১০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করার আগ্রহ প্রকাশ করেছে। চলতি বছরের মার্চ মাসে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পাঠানো এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মেরিটাইম অ্যাফেয়ার্স বিষয়ক সচিব রিয়ার এডমিরাল (অবঃ) মোঃ খুরশীদ আলম বলেন, বিশ্বজুড়ে সমুদ্র সম্পদের পরিমাণ প্রায় ২৪ ট্রিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে এখন পর্যন্ত দেশগুলো আহরণ করতে পেরেছে মাত্র ৩ ট্রিলিয়ন ডলারের সম্পদ। বিনিয়োগকারীদের সাগরমুখী হওয়ার পরামর্শ দিয়ে খুরশীদ আলম বলেন, সুনীল অর্থনীতিতে বিনিয়োগ করলে সরকার ব্যবসায়ীদের সহায়তা দিতে প্রস্তুত আছে।
এফআইসিসিআইয়ের নির্বাহী পরিচালক টিআইএম নুরুল কবির বলেন, “বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে হলে কেবলমাত্র ব্যবসায়ীরা বললেই হবে না। বর্তমানে যে বিনিয়োগকারীরা রয়েছেন তাদের দিয়ে যদি বিশ্বের কাছে তাদের অভিজ্ঞতা এবং মনোভাব শেয়ার করা যায়, তাহলে নতুন বিনিয়োগকারীরা আশ্বস্ত হবে।”
বিনিয়োগে বাধা
ব্লু-ইকোনমিতে বেসরকারি খাতকে কাজে লাগানোর জন্য যেসব সহায়ক নীতিমালা প্রণয়ন করা প্রয়োজন, তা এখনও সম্পন্ন হয়নি। এছাড়া নানা ধরনের আইনি জটিলতাও রয়েছে এসব ক্ষেত্রে। এসব বাধা দূর করে একটি অনুকূল ও সহায়ক পরিবেশ তৈরি করতে না পারলে দেশি বা বিদেশি কোনো উদ্যোক্তাই এ খাতে বিনিয়োগে আগ্রহী হবেন না। বা যে সব বিদেশি বিনিয়োগ প্রস্তাব এসেছে তা আলোর মুখ দেখছে না। তাছাড়া আমলাতান্ত্রিক জটিলতাও একটা বিনিয়োগ অন্তরায় হিসেবে কাজ করছে বলে এ খাতের সংশ্লিষ্টরা বলছেন।
মেরিটাইম অ্যাফেয়ার্স বিষয়ক সচিব মোঃ খুরশীদ আলম বলেছেন, সমুদ্র সম্পদ আহরণ ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনায় বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের কর্মপরিকল্পনা ঠিক করে দেওয়া হয়েছে। এরপরও তেমন সুফল আসেনি। কারণ বর্তমানে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় বা বিভাগে সাগর বা সমুদ্র নিয়ে যথেষ্ট দক্ষ লোকের অভাব রয়েছে। এ কারণে এখন পর্যন্ত সমুদ্র সম্পদ আহরণে খুব একটা দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই।
মৎস্য আহরণে চীনের প্রস্তাব
বাংলাদেশের সাগরে মৎস্য আহরণে জন্য চীনের একটি বিনিয়োগ প্রস্তাব আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে আটকে আছে। যা প্রায় আড়াই শত কোটি টাকার সমপরিমাণ। একটি প্রকল্পের মাধ্যমে চীন গভীর সমুদ্র থেকে মাছ আহরণের জন্য নৌকা, বর্তমানে যেসব নৌকা রয়েছে তার আধুনিকায়ন, প্রসেসিং কেন্দ্র, কোল্ড স্টোরেজ এবং আধুনিক পরিবহণ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে চায়।
বাংলাদেশ-চায়না চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিসিসিআই) মহাসচিব আল মামুন মৃধা দ্য রিপোর্টকে বলেন, আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে প্রকল্পটি থমকে গেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিভিন্ন খাতে সরকারের ঋণের দায় বেড়ে গেছে তাই এ অবস্থায় সরকার আর দায় বাড়াতে চায় না। উল্লেখ্য, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ‘সেভ আওয়ার সি’ এর তথ্য মতে প্রতি বছর বঙ্গোপসাগর থেকে ৮০ লাখ টন মাছ ধরা হয়। কিন্তু যথাযথ সরঞ্জাম ও প্রযুক্তির অভাবে বাংলাদেশের জেলেরা ধরতে পারছে মাত্র সাত লাখ টন।
সমুদ্রে মাছ এবং চিংড়ি বেশি ধরা হয়
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্র বিজ্ঞান বিভাগ ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সাইদুর রহমান চৌধুরী বলেন, এখনো সমুদ্র থেকে মূলত মাছ এবং চিংড়ি বেশি ধরা হয়। কারণ খাবার হিসেবে বাংলাদেশীদের মাঝে এসবের চাহিদাই বেশি। তবে ইদানীং দেশের নানা স্থানে অক্টোপাস, স্কুইড, ক্যাট ফিস, কাঁকড়া ও ঝিনুক খাওয়ার অভ্যাস তৈরি হয়েছে। স্থানীয় বাজারে এসবের চাহিদা কম থাকলেও এগুলোও প্রচুর পরিমাণে ধরা হয়। কারণ এসব মাছ বিদেশে রফতানি হয়। আর যথাযথভাবে ব্যবহার করতে পারলে সি-উইড বাংলাদেশের জন্য ব্যাপক বাণিজ্যিক সম্ভাবনা তৈরি করতে পারে।
