thereport24.com
ঢাকা, মঙ্গলবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০ পৌষ ১৪৩১,  ২২ জমাদিউস সানি 1446

হরতাল-অবরোধ

লাটে উঠেছে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য

২০১৩ ডিসেম্বর ১৭ ২২:৩৯:৫১
লাটে উঠেছে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য

চট্টগ্রাম সংবাদদাতা : বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলের টানা হরতাল-অবরোধে লাটে উঠেছে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য। স্থবির হয়ে পড়েছে শিল্প-কারখানার উৎপাদন। মারাত্মক ব্যাহত হচ্ছে আমদানি-রফতানি। এ অবস্থায় বহুমুখী লোকসানের ঝুঁকিতে দেশের আমাদানি-রফতানি ও সামগ্রিক শিল্প উৎপাদন। ব্যবসায়ী ও শিল্পোদ্যক্তরা বলেছেন, হরতাল-অবরোধে ইতোমধ্যে দেশের অর্থনীতি হুমকির মুখে পড়েছে।

ইতোমধ্যে স্থবির হয়ে পড়েছে দেশের ৯২ ভাগ আমদানি-রফতানির সিংহদ্বারখ্যাত চট্টগ্রাম বন্দর। চলমান হরতাল-অবরোধে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে উভয়খাত। হরতাল-অবরোধে বন্দর জেটি ও বহির্নোঙরে পণ্য উঠা-নামা স্বাভাবিক থাকলেও ডেলিভারি না হওয়ায় বন্দরে বাড়ছে আমদানি কন্টেইনারজট। স্থানীয়ভাবে যা ডেলিভারি হয় তাও পরিমাণে কম। একইভাবে রফতানিতেও মারাত্মক ব্যাঘাত ঘটছে। খালি ফেরত যাচ্ছে পণ্য নিয়ে আসা ফিডার জাহাজ। ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, সাভারসহ আশপাশের এলাকার রফতানিপণ্য পরিবহন সংকটে বন্দরে আনা সম্ভব হচ্ছে না।

বন্দর কর্তৃপক্ষের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গত বছরের এ সময়ের তুলনায় চলতি বছর চার লাখ টনেরও বেশি পণ্য কম রফতানি হয়েছে।

সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অস্থিরতায় রফতানির এই হতাশাজনক চিত্র নিয়ে প্রতিমুহূর্তে চলছে চট্টগ্রাম বন্দর। অস্থির অবস্থার মধ্যেও যে পরিমাণ রফতানি কন্টেইনার বন্দরে আসে তাও সীমিত। যা একটি জাহাজ পণ্য ভর্তি হয়ে ফেরার মতো নয়। স্বাভাবিক সময়ে প্রতিটি ফিরতি জাহাজ পুরো কন্টেইনার ভর্তি হয়ে ফেরত যেত। রফতানির এই বেহাল অবস্থায় শিপিং এজেন্টগুলোকেও মোটা অংকের লোকসান গুনতে হচ্ছে।

চট্টগ্রাম বন্দরের পরিচালক (পরিবহন) গোলাম ছরওয়ার জানান, হরতাল-অবরোধে জেটি ও বহির্নোঙরে পণ্য উঠা-নামায় ব্যাঘাত না ঘটলেও ডেলিভারিতে মারাত্মক সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। হরতাল-অবরোধের সময় মাত্র ৩০০-৪০০ টিইইউএস কন্টেইনার ডেলিভারি হয়। এর বিপরীতে স্বাভাবিক অবস্থায় বন্দর থেকে গড়ে ডেলিভারি হওয়া কন্টেইনারের পরিমাণ দুই হাজার টিইইউএস। একইভাবে কমে যায় রফতানি পণ্য ভর্তি কন্টেইনারের পরিমাণও।

পানগাঁও কন্টেইনার টার্মিনালে গত এক সপ্তায় দুটি জাহাজ আমদানি কন্টেইনার নিয়ে গেলেও ফিরতি যাত্রায় কোনো রফতানিকারক কন্টেইনার দেয়নি বলে জানান গোলাম ছরওয়ার। তিনি বলেন, পানগাঁও থেকে ঢাকা এবং আশপাশের রফতানি কন্টেইনার ভর্তি করা হলে রফতানিতে সংকট কেটে ওঠা সম্ভব হতো।

তিনি জানান, সাম্প্রতিক সময়ে যে কদিন অবরোধ ছিল না তখন গড়ে চার হাজারের অধিক কন্টেইনার ডেলিভারি ও লেডিং হয়।

চতুর্থ দফায় টানা অবরোধের শুরুতে চট্টগ্রাম বন্দর ইয়ার্ডে কন্টেইনার জট আরও বাড়তে শুরু করেছে। এতোদিন জমা কন্টেইনারের পরিমাণ ২৫ হাজারে সীমাবদ্ধ থাকলেও মঙ্গলবার তা বেড়ে ঠেকেছে ২৭ হাজার ৭০০ তে।

চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজের যুগ্ম-কমিশনার আবদুল হাকিম জানান, রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে পণ্য ডেলিভারি না হওয়ায় চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজ রাজস্ব আয় থেকে পিছিয়ে এটা স্বাভাবিক। গত অর্থ বছরের তুলনায় চলমান অর্থ বছরে রাজস্ব আয় অনেক কম হবে। তিনি জানান, পণ্য ডেলিভারি না হওয়ায় আমদানিকারকরা বিল অব এন্ট্রি (বিই) দাখিল করতে পারছেন না।

