হাসান কবীর

হারানো পা, মূল্য ৫০ লাখ । উসুল ৫ লাখ। অনাদায়ী ৪৫ লাখ। তবে বিজ্ঞ আদালতের যা তৎপরতা তাতে বাকি ৪৫ লাখ উসুল হতে বেশিদিন অপেক্ষা করতে হবে না। ধন্যবাদ বিজ্ঞ আদালত।

ঘটনাটা মনে করিয়ে দেই। রাসেল সরকার, একটি প্রতিষ্ঠানের ভাড়া গাড়ি চালাতেন। ২৮ এপ্রিল ২০১৮ কেরানীগঞ্জ থেকে ঢাকায় ফেরার পথে যাত্রাবাড়ীর হানিফ উড়ালসড়কে গ্রীনলাইন পরিবহনের বাসের চাপায় পা হারান।ঘটনা ছিল অতি সাধারণ।যাত্রাবাড়ীতে গ্রীনলাইন পরিবহনের একটি বাস তার গাড়িকে ধাক্কা দেয়। পরে রাসেল সরকার গাড়ি থামিয়ে বাসের সামনে গিয়ে বাসচালককে নামতে বলেন।

তখন তার সঙ্গে বাসচালকের কথা কাটাকাটি হয়। একপর্যায়ে বাসচালক গাড়ি চালাতে শুরু করেন। তখন রাসেল সরতে গেলে উড়ালসড়কের রেলিংয়ে আটকে যান। এ সময় রাসেলের পায়ের ওপর দিয়ে বাস চলে যায়।পরে অস্ত্রোপচার করে তার বাঁ পা কেটে ফেলা হয়।

৫ এপ্রিল,২০১৯। শুক্রবার, দুপুর ১টা। যশোর-খুলনা মহাসড়কে নওয়াপাড়া হাইওয়ে থানার সামনে অভয়নগর ট্রান্সপোর্ট এজেন্সির একটি ট্রাক অবস্থান করছিল। এ সময় বেনাপোলগামী যাত্রীবাহী ফেম নামে একটি বাস আটকা পড়ে। বাসের সুপারভাইজার আকাশ মাতবর রাস্তায় নেমে ট্রাকটিকে সরাতে বলেন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে ওই ট্রাকের চালক, হেলপারসহ এজেন্সির ৪/৫জন শ্রমিক আকাশ মাতবরকে এলোপাথাড়ি কিল-ঘুষি মারতে থাকেন। এতেই তারা ক্ষান্ত হননি। এক পর্যায়ে তাকে রাস্তার ওপর ছুঁড়ে ফেললে অপর দিক থেকে আসা একটি তেলবাহী ট্রাকের চাপায় পিষ্ট হয়ে ঘটনাস্থলে মৃত্যু হয় আকাশের।


লেখকের আরো লেখা:

নুসরাতের শেষ ইচ্ছা

সুপেয় পানি ও তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ

স্কুলে শিশুর ও বাড়িতে মায়ের আর্তনাদ

সাত শতাংশ সুদ ও কিছু কথা


উপরের দুটি ঘটনার মধ্যে কিছুটা সাদৃশ্য পাওয়া যায়। দুটি ঘটনায় উৎস একেবারে তুচ্ছ ঘটনা। তর্কবির্তকের এক পর্যায়ে তাদের উপর গাড়ি চালিয়ে দেওয়া হয়। দুটি ঘটনাই ঘটেছে পরিবহন শ্রমিকদের মধ্যে। তবে একজনকে ভাগ্যবান বলতে হবে। তিনি পা হারিয়েছেন বটে, কিন্তু শেষমেশ নিজের জানটা নিয়ে বাড়িতে ফিরতে পেরেছেন।

অপরজন চরম হতভাগা । হাসপাতালে যাওয়ার সুযোগটুকু হয়ে ওঠেনি।রাস্তার ওপরেই তাকে প্রাণটা হারাতে হলো। এক্ষেত্রে যারা তাকে ট্রাক চাপা দিয়েছেন তারা অত্যন্ত সুচতুর দক্ষ। তারা শুধু তাকে ট্রাক চাপাই দেন নি তাদের বিভিন্ন সহযোগীদের সহযোগিতায় সেখান থেকে কোনো রকমের ঝামেলা ছাড়াই বুক ফুলিয়ে সরে পড়তে সক্ষম হয়েছেন।

দুটি ঘটনায় মামলা হয়। প্রথম ঘটনায় মাননীয় হাইকোর্ট একটা রায় প্রদান করেন। এক পায়ের হাটুর নীচের অংশ হারানো রাসেল সরকারকে ৫০ লাখ টাকা ক্ষতি পূরণ প্রদান করতে হবে। মালিক পক্ষ ক্ষতি পূরণ দিতে অস্বীকার করলে গ্রীনলাইন পরিবহন বন্ধ করে দেওয়ার কথাও বলা হয়। এমনকি বলা হয় প্রয়োজন হলে গ্রীনলাইন পরিবহন বিক্রি করে হলেও এ ক্ষতিপূরণ তাকে দিতে হবে। ভিকটিম রাসেল সরকার ইতোমধ্যে কৃত্রিম পা সংযোজনের জন্য ৫ লাখ টাকাও হাতে পেয়েছেন।

বিজ্ঞ আদালত রাসেল সরকারকে কিছুতেই হারানো পা ফিরিয়ে দিতে পারবেন না, কিন্তু গ্রীনলাইন পরিবহন মালিকের কাছথেকে ক্ষতিপূরণ আদায়ের জন্য যে পদক্ষেপ নিয়েছেন তা নিঃসন্দেহে নজিরবিহীন এবং যথেষ্ট প্রশংসার দাবি রাখে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, উপর্যুক্ত ঘটনায় প্রকৃত অপরাধী কে? গ্রীন লাইনের মালিক মোহাম্মদ আলাউদ্দিন? নাকি গ্রীন লাইন পরিবহনের চালক?

