thereport24.com
ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৯ মে 25, ১৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২,  ১ জিলহজ 1446

প্রবাসীদের লেখা থেকে

একজন আলো খালা

২০১৪ এপ্রিল ১২ ১৫:১০:৩১
একজন আলো খালা

নাইম আব্দুল্লাহ

সকালে মোবাইল ফোনের রিঙের শব্দে মহির ঘুম ভাঙ্গল। কিছুদিন হল তার উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ হয়েছে। ভেবে রেখেছিল পরীক্ষা শেষে বেশ কয়েকদিন আয়েশ করে ঘুমিয়ে নেবে। কিন্তু প্রত্যেক সকালে ভিন্ন ভিন্ন কারণে তাকে ভোর-বেলাতেই বিছানা ছাড়তে হয়। বিরক্তি নিয়ে ঘুম চোখে বালিশের পাশ থেকে মোবাইলটা নিয়ে বলল, হ্যালো...

-আমি তোর আলো খালা বলছি। তোরা কেমন আছিস মহি?

-আমরা ভাল আছি খালা, তোমার খবর বলো?

ওপাশ থেকে খালার দীর্ঘশ্বাস শোনা গেল। হয়তো কথা এড়ানোর জন্য বলল, তোর পরীক্ষা শেষ হওয়ার পরদিন কল দিয়েছিলাম। তুই ধরলিও না কল ব্যাকও করলি না?

-স্যরি খালা, আমি ধরতে ধরতে লাইন কেটে গিয়েছিল। আর তখন আমার ফোনে কোনো টাকাও ছিল না। তাই তোমাকে আর কল করা হয় নি।

মহির সাথে কথা শেষ করে খালা মহির মার সাথে কথা বলে। পরদিন মা তাকে ডেকে বলে, ‘শোন তোর তো পরীক্ষা শেষ। তোর বড় খালার বাড়ী থেকে বেড়িয়ে আস। বড়-আপা তোর কথা বলেছেন।’

-মা, আমি কখনো ঢাকায় যাইনি। রাস্তাঘাটও চিনি না। তা ছাড়া খালার ছেলে-মেয়ে দু’জনেই দেশের বাইরে থাকে। একা একা সময় কাটাতে কি ভাল লাগবে?

-তোর খালা অনেক করে বলেছে। তা ছাড়া ঢাকাতে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে চাইলে তোকে আগে থেকেই খোঁজ খবর করতে হবে। আমি তোর বাবাকে বলে যাওয়ার ট্রেন ভাড়াটা জোগাড় করে দেব। বাকীটা বলেছে তোর খালাই ব্যবস্থা করবে।

আলো খালা মহির মায়ের বোনদের মধ্যে বড়। লেখাপড়া তেমন একটা করেননি। বিয়ের পর পরই খালু তাকে ঢাকায় নিয়ে যান। খালুকে মহি দেখে নি। খালাকেও চোখের দেখা দেখেছে, যখন সে প্রাইমারীতে পড়ে। খালার বিয়ের সময়ও খালু ঢাকায় একটা সাধারণ চাকুরী করতেন। এর কিছুদিন পরে কীসের যেন ব্যবসা শুরু করলেন। তারপর শুরু হয় টাকা আসা, আর সেই টাকা এখনো খালুকে ধাওয়া করে চলেছে। ব্যবসা-বাণিজ্য, টাকা-পয়সা, প্রভাব প্রতিপত্তি কোনো কিছুরই অভাব নেই এখন তাদের। ছেলে-মেয়ে দু’জনেই দেশের বাইরে।

কমলাপুর স্টেশনে ট্রেন থেকে নামতেই ভিড় ঠেলে চোখে কালো সানগ্লাস পড়া এক ভদ্র-মহিলা তার সামনে এসে দাঁড়ালে প্রথমে তাকে চিনতে মহির কষ্ট হয়। খালা হয়তো সেটা ভেবেই সানগ্লাসটা কপালে তুলে দিয়ে মিষ্টি হেসে বলেন, ‘আমাদের মহি তো অনেক বড় হয়ে গেছে দেখছি!’

সে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। খালা তার হাত থেকে কাপড়ের ব্যাগটা নিতে নিতে বলেন, ‘খুব গরম পড়েছে। গাড়ীতে ওঠ, তারপর সব কথা হবে।’

ভাদ্রের তাল পাকা গরমে গাড়ীর ভেতর গিয়ে বসতেই তার সারা শরীর জুড়িয়ে গেল। খালা গাড়ী স্টার্ট দিয়ে ধমকের সুরে বলেন, ‘কীরে কথা বলছিস না কেন?’