মৎসজীবিরা জানান, বাংলাদেশের সমুদ্র থেকে মূলত লাক্ষা, রূপচাঁদা, কালোচাঁদা, টুনা, ম্যাকারেল, লইট্টা, চ্যাপা, সামুদ্রিক রিঠা, শাপলা পাতা মাছ, তাইল্লা, পোয়া, সুরমা, ইলিশ, ছুরি, ফাইস্যা, সামুদ্রিক বাইন ও কই মিলিয়ে ২০ প্রজাতির মাছ বাণিজ্যিক ভাবে আহরণ করা হয়। কারণ এসব মাছের স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদা রয়েছে। সবমিলিয়ে বঙ্গোপসাগর থেকে খাদ্য হিসেবে দুই শ’ প্রজাতির মাছ ও চিংড়ি নিয়মিত ধরে বাংলাদেশের জেলেরা। সঠিক বিনিয়োগ করলে প্রতি বছর সেখান থেকে ৬৬ লাখ টন মৎস্য আহরণ করা যেতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশের জেলেরা প্রচলিত পদ্ধতিতে যে সাত লাখ টন মাছ ধরে তাহাই উপকূলীয় এলাকার ৫০ লাখের বেশি মানুষের আয়ের প্রধান উৎস।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশের মৎস্য উৎপাদনের ২০ শতাংশ যোাগান আসে সমুদ্র থেকে। বিশ্বের মোট মৎস্য উৎপাদনের ১৬ শতাংশ অবদান খোদ বঙ্গোপসাগরের।



সমুদ্র থেকে মৎস্যসম্পদ আহরণের লক্ষ্যে ব্যবস্থাপনা ও অবকাঠামো উন্নয়নে বিভিন্ন দাতা দেশ ও সংস্থার কাছে অনেক দিন ধরে অর্থসহায়তা চেয়ে আসছে সরকার। জানা যায়, এরই অংশ হিসেবে এ বিষয়ে প্রস্তাবিত একটি প্রকল্পে ২০ কোটি মার্কিন ডলার সহায়তা দিতে সম্মত হয়েছে বিশ্বব্যাংক।
মাছের তথ্য জানতে জরিপ
মাছের তথ্য জানতে ২০১৬ সাল থেকে আরভি মীন সন্ধানী নামের সমুদ্র গবেষণা ও জরিপ জাহাজের মাধ্যমে সমুদ্রের চিংড়িসহ তলদেশীয় ও উপরিস্থ মাছের জরিপের কাজও চলছে। যার কার্যক্রম সাগরের ২০০ মিটার গভীরতা পর্যন্ত বিস্তৃত। যদিও আরভি মীন সন্ধানী জাহাজের মাধ্যমে সমুদ্রে সব অঞ্চলে জরিপ চালানো সম্ভব নয়। তাই ২০১৮ সাল থেকে সাগরের মাছ, পানিসহ বিভিন্ন উপাদানের নমুনা সংগ্রহ ও গবেষণা কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে ফ্রিডজফ ন্যানসেন নামের নরওয়ের একটি জাহাজ। চলতি বছরের ২ থেকে ১৭ আগস্ট বঙ্গোপসাগরের ৫ হাজার ২০০ কিলোমিটার এলাকায় দেশের ১৮ জন সহ মোট ৩০ জন বিজ্ঞানী নিয়ে এ জরিপ চালানো হয়। জরিপের ফলাফল বের হলে মাছ ও জলজ উদ্ভিদের প্রজাতি এবং মজুদসহ জানা যাবে নানা তথ্য।

ফ্যাক্টরি শিপ পরিচালনা
গভীর সমুদ্রে মৎস আহরণে এখন যে অত্যাধুনিক ‘ফ্যাক্টরি শিপ’ ব্যবহৃত হয় সেগুলো ক্রয় করে পরিচালনার ক্ষমতা রয়েছে এরকম ১৮টি প্রতিষ্ঠানকে ২০২৭ সালে জাহাজ কেনার লাইসেন্স দিয়েছে সরকার। কিন্তু প্রতিষ্ঠানগুলো এখন পর্যন্ত কোন কার্যক্রম শুরু করতে পারেনি। এসব ফ্যাক্টরি শিপে মাছ ধরা থেকে শুরু করে মাছ প্রসেসিং করে রফতানির জন্য ক্যানিং পর্যন্ত অত্যাধুনিক পদ্ধতিতে সম্পন্ন করার ব্যবস্থা থাকে, যাতে এক এক ট্রিপে মাসাধিককালও জাহাজগুলো গভীর সমুদ্রে মৎস আহরণ চালিয়ে যেতে পারে।
বঙ্গোপসাগরের ‘সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড’ টুনা মাছের একটা সমৃদ্ধ বিচরণক্ষেত্র হিসেবে পরিচিত। ওই অঞ্চলে এখন বাংলাদেশের আইনি কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং এর সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে চায় সরকার। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম এ প্রসঙ্গে বলেন, “সমুদ্র অঞ্চলে আমাদের খুব বেশি অভিজ্ঞতা নেই। এ জন্য জার্মানিসহ বিভিন্ন উন্নত দেশকে এ নিয়ে গবেষণা ও বিনিয়োগ বিষয়ে দুই দেশের একসঙ্গে অভিজ্ঞতা বিনিময়ের বিষয়ে বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে আলোচনা হয়েছে।”
মূল্যবান খনিজ সম্পদের অস্তিত্ব