দ্বিতীয় ঘটনা আরও স্বেচ্ছাপ্রণোদিত। আকাশ মাতবরকে ইচ্ছাকৃতভাবে ফেলে দিয়ে ট্রাকের চাকায় পিষ্ট করা হয়।একটা জলজ্যান্ত মানুষকে ধাক্কা দিয়ে গাড়ির চাকায় পিষ্ট করে মারা কোন বিবেকবান মানুষের দ্বারা সম্ভব নয়। তবে কি পরিবহন শ্রমিকরা ধীরে ধীরে বিবেকহীন হয়ে পড়ছে ? তাদের মধ্যে মানবিকতা হারিয়ে যাচ্ছে? ঘটনা তুচ্ছ হতে পারে, কিন্তু ক্ষয়ক্ষতি অপূরণীয়।
একটা বিষয় স্পষ্ট যে, পরিবহন শ্রমিক নিজেদের মধ্যে কেমন অসহিষ্ণু, অমানবিক আচরণ করছে। যার কারণে আমাদের এমন নিষ্ঠুর ঘটনার বারবার সাক্ষী হতে হচ্ছে।

আসি পায়েলের ঘটনায়। ২০১৮ সালের ২১ জুলাই, নির্জন রাত । সেরাত হৃদয়বিদারক এক ঘটনার নির্মম সাক্ষী। দুই বন্ধুর সঙ্গে হানিফ পরিবহনের একটি বাসে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকার পথে রওনা হন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সাইদুর রহমান পায়েল।গজারিয়ার ভাটেরচর ব্রিজ এলাকায় যানজটের কবলে পড়ে তার বাস।বাস থেকে নামতে যান পায়েল। তখনই হঠাৎই চলতে শুরু করে বাস।পায়েল মাথায় গুরুতর আঘাত পান।ছিটকে পড়ে জ্ঞান হারান।দ্রুত হাসপাতালে নেওয়ার পরিবর্তে বাসে থাকা ড্রাইভার সুপারভাইজার হেলপার ভাটেরচর ব্রিজের নিচে ফুলদী নদীতে পায়েলকে ছুড়ে ফেলে দেয়।

কী নির্মম! কতোটা বীভৎস এদের চরিত্র!মুমূর্ষু একজন মানুষকে হাসপাতালে নেয়ার পরিবর্তে কতটা পাষাণহৃদয় হলে নদীতে ছুড়ে ফেলা যায়!সাধারণ কোনো মানুষের মাথায় এমন ভাবনা আসার কথা নয়।এটা যদি তাদের সন্তান হতো তবে কি পারতেন এমনটি করতে?
এ ঘটনায় মামলা হয়। মামলাটি এখন দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন। পায়েলের পিতার চাওয়া নির্মম ঘটনার যেন সুষ্ঠু বিচার হয়। কিন্তু পায়েলের মৃত্যুর ক্ষতিপূরণ কী হতে পারে? পায়েলের পরিবার ক্ষতিপূরণ বাবদ কী আশা করতে পারে ? যদি ক্ষতিপূরণ টাকা হিসেবে বিবেচনা করা হয় তবে তার পরিমাণ কত ? বিজ্ঞ আদালত এ বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত দেবেন বলে আশাবাদী।

সড়ক-মহাসড়কে এসব নির্মমতার ঘটনায় অনেকেই পরিবহন শ্রমিকদের অসহিষ্ণু মনোভাব ও নেশাগ্রস্ত অবস্থাকে দায়ী করছেন।

৪ আগস্ট ২০১৮, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ শুধু ঢাকা শহরের মাদকাসক্ত চালক সম্পর্কে বলেন, শতকরা ৩৫ ভাগ চালকই মাদকাসক্ত। সারা দেশের এই চিত্র আরও ভয়াবহ।একবারও কি আমরা ভেবে দেখেছি, সকালে বের হয়ে শতকরা ৩৫ জন মাদকাসক্ত মাতাল চালকের পরিবহনে উঠে গন্তব্যে ছুটে চলেছি? এ সমস্ত চালকের দ্বারা যে কোনো রকমের দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা রয়েছে।
সময় এসেছে তাই নতুন করে ভাবার। যেকোনো ধরনের পরিবহন মালিকদের বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হবে। চালক শুধু দক্ষ হলেই চলবে না, চালককে হতে হবে মাদকমুক্ত ও শান্তস্বভাবের।

আমরা জানি, একটি দুর্ঘটনা সারা জীবনের কান্না,কারো কান্না স্বজন হারিয়ে, কারো কান্না জেল-জরিমানায়। অনেকেই মনে করেন, দুর্ঘটনার সঠিক কারণ অনুসন্ধান ও সঠিক বিচার না হওয়া ইচ্ছাকৃত।

বিচারহীন এই সংস্কৃতি থেকে আমাদের বেরিয়ে আসা দরকার। রাসেল সরকারের ক্ষতিপূরণ আদায়ের মাধ্যমে বিজ্ঞ আদালত বিচারহীন সেই সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসার আভাস দিয়েছেন। তাই আদালতকে আরো একবার ধন্যবাদ জানাচ্ছি । এই আভাস যেন ধীরে ধীরে পরিণত হয় অভ্যাসে। প্রতিটি দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি বা পরিবার ন্যায় বিচার পাক এটাই সবার প্রত্যাশা।

লেখক: কলামিস্ট ও ব্যাংকার

(দ্য রিপোর্ট/একেএমএম/এপ্রিল ১৫,২০১৯)