এদিকে টানা অস্থিরতার পরিপ্রেক্ষিতে চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি মাহবুবুল আলমের অনুরোধে নৌ-পরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খান ডেলিভারি না হওয়া কার্গোর উপর ডেমারেজ চার্জ মওকুফফের ঘোষণা দেন। আমদানিকারকরা বলেছেন, দুই সপ্তাহ আগে দেওয়া মন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি এখনও কার্যকর হয়নি। এ প্রসঙ্গে বন্দরের পরিচালক (পরিবহন) গোলাম ছরওয়ার জানান, ডেমারেজ মওকুফের প্রস্তাব নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। সেটি এখনও অনুমোদিত হয়ে আসেনি।

চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সাবেক সভাপতি ও আরামিট গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ এমপি বলেন, যেসব শিল্পপণ্য আমার প্রতিষ্ঠান উৎপাদন করে তার ৬০ শতাংশ উৎপাদন ঘাটতি থাকছে শুধু সাম্প্রতিক হরতাল-অবরোধে। পাশাপাশি সরবরাহ না হওয়ায় পণ্য রাখা যেমন কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে তেমনি বন্দর কাঁচামাল ডেলিভারি বিঘ্ন হওয়ায় মারাত্মক সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। এছাড়া পণ্য বিক্রি না হওয়ায় ব্যাংক ইন্টারেস্ট ও শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন দেওয়াও দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় দেশের অর্থনীতির মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। ৬ শতাংশের উপরে যাওয়া প্রবৃদ্ধিও আর ধরে রাখা যাবে না।

দেশের রফতানির প্রধান খাত গার্মেন্টস। চলমান হরতাল-অবরোধে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হচ্ছে এ খাতের। শতভাগ রফতানি নির্ভর এ খাতের ৮০ ভাগই হচ্ছে আমদানি নির্ভর। তৈরি পোশাক খাতের সংগঠন বিজিএমইএর ভারপ্রাপ্ত প্রথম সহ-সভাপতি আবদুল ওয়াহাব এ তথ্য জানান।

তিনি বলেন, একদিকে ডেলিভারি না হওয়ায় ফেব্রিক্সসহ অন্যান্য অনুষঙ্গ পড়ে আছে চট্টগ্রাম বন্দরে। অন্যদিকে হরতাল-অবরোধে তৈরি করা পণ্য বন্দরে পাঠানো যাচ্ছে না। এ কারণে অনেক গার্মেন্টসের শিপমেন্ট বাতিল হচ্ছে। অনেকের পণ্যস্টক লটে যাবে। এই অস্থিরতা চলতে থাকলে অনেক গার্মেন্টস রুগ্ন হয়ে যাবে। আর কিছুদিন এই অবস্থা চলতে থাকলে গার্মেন্টস শিল্পে ভয়াবহ দুর্দিন নেমে আসবে।

বিজিএমইএর পরিচালক মোহাম্মদ নাছির জানান, ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম বন্দর পর্যন্ত ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকার মধ্যে উঠা-নামা করা কাভার্ডভ্যান ভাড়া এখন লাফিয়ে ঠেকেছে এক লাখ ১০ থেকে ২০ হাজার টাকায়। এ ভাড়ায় পণ্য পাঠিয়ে কেউ ব্যবসায় লাভ করতে পারবে না। তবুও শিপমেন্ট ধরে রাখার জন্য আমরা রেডিমেড পণ্য পাঠাই। কিন্তু এরপরও শঙ্কামুক্ত থাকতে পারি না। পথে পথে রয়েছে অবরোধকারীদের আক্রমণ। তারা নির্বিচারে পরিবহনসহ পণ্য জ্বালাচ্ছে। এ অবস্থা চললে দেশের গার্মেন্টস শিল্প রুগ্ন থেকে রুগ্নতর হবে।

খাতুনগঞ্জ ট্রেড অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ও চট্টগ্রাম চেম্বার পরিচালক সৈয়দ ছগীর আহমেদ জানান, সারাদেশের ভোগ্য পণ্যের মূল বাজার হচ্ছে খাতুনগঞ্জ। তিন মাস ধরে চলা রাজনৈতিক অস্থিরতায় খাতুনগঞ্জের ব্যবসা-বাণিজ্যে মারাত্মক স্থবিরতা চলছে। স্বাভাবিকভাবে এই বাজারে যেখানে দৈনিক ৯০০ কোটি থেকে ১২০০ কোটি টাকার পণ্য বিক্রি হয় সেখানে বিকিকিনি নেমে এসেছে ১০০ কোটি টাকার মধ্যে।

তিনি জানান, এই স্থবিরতায় ব্যাংক ঋণের সুদ, পোর্ট ডেমারেজ, স্টাবিলিস্টমেন্ট খরচ সবমিলিয়ে ব্যবসায়িরা এখন ক্যাপিটাল লস করতে বসেছেন। অনেক ব্যবসায়ী ব্যাংকঋণের সুদ পরিশোধ করতে গিয়ে ইতোমধ্যে কিছু পণ্য লোকসানে বিক্রি শুরু করেছেন।

ইস্পাত শিল্প মালিক সমিতির সহ-সভাপতি আনামূল হক ইকবাল জানান, কাঁচামাল সংকটে ইতোমধ্যে অনেক ইস্পাত মিল উৎপাদন বন্ধ রেখেছে। এ খাতের উৎপাদন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৬০ শতাংশেরও বেশি।

তিনি জানান, চলতি নির্মাণ মৌসুমের শুরুতে রাজনৈতিক অস্থিরতায় উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার প্রভাব দেশের নির্মাণ শিল্পেও পড়বে।

(দ্য রিপোর্ট/এমকে/এমএআর/ডিসেম্বর ১৭, ২০১৩)

পাঠকের মতামত:

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

SMS Alert

অর্থ ও বাণিজ্য এর সর্বশেষ খবর

অর্থ ও বাণিজ্য - এর সব খবর