thereport24.com
ঢাকা, সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১,  ২১ জমাদিউস সানি 1446

তাওফীক আল্-হাকীম ও তার সাহিত্যভুবন

২০১৩ ডিসেম্বর ২৮ ০০:৪০:২৯
তাওফীক আল্-হাকীম ও তার সাহিত্যভুবন

জগৎখ্যাত সাহিত্যিক মিশরের তাওফীক আল্-হাকীম। ১৯৮৮ সালে নোবেল প্রাপ্তির সুসংবাদ পাওয়ার পর নগীব মাহফুজ অভিব্যক্তি প্রকাশ করে বলেছিলেন, ‘আমার চেয়ে আরও অনেক বড় লেখক রয়ে গেছেন যারা নোবেলের দাবিদার। তাদের মধ্যে অন্যতম ত্বাহা হুসেইন, তাওফীক আল্-হাকীম, মাহমুদ আব্বাস আক্কাদ।’ সাহিত্য বিভাগে আজ সন্নিবেশ করা হচ্ছে সেই মহান আরব মনীষা তাওফীক আল্-হাকীমকে নিয়ে নিবন্ধ। নিবন্ধটি লিখেছেন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বনামধন্য শিক্ষক প্রফেসর . এম মোত্তালিব। -বি.স.

শুরুর আগে : সাহিত্য মানব মনের শৈল্পিক অভিব্যক্তি। যেখানেই মানুষের আনাগোনা সেখানেই সাহিত্যের উত্থান। রাষ্ট্রীয় বা ভূমির সীমারেখা দিয়ে সাহিত্যের বিষয়বস্তুকে কখনই সীমাবদ্ধ করা যায় না। সাহিত্যের বিচরণ সর্বজনীন। এর পরিধি বিশ্বব্যাপী। পথের দূরত্ব অনেক হলেও সর্বত্র এর প্রকাশ ও প্রভাব একই। যেকোনো দেশে সাহিত্যিকের কলমেই ফুটে ওঠে সমকালীন সমাজ, সভ্যতা ও সংস্কৃতির বাস্তবচিত্র। অবশ্য আমাদের জানার সীমাবদ্ধতার কারণে তা অগোচরেই থেকে যায়। ভাষার ভিন্নতার কারণে মানুষের পক্ষে মাতৃভাষা ছাড়া অন্য যেকোনো ভাষার সাহিত্য সম্পর্কে খুব কমই জানা হয়ে থাকে। অনুবাদ সাহিত্যের মাধ্যমেই সম্ভব পৃথিবীর সকল ভাষায় রচিত সাহিত্যের মাঝে এক গভীর সেতুবন্ধন সৃষ্টি করা। এ বাস্তবতাকে সামনে রেখেই আলোচ্য নিবন্ধে বিদেশী ভাষার সাহিত্যিক ও সাহিত্য সম্পর্কে যৎকিঞ্চিৎ আলোকপাত করা হয়েছে। আজকের প্রতিপাদ্য বিষয় আরবী ভাষা ও সাহিত্য। ধর্মীয় প্রয়োজনেই আরবী ভাষা বিশ্বব্যাপী ব্যাপক প্রসার লাভ করেছে। সেই সাথে প্রসারিত হয়েছে এ ভাষার সাহিত্য। আমাদের দেশে দীর্ঘদিন যাবত সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আরবী চর্চা হলেও বাংলা ভাষায় আরবী সাহিত্যের অনুবাদ একেবারেই অপ্রতুল।

ফলে আজও বাংলা ভাষাভাষী উচ্চশিক্ষিত অনেক মানুষের ধারণা, আরবী ভাষা শুধু কুরআন ও হাদীসের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। অথচ আরবী ভাষায় রচিত সাহিত্য পৃথিবীর অন্য যেকোনো প্রসিদ্ধ ভাষার সাহিত্যের চেয়ে কোনো অংশেই কম নয়। বরং অনেক সমৃদ্ধ। কবিতা, নাটক, উপন্যাস, ছোটগল্প, লোক-সাহিত্যসহ কী নেই এ ভাষায়! এ ভাষায় অর্জিত হয়েছে নোবেল পুরস্কার। আধুনিক যুগে নাজীব মাহফুজ, ত্বহা হুসায়ন, মাহমুদ আব্বাস আক্কাদ, আহমদ শাত্তেকী, হাফিজ ইব্রাহীমসহ অসংখ্য কবি সাহিত্যিক এ ভাষার সাহিত্যাঙ্গনে এক একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র তুল্য।

