thereport24.com
ঢাকা, সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১,  ২১ জমাদিউস সানি 1446

নিয়ন্ত্রনহীন রোজার বাজার: এক বছরে দর বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ

২০২৪ মার্চ ১১ ১৬:৪৩:০৩
নিয়ন্ত্রনহীন রোজার বাজার: এক বছরে দর বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ

মাহি হাসান, দ্য রিপোর্ট: দেশে ধর্মীয় উৎসবসহ যেকোনো উপলক্ষকে কেন্দ্র করে তৎপরতা বাড়ে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের। প্রতি বছরই সরকারের পক্ষ থেকে রমজানে নানা পদক্ষেপের কথা বলা হয়। এবারও রমজান মাসকে ঘিরে বাজারে জেগে উঠেছে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট। প্রতিদিনই ভোক্তা অধিদফতরের অভিযান চললেও কোন ভাবেই সামাল দেওয়া যাচ্ছেনা বাজারকে।

গতকাল রোববার (১০ মার্চ) মাঝরাতেও রাজধানীর কারওয়ানবাজারে অভিযান চালায় ভোক্তা অধিদপ্তরের একটি দল। এতে নেতৃত্ব দেন ভোক্তা অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক বিকাশ চন্দ্র। এ সময় পাইকারি এ বাজারে পণ্য বিক্রিতে বিভিন্ন অনিয়ম পায় দলটি। এছাড়া আজ (সোমবার) শান্তিনগর বাজারে অভিযান তদারকিতে করেন বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু। এদিকে, সরেজমিনে রাজধানীর একাধিক বাজার বাজার পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, দেশের প্রতিটি পণ্য নিম্ন ও নিম্নমধ্যবিত্তের আয়ত্তের বাইরে চলে গেছে। যদিও এবার আরও আগে থেকেই নিত্যপণ্যের বাজার বেসামাল। আর রোজার আগ দিয়ে বাজার আরও টালমাটাল হয়ে পড়েছে। অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে এবারের রোজার বাজার বেশি বেসামাল এবং এবারের রোজা হবে বেশি খরচে। কারণ গত বছরের রোজার আগের বাজারে যে পণ্যমূল্য ছিল, এবারে তার চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি। ফলে স্বাভাবিকভাবেই এবারের রোজায় ভোক্তাকে হয় গত বছরের চেয়ে দ্বিগুণ খরচ করতে হবে, নতুবা কম পণ্য কিনে অল্প খেয়ে রোজা রাখতে হবে। এমনটিই মনে করছেন বাজার বিশ্লেষকরা।

গতকাল রবিবার মালিবাগ কাঁচাবাজারে কথা হয় ব্যবসায়ী রবিউল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, প্রতিবছর রোজার আগেই বাজারে সব পণ্যের দাম বাড়ে, তবে এবার অতিরিক্ত বেড়েছে। নিম্নবিত্ত থেকে মধ্যবিত্ত সকলের জন্য এ রমজান হবে অনেক কস্টের। সাধারণত রোজার মাসে অন্তত খেজুর আর এক গ্লাস শরবত দিয়ে ইফতার করে অনেক ধর্মপ্রাণ মুসুল্লী। এবার সেই ন্যূনতম ইফতারি পণ্যেই লেগেছে আগুন। খেজুরে এবার হাতই দেওয়া যাচ্ছে না, চিনির দাম বেড়েছে সারাবছর জুড়ে। লেবু এখন পিস হিসেবে বিক্রি হচ্ছে ১৫ থেকে ২০ টাকায়।কেজিতে ৫০০ টাকা বেড়েছে ইসবগুলের ভুসি। রোজা শুরুর আগেই সব ধরনের মুরগির দাম বেড়েছে। মাস দুয়েক আগে নির্বাচনের সময় দাম কমা গরুর মাংস কেজিতেই বেড়ে গেছে একশো টাকার বেশি। প্রতিটা মাছের দামও বেড়েছে। বাজারে এমন কোন সবজি খুঁজে পাওয়া যায়নি যার দাম কমেছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, নিত্যপণ্যের বাজার এখন অনেকটাই অস্থির। তবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা গেলে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা যাবে বলে মনে করেন অনেকে। বাজারের ব্যবস্থাপণা সম্পূর্ণ বদলানোর পাশাপাশি মনিটরিংয়ের উপর জোর দেওয়ার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের। গতবছরের তুলনায় এবার শুধু এক কেজি খেজুর আর এক কেজি পেঁয়াজ কিনতেই বাড়তি গুনতে হবে ২৫০ টাকার বেশি। এক বছরের ব্যবধানে রোজায় ব্যবহৃত দ্রব্যের দাম বেড়েছে কতটুকু দেখে আসা যাক।

