চরমপন্থা ও সন্ত্রাসবাদ : ইসলামী দৃষ্টিকোণ-৩
এস কে জামান
(পূর্ব প্রকাশের পর ) সপ্তম শতকের খারিজীদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে সালাফিস্টদের অভিযাত্রা শুরু হয় ১৯৮৮-১৯৯৯ সালে । খারিজীদের চিন্তাধারার তাত্ত্বিক দর্শনের সাথে সালাফিস্টদের দৃষ্টিভঙ্গির যথেষ্ট মিল পাওয়া যায় । এদের লক্ষ্য হলো আল্লাহর শাসন প্রতিষ্ঠা, মানব সৃষ্ট সকল সংবিধান অমান্যকরণ এবং কল্পিত খেলাফাত পুনঃপ্রতিষ্ঠা । শরিয়া আইন পরিপালন করে ইসলামী রাষ্ট্রগুলোতে প্রচলিত শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন এবং তথাকথিত অবিশ্বাসীদের রাষ্ট্রে আঘাত সাধন এদের সুপ্ত লক্ষ্য । পরবর্তী কালে এসে প্যান-ইলামিস্টদের বিস্তার ঘটে মিশর, ইয়েমেন, লিবিয়া, ইরাক, সিরিয়া, ও তুরুস্কে । মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে বাথ পার্টি ও নাসেরী চিন্তার বিকাশ ঘটে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ।
সাম্প্রতিক আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হলো আই এস (ইসলামিক স্টেট) এর উত্থান ও পরবর্তী উগ্র সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ড বিশ্ব রাজনীতির চালকদের গভীরভাবে ভাবিয়ে তুলেছে । আদর্শিক দিক থেকে সালাফিস্ট, খারিজাইট, তাকফির ও আই এস কাছাকাছি । আই এসের মূল উদ্দেশ্য হলো অভ্যন্তরীণ ও বহিঃশত্রুদের বিরুদ্ধে জিহাদের মাধ্যমে ইসলামী খিলাফত রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা করা । অন্যদিকে পদ্ধতিগত দিক থেকে আই এসের উদ্দেশ্য হলো সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে বর্তমান উদারনৈতিক সামজব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করে শরিয়াহ আইনভিত্তিক সমাজ ও রাজনৈতিক মূল্যবোধ তৈরি করা ।
আই এস ২০০৪ সালে সন্ত্রাসবাদী জঙ্গি সংগঠন আল-কায়দার অন্যতম শাখা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হলেও ২০১৪ সালের শুরুতে একটি স্বতন্ত্র সংগঠন হিসাবে আত্মপ্রকাশ সত্যিই আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা ব্যবস্থায় বেড়ে ওঠা নতুন চ্যালেঞ্জ । কোনো কোনো নিরাপত্তা বিশ্লেষক মনে করেন ৯/১১ এবং আরববসন্ত পরবর্তী অস্থিতিশীল মধ্যপ্রাচ্যে আই এসের উত্থান ও বিকাশ বিশ্বব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণকারী রাষ্ট্রগুলোর রাজনৈতিক স্বার্থকে সমুন্নত রাখতে এ সমস্ত সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলোর সাথে গোপনে আঁতাত করে আসছে । কিছু পশ্চিমা বিরোধী রাজনৈতিক বিশ্লেষকের ধারণা বর্তমান বিশ্ব ব্যবস্থার ত্রাণকর্তারাই মধ্যপ্রাচ্যের তেল সম্পদের উপর নিয়ন্ত্রণ এবং রমরমা অস্ত্র ব্যবসাকে জিইয়ে রাখতে আই এসের ভিতর থেকেই সকল কর্মকাণ্ডের কলকাঠি নাড়ছে ।
ইসলাম: চরমপন্থা ও সন্ত্রাসবাদ