বিখ্যাত নাট্যকার তাওফীক আল্-হাকীম আরবী নাট্যজগতের এক কিংবদন্তী। বিশ্বসাহিত্যের প্রতি অনুরাগী বাংলা ভাষাভাষীদের নিকট তাকে তুলে ধরতে পারলে বিষয়টি আরও স্পষ্ট হবে বলে আমার বিশ্বাস।

জীবনী ও সাহিত্যকর্ম : আধুনিক আরবী নাট্য সাহিত্যের অন্যতম পথিকৃত তাওফীক আল্-হাকীম ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। কৃষক পরিবারে বেড়ে ওঠা তাওফীক আজীবন আরবী সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় অনন্য সৃজনশীলতার পরিচয় দিয়েছেন। নিম্নে তাঁর জীবনী ও সাহিত্যকর্ম সম্পর্কে আলোচনা করা হলো।

জন্ম ও শৈশব : তাওফীক আল্-হাকীম মিসরের হীরা প্রদেশের আলেকজান্দ্রিয়া অঞ্চলের দলনজাত গ্রামে ১৮৯৮ খ্রিষ্টাব্দে এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম ইসমাঈল হাকীম। তাওফীকের পিতা মিসরীয় বংশোদ্ভূত হলেও মাতা ছিলেন তুর্কী। পিতা বুহায়রা জেলা জজকোর্টে চাকরি করতেন। তিনি স্বভাবগতভাবেই নরম প্রকৃতির ছিলেন। আর মাতা ছিলেন অত্যন্ত কর্কশ ও রূঢ় স্বভাবের। বিবাহের মাধ্যমে শ্বশুরালয়ের অনেক সম্পদের অধিকারী হওয়ায় তাঁর পিতার পরিবার দলনজাত এলাকার সম্পদশালী পরিবার বলেই পরিচিত ছিল।

তাওফীক আল্-হাকীমের শৈশবের দিনগুলো দলনজাত এলাকার কৃষি পরিবারের বালক-বালিকাদের সাথেই কাটে। বয়স বাড়ার সাথে সাথে মাতা তাঁর চলাফেরা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করেন। গ্রামীণ পরিবেশের ছেলে-মেয়েদের সাথে ওঠা-বসার সকল পথ বন্ধ করে দেন। বাল্যকালের কঠোর নিয়ন্ত্রণ তাঁর মানসিক বিকাশকে চরমভাবে বাধাগ্রস্ত করে। এ কারণেই হয়তো পরিণত বয়সেও তিনি নারীদের প্রতি বীতশ্রদ্ধে ছিলেন।

প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা : ১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দে সাত বছর বয়সে পিতা তাঁকে দামানহুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করে দেন। এ সময় তিনি স্কুলের নির্ধারিত নিয়ম-কানুন ও মায়ের কঠোর নিয়ন্ত্রণ থেকে নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টা করেন। কিন্তু সম্ভব না হওয়ায় প্রাথমিক শিক্ষার এখানেই ইতি টানেন। তখন তাঁর বয়স প্রায় বার বছর।