-খালা ঢাকা শহরে এত মানুষ আমার তো দেখেই কেমন যেন লাগছে। খালা হেসে বলেন, ‘মানুষের মাথা দেখেই থমকে গেলি? আর গাড়ীর জ্যাম দেখলে তো মাথা ঘুরে যাবে।’

খালার কথা মুখ থেকে বেরুতে না বেরুতে শুরু হল জ্যাম।

-খালা তুমি ড্রাইভার সাথে আনলে না যে?

-আরে বোকা আনি নি কি আর সাধে! বলব সব, আগে চল একটা মার্কেটে যাই তোর জন্য কিছু কেনাকাটা করতে হবে।

খালা তাকে একটা বড় শপিং সেন্টারে নিয়ে এলেন। মহিকে পছন্দ-মতো জামা-প্যান্ট আর জুতা কিনে দিলেন। ট্রায়েল রুমে পরে দেখার সময় খালার কথামতো পরনের জামা কাপড় বদলে নূতন জামা-প্যান্ট আর জুতা পরে নিল মহি। সবশেষে প্রচণ্ড খিদে নিয়ে দু’জনে একটা থাই রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসল।

রেস্টুরেন্টে ঢুকে তো মহির চোখ ছানাবড়া। খালা হেসে বললেন, ‘এখন বল কী কী খাবি?’ মহি মেনু দেখে কোনো খাবারই চিনতে পারল না। সে বলল, ‘খালা তুমিই বল।’ সে সংকোচ নিয়েই খাওয়া শুরু করল। খালা খাওয়ার এক পর্যায়ে হাসতে হাসতে বললেন, ‘ড্রাইভারকে সাথে আনি নি ইচ্ছে করেই। কারণ তোকে মলিন শার্ট-প্যান্ট আর স্যান্ডেল পরা দেখলে আমার স্ট্যাটাস কোথায় থাকে বল? তাইতো তোর জন্য আগে শপিং করলাম।’

বাসায় ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল। মহির খালাদের বাসা খুবই সুন্দর, ছিমছাম সাজানো। সুইমিং পুল আর লাগোয়া বিশাল বাগানটা দেখে সবচেয়ে বেশী মুগ্ধ হল মহি।

অনেক রাতে মহির খালু বাসায় ফিরলেন। মহি ভেবে রেখেছিল খালু তাকে অবশ্যই পরীক্ষা আর পড়াশুনা সংক্রান্ত অনেক প্রশ্ন করবে। কিন্তু তিনি দায়সারা গোছের কিছু কুশল বিনিময় করে নিজের রুমে ঢুকে গেলেন।

মহিদের চার ভাই-বোনের মধ্যে সে সবার বড়। ওদের পরিবারের একমাত্র আয়ের উৎস গ্রামের বাজারে তার বাবার ছোট্ট কাপড়ের দোকান। ওদের বড় দু’জনের পড়াশুনার খরচ চালাতেই বাবার গলদঘর্ম দশা। ছোট দু’ভাই-বোন তো সবেমাত্র প্রাইমারীতে পড়ে। মাছ-মাংস সব সময় জোটে না। দুই কামরার টিনের ঘরটা সারাদিনের গরমে তেতে থাকে। তাদের কোনো বৈদ্যুতিক পাখা নেই। তাই গরমের রাতগুলোতে ওরা সবাই মিলে উঠানে খোলা আকাশের নীচে শীতলপাটি বিছিয়ে শুইয়ে থাকে।

খালাদের বিশাল বাসার পুরাটাই শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। বাইরের তপ্ত গরম কোনোভাবেই ঘরের ভেতরের মানুষগুলোকে স্পর্শ করতে পারে না। খালা বেশ রাত পর্যন্ত তার সাথে গল্প করে কাঁটালেন।

পরদিন সকালে খালার ডাকে ঘুম ভাঙ্গে। দু’জনে একসাথে নাস্তার টেবিলে গিয়ে বসে। খালুর কথা জিজ্ঞেস করে জানতে পারে অফিসে বেড়িয়ে গেছে। বিশাল বাড়ীটাতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে মালী-বাবুর্চি-ড্রাইভার আর দারোয়ান। দুপুরে একটা রেস্টুরেন্টে খাবার খেতে খেতে খালা জিজ্ঞেস করেন, ‘কীরে ঢাকা কেমন লাগছে?’