পৃথিবীর সূচনালগ্ন থেকে আজ পর্যন্ত বিশ্ব সভ্যতা-সংস্কৃতি পর্যালোচনা করলে আমাদের সামনে এটি সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, একটি মাত্র আদর্শ স্বীয় প্রজ্ঞা ও সৌন্দর্য প্রদর্শন করে যে কোন সমস্যা মোকাবেলায় পুরোপুরি সাফলতা অর্জন করেছে । আর এ সাফল্য ধরা দেয় অতি অল্প সময়ে, এক জীবদ্দশায়ই । সাফল্যমণ্ডিত কার্যকর এ কালজয়ী জীবনাদর্শের নাম হলো “ইসলাম”- যা শান্তি শৃংখলা, পারস্পরিক সম্প্রীতি ও সহানুভূতির মাধ্যমে জাতি-ধর্ম- বর্ণ–গোত্র নির্বিশেষে সব মানুষের প্রতি ভালোবাসা, দয়া, সহনশীলতা ও সহিষ্ণুতার শিক্ষা দেয় যা বিশ্ব পরিমণ্ডলে সর্বজনীন।
এ ধর্মের শ্বাশত বাণী এসেছে গোটা বিশ্ব জাহানের প্রতিপালক মহান আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে; মানবতার মহান মুক্তির দিশারী সভ্যতার বাহক হযরত মুহাম্মাদ (সা.) এর মাধ্যমে । প্রায় ১৪০০ বছর আগে গোটা বিশ্বজাহান যখন পাপ পঙ্কিলতায় সয়লাব হয়ে গিয়েছিলো । আইয়ামে জাহেলিয়াতের সেই যুগে অজ্ঞতা, বর্বরতা, মারামরি, হানাহানি ও কন্যাসন্তান জীবন্ত মাটি চাপা দিয়ে সমাজ জীবনে নেমে আসে এক ঘোর অমানিশার অন্ধকার । মানবতা যখন ডুকরে ডুকরে কেঁদে ফিরছিলো ঠিক তখনই তিনি বিশ্ব শান্তির অগ্রদূত মানবতার মহান মুক্তির দিশারী হয়ে এই ধরাধমে আবির্ভূত হন । মানুষের সাথে মানুষের ভ্রাতৃত্বের বন্ধন, দয়ামায়া ও ভালবাসা বিনির্মাণের এক অনুপম আদর্শ স্থাপন করেন । নবুয়াত প্রাপ্তির পরে তো বটেই আগেও তিনি চরমপন্থা ও সন্ত্রাসমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠায় সর্বতোভাবে প্রচেষ্টা চালিয়েছেন ।
তাই আমরা দেখতে পাই মাত্র ২০ বছর বয়সে তিনি ' হিলফুল ফুজুল' সংগঠন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদ নির্মূলের ব্যবস্থা নিয়েছিলেন । যে সময়ে মদ, নারী ও যুদ্ধ ছিল মানবজীবনের সবচেয়ে আকাঙ্ক্ষার বস্তু । এমনই এক দুঃসময়ে সমাজ ও রাষ্ট্র বিধ্বংসী সন্ত্রাসবাদের মূলোৎপাটন করে শান্তিপূর্ণ সন্ত্রাসবিহীন সুশৃঙ্খল আদর্শ কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন । হিজরোত্তর মদিনায় স্থায়ীভাবে শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষা এবং চরমপন্থী ও সন্ত্রাসবাদ সকল ধর্মাবলম্বী বিশেষ করে ইহুদীদের সাথে এক ঐতিহাসিক শান্তি চুক্তি সম্পাদন করেন ।
আগের দুটি পর্ব :
চরমপন্থা ও সন্ত্রাসবাদ : ইসলামী দৃষ্টিকোণ-১
চরমপন্থা ও সন্ত্রাসবাদ : ইসলামী দৃষ্টিকোণ-২
মদিনা সনদের ১৩ নং ধারায় বলা হয়েছে -“তাকওয়া অবলম্বনকারী ধর্মপ্রাণ বিশ্বাসীদের হাত সমবেতভাবে ওইসব ব্যক্তির হাতে উত্থিত হবে, যারা বিদ্রোহী হবে অথবা বিশ্বাসীদের মধ্যে অন্যায়, পাপাচার সীমালঙ্ঘন, বিদ্বেষ অথবা দুর্নীতি ও ফ্যাসাদ ছড়িয়ে দিতে তৎপর হবে । তারা সবাই সমেবেতভাবে তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে, যদিও সে তদেরই কারো আপন পুত্রও হয়ে থাকে” ।
ইসলাম ও সন্ত্রাস শব্দ দুটি ভাবার্থের দিক দিয়ে এবং কার্যত পরস্পর সাংঘর্ষিক । সন্ত্রাসের স্থান ইসলামে নেই আছে কল্যাণমুখী সমাজ বিনির্মাণের আত্মপ্রত্যয় । মহান আল্লাহ বলেন-“তোমরা দুনিয়ার শ্রেষ্ঠজাতি । মানবতার কল্যাণের জন্য তোমাদের সৃষ্টি করা হয়েছে । তোমরা সৎকাজের আদেশ দিবে ও অসৎকাজ থেকে মানুষকে বিরত রাখবে” । (সুরা আল ইমরানঃ ১১০)