প্রাথমিক শিক্ষা শেষে ১৯১১ খ্রিষ্টাব্দে পিতা তাঁকে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করানোর জন্য কায়রো নগরীতে পাঠান। কায়রোর ‘যয়নাব’ আবাসিক এলাকায় তাঁর দুই চাচা ও এক ফুফু থাকতেন। এক চাচা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চাকরি এবং অন্যজন কারিগরী বিদ্যালয়ে লেখাপড়া করতেন। পিতা ভাবলেন চাচা ও ফুফুর তত্ত্বাবধানে থাকলে তারা তাঁর পড়াশুনার ক্ষেত্রে সহযোগিতা করতে পারবে। উপরন্তু মায়ের কঠোর নিয়ন্ত্রণ থেকে দূরে থাকাটা স্বাধীনভাবে তাঁর মানসিক বিকাশে সহায়ক হবে। নানাবিদ আশা নিয়েই তাওফীক আল্-হাকীম কায়রোর এক মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। কিন্তু বিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচির চেয়ে সঙ্গীত, উপন্যাস, নাটক ইত্যাদি বিষয়ের প্রতিই তিনি বেশী ঝুঁকে পড়েন। বাড়িতে মায়ের তত্ত্বাবধানে থাকাকালে যেগুলো পাঠ করা একেবারেই নিষিদ্ধ ছিল। এক পর্যায়ে তিনি বিভিন্ন নাট্যগোষ্ঠীর সাথে মঞ্চ নাটক ও অভিনয়ে জড়িয়ে পড়েন। প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়ার পাশাপাশি অভিনয় ও নাট্য জগতে বিচরণের মধ্য দিয়েই তাঁর মাধ্যমিক শিক্ষার সমাপ্তি ঘটে।


আইন বিষয়ে শিক্ষা লাভ : মাধ্যমিক শিক্ষা শেষে তাওফীক আল্-হাকীম আইন বিষয়ে অধ্যয়নের জন্য ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দে কায়রোর আইন কলেজে ভর্তি হন। আইন বিষয়ে অধ্যয়নের পাশাপাশি তিনি নাট্যচর্চা ও চলচ্চিত্র জগতে অভিনয়ের ধারাকেও অব্যাহত রাখেন। কিন্তু পাঠ্যবিষয়ের প্রতি ততটা মনোযোগী না হতে পারায় পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ থেকে বিরত থাকেন। পাশ্চাত্য নাট্য সাহিত্য ও আইন বিষয়ে অধিক দক্ষতা অর্জনের জন্য এ সময় তিনি ফরাসী ভাষা শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব দেন। এ কারণে যথা সময়ে তিনি আইন কলেজের পাঠ শেষ করতে পারেন নি। বলা হয়ে থাকে, তিনি ছিলেন তার ব্যাচের সর্বশেষ ছাত্র যিনি ১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দের চূড়ান্ত পরীক্ষায় অংশ নিয়ে আইন কলেজের শিক্ষা পর্ব শেষ করেন।

ফ্রান্সে উচ্চ শিক্ষা লাভ: কায়রোর আইন কলেজের শিক্ষা সমাপনান্তে তাওফীক আল্-হাকীম প্যারিস থেকে আইন বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনের আগ্রহ প্রকাশ করেন। পিতা তাঁর এ আগ্রহকে সাধুবাদ জানিয়ে পড়াশুনার জন্য ফ্রান্সে প্রেরণ করেন। মুক্ত চিন্তার লীলাভূমি ফ্রান্সেও তিনি শুধু আইন বিষয়ে অধ্যয়ন করেই ক্ষান্ত হননি, বরং ফরাসী ও পাশ্চাত্য জগতের অন্যান্য ভাষার নাটক-উপন্যাসে ও বিনোদন সাহিত্যে ব্যাপক ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন। পিতার দেওয়া অর্থে প্যারিসে তিনি অতি স্বাচ্ছন্দ্যে প্রায় চার বছর সময় অতিবাহিত করেন। আর্থিক স্বচ্ছলতা থাকায় এ সময় তিনি পাশ্চাত্য নাট্যজগত, অভিনয় ও সঙ্গীতাঙ্গন চষে বেড়ানোর সুযোগ পান। সেই সাথে তিনি কালের গর্ভে হারিয়ে যাওয়া প্রাচীন সভ্যতা ও সস্কৃতি জানতে ব্যাপকভাবে ইতিহাস চর্চা করেন। পাশ্চাত্য নাট্য সাহিত্যের সাথে তাঁর এতটাই সম্পর্ক গড়ে ওঠে যে, ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ‘আওদাতুর-রুহ’ (আত্মার প্রত্যাবর্তন) শীর্ষক একটি গল্প ফরাসী ভাষায় রচনা করেন। ১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দে সেটি প্যারিস থেকে প্রকাশিত হয়। তবে স্বদেশের নানা ঘটনা ও উপাত্তকে নিজের ভাষায় অভিনয় ও রসাত্মক ভঙ্গিতে উপস্থাপনের মাধ্যমে ব্যাপক প্রসিদ্ধি লাভ করার বিষয়ে তাঁর প্রবল ইচ্ছাই ছিল। তাই দেখা যায় ১৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দে ‘আওদাতুর-রুহ’ গল্পটি তিনি আরবী ভাষায অনুবাদ করেন। এভাবেই তিনি আইন শিক্ষার পাশাপাশি পাশ্চাত্য নাট্য-সাহিত্য ও সংস্কৃতির বিভিন্ন বিষয়ে ব্যাপক যোগ্যতা অর্জনের পর ১৯২৮ খ্রিষ্টাব্দে মিসর প্রত্যাবর্তন করেন।