মহি মাথা নীচু করে বলে, ‘ভাল লাগছে না খালা। এত মানুষ এত শব্দ আর জ্যাম। সবাই যেন হন্যে হয়ে ছুটছে। এ সব দেখলে আমার মাথা ঘুরতে শুরু করে।’

ঘুমানোর সময়টুকু ছাড়া খালা প্রায় সারাক্ষণই তার সাথে-পাশে থাকেন। বেশ কয়েকদিন পরে মহি লক্ষ্য করে খালু মাঝে-মাঝে রাতে বাসায় ফেরেন না। খালাকে প্রশ্ন করলে বিরস ভঙ্গিতে বলেন, ‘মাঝে মাঝে তোর খালু কাজের চাপে ক্লান্ত হলে আর বাড়ী ফেরেন না। অফিসেই থেকে যায়।’ কিন্তু সে বিষয়টা ভেবে মেলাতে পারে না।

এক রবিবারে খালা অনেকটা আবেগ আপ্লুত হয়ে মহির সাথে কথা বলিয়ে দেওয়ার জন্য প্রথমে তার ছেলের বার্লিনের বাসায় ফোন করেন। ওপাশ থেকে ছেলের বৌ বলে, ‘আম্মা আপনার ছেলে গেস্টদের নিয়ে একটু ব্যস্ত আছে। ফ্রি হলে আপনাকে কল দিতে বলব।’ তারপর উত্তরের অপেক্ষা না করে লাইনটা কেটে দেয়।

মেয়েকে অকল্যান্ডে ফোন করলে বলে, ‘মাম্মি তুমি অসময়ে ফোন করেছ। আমি এখন তোমার নাতনীকে খাওয়াচ্ছি। একটু পরেই তোমাকে কল ব্যাক করছি।’

দু’টো ফোনের কোনো প্রান্ত থেকেই পরে আর কোনো কল আসে না। ছেলেমেয়েদের সাথে কথা বলিয়ে দিতে না পারার ব্যর্থতার লজ্জা নিয়ে খালা তার রুমে ফেরেন।

পরদিন খালা মহিকে ঢাকার দর্শনীয় আর ঐতিহাসিক স্থানগুলো ঘুরিয়ে দেখায়। পাশাপাশি অনেকগুলো ইউনিভার্সিটিতেও নিয়ে যায়। দেখতে দেখতে দু’সপ্তাহ কীভাবে যেন পার হয়ে যায়। এবার মহির বাড়ী ফিরার পালা।

কমলাপুর স্টেশনে মহিকে বিদায় দিতে এসে খালা তার চোখের পানি ধরে রাখতে পারলেন না। বাচ্চাদের মতো ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করলেন। খালার চোখে পানি দেখে তারও চোখে পানি এসে গেল। ট্রেন ছাড়ার পর কি মনে করে মহি তার মাকে লেখা খালার চিঠিটা পড়তে শুরু করে-

“বোন সালেহা,

অনেকদিন তোকে লেখা হয়ে ওঠে না। মহির সাথে কয়েকটা দিন আমার খুব আনন্দে কেটেছে। ’ও আমার ছেলে-মেয়েদের শূন্যতা পূরণ করে রেখেছিল। ওর কাছ থেকে পড়াশুনার খোঁজ খবরও জেনেছি। তোদের যদি কোনো আপত্তি না থাকে তাহলে মহি আমার কাছে থেকে ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হতে পারে। ওর পড়াশুনা আর অন্যান্য খরচ নিয়ে তোদের ভাবতে হবে না। তুই দুলামিয়ার সাথে পরামর্শ করে মতামত জানালে বাকী সব ব্যবস্থা আমি করব। সবার জন্য দোয়া রইল।

তোর বড় আপা।”

চিঠিটা পড়ে মহির বুক থেকে আলো খালার জন্য একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। স্বামী সন্তান অর্থ-বৈভব-পতিপত্তি থাকতেও সে কত একা। বিরাট বাড়ীটা যেন একটা নিঝুমপুরী।

গ্রামে ফিরে রাতে সবাই মিলে যখন খোলা আকাশের নীচে শুয়ে থাকে তখন নিজেকে তার বড় ভাগ্যবান বলে মনে হয়। হাত বাড়ালেই সবাইকে ছোঁয়া যায়। চোখ মেললেই নাম না জানা তাঁরার মেলা দেখা যায়। সীমাহীন আকাশের নীচে সবাই মিলে একসাথে সুখ-দুঃখ ভাগাভাগির যে আনন্দ তা ছেড়ে তার কোথাও যেতে ইচ্ছে করে না...

লেখক : সিডনি (অস্ট্রেলিয়া) প্রবাসী

পাঠকের মতামত:

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

M

M

SMS Alert

এর সর্বশেষ খবর

- এর সব খবর