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, তেল-গ্যাস ছাড়াও বাংলাদেশের অগভীর ও গভীর সমুদ্রের তলদেশে অতি মূল্যবান খনিজ সম্পদের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। এর মধ্যে রয়েছে ইউরেনিয়াম ও থোরিয়াম। আর অগভীর সমুদ্রে বিপুল পরিমাণ ‘ক্লে’-এর সন্ধান মিলেছে। এটি সিমেন্ট তৈরির অন্যতম কাঁচামাল। এছাড়া বঙ্গোপসাগরের ১৩টি স্থানে অতি মূল্যবান ভারী খনিজ বালু পাওয়া গেছে। এ বালু ইলমেনাইট, গার্নেট, সিলিমানাইট, জিরকন, রুটাইল ও ম্যাগনেটাইট সমৃদ্ধ।
গ্যাস-হাইড্রেটের মজুদ
২০১৮ সালে বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের অধিকৃত জলসীমায় সমুদ্রে ও তলদেশে গ্যাস-হাইড্রেট এর উপস্থিতি, অবস্থান, প্রকৃতি ও মজুদ নির্ণয়ের জন্য পূর্বের করা বিভিন্ন জরিপ থেকে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করার জন্য বিভিন্ন মন্ত্রণালয়/বিভাগ/দপ্তরের অভিজ্ঞ ও দক্ষ প্রতিনিধিগণের সমন্বয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মেরিটাইম অ্যাফেয়ার্স ইউনিটের সচিব রিয়ার এডমিরাল (অবঃ) মোঃ খুরশীদ আলমের নেতৃত্বে একটি ডেস্কটপ স্টাডি গ্রুপ গঠন করা হয়েছিল।

গ্যাস হাইড্রেটের ডেস্কটপ স্টাডি বলতে মূলতঃ সমুদ্রে যে সব অঞ্চলে ইতোমধ্যে জরিপ করা হয়েছে সে সব অঞ্চলের তথ্য-উপাত্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে বাংলাদেশের সমুদ্রাঞ্চলে গ্যাস হাইড্রেটের উপস্থিতি সম্পর্কে একটি প্রাথমিক ধারণা পাওয়াকে বুঝায়। পরিপূর্ণ ধারণা পেতে হলে সম্পূর্ণ সমুদ্রাঞ্চলে সিসমিক জরিপের প্রয়োজন রয়েছে যা অনেক ব্যয়বহুল এবং সময়সাপেক্ষ। তাই আগের করা সিসমিক জরিপের উপর ভিত্তি করেই এই ডেস্কটপ স্টাডি করার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার।
এ ডেস্কটপ স্টাডি গ্রুপ গঠনের পর যুক্তরাজ্যের সাউদাম্পটনে অবস্থিত ন্যাশনাল ওশেনোগ্রাফি সেন্টারসহ পেট্রোবাংলা, বাপেক্স এবং স্থানীয় বিশেষজ্ঞদের যৌথ প্রয়াসে চার বছর কাজ করে স্টাডি সম্পন্ন করা হয়। এই স্টাডির মাধ্যমে সমুদ্রের তলদেশে গ্যাস-হাইড্রেট-এর উপস্থিতি এবং এর অবস্থান, প্রকৃতি ও মজুদের ব্যাপারে প্রাথমিক ধারণা পাওয়া গেছে।
সিসমিক লাইনের অবস্থানের উপর ভিত্তি করে শুধুমাত্র বাংলাদেশের ইইজেড-এ ০.১১ থেকে ০.৬৩ টিসিএফ (ট্রিলিয়ন কিউবিক ফিট) সম্ভাব্য প্রাকৃতিক গ্যাস হাইড্রেট জমা থাকার অনুমান করা গেছে যা ১৭-১০৩ টিসিএফ প্রাকৃতিক গ্যাস মজুদের সমান। এ বিপুল পরিমাণ গ্যাস হাইড্রেট এর উপস্থিতি ও মজুদের সমূহ সম্ভাবনা আগামী শতকে বাংলাদেশের জ্বালানি খাতের সামগ্রিক চাহিদা মেটাতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্র বিজ্ঞান বিভাগ ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সাইদুর রহমান চৌধুরী বলেন, সমুদ্রে তেল ও গ্যাস মজুদ রয়েছে বলে অনুমান করা হয়ে থাকে। এখানে নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার হলে সেটা দেশের জন্য আরেকটি বড় শক্তি হয়ে উঠবে। তেল গ্যাস ছাড়াও বঙ্গোপসাগরের বাংলাদেশ অংশে সালফার, মেটালিক মডিউল, কোবাল্ট পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানান তিনি।
সমুদ্রে তেল-গ্যাস উত্তোলন শূন্য
২০১৩ সালের শেষের দিকে সমুদ্রে বাংলাদেশের একমাত্র গ্যাসক্ষেত্র সাঙ্গু থেকে গ্যাস তোলা শেষ হয়ে যাওয়ার পর সমুদ্র অর্থনীতিতে তেল-গ্যাস খাতের ভূমিকা এখন শূন্য। সমুদ্র সীমানা নির্ধারিত হওয়ার পর ২৬টি নতুন বøকে বিন্যাস করে এর মধ্যে ১১টি অগভীর ও ১৫টি গভীর সমুদ্রের বøক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এরপর বহু সময় চলে গেছে, কিন্তু কোন অগ্রগতি দেখা যায়নি।