কর্ম-জীবন : উচ্চশিক্ষা শেষ করে ১৯২৮ খ্রিষ্টাব্দে দেশে ফিরে তিনি সরকারি বিদ্যুৎ বোর্ডের ভারপ্রাপ্ত অফিসার হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। তখন তাঁর বয়স ত্রিশ বছর। ১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দে তাঁকে সরকারি বিদ্যুৎ বিভাগের লিগ্যাল এডভাইজার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। ১৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দে ‘শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ’ বিভাগের পরিচালক হিসেবে তাঁকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে বদলি করা হয়। ১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে বদলি হয়ে সমাজ সংস্কার উপদেষ্টা পরিষদের কার্যনির্বাহী অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী প্রশাসনযন্ত্রের লাগামহীন স্বেচ্ছাচারিতা ও তাদের অনুগামী সরকারি কর্মকর্তাদের নানাবিধ দুর্নীতির সাথে নিজেকে খাপ খাওয়ানো স্বাধীনচেতা তাওফীক আল্-হাকীম এর পক্ষে সম্ভব হয়নি। তাই তিনি ১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দে সরকারি চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে জাতীয় সংকট মুহূর্তে দেশবাসীর পাশে দাঁড়ান। ব্রিটিশ শাসনের যাঁতাকলে নিষ্পেষিত মিসরবাসীর সাথে স্বদেশ মুক্তি আন্দোলনে সক্রিয় অংশ গ্রহণ করেন।

১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দে সরকারি চাকরি থেকে অব্যাহতি নেওয়ার পর তিনি স্বাধীনভাবে তাঁর সাহিত্যিক কর্মকাণ্ডে আত্মনিয়োগ করেন। এ সময় তাঁর সম্পাদনায় ‘আখবার আল্-ইয়াওম’ শীর্ষক একটি দৈনিক পত্রিকা প্রকাশ করেন। যাতে স্বরচিত ছোটগল্প, নাটক ও তথ্যসমৃদ্ধ প্রবন্ধসমূহ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ছাপানো হতো। ১৯৪৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ‘দার আল্-কুতুব আল্-মিসরিয়্যাহ’ এর প্রধান নির্বাহী এবং সেই সাথে ‘আরবী ভাষা সংঘের’ অন্যতম সদস্য মনোনীত হন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে সিরিয়া, ইরাক ও ফিলিস্তিন ব্রিটিশ শাসন থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। মিসরও স্বাধীনতা লাভের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। ব্রিটিশ বেনিয়াদের সাথে নানা আলোচনা পর্যালোচনা ও দীর্ঘ সংগ্রামের পর ১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দে মিসর স্বাধীনতা লাভ করে। যাদের সক্রিয় অংশগ্রহণে মিসরের স্বাধীনতার সূর্য উদিত হয় তাওফীক আল্-হাকীম ছিলেন তাদের অন্যতম। জাতি তাঁর এ অবদানকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে স্বীকৃতি স্বরূপ তাঁকে ১৯৫১ খ্রিষ্টাব্দে জাতীয় সাহিত্য ও বার্তা বিষয়ক উচ্চ-ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটির স্থায়ী সদস্য নির্বাচিত করা হয়।