হত্যা, সন্ত্রাস, জিঘাংসা, নির্যাতন নয়, পারস্পরিক সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি, সহানুভূতি, সহনশীলতা জীবনের নিরাপত্তা দানের শিক্ষাই দেয় ইসলাম । যেকোনো হত্যাকাণ্ড মানবজাতিকে হত্যার শামিল । হত্যাকারীর স্থান যে শুধুই জাহান্নাম হবে তা কুরআনে বলা হয়েছে - 'কেউ ইচ্ছাকৃত ভাবে কোন মুমিনকে হত্যা করলে তার শাস্তি হবে জাহান্নাম । সেখানে সে স্থায়ী হবে।' (সুরা নিসা- ৯৩)
ইসলাম তার অনুসারীদের সর্বত্র শান্তি প্রতিষ্ঠার নির্দেশ দিয়েছে । কোন অবস্থাতেই চরমপন্থী ও সন্ত্রাসী হয়ে অশান্তি সৃষ্টি করতে কঠিন ভাবে বারণ করে কুরআন বলেছে - দুনিয়ায় শান্তি স্থাপনের পর তাতে বিপর্যয় সৃষ্টি করো না । (সুরা আরাফ – ৫৬ )
বর্তমান সময়ের ইসলামের নামে যে মারাত্মক ব্যাধি চরমপন্থা ও সন্ত্রাসবাদ সৃষ্টির গভীর ষড়যন্ত্র চলছে তাতে গুটি কয়েক উগ্রবাদী নামধারী মুসলামান জড়িত । যারা ইসলামের সুমহান আদর্শকে মনে প্রাণে লালন না করে বরং একে কুলশিত করার হীন প্রচেস্টায় লিপ্ত । বিশ্বের সকল বরেন্য ইসলামী চিন্তাবিদ এ ব্যপারে একমত হয়েছেন যে, এ ধরণের ব্যক্তি ও তাদের সংগঠন বিভ্রান্ত ও বিপথগামী । এরা ইসলামের শত্রুদের হাতের পুতুলে পরিণত হয়েছে । বিশ্বব্যাপী ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নেওয়ার যে জাগরণ উঠেছে তাতে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসী শক্তি কিছু অজ্ঞ ও বিক্ষুদ্ধ তরুনদের কৌশলে দলে ভিড়িয়ে ইসলাম কায়েমের নামে সন্ত্রাসী কর্মে লিপ্ত হওয়ার জন্য অনুপ্রাণিত ও প্রশিক্ষিত করছে ।
বর্তমানে স্যাটেলাইট প্রযুক্তির যুগে ইসলামের বিভিন্ন বিষয়কে ভিন্নভাবে অতি ধূর্ততার সাথে বিশ্ববাসীর সামনে উপস্থাপন করা হচ্ছে, যেমন ইসলামের জিহাদকে বিকৃত করে একে সন্ত্রাসের সমার্থক হিসাবে অপব্যাখার নিমিত্তে বহু চক্রান্তমূলক কথিত ইসলামিক ওয়েব সাইট চালু করা হয়েছে । এতে করে সাধারণ মুসলিম ঘরের তরুণরা ভ্রান্তিবশত মনে করছে এগুলো ইসলাম কে জানার আধুনিক মাধ্যম মাত্র । যা কিনা আমাদেরকে ইসলামের সুমহান দিকগুলো তুলে ধরছে । অথচ এর মাধ্যমে তারা উগ্র মতবাদ গ্রহণ করে সন্ত্রাসবাদের দিকে ধাবিত হছে । সাথে সাথে ইহুদীবাদী ও সম্রাজ্যবাদীদের ইসলাম ও মুসলমানদের অগ্রগতি রোধ করার হীন মনোবাঞ্চনা হাসিলের পথ সুগম হচ্ছে ।
চরমপন্থী ও সন্ত্রাসী সবার কাছে সব সময় ঘৃণিত । মহান আল্লাহ এদের ঘৃণার চোখে দেখে তাদের উপর লানত করেছেন । পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে - “যারা পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টি করে বেড়ায় তদের জন্য রয়েছে লানত এবং মন্দ আবাস” । (সুরা রাদ – ২৫ ) কুরআনে চরমপন্থা ও সন্ত্রাসবাদের ভয়াবহতা তুলে ধরা হয়েছে এভাবে - “ফিতনা (অর্থ প্রলোভন, দাঙ্গা, বিশৃঙ্খলা, যুদ্ধ, শিরক, ধর্মীয় নির্যাতন ইত্যাদি) হত্যার অপরাধ গুরুতর” । (সুরা বাকারা – ১৯১ )
(চলবে)
লেখক: প্রাবন্ধিক ও ব্যাংকার
(দ্য রিপোর্ট/একেএমএম/এপ্রিল ১৪,২০১৯)