thereport24.com
ঢাকা, বুধবার, ২৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১ পৌষ ১৪৩১,  ২৩ জমাদিউস সানি 1446

শিখ ধর্ম : উৎপত্তি ও বিকাশধারা

২০১৩ ডিসেম্বর ২০ ০১:৩১:৩১
শিখ ধর্ম : উৎপত্তি ও বিকাশধারা

আজ সন্নিবেশিত হলো শিখ ধর্ম সম্পর্কে আলোচনা। বর্তমান নিবন্ধে এই ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা, মূলমন্ত্রসহ সংক্ষেপে এ সম্পর্কে তথ্য পেশ করা হয়েছে। এটা আমাদের ধারাবাহিক কর্মপ্রয়াস। সময় সুযোগ মতো এ নিয়ে আরও বিস্তারিত পর্যালোচনার সুযোগ থাকছে। প্রিয় পাঠক, সারা বিশ্বে শিখদের সংখ্যা আড়াই কোটির বেশি। শিখরা মূলত ভারতের পাঞ্জাব ও অন্যান্য রাজ্যে বাস করেন। এ ছাড়া বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তাদের অস্তিত্ব বিদ্যমান। বি.স

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক : ভারতীয় উপমহাদেশে প্রবর্তিত ধর্মগুলোর অন্যতম শিখ ধর্ম। এই অঞ্চলের অন্যান্য ধর্মের মতো এর শক্তিশালী দার্শনিক ভিত্তি আছে। একেশ্বরবাদী ধর্মটি খ্রিষ্টীয় ১৫ শতকে পাঞ্জাব অঞ্চলে প্রবর্তিত হয়। এই ধর্মের মূল ভিত্তি গুরু নানক দেব ও তার উত্তরসূরি দশজন গুরুর ধর্মোপদেশ। এর মধ্যে ধর্মগ্রন্থ ‘গ্রন্থসাহেব’ দশম গুরু হিসেবে বিবেচিত।

শিখ শব্দটির সংস্কৃত মূল শিষ্য বা শিক্ষা। এই ধর্মে ঈশ্বরকে ওয়াহেগুরু নামে ডাকা হয়। এই ধর্ম ওয়াহেগুরুর নাম ও বাণীর নিয়মবদ্ধ ও ব্যক্তিগত ধ্যানের মাধ্যমে মোক্ষলাভের কথা বলে। এর মূল কথা হলো এক-ওঙ্কার।

সারা বিশ্বে শিখদের সংখ্যা আড়াই কোটির বেশি। শিখরা মূলত ভারতের পাঞ্জাব ও অন্যান্য রাজ্যে বাস করেন। এ ছাড়া বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শিখদের বসবাস রয়েছে।

উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ : শিখ ধর্মের প্রবর্তক গুরু নানক ১৪৬৯ সালে পাঞ্জাব প্রদেশের লাহোর শহর থেকে ৩৫ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে 'রায় ভর দি তালবন্দী' (বর্তমান নাম, নানকানা সাহেব) গ্রামে হিন্দু ধর্মাবলম্বী এক ক্ষৈত্রেয় পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম মেহতা কল্যাণ বেদী ও মা তৃপ্তা দেবী এবং স্ত্রী সুলক্ষিণী। তার দুইজন ছেলে ছিল।

বলা হয়ে থাকে, একদিন নানক তার মুসলমান বন্ধু মারকানার সঙ্গে বাইন নদীতে স্নান করতে গিয়ে ডুব দিয়ে হারিয়ে যান। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও তার কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। তিনদিন পর নানক উপস্থিত হয়ে বলেন, 'আমি ঈশ্বরের দেখা পেয়েছি, তিনি আমাকে তার প্রেরিত গুরু হিসাবে উল্লেখ করেছেন'। নানকের এই জাগরণ হয় ১৫০৭ সালের ২০ আগস্ট।

কয়েকজন সাধু-সন্তের জীবনাদর্শ এই ধর্মের দর্শনে বিশেষভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। এদের মধ্যে রয়েছেন রবিদাস ও কবির। তাদের ঈশ্বরভক্তি অনেকটা বৈষ্ণববাদের ভক্তি আন্দোলনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। তবে শিখ ধর্মে মূর্তিপুজা নিষিদ্ধ। শিখ ধর্ম কঠিন আত্ম সাধনায় বিশ্বাসী।