২০১৯ সালের সর্বশেষ তথ্যে বলা হচ্ছে, মাত্র ৪টি বøকে অনুসন্ধানের জন্য বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি হয়েছে। কিন্তু একটি কূপও বাংলাদেশ খনন করতে পারেনি। বাকি ২২টি বøক স্থবির পড়ে রয়েছে। বিদেশি কোম্পানিগুলোর সঙ্গে উৎপাদন ও ভাগাভাগি চুক্তির আগে মাল্টি ক্লায়েন্ট সার্ভে হবে কি হবে না সে বিষয়েও সিদ্ধন্ত হীনতায় সরকার। ফলে বাংলাদেশের সমুদ্র সম্পদ এখন পর্যন্ত প্রায় অনাবিষ্কৃত ও অব্যবহৃত।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন দেশের উত্তোলনযোগ্য খনিজসম্পদ ফুরিয়ে যাবে একদিন তবে অনিঃশেষ রয়ে যাবে গ্রীন এনার্জি বা নবায়নযোগ্য শক্তি। যেমন বায়ু শক্তি, সমুদ্র তরঙ্গ, সমুদ্রস্রোত ইত্যাদি। সাগরের বাতাস কাজে লাগিয়ে উইন্ড এনার্জি এবং তরঙ্গকে কাজে লাগিয়ে ওয়েব এনার্জি, জোয়ার ভাটাকে কাজে লাগিয়ে টাইডাল এনার্জি তৈরি করা সম্ভব হবে। এই এনার্জি কাজে লাগিয়ে দেশের জন্য বিদ্যুৎ উৎপাদন সহ অন্যান্য নানা উৎপাদনমুখী কাজে লাগানো যাবে।
জ্বালানী বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, গভীর সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে বিশাল বিনিয়োগ করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্রের বহুজাতিক কোম্পানি এক্সন মবিল। তারা ৩ লাখ ২৫ হাজার ৫০০ কোটি টাকা বিনিয়োগের প্রস্তাব দিয়েছে। যা মার্কিন মুদ্রায় ৩০ বিলিয়ন ডলার। এ ব্যাপারে এ ধরণের অন্য প্রতিষ্ঠানকেও উৎসাহিত করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।

চীন-ভারতের আগ্রহ
দ্য ইকোনোমিস্টের ‘দ্য ফিউচার অব চাইনিজ ইনভেস্টরস’ শিরোনামের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চীনের বিনিয়োগ পাওয়ার ক্ষেত্রে বর্তমানে বাংলাদেশের অবস্থান ১২তম। ২০১৩ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৫২তম। যা প্রমাণ করে, চীনের বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে বিনিয়োগে আগ্রহী। অপর দিকে ২০৪০ সালে উন্নত দেশ হতে বাংলাদেশের অবকাঠামো খাতে ৬০৮ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ প্রয়োজন। বাংলাদেশে অবস্থিত চীনা দূতাবাস ও বাংলাদেশ-চায়না চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (বিসিসিসিআই) সূত্রে জানা গেছে, ২০১৯ সাল পর্যন্ত চীন বাংলাদেশে একক সর্বোচ্চ বিনিয়োগকারী ছিল।
বিসিসিসিআই-এর মহাসচিব আল মামুন মৃধা বলেন, ২০১৯ সাল পর্যন্ত চীন বাংলাদেশে একক সর্বোচ্চ বিনিয়োগকারী ছিল। কোভিড ও চীনের জিরো কোভিড নীতির কারণে কয়েকবছর চীনা বিনিয়োগ কম এসেছে। তবে এখন অনেক বিনিয়োগ আসছে। এছাড়া চীন বাংলাদেশের ব্লু-ইকোনমিতে ব্যাপক বিনিয়োগে আগ্রহী। যদিও মৎস্য খাতে চীনের একটা বিনিয়োগ প্রস্তাব থমকে আছে। তবে বায়ু বিদ্যুৎ ও সৌর বিদ্যুৎ খাতে চীনের দুইটি প্রকল্প চলমান রছেছে। তার মতে চীনা বিনিয়োগ বাড়ানোর মাধ্যমে বিদ্যমান রিজার্ভ সংকট মোকাবিলা করা সহজ হবে।
সমূদ্র বন্দরে আগ্রহ
বাংলাদেশে গভীর সমূদ্র বন্দর স্থাপনে ব্যাপক আগ্রহ রয়েছে চীন ও ভারতের। কিন্তু এসব প্রকল্প খুব বেশি আগাচ্ছে না। ভারত বাংলাদেশের সুন্দরবনের কাছে যে কয়লা চালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের কাজ পেয়েছে সেটি বেশ কিছু বাস্তব এবং পরিবেশগত চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে।
এই বিষয়ে ন্যাশনাল মেরিটাইম ইনস্টিটিউট অধ্যক্ষ ক্যাপ্টেন আতাউর রহমান দ্য রিপোর্টকে বলেন, বাংলাদেশে যে প্রকল্পগুলোতে হাত দিয়েছে তার মধ্যে একটিতে চীনর বিশেষ আগ্রহ রয়েছে। সেটি হলো পায়রা গভীর সমুদ্র বন্দরের বিস্তার ও উন্নয়ন। এই বন্দরের মূল অবকাঠামো নির্মাণে ৬০ কোটি ডলারের চুক্তি স্বাক্ষর করেছে চীনের দু’টি প্রতিষ্ঠান চায়না হারবার ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি ও চায়না স্টেট কনস্ট্রাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং। নদী তীরবর্তী অবকাঠামো নির্মাণের কথাও রয়েছে এর মধ্যে। তার মধ্যে আছে গৃহায়ন, স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষা।