এ ছাড়া মিসরের বহুল প্রচারিত দৈনিক ‘আল্-আহরাম’ পত্রিকার সম্পাদনা বোর্ডের কার্যনির্বাহী সদস্য মনোনীত হন। ১৯৫১ খ্রিষ্টাব্দে প্যারিসে অনুষ্ঠিত ইউনেস্কো সম্মেলনে মিসরের স্থায়ী প্রতিনিধি হিসেবে অংশ নেন। সমকালীন সাহিত্যানুরাগীদের সাহিত্যিক অবদানের জন্য রাষ্ট্রীয় পুরস্কার প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়। তাওফীক আল্-হাকীম আরবী সাহিত্য তথা নাট্য জগতে অসাধারণ অবদানের জন্য ১৯৬০ খ্রিষ্টাব্দে জাতীয় পুরস্কার লাভ করেন। সরকারি চাকরি ও সকল প্রকার ঝামেলামুক্ত হয়ে জীবনের শেষ দিকে তিনি আরও বেশী জাতীয় সমস্যা সমাধানে তাঁর সাহিত্যিক মনোবৃত্তিকে কাজে লাগান। সাহিত্যের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলেন সমাজের তন্ত্রে-তন্ত্রে প্রবাহিত সরকারি কর্মকর্তা থেকে শুরু করে বিদেশী বেনিয়াদের অপকর্ম ও অত্যাচারের নির্মমচিত্র। উদ্বুদ্ধ করেন সাধারণ জনতাকে তাদের ন্যায্য অধিকার আদায়ে সোচ্চার হওয়ার জন্যে। স্বদেশ ও স্বজাতির সেবায় তাঁর অসাধারণ মেধা-মনন ও প্রতিভাকে উৎসর্গ করে নব্বই বছর বয়সে আরবী সাহিত্যের এ উজ্জ্বল নক্ষত্রের জীবনাবসান ঘটে। ১৯৮৭ খ্রিষ্টাব্দে ২৬ জুলাই তিনির মৃত্যুবরণ করেন।

রাজনৈতিক অঙ্গনে তাওফীক আল্-হাকীম: তাওফীক আল্-হাকীম কায়রোয় মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে অধ্যায়ন কালেই মিসরে সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সূত্রপাত হয়। আন্দোলনে নেতৃত্বদেন তৎকালীন আরব জাতীয়তাবাদী চেতনার মুখ্য সংগঠক সা’দ জগলুল পাশা। তাওফীক আল্-হাকীমও তাতে সক্রিয় অংশ নেন। তখন তার বয়স প্রায় ২১ বছর। আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী অন্যান্যের সাথে তাঁকেও ১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দে গ্রেফতার করে জেলে দেওয়া হয়। এক বছর কারাভোগের পর ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি আবার তাঁর বিদ্যালয়ে ফিরে আসেন এবং মাধ্যমিক পাঠ সমাপ্ত করেন।