এবার খেজুর খাওয়া হবেনা মধ্য ও নিম্নবিত্তের

গত এক বছরের রোজা থেকে প্রতিটা পণ্যের দাম বেড়েছে। খেজুরের দাম যাচাই করতে রাজধানীর কারওয়ান বাজার ঘুরে দেখা যায়, গত বছর রোজায় সাধারণ যে খেজুরের কেজি ছিল ১৫০ থেকে ২০০ টাকা তা এবার বিক্রি হচ্ছে ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকায়। অর্থ্যাৎ এক কেজি খেজুরে ক্রেতা এবার অতিরিক্ত গুনতে হবে প্রায় ২০০ টাকা। বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের তথ্য বলছে, দেশে বছরে খেজুরের চাহিদা এক লাখ টনের। শুধু রমজানেই দরকার হয় ৫০ হাজার টন। রোজায় চাহিদা বেশি থাকায় দরও বাড়িয়ে দেন ব্যবসায়ীরা। তবে এবার ব্যবসায়ীদের সেই অপচেষ্টার সঙ্গী উচ্চ শুল্ক। ফল আমদানিকারকদের দাবি, ১০ শতাংশ কমালেও এখনও সাধারণ মানের প্রতি কেজি খেজুরে শুল্ক পরিশোধ করতে হয় ১৫০ টাকার মতো। ফল আমদানিকারক সমিতির সভাপতি সিরাজুল ইসলাম বলেন, বিলাসী পণ্যে অন্তর্ভুক্ত করায় খেজুর আমদানিতে উচ্চ শুল্ক রয়েছে। কাস্টমস ইচ্ছামতো খেজুরের আমদানিমূল্য বেশি ধরে শুল্কায়ন করছে। বাজারে এর প্রভাব পড়েছে। বাজারে প্রতি কেজি খেজুরে সর্বনিম্ন ১০০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত দর বেড়েছে।

বেড়েছে সব ফলের দাম

ডলারের উচ্চমূল্যের পাশাপাশি আমদানি করা আপেল, কমলা ও আঙুরের ওপর গত বছরের মে মাস থেকে ২০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্কারোপ করায় প্রায় এক বছর ধরেই এসব ফলের দাম বাড়তি। রমজানে চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় নতুন করে আবার দাম বেড়েছে। সব ধরনের ফলের সরবরাহ বেড়েছে। গত ১৫ দিনে প্রচুর ফল আমদানি হলেও দাম কমার কোনো লক্ষন নেই। বরং ক্ষেত্র বিশেষে দাম আরও বেড়েছে। বাংলাদেশ ফ্রুট ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম বলেন, আমাদের দেশে বেশিরভাগ ফল আমদানি করতে হয়। কিন্তু গত বছর থেকে সরকার এসব ফলকে ‘বিলাসী পণ্য’ তকমা দেওয়ায় নতুন সমস্যা তৈরি হয়েছে। রাজস্ব বোর্ড ২০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক আরোপ করেছে। এর সঙ্গে ডলার সংকট, তেল ও জাহাজের কনটেইনারের ভাড়া বৃদ্ধি তো আছেই।