বহুখাতে বিনিয়োগের একটি সামষ্টিক চুক্তি (আমব্রেলা ডিল) করেন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। এর আওতায় এদেশের ২৭ প্রকল্পে অর্থায়নের প্রতিশ্রুতি দেয় চীন, যার মধ্যে মোংলা বন্দরের সম্প্রসারণ ও পরিষেবা উন্নয়নের একটি প্রকল্পও ছিল। সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে প্রকল্পটিকে বাংলাদেশের জন্য 'গুরুত্বপূর্ণ' হিসেবে উল্লেখ করা হলেও, প্রস্তাবিত ৪০ কোটি ডলার অর্থায়ন এখনও শুরু হয়নি।
নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, দেশে বর্তমানে চট্টগ্রাম, মোংলা, পায়রা ও মাতারবাড়ি এই চারটি সমুদ্রবন্দর রয়েছে। এসব বন্দরের অবকাঠামো উন্নয়ন কার্যক্রম একটি চলমান প্রক্রিয়া। এর মধ্যে চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে কিছু প্রকল্প প্রস্তাব রয়েছে যেগুলোতে বিদেশি অনেক সংস্থাই আগ্রহ প্রকাশ করেছে। কিছু প্রকল্প প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে। মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দরের সঙ্গে যুক্ত আছে জাপান। পায়রা বন্দরের বিষয়ে চীন, ভারতসহ বেশ কিছু উন্নয়ন সহযোগীর প্রস্তাব রয়েছে। এখন যুক্তরাষ্ট্র এই বন্দরের অবকাঠামো উন্নয়নে আগ্রহ দেখাচ্ছে।
সমঝোতা স্মারক সই
২০২২ সালের ৬ই আগস্ট সমুদ্র সম্পদের তথ্যানুসন্ধানে বঙ্গোপসাগর এলাকায় জরিপ চালাতে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে বাংলাদেশ ও চীন। চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই’র স্বপ্রণোদিত ঢাকা সফরে ‘মেরিন সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি সহযোগিতা’ বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ এই সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হয়। এর মাধ্যমে চীন বাংলাদেশের বøু-ইকোনমিতে সরাসরি সম্পৃক্ত হয়। যদিও ভারত ২০১৫ সালেই এই জাতীয় চুক্তি বাংলাদেশের সাথে স্বাক্ষর করে রেখেছে।
যৌথ সহযোগিতা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মেরিটাইম অ্যাফেয়ার্স ইউনিট এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের যৌথ উদ্যোগে ‘ব্লু-ইকোনমিতে ইইউ-বাংলাদেশ যৌথ সহযোগিতা’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় সুনীল অর্থনীতি উন্নয়নের সম্ভাবনা এবং চ্যালেঞ্জ নিরূপণে মাঠ পর্যায়ে একটি সমীক্ষা পরিচালনা করা হয়। এই সমীক্ষা থেকে নয়টি খাতকে চিহ্নিত করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে- সামুদ্রিক মৎস্য ব্যবস্থাপনা, সামুদ্রিক মৎস্যচাষ উন্নয়ন, বাণিজ্যিক নৌপরিবহনের উন্নয়ন, সমুদ্রভ্রমণে পর্যটনের বিকাশ সাধন, অফশোর ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি ও সুনীল বায়োটেকনোলজি গবেষণা ও উন্নয়ন, জাহাজ নির্মাণ ও রিসাইক্লিং শিল্প সম্প্রসারণ, স্থিতিশীল জীবিকার জন্য ম্যানগ্রোভের বাস্তুসংস্থানগত সেবা, সামুদ্রিক দূষণ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ এবং মেরিন স্পেশাল প্ল্যানিং বাস্তবায়ন।
এই কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে, অফশোর জ্বালানি ও সুনীল বায়োটেকনোলজি গবেষণা ও উন্নয়ন কার্যক্রমের আওতায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বাংলাদেশের সমুদ্রাঞ্চলে গ্যাস হাইড্রেট ও মেরিন জেনেটিক রিসোর্স বিশেষতঃ সামুদ্রিক শৈবাল-এর সম্ভাবনা, উপস্থিতি, প্রকৃতি ও মজুদ নির্ণয়ের জন্য দুটি গবেষণা কার্যক্রম যুক্তরাজ্য ও নেদারল্যান্ডসের সহায়তায় সম্পন্ন করেছে।
গবেষণা কার্যক্রম