সাহিত্যাঙ্গনে তাওফীক আল্-হাকীম : সাহিত্যের ইতিহাসে কোনো কবি-সাহিত্যিকের কর্মজীবন ও সাহিত্যিক জীবনকে আলাদা আলাদা তুলে ধরা সম্ভব হয়নি বরং অসম্ভবই বটে। কেননা যিনি কবি বা সাহিত্যিক তার জীবনের প্রতিটি স্তরেই সাহিত্যের সংশ্লিষ্টতা অনিবার্য। কর্মজীবন থেকে সাহিত্যিক জীবনকে আলাদা করার কোনো অবকাশ নেই। তাওফীক আল্-হাকীমের জীবনেও এর কোনো ব্যত্যয় ঘটে নি। শিক্ষাকাল থেকে শুরু করে মৃত্যু পর্যন্ত সাহিত্য সাধনাই ছিল তাঁর জীবনের একমাত্র ব্রত। তাই বলে তিনি কর্মকে জীবন থেকে দূরে ঠেলে দেন নি। বরং কর্মব্যস্ততার মধ্যেই বিকাশ ঘটেছে তাঁর সাহিত্য প্রতিভার। দীর্ঘ দিন দেশের বাইরে থাকলেও স্বদেশ ও কৃষি সমাজভুক্ত পিতৃপরিবারের কথা তিনি মুহূর্তের জন্যও ভুলেন নি। তিনি গ্রামীণ কৃষি পরিবারসমূহের অনুন্নত জীবনধারা, তাদের কৃষ্টি-কালচার, কথা-বার্তা, সরল ধর্ম বিশ্বাস, কৃষকদের প্রতি সরকারি কর্মকর্তাদের অহেতুক নানা শর্তারোপ ও হয়রানি এবং ধনী ভূ-স্বামী জমিদারদের সীমাহীন বাড়াবাড়ি সম্পর্কে সম্যক অবগত ছিলেন। এমনিতর জীবন ও জগৎ সংসারে ঘটে যাওয়া অনুকূল ও প্রতিকূল নানা বিষয়কে অবলম্বন করেই রচিত হয়েছে তাঁর সাহিত্যকর্ম। তিনি সমাজের নানা বিষয়কে রসালো ভঙ্গিতে উপস্থাপনের মাধ্যমে তন্দ্রাগ্রস্ত জনতার অনুভূতিকে নাড়া দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। রসাত্মক হলেও সেগুলোর কোনোটিই সূক্ষ্ম-শিক্ষা বর্জিত নয়। তাওফীক আল্-হাকীম আরবী নাট্য সাহিত্যের কিংবদন্তী হিসেবে পরিচিত হলেও সাহিত্যের অন্যান্য বিষয়েও তাঁর অবদানকে একেবারে খাটো করে দেখার অবকাশ নেই। নাটক-উপন্যাস-প্রবন্ধ-গল্পগুচ্ছ প্রভৃতিতে ছিল তাঁর সমান বিচরণ। নিম্নে তাঁর সাহিত্যকর্মের কিছু নিদর্শন উদ্ধৃত হলো :

আরবী নাট্যসাহিত্য :

১. মুহাম্মদ [সংলাপে মুহাম্মদ (স.)-এর জীবন চরিত] গ্রন্থটি ১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয়।

২. আহলুল কাহাফ (তাওরাত ও কুরআনে বর্ণিত ঘটনা) প্রকাশ সাল- ১৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দ।

৩. কিংবদন্তীর রাণী (শাহরা-যাদ), প্রকাশ সাল- ১৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দ।

৪. রাজা-ইডিপাস (মালিক উদায়ব), প্রকাশ সাল- ১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দ।

৫. মাসরাহ আল্-মুজ্তামা‘ (২১টি সামাজিক নাটিকা), প্রকাশ সাল- ১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দ।

৬. পুণ্যময় হস্তযুগল (আল্-আয়দী আল্-না‘ঈমা), প্রকাশ সাল- ১৯৫৯ খ্রিষ্টাব্দ।

৭. এয়জীস, প্রকাশ সাল -১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দ।

৮. করতালি (আল্-সাফকাহ), প্রকাশ সাল- ১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দ।

৯. আল্-মাসরাহ আল্-মানু‘উ (২১টি নাটিকা), প্রকাশ সাল- ১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দ।

১০. মৃত্যুর খেলা (লু‘বাতুল মাওত), প্রকাশ সাল- ১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দ।

১১. শান্তির কাঁটা (আশওয়াকুস-সালাম), প্রকাশ সাল- ১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দ।

১২. আগামীর পথে যাত্রা (রিহলাতু ইলাল-গাদ), প্রকাশ সাল -১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দ।

১৩. দিশেহারা সম্রাট (আল্-সুলতান আল্-হায়ির), প্রকাশ সাল- ১৯৬০ খ্রিষ্টাব্দ।

১৪. হে বৃক্ষারোহী (ইয়া তালি‘আশ-শাজারাহ), প্রকাশ সাল- ১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দ।