কেজিতে ৫০০ টাকা বেড়েছে ইসবগুলের ভুসি

রমজান এলেই বাজারে চাহিদা বাড়ে ইসবগুলের ভুসির। ইফতারে এই পানীয় দিয়ে রোজা ভাঙতে পছন্দ করেন রোজাদাররা। তবে এবার রোজার আগেই প্রতিনিয়ত দাম বেড়েছে শরবতে ব্যবহৃত ইসবগুলের ভুসির। বিক্রেতারা বলছেন, গত রমজানের পর থেকেই একটু একটু করে প্রতিনিয়ত দাম বেড়েছে ইসবগুলের ভুসির। গত ৬ মাসের ব্যবধানের রাজধানীর বাজারগুলোতে শরবতে ব্যবহৃত এই পণ্যটির দাম কেজিতে প্রায় ৫০০-৬০০ টাকা বেড়েছে। দাম বাড়ার কারণ হিসেবে তারা আমদানি খরচ বৃদ্ধি, ভ্যাট-ট্যাক্স বাড়ানো, ডলার সংকটে সরবরাহ ঘাটতির কথা বলছেন।

বিক্রেতারা জানান, বর্তমানে পাইকারিতে প্রতি কেজি ইসবগুলের ভুসি মানভেদে ১ হাজার ৫০০ টাকা থেকে ২ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। যা ৬ মাস আগে ১ হাজার ১০০ টাকা থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা ছিল। খুচরা বাজারে প্রতি কেজি ইসবগুলের ভুসি ১ হাজার ৬০০ থেকে ২ হাজার ২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। যা ৬ মাস আগে ১ হাজার থেকে ১ হাজার ৭০০ টাকা ছিল।

পেঁয়াজের দর বেড়েছে তিনগুণ

গত বছর রোজার আগে পেঁয়াজের কেজি ছিল ৩০ থেকে ৪০ টাকা। সেই দাম এখন প্রায় তিন গুণ। প্রতি কেজি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ১১০ থেকে ১২৫ টাকা দরে। সে হিসাবে কেজিতে বেশি খরচ হবে ৮০ থেকে ৮৫ টাকা।

লেবুর শরবত এখন বিলাসিতা

ইফতারে লেবুর সরবতের চাহিদা অনেক। সব শ্রেণির মানুষই ইফতারে কম বেশি লেবুর শরবত খেয়ে থাকতো। তবে এবার লেবুর শরবত খাওয়া যেনো এক প্রকার বিলাসিতা। লেবুর হালি ৩০ থেকে ৪০ টাকা পার করে এখন বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৬০ টাকায়। কিছু কিছু জায়গায় পিস ২০ টাকা হিসেবে বিক্রি করতে দেখা গিয়েছে।

চিনি দাম বেড়েছে কেজিতে ৩০ টাকা

গতবছর রোজার সময় চিনির কেজি ছিলো ১১৫ থেকে ১২০ টাকা। এবার সেই চিনি বিক্রি হচ্ছে ১৫০ টাকায় পর্যন্ত। এক কেজি চিনির কিনতে ক্রেতাদের অতিরিক্ত গুণতে হচ্ছে ৩০ থেকে ৪০ টাকা। তথ্য বলছে, দেশে বছরে চিনির চাহিদা ২২ লাখ টন। শুধু রোজায় দরকার হয় তিন লাখ টন। দেশে চিনি উৎপাদন হয় ৩০ হাজার টনের মতো। বাকিটা আমদানি করে মেটাতে হয়।

এক বছরে আলুর দাম ডবল

আলুর চপ ইফতারে রোজাদারদের বেশ প্রিয় খাবার। বাজারেআলুএখন ভরপুর। তবুও কেজি বিক্রি হচ্ছে ৩২ থেকে ৩৫ টাকা দরে। গত বছরের এ সময়ে কেজি ছিল ১৮ থেকে ২০ টাকা। তাতে গত রমজানের চেয়ে এবার কেজিতে বেশি গুনতে হবে ১৪ থেকে ১৫ টাকা, বলা যায় আলুর দাম বছরের ব্যবধানে দ্বিগুণ।

ছোলার দামও বাড়তি

বছরে প্রায় দুই লাখ টন ছোলা আমদানি হয়। রোজায় দরকার হয় এক লাখ টন। গত বছর বাজারে এ সময় ছোলার কেজি ছিল ৯০ থেকে ৯৫ টাকা। এখন বিক্রি হচ্ছে ১০৫ থেকে ১১২ টাকা দরে। সে হিসাবে এবার কেজিতে বেশি খরচ করতে হবে ১৫ থেকে ১৭ টাকা।