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, মেরিটাইম অ্যাফেয়ার্স ইউনিটের প্রতিনিধিসহ নেদারল্যান্ডস্ ভিত্তিক গবেষকরা ২০২০ সালে বাংলাদেশের সমুদ্র এলাকায় মাঠ পর্যায়ে গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করেন। সেই গবেষণা থেকে বাংলাদেশের একান্ত অর্থনৈতিক এলাকা (ইইজেড)-এ এমজিআর-এর সার্বিক অবস্থান চিহ্নিত করা (ম্যাপিং), বিবিধ প্রজাতি চিহ্নিত করাসহ অর্থনৈতিক সম্ভাবনা বিশ্লেষণ করা হয়। সেই ফলাফলের ভিত্তিতে বাংলাদেশে ২২০ প্রজাতির সামুদ্রিক শৈবাল, ৩৪৭ প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ, ৪৯৮ প্রজাতির ঝিনুক, ৫২ প্রজাতির চিংড়ি, ৫ প্রজাতির লবস্টার, ৬ প্রজাতির কাঁকড়া, ৬১ প্রজাতির সি-গ্রাস ইত্যাদি চিহ্নিত করা হয়। পরবর্তীতে এ সব প্রজাতির উপর প্রয়োজনীয় ল্যাবরেটরি টেস্ট নেদারল্যান্ডসে সম্পন্ন করা হয়। কোভিড-১৯ জনিত উদ্ভুত পরিস্থিতিতে গবেষণা কার্যক্রমে সাময়িক বিরতির পর ২০২১ সালে তা পুনরায় শুরু হয়েছে। এই কার্যক্রমে বিশেষ করে বাংলাদেশে সামুদ্রিক শৈবাল এর সম্ভাবনা ও বাণিজ্যিকীকরণের উপর গুরুত্ব দেয়া হয়। গবেষণালব্ধ ফলাফলে দেখা যায় বাংলাদেশে প্রাপ্ত বহু সংখ্যক প্রজাতির সামুদ্রিক শৈবাল-এর মধ্যে কয়েকটি প্রজাতির ব্যাপক বাণিজ্যিক সম্ভাবনা রয়েছে, যা বাংলাদেশের ব্লু-ইকোনমিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে সক্ষম। এর মধ্যে নির্দিষ্ট প্রজাতির কিছু সামুদ্রিক শৈবাল ৫টি শিল্প খাতে ব্যবহারের জন্য চিহ্নিত করা হয়।
বাংলাদেশে প্রাপ্ত কিছু প্রজাতির সামুদ্রিক শৈবাল-এ প্রচুর পরিমাণ প্রোটিন রয়েছে যা মাছের খাদ্যের প্রোটিনের উৎস হিসাবে ব্যবহৃত হতে পারে এবং মাছের খাদ্যের জন্য আমদানিকৃত মাছের তেল-এর বিকল্প হতে পারে। কিছু প্রজাতির সামুদ্রিক শৈবাল এ প্রচুর পরিমাণ পশুর খাদ্য রয়েছে যা পশুর খাদ্যের মান বৃদ্ধিতে ও প্রাণির রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে। কিছু প্রজাতির সামুদ্রিক শৈবাল এ প্রচুর পরিমাণ আগার-আগার রয়েছে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের খাদ্য শিল্পে বর্তমানে আমদানিকুৃত আগার-আগার প্রচুর পরিমাণে ব্যবহৃত হচ্ছে। এছাড়া, সামুদ্রিক শৈবাল সরাসরি বা প্রক্রিয়া করে বিশ্বব্যাপী অসংখ্য মানুষ খাবারের সাথে গ্রহণ করছে। এছাড়া বাংলাদেশের সামুদ্রিক শৈবাল-এ প্রচুর পরিমাণে উচ্চ মূল্যের উপাদান রয়েছে যা ত্বকের যত্নের পণ্য সহ বহুবিধ প্রসাধনী পণ্য তৈরিতে ব্যবহার করার সুযোগ রয়েছে। এসব পন্যের বিশাল বাজার তৈরি হবে। তবে বর্তমান প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে সামুদ্রিক সামুদ্রিক শৈবাল থেকে বাণিজ্যিক উৎপাদন ও পরিচালনার জন্য হ্যাচারি, ফার্মিং, প্রসেসিং প্ল্যান্ট এবং শিল্প প্রয়োজন হবে।
বাংলাদেশে সামুদ্রিক শৈবাল-এর উৎপাদন পরিবেশবান্ধব পদ্ধতিতে অতি সহজেই করা সম্ভব। সামুদ্রিক শৈবালের চাষ পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষাসহ উপকূলীয় এলাকা রক্ষায় ভূমিকা রাখতে পারে। সামুদ্রিক শৈবাল-এর চাষ বাংলাদেশের উপকূলীয় জনগণের জন্য সহজ ও নিরাপদ কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করতে সক্ষম, যেখানে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নারীকর্মীর সহজ কর্মসংস্থান হতে পারে।
পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মোঃ শাহরিয়ার আলম বলেন, “সমুদ্র সম্পদ থেকে নতুন বাণিজ্যিক সম্পদ আহরণের একটি যুগান্তকারী সাফল্য অর্জনে সক্ষম হতে যাচ্ছি। এ প্রেক্ষিতে আমাদের পরবর্তী পদক্ষেপ হচ্ছে, আগ্রহী ও যোগ্য শিল্প প্রতিষ্ঠান/ উদ্যোক্তাকে বাংলাদেশের সামুদ্রিক শৈবাল এর সম্ভাবনাময় বিবিধ খাতে কার্যকরী বিনিয়োগ/ অংশগ্রহণ করানো। এই কার্যক্রম সফল করার লক্ষ্যে যোগ্য শিল্প প্রতিষ্ঠান/ উদ্যোক্তাকে প্রয়োজনীয় সহায়তা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মেরিটাইম অ্যাফেয়ার্স ইউনিট থেকে দেওয়া হবে।”
লবণ শিল্প
বাংলাদেশের জলসীমায় সমুদ্র থাকার বড় একটি সুবিধা হলো, বাণিজ্যিক ভিত্তিতে সমুদ্রের পানি ব্যবহার করে লবণ উৎপাদন। উপকূলে সমুদ্রের পানি ধরে রৌদ্র বা সৌরশক্তি ব্যবহার করে শুকিয়ে অপরিশোধিত লবণ আহরণ করা হয়। বর্তমানে কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাটের এক লাখ একরের বেশি জমিতে লবণ চাষ করা হয়। এই শিল্পের সাথে জড়িত রয়েছেন ১৮ লাখের বেশি মানুষ।