১৫. সকল মুখে খাদ্য (আত্তা‘আম লি-কুল্লি ফাম), প্রকাশ সাল- ১৯৬৩ খ্রিষ্টাব্দ।

১৬. দিবাকর (শামসুন্নাহার), প্রকাশ সাল -১৯৬৫ খ্রিষ্টাব্দ।

১৭. র্সাসারার পরিণতি (মাসির সারসারা), প্রকাশ সাল- ১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দ।

১৮. জটিল সমস্যা (আল্-ওয়ারতাত), প্রকাশ সাল- ১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দ।

১৯. দুঃশ্চিন্তার ডিপো (বাঙ্ক আল্-কাল্ক), প্রকাশ সাল- ১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দ।

২০ ইনসাফের বৈঠক (মাজলিস আল্-‘আদল), প্রকাশ সাল- ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দ।

২১. তারার সাথে দুটি কথা (হাদীস মা‘আল কাওকাব), প্রকাশ সাল- ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দ।

২২. পৃথিবী এক মুগ্ধকর উপন্যাস (আল্-দুনিয়া রিওয়াতুন হাযীলাহ), প্রকাশ সাল- ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দ।

২৩. রক্তিমাভ (আল্-হুমায়র), প্রকাশ সাল- ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দ।

আরবী ছোটগল্প-উপন্যাস-গল্পগুচ্ছ-প্রবন্ধ প্রভৃতি :

১. বাসর রাত (লায়লাত আল্-যিফাফ), প্রকাশ সাল- ১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দ।

২. আত্মার প্রত্যাবর্তন (আওদাতুর-রুহ), প্রকাশ সাল- ১৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দ।

৩. গ্রামে নায়েবের দিনপুঞ্জি (ইয়াওমিয়্যাত নায়েব ফী আল্-আরইয়াফ), প্রকাশ সাল-১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দ।

৪. প্রাচ্যের চড়–ই (‘উসফুর মিনাশ-শারক), প্রকাশ সাল- ১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দ।

৫. স্বচ্ছ চিন্তার ছায়াতলে (তাহতা শামস আল্-ফিকর), প্রকাশ সাল-১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দ।

৬. গিরিপথ (আশ‘আব), প্রকাশ সাল- ১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দ।

৭. শয়তানের অঙ্গীকার (‘আহদুশ-শায়তান), প্রকাশ সাল- ১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দ।

৮. আমার গাধা আমাকে বলেছে (হিমারী ক্বালা লি), প্রকাশ সাল- ১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দ।

৯. নর্তকী (রাক্বিসাতুল-মা‘দ), প্রকাশ সাল-১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দ।

১০. সঙ্গীত (নাশীদুল আনশাদ), প্রকাশ সাল-১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দ।

১১. বিচারকের গাধা (হিমারুলে হাকীম), প্রকাশ সাল- ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দ।

১২. অত্যাচারী শাসক (সুলতানুজ-জুল্লাম), প্রকাশ সাল- ১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দ।

১৩. মিন আল-বুরজ আল্-‘আযী, প্রকাশ সাল-১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দ।

১৪. সোডিয়াম বাতির নীচে (তাহতা আল্-মিসবাহ আল্-আখদার), প্রকাশ সাল- ১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দ।

১৫. জীবনের পুষ্প (যাহরাত আল্-‘উমর) পত্রাবলী, প্রকাশ সাল-১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দ।

১৬.পবিত্র সম্পর্ক (আল্-রিবাত আল্-মুকাদ্দাস), প্রকাশ সাল-১৯৪৪ খ্রিষ্টাব্দ।

১৭. শাসনতন্ত্রের চারাগাছ (শাজরাত আল্-হুকম), প্রকাশ সাল-১৯৪৫ খ্রিষ্টাব্দ।

১৮. সাহিত্যের শিল্প (ফান্ন আল্-আদাব), প্রকাশ সাল- ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দ।

১৯. ন্যায়-পরায়নতা ও শিল্প (‘আদালাত ওয়া ফান্ন), প্রকাশ সাল- ১৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দ।