খালাসা : শিখদের গুরু অর্জন দেব ও গুরু তেগ বাহাদুর মুসলমান শাসকদের হাতে নিহত হন। এরপর দশম গুরু গোবিন্দ সিং মোঘল বাদশাহ আওরঙ্গজেবের আমলে ১৬৯৯ সালের ৩০ মার্চ পাঞ্জাবের আনন্দপুর নামক স্থানে 'খালসা'র প্রবর্তন করেন। উদ্দেশ্য ছিল শিখ জাতিকে একত্রিত করা। একে তিনি 'আকাল পুরখ দ্যে ফৌজ' বা ঈশ্বরের সেনাদল নাম দেন। ঈশ্বর সৃষ্ট মানব হিসাবে সকলকে আশ্রয় দেয়া, পালন করা, রক্ষা করা এই সেনাদলের কাজ। পাঁচজন নির্ভীক বীরকে তিনি 'খালসা' বা পবিত্র ধর্মে দীক্ষা দেন। এই পাঁচজনকে বলা হলো 'পঞ্চ পিয়ারে'। পরে গুরু গোবিন্দ সিং এই 'পঞ্চ পিয়ারে'র কাছে দীক্ষিত হন। তিনি পরবর্তীকালে আরও অনেক শিখকে 'খালসা' হিসেবে দীক্ষা দেন। এদেরকে পাঁচটি 'ক' দ্বারা চিহ্নিত করা হয়-

১. চুল না কেটে লম্বা করা।

২. কাঙ্গা বা চিরুনি ব্যবহার করা।

৩. আত্মশক্তি ও আত্মসংযমের জন্য কড়া বা লোহার চুড়ি ব্যবহার করা।

৪. আত্মরক্ষার জন্য কৃপাণ বা ছুরি রাখা।

৫. হাঁটু অবধি লম্বা অন্তর্বাস ও মাথায় পাগড়ি পরিধান করা।

যারা 'খালসা' হিসাবে দীক্ষা গ্রহণ করেন তাদেরকে বলা হয় 'অমৃতধারী'। যারা গুরুদের বাণী, রীতি-নীতি ও গ্রন্থসাহেব মানেন কিন্তু 'খালসা' হিসেবে দীক্ষিত নন এবং পঞ্চ 'ক' ধারণ করেন না তাদেরকে বলা হয় 'সহজধারী'।

বিশ্বাস ও প্রার্থনা : একেশ্বরবাদ এই ধর্মের প্রধান বিশ্বাস। নানক স্বর্গ, নরক ও কর্মফলে বিশ্বাস করতেন। তিনি বলেন, ধর্মাচরণ করলেই সমস্ত পাপ ক্ষয় হয় ও ঈশ্বরের নাম জপ করে স্বর্গের অধিকারী হওয়া যায়। পশুবলীর চেয়ে সত্যভাষণ ভালো। ওয়াহেগুরুর প্রতি অনুরাগ তীর্থ ভ্রমণ ও ধর্মানুষ্ঠানের চেয়ে শ্রেয়। সকল মানুষই ঈশ্বরের সন্তান- কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাস দিয়ে মানুষ সমাজে ভেদ-বুদ্ধি সৃষ্টি করেছে।

শিখ ধর্ম মতে, মানুষের ক্ষতিকর পাঁচটি মন্দ দিক হলো- কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ ও অহঙ্কার। অন্যদিকে মানুষের পাঁচটি সদগুণ হলো- সততা, সন্তোষ, দয়া, নম্রতা ও প্রেম।

শিখ ধর্ম তিনটি বিশেষ স্তম্ভের ওপর প্রতিষ্ঠিত। সেগুলো হলো-

১. নামজপ: প্রতিদিন সকালে স্নানের পর ছন্দে ছন্দে মন্ত্রোচ্চারণের মাধ্যমে ওয়াহেগুরুকে স্মরণ করা।

২. কিরাত: সৎভাবে জীবিকা অর্জন ও সক্ষমতা অনুযায়ী পরিশ্রম করা।

৩. ভান্দ চাখো (ভাগে চাখো): নিজের যা সম্পদ তা সবার সঙ্গে সহভোগ করো।

ধর্মপ্রাণ শিখরা সাধারণত সূর্য ওঠার তিন ঘণ্টা আগে ঘুম থেকে ওঠেন। স্নান শেষে তিনি ওয়াহেগুরুর আরাধনায় মনোনিবেশ করবেন। তাদের মধ্যে সকাল, সন্ধ্যা ও রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে প্রার্থনা করার রীতি প্রচলিত আছে। শিখ ধর্মালম্বীরা গুরুদুয়ারায় উপস্থিত হয়েও সমবেত প্রার্থনায় যোগ দেন।