বাংলাদেশের উপকূলে রয়েছে ৩০০ লবণ শোধনাগার, যেগুলো সাত বছর ধরে বছরে ১৩ দশমিক ২৫ লাখ টন করে লবণ উৎপাদন করছে, যা বাজারের চাহিদার তুলনায় ৩.৩২ লাখ টন কম। লবণ শিল্পের দিকে একটু মনোযোগ দিলেই একে একটি রফতানিমুখী লাভজনক শিল্পে পরিণত করা সম্ভব হবে বলে সংশ্লিষ্টরা বলছেন যা বøু-ইকোনমিরই অংশ।
জাহাজশিল্প
সমুদ্রকে ঘিরেই দেশে এখন বিশ্বমানের জাহাজ তৈরি হচ্ছে। জাহাজ তৈরি শিল্পে এশিয়ায় বাংলাদেশের অবস্থান ১৩তম। বিশ্বে জাহাজভাঙা শিল্পে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়। পৃথিবীর মোট জাহাজ ভাঙার ২৪.৮ শতাংশ বাংলাদেশে হয়। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশে গত অর্থবছরে সমুদ্রপথে ছয় হাজার ৬০০ কোটি ডলারের বাণিজ্য হয়েছে। এজন্য ৬০০ কোটি ডলার জাহাজ ভাড়া দিতে হয়েছে। অধিকাংশ জাহাজ বিদেশি মালিকানাধীন থাকায় বৈদেশিক মুদ্রার বেশির ভাগই বিদেশে চলে যায়। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, প্রতি বছর বড় আকারের জাহাজের জন্য বৈশ্বিক শিপ বিল্ডিং অর্ডার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ছোট ও মাঝারি সমুদ্রগামী জাহাজের চাহিদার পাশাপাশি বাংলাদেশের জন্য একটি উচ্চ সম্ভাবনাময় বাজার গড়ে উঠেছে। তিনি বলেন, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, সারাবিশ্বে জাহাজ নির্মাণে বাজারের আকার ১৬০০ বিলিয়ন ডলার। যদি বাংলাদেশ মাত্র ১ শতাংশ মার্কেট শেয়ার দখল করতে পারে তাহলে এর মূল্য হবে ১৬ বিলিয়ন ডলার। আর বাংলাদেশ যদি শুধু ছোট জাহাজের বাজারের বৈশ্বিক অর্ডারের ১ শতাংশ দখল করতে পারে তবে এর পরিমাণ হবে ৪ বিলিয়ন ডলার।
জীববৈচিত্র
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সমুদ্রের নিচের জীববৈচিত্র হতে পারে বাংলাদেশের অর্থনীতির বড় শক্তি। ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র সংরক্ষণ করে দেশের পর্যটন বিকশিত করা উদ্যোগ রয়েছে। সরকার দেশের সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকায় পরিবেশ সুরক্ষার জন্য পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় সেন্টমার্টিন দ্বীপ, কক্সবাজার-টেকনাফ সমুদ্র সৈকত এবং সুন্দরবনকে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) ঘোষণা করেছে। এসব এলাকায় পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রমসহ পরিবেশ সংরক্ষণে বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। সেন্টমার্টিন দ্বীপ সংলগ্ন এক হাজার ৭৪৩ বর্গ কিলোমিটার এলাকার জীববৈচিত্র সংরক্ষণের লক্ষ্যে মেরিন প্রটেক্টেড এরিয়া হিসেবে ঘোষণার কার্যক্রম চলমান।
দক্ষ জনশক্তি
যেকোনো সম্পদ আহরণের ক্ষেত্রে দক্ষ জনশক্তির বিকল্প নেই। তাই সমুদ্রের সম্পদ আহরণের জন্যও দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলা প্রয়োজন। এই দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে বিভিন্ন জেলায় ন্যাশনাল মেরিটাইম ইন্সটিটিউট চালু করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে- ন্যাশনাল মেরিটাইম ইন্সটিটিউট, মাদারীপুর। তাছাড়া ন্যাশনাল মেরিটাইম ইন্সটিটিউট, কুড়িগ্রাম, রাজশাহী, দিনাজপুর ও মেহেরপুর স্থাপনের কার্যক্রম চলছে।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্রবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক কাউসার আহমেদ বলেন, “আমাদের সমুদ্রের মৎস্যসম্পদ কী পরিমাণ আছে তা জরিপ করতে হবে। সমুদ্রের তলদেশের প্রাণিজ ও অপ্রাণিজ সম্পদ ব্যবহার করতে হলে যে পরিমাণ দক্ষ জনশক্তি দরকার, বর্তমানে বাংলাদেশে সেই পরিমাণ জনশক্তি নেই। বøু ইকোনমিকে এগিয়ে নিতে এই খাতে দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে সরকারকে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে।”

চ্যালেঞ্জ