২০. আল্লাহ আমাকে দেখিয়েছে (আরানী আল্লাহ), প্রকাশ সাল- ১৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দ।

২১. বিচারকের ডাণ্ডা (‘আসা আল্-হাকীম), প্রকাশ সাল- ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দ।

২২. রাজনৈতিক ভাবনা (তাআ মূলাত ফী আল্-সিয়াসাত), প্রকাশ সাল-১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দ।

২৩. নিরপেক্ষতা (আল-তা‘আদিলিয়্যাত), প্রকাশ সাল- ১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দ।

২৪. শরৎ ও বসন্তের প্রস্থান (রিহলাত আল্-রবী‘ ওয়া আল্-খারীফ), প্রকাশ সাল-১৯৬৪ খ্রিষ্টাব্দ।

২৫. জীবনের বন্দীশালা (সিজনু আল্-‘উমর), প্রকাশ সাল-১৯৬৪ খ্রিষ্টাব্দ।

২৬. সেকাল-একাল (রিহলাত বায়না ‘আসরায়ন), প্রকাশ সাল-১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দ।

২৭. হারানো স্মৃতি (‘আওদাত আল্-ও‘আ), প্রকাশ সাল-১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দ।

২৮. যুব বিদ্রোহ (ছাওরাত আল্-শাবাব), প্রকাশ সাল-১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দ।

২৯. জীবনের শিষ্টাচার (আদাব আল্-হায়াত), প্রকাশ সাল-১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দ।

৩০. মুখতার তাফসীর আল্-কুরতুবী, প্রকাশ সাল-১৯৭৭ খ্রিষ্টাব্দ।

৩১. ২০০০ সালের চ্যালেঞ্জ (তাহাদিয়াত ২০০০), প্রকাশ সাল-১৯৮০ খ্রিষ্টাব্দ।

৩২. মিসরের সেকাল-একাল (মিসর বায়না ‘আহদায়ন), প্রকাশ সাল-১৯৮৩ খ্রিষ্টাব্দ।

৩৩. রাজনৈতিক শাসনতন্ত্রের বটবৃক্ষ (শাজরাত আল্-হুকম আল্-সিয়াসী), প্রকাশ সাল- ১৯৮৫ খ্রিষ্টাব্দ।

৩৪. কয়েকটি হাদীস (আল্-আহাদীস আল্-আরবা‘আহ), প্রকাশ সাল-১৯৮৩ খ্রিষ্টাব্দ।

৩৫. ইসলামের ন্যায়পরায়নতা ও নিরপেক্ষতা (আল্-তা‘আদিলিয়্যাত মা‘আ আল্- ইসলাম ও আল্-তা‘আদিলিয়্যাত), প্রকাশ সাল- ১৯৮৩ খ্রিষ্টাব্দ।

৩৬. একান্ত সাক্ষাৎকার (মূলামিহ দাখিলিয়্যাহ), প্রকাশ সাল-১৯৮২ খ্রিষ্টাব্দ। ইত্যাদি।

সব মিলিয়ে তাঁর রচিত গ্রন্থের সংখ্যা প্রায় ১০৪ টি। অধিকাংশ গ্রন্থই ফরাসী, ইংরেজীসহ বিশ্বের অনেক ভাষায় অনুদিত হয়েছে। এ ছাড়াও তাঁর অসংখ্য কবিতা, নাটিকা, প্রবন্ধ, গল্প, বক্তৃতাসহ প্রভৃতি সাহিত্য কর্ম রয়েছে।

পরিশেষে বলা যায় তাওফীক আল্-হাকীম আরবী সাহিত্যাঙ্গনে সত্যিকার অর্থে একজন অমর ব্যক্তিত্ব। তাঁর সাহিত্যকর্ম যুগ যুগ ধরে আরবী সাহিত্যানুরাগীদের প্রেরণার উৎস হিসেবে কাজ করবে।

পাঠকের মতামত:

SMS Alert

সাহিত্য এর সর্বশেষ খবর

সাহিত্য - এর সব খবর