তবে গুরু নানক ধর্মানুষ্ঠানকে বর্জন করতে বলেছেন। আদিগ্রন্থের মূল কথা হলো- যোগসাধনা, পূজানুষ্ঠান, কৃচ্ছসাধন বা দীর্ঘ প্রার্থনাও নয়। বরং এই প্রলোভনে ভরা জগতে পবিত্র জীবনই ধর্ম। গুরুকে ভালোবাসবে, সব মানুষকে সমান ভাববে, সবার জন্য থাকবে সমবেদনা, কোনো গর্ব নয়, অহঙ্কার নয়, বিনয় ব্যবহারেই ধর্ম পালিত হবে। তবে পরবর্তীকালে শিখ ধর্মালম্বীরা কিছু পর্ব বা উৎসব পালন শুরু করেন।

১. গুরুপর্ব : সকল শিখ গুরুর জন্মদিনে গুরদুয়ারায় গুরুর নামে এই উৎসব পালিত হয়। তবে গুরু নানক ও গুরু গোবিন্দ সিংয়ের গুরুপর্ব উৎসব সব গুরদুয়ারায় বিশেষভাবে পালিত হয়।

২. বৈশাখী : দশম গুরু গোবিন্দ সিং-এর 'খালসা' প্রবর্তনের দিন হিসেবে বৈশাখী উৎসব পালিত হয়।

৩. হলা মহলা : হিন্দুদের হোলি উৎসবের একদিন পর পাঞ্জাবের আনন্দপুরে খালসারা একত্রিত হয়ে তাদের নানাবিধ কলাকৌশল প্রদর্শন করেন।

গুরু : গুরু ও শিষ্যের ধারণা শিখ ধর্মে গুরুত্বপূর্ণ। আমরা জেনেছি শিখ শব্দটি এসেছে শিষ্য বা শিক্ষা থেকে। নানক গুরুর প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করেছেন। নদী যেমন সমুদ্রের সঙ্গে মিলিত হয়ে পূর্ণতা লাভ করে, তেমনি সাধারণ মানুষ গুরুতে আত্মসমর্পণ করে ঈশ্বরকে লাভ করে। শিখ ধর্মমত ও দর্শন গুরমত (অর্থাৎ, গুরুর উপদেশ) নামেও পরিচিত।

প্রধান গ্রন্থ : শিখ ধর্মের প্রধান গ্রন্থের নাম ‘গ্রন্থসাহেব’। প্রথমে গুরু অর্জন দেবের তত্ত্বাবধানে ভাই গুরুদাস আদিগ্রন্থ সংকলন করেন। ১৬৭৮ সালে দশম গুরু গোবিন্দ সিং আদিগ্রন্থের সঙ্গে গুরু তেগ বাহাদুরের কিছু রচনা যোগ করে গুরু গ্রন্থসাহেব সংকলিত করেন। এতে কবীর, নামদেব, রবিদাস, শেখ ফরিদ ও আরও কিছু জ্ঞানী ব্যক্তির বাণী অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। গুরু গোবিন্দ সিংহ এই গ্রন্থটিকে দশম গুরু বা খালসা পন্থের সর্বশেষ গুরু বলে ঘোষণা করে যান।

গুরু দুয়ারা : শিখ ধর্মের প্রার্থনা কেন্দ্রকে বলা হয় 'গুরু দুয়ারা'। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাই গুরুদুয়ারায় প্রার্থনায় অংশগ্রহণ করতে পারে। গুরুদুয়ারায় প্রার্থনাস্থলকে বলা হয় ‘দরবার সাহেব’। এর চারদিক দিয়েই ভেতরে প্রবেশের ব্যবস্থা থাকে। ফলে অন্যান্য ধর্মীয় স্থাপত্যের তুলনায় গুরুদুয়ারা উপাসনালয়ে প্রবেশদ্বারের সংখ্যা সাধারণত বেশি থাকে। প্রত্যেক গুরুদুয়ারায় হলুদ রঙের পতাকা টাঙানো থাকে। একে বলা হয় ‘নিশান সাহেব’। নিশানের দুই দিকে তলোয়ারের ছবি আঁকা থাকে, যা ‘খাণ্ডা’ নামে পরিচিত। এই নিশানকে জাগতিক ও আধ্যাত্মিক মিশ্রণের প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