ব্লু-ইকোনমি উন্নয়নের পথে বাংলাদেশের মূল চ্যালেঞ্জগুলো হলো-পর্যাপ্ত নীতিমালার ও সঠিক কর্ম পরিকল্পনার অভাব, দক্ষ জনশক্তির অভাব, প্রযুক্তিগত জ্ঞানের অভাব, সম্পদের পরিমাণ ও মূল্য সম্পর্কে সঠিক তথ্যের অভাব, মেরিন রিসোর্সভিত্তিক গবেষণাগার না হওয়া, ব্লু-ইকোনমি সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক যোগাযোগের অভাব এবং গবেষণা কার্যক্রম সম্পাদনের জন্য গবেষণা জাহাজ না থাকা।
তাই বিশেষজ্ঞরা বলছেন প্রযুক্তি-নির্ভরতা ও দক্ষ জনশক্তি নিয়োগ সম্পর্কে স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে। বাংলাদেশের সমুদ্র সীমানায় যেসব অনাবিষ্কৃত সমুদ্র সম্পদ আছে সেগুলোর বিজ্ঞানভিত্তিক ও পরিবেশবান্ধব সংগ্রহ এবং টেকসই ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
এ বিষয়টি নিয়ে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মাদ শাহরিয়ার আলম বলেন, দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে সমুদ্র সম্পদ ব্যবহার করতে চায় সরকার, কিন্তু এ সম্পদ টেকসই ভিত্তিতে আহরণের জ্ঞান,দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার অভাব রয়েছে বাংলাদেশের।এ বিষয়ে বাংলাদেশের সক্ষমতা বৃদ্ধি ও প্রশিক্ষণ, আবহাওয়া তথ্য বিনিময় এবং যৌথ গবেষণা, গভীর সমুদ্রে মাছ আহরণ ইত্যাদি প্রসঙ্গে চীন ও ভারতের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে সরকার। চীনও বাংলাদেশকে সহায়তা দিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে।
গত পাঁচ বছরে চীনের অর্থনীতিতে মেরিটাইম ইন্ডাস্ট্রির অবদান বৃদ্ধি পেয়েছে যা চীনের মোট দেশজ সম্পদের প্রায় ১০ শতাংশ। দেশটি ব্লু-ইকোনমি কেন্দ্রিক যে পরিকল্পনা নিয়েছে তা বাস্তবায়ন হলে ২০৩৫ সাল নাগাদ জিডিপিতে মেরিন সেক্টরের অবদান হবে প্রায় ১৫ শতাংশ। একই ভাবে ইন্দোনেশিয়ার সাম্প্রতিক পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়ন হলে সমুদ্র থেকে আহরিত সম্পদের মূল্যমান হবে সে দেশের জাতীয় বাজেটের প্রায় দশগুণ। কর্মসংস্থান হবে ৭৫ হাজার লোকের এবং প্রতি বছর ১১৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় হবে। অস্ট্রেলিয়া এ খাত থেকে বছরে আয় করছে প্রায় ৪৭.২ বিলিয়ন অস্ট্রেলিয়ান ডলার। ২০২৫ সালের মধ্যে সমুদ্র অর্থনীতির আয়কে ১০০ বিলিয়ন ডলারে নিতে চায় দেশটি। সিঙ্গাপুরের জিডিপির ৪০ ভাগ সমুদ্রনির্ভর।
বাংলাদেশ ২০১২ সালে মিয়ানমার থেকে ৭০ হাজার বর্গ কিলোমিটার এবং ২০১৪ সালের জুলাইয়ে ভারত থেকে ১৯ হাজার ৪৬৭ বর্গ কিলোমিটার সমুদ্র এলাকার মালিমাকানা পায় যার মোট পরিমাণ ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার বা মূলখন্ডের ৮১ ভাগের সমান। সেখানে অন্তত চারটি ক্ষেত্রে কার্যক্রম চালানো হলে ২০৩০ সাল নাগাদ প্রতিবছর প্রায় আড়াই লাখ কোটি মার্কিন ডলার উপার্জন করা সম্ভব বলে মনে করেন এ খাত সংশ্লিষ্টরা। এই ক্ষেত্র চারটি হলো তেল-গ্যাস উত্তোলন, মৎস্য সম্পদ আহরণ, বন্দরের সুবিধা সম্প্রসারণ ও পর্যটন।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো অধ্যাপক মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, প্রতিবেশী দেশগুলো তাদের সমুদ্রে বহুদিন আগে থেকেই অনুসন্ধান ও সম্পদ আহরণ শুরু করলেও বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বলা যায় যে কাজ শুরু হয়েছে কেবল গতকাল থেকে। “এটাকে আমরা অনেকদিন অবহেলা করেছি, এখন হয়তো কিছুটা গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। এখানে বিশেষ করে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে বিদেশি বিনিয়োগের বিশাল সুযোগ রয়েছে। সেই সঙ্গে সমুদ্রে মৎস্য সম্পদ আহরণেও বাণিজ্যিক খাতে বিনিয়োগের সুযোগ রয়েছে।”

(দ্য রিপোর্ট/ হা আ / মাহা/ ছাব্বিশ অক্টোবর দুই হাজার তেইশ)

পাঠকের মতামত:

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

SMS Alert

অর্থ ও বাণিজ্য এর সর্বশেষ খবর

অর্থ ও বাণিজ্য - এর সব খবর