মাছ-মাংসের দাম বেড়েই চলেছে

ব্রয়লার মুরগি গত দু’দিনের ব্যবধানে কেজিতে ২০ থেকে ২৫ টাকা বেড়েছে। দু’দিন আগে কেজি ২০০ থেকে ২১০ টাকায় বিক্রি হলেও আজ বিক্রি হচ্ছে ২২০ থেকে ২৩৫ টাকায়। গত বছর এ সময় দর ছিল ২৩০ থেকে ২৫০ টাকা। রোজার আগে আগে মাছের বাজারও গরম। পাঙাশ, কই, রুই, কাতলাসহ প্রায় সব ধরনের মাছের কেজিতে ২০ থেকে ৫০ টাকা বেড়েছে। ডিমের দামও গত বছরের তুলনায় কিছুটা বাড়তি।

নির্বাচনের আগে দাম কমেছিলো গরুর, এখন বাড়তি

জাতীয় নির্বাচনের আগে গরুর মাংসের দাম কমায় বাজারে কিছুটা স্বস্তি ফিরেছিল। কিন্তু আবার দাম বেড়ে এখন আগের জায়গায় চলে গেছে গরুর মাংস। প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৭৫০ থেকে ৭৮০ টাকায়। গত বছর রোজার আগে ছিল ৭০০ থেকে ৭২০ টাকা, অর্থাৎ ভোক্তাদের এবার গরুর মাংসের কেজিতে এক বছরের ব্যবধানে অতিরিক্ত গুনতে হবে ৫০ থেকে ৬০ টাকা।

চালের দাম বাড়লেও কমেছে একমাত্র ভোজ্যতেলের দাম

গত বছর এ সময় মোটা চালের কেজি ৪৬ থেকে ৫০ টাকা ও চিকন চালের কেজি ৬০ থেকে ৭৫ টাকা ছিল। এখন দুই রকমের চালের দর যথাক্রমে ৪৮ থেকে ৫২ ও ৬২ থেকে ৭৫ টাকা। অর্থাৎ কেজিতে প্রায় দুই টাকা বেশি। গত বছরের চেয়ে এবার ভোজ্যতেলের দরই কমেছে। গত বছর এ সময় খোলা সয়াবিনের লিটার ছিল ১৬৮ থেকে ১৭২ টাকা। এখন বিক্রি হচ্ছে ১৫২ থেকে ১৫৮ টাকা। সে হিসাবে লিটারে খরচ কমবে ১৪ থেকে ১৬ টাকা। যদিও বিশ্ববাজারে এখন তেলের দর অনেক কম।

কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান দ্য রিপোর্টকে বলেন, সরকার নানা পদক্ষেপ নিচ্ছে, মনিটরিং বাড়িয়েছে অনেক। তবে রোজার এক দুইদিন আগে মনিটরিং বাড়িয়ে লাভ নেই, এটি চলমান প্রক্রিয়া। অব্যাহত রাখতে হবে। ইতিবাচক পদক্ষেপ সময়মতো নেওয়া হয়নি। যথাসময়ে নিলে ভোক্তা এখন সুফল পেতেন। গোলাম রহমান বলেন আরো সরকার টিসিবি ও ওএমএসের মাধ্যমে স্বল্প আয়ের মানুষকে ভর্তুকি মূল্যে পণ্য দিচ্ছে। এটি ভালো উদ্যোগ। এ ধরনের আরও নতুন নতুন পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি বলে মনে করেন ক্যাব সভাপতি। এদিকে, আজ বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু বলেছেন, উৎপাদক থেকে ভোক্তা পর্যায় পর্যন্ত বাজারকে শৃঙ্খলার মধ্যে আনা হবে। বাজার নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজনে আরও কঠোর হবে সরকার। তিনি আরো বলেন, মৌসুমী ব্যবসায়ীদের কারণেই বাড়ছে বিভিন্ন পণ্যের দাম।

(দ্য রিপোর্ট/ টিআইএম/মাহা/১১ই মার্চ দুইহাজার চব্বিশ)

পাঠকের মতামত:

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

SMS Alert

অর্থ ও বাণিজ্য এর সর্বশেষ খবর

অর্থ ও বাণিজ্য - এর সব খবর