প্রধান তীর্থ : শিখ সম্প্রদায়ের চতুর্থ গুরু রাম দাস 'চক রাম দাস' নামে একটি নগর প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তী সময়ে এর নামকরণ হয় 'অমৃতসর'। এই অমৃতসরেই শিখদের প্রধান তীর্থস্থান স্বর্নমন্দির বা হরিমন্দির অবস্থিত। গুরু অর্জনদেব এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন।

লঙ্গর: লঙ্গর হলো- যেখানে সব ধর্ম, গোত্র, লিঙ্গ ও সমাজের সর্বস্তরের মানুষেরা পাশাপাশি বসে আহার করতে পারে। গুরু নানক তার সময়ে লঙ্গরের প্রচলন করেছিলেন। বর্তমানে প্রতিটি গুরদুয়ারায় লঙ্গরের ব্যবস্থা আছে। দ্বিতীয় শিখগুরু অঙ্গদ দেবের সময় থেকে লঙ্গরে মাংসের ব্যবহার রদ করা হয়।

বাংলাদেশে শিখ ও গুরু দুয়ারা

বাংলাদেশে বসবাস করা শিখ ধর্মাবলম্বীদের কোনো পরিসংখ্যান নেই। তবে বিভিন্ন স্থানে তাদের প্রার্থনাগার এই ধর্মাবলম্বীদের সুদীর্ঘকালের উপস্থিতি প্রমাণ করে।

বাংলাদেশে এই ধর্মের প্রধান উপাসনালয় হচ্ছে গুরুদুয়ারা নানক শাহী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের ধার ঘেঁষে এটি অবস্থিত। প্রচলিত কাহিনী অনুযায়ী সম্রাট জাহাঙ্গীরের রাজত্বকালে (১৬০৬-১৬২৮) ষষ্ঠ শিখগুরু হরগোবিন্দ সিং শিখ পুরোহিত আলমাসত বা আলামাস্টকে ঢাকায় পাঠান। তারই প্রচেষ্টায় এই গুরুদুয়ারা উপাসনালয়টি নির্মিত হয়। ঐতিহাসিক আহমাদ দানীর মতে, ১৮৪৭ সালের পর থেকে ষাট দশক পর্যন্ত এটি প্রায় পরিত্যক্ত অবস্থায় ছিল। স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে এটি আবার সংস্কার হয়ে প্রায় নতুন চেহারা দেয়া হয়।

এ ছাড়া বাংলাদেশে শিখ সম্প্রদায়ের আরও কিছু স্থাপত্য রয়েছে। ঢাকার বাংলাবাজারে অবস্থিত গুরুদুয়ারা গুরু তেগবাহাদুরের সঙ্গত বা আস্তানা, গুরুদুয়ারা নানক কুয়ান। উর্দুবাজারের গুরুদুয়ারা সুতরা শাহী ও ইংলিশ রোডের গুরুদুয়ারা বাবা মোহন সিং এখন বিলুপ্ত। ঢাকার বাইরে চট্টগ্রামের চকবাজার শিখ মন্দির ও পাহাড়তলী শিখ মন্দির, ময়মনসিংহের এ.বি. গুহ রোডের গুরু নানক মন্দির অন্যতম। সিলেটের গুরুদুয়ারা সাহেব এখন পরিত্যক্ত অবস্থায় আছে।

অবদান : এই ধর্ম জাত-পাত বিরোধী। এর মধ্যে সমন্বয়ী ভাবধারা বিদ্যমান। একই ছায়াতলে সকল মানুষকে আশ্রয় দেয়ার কথা বলে। হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ই গুরু নানককে মান্য করতেন। ধর্মবিশ্বাসে যে ঐক্য আছে তাই গ্রহণ করে সামাজিক বাধা দূর করবার চেষ্টা করেছিলেন। দরিদ্রের প্রতি ভালোবাসা এই ধর্মের অন্যতম প্রধান অঙ্গ। এ ছাড়া উপমহাদেশের সংস্কৃতিতে এই ধর্মের অবদান রয়েছে।

(দ্য রিপোর্ট/ওএস/ডব্লিউএস/একেএম/লতিফ/ডিসেম্বর ২০, ২০১৩)

পাঠকের মতামত:

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

SMS Alert

ধর্ম এর সর্বশেষ খবর

ধর্ম - এর সব খবর