নিউজিল্যান্ড থেকে শ্রীলংকা: সন্ত্রাসের নতুন রূপান্তর
তৌহিদুল ইসলাম মিন্টু
শ্রীলংকায় ২১ এপ্রিল রবিবার ভয়াবহ এক সন্ত্রাসী হামলায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী এ পর্য্ন্ত ২৫৩ জন মারা গেছেন। এই আক্রমণের শিকার হয়েছেন গীর্জা ও চার্চে অবস্থানকারী খ্রিস্টান ধর্মালম্বীরা। মাস খানেক আগে ১৫ মার্চ নিউজিল্যান্ডে ক্রাইস্টচার্চের মসজিদে একইভাবে অস্ত্রধারীর গুলিতে নিহত হন ৫০ জন মুসলমান। নিউজিল্যান্ডের ওই আক্রমণে একজন উগ্রখ্রিস্টান ধর্মানুসারী অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক ব্রেনটন টারান্ট দুটি মসজিদে হামলা চালান। তাৎক্ষণিকভাবে তাকে পাকড়াও করে সেদেশের সরকার। সেদেশের নারী প্রধানমন্ত্রী জাসিন্ডা আরডার্ন সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেন। একই সঙ্গে মুসলমানদের প্রতি এক বিরল সহানুভূতি দেখিয়ে বিশ্ববাসীর কাছে শান্তিরদূত হিসেবে পরিচিতি পান। সারাবিশ্বের মুসলমানরা তার প্রতি গভীরভাবে শ্রদ্ধাশীল হয়ে পড়েন।
নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী মূলত এই বার্তাটিই বিশ্ববাসীর কাছে দিতে পেরেছেন যে সন্ত্রাসীদের কোনো ধর্ম নেই। কোনো দেশ নেই। তার দেশ কোনো রকম উগ্রপন্থাকে সমর্থন করে না্ ।
এদিকে শ্রীলংকার এই হামলার জন্য সেদেশের প্রতিরক্ষা প্রতিমন্ত্রী রুয়ান বিজেওয়ার্দেনে বলেছেন, নিউজিল্যান্ডের মসজিদের হামলার প্রতিশোধ নিতেই ইসলামী চরমপন্থী সংগঠন এই হামলা চালিয়েছে। [অবশ্য ক্রাইস্টচার্চে মসজিদে হামলার প্রতিশোধ নিতে শ্রীলঙ্কায় সিরিজ বোমা হামলার দাবিকে উড়িয়ে দিলেন নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জাসিন্ডা আরডার্ন।]
মঙ্গলবার বার্তাসংস্থা রয়টার্সের এক খবরে বলা হয়েছে ইসলামী স্টেট বা আইএস এই হামলার দায় স্বীকার করেছে।
বিরল এই ঘটনা সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের এক নতুন দিকের ইঙ্গিত দিচ্ছে। বিশ্ব রাজনীতিতে যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও দুঃশ্চিন্তার বিষয়। সভ্যতার এক বিশেষ সময়ে খণ্ড খণ্ড রাষ্ট্র গঠিত হয়েছিলো। আবার সভ্যতার প্রয়োজনেই একসময় অঞ্চলভেদে বিভিন্ন ধর্মের আবির্ভাব ঘটেছিলো। ধর্ম ও রাষ্ট্রের মধ্যে সংঘাত ছিলো দীর্ঘসময়ব্যাপী। একসময় রাষ্ট্রের কাছে হার মানেন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের প্রধানরা। রাষ্টের কর্ণধারেরা নিজেদের প্রয়োজনে ধর্ম ও ধর্মগুরুদের ব্যবহারে পারঙ্গম হয়ে উঠেন। আজও এই প্রক্রিয়া চলমান।
আরো পড়ুন:
চরমপন্থা ও সন্ত্রাসবাদ : ইসলামী দৃষ্টিকোণ-১
চরমপন্থা ও সন্ত্রাসবাদ : ইসলামী দৃষ্টিকোণ-২
চরমপন্থা ও সন্ত্রাসবাদ : ইসলামী দৃষ্টিকোণ-৩
চরমপন্থা ও সন্ত্রাসবাদ: ইসলামী দৃষ্টিকোণ-শেষ
কিন্তু পাল্টাপাল্টি এই দুটি আক্রমণ ধর্মের ওপর রাষ্ট্রের এই নিয়ন্ত্রণকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছে। তাহলে কি পৃথিবী আবার ফিরে যাবে ধর্মযুদ্ধের সেই ক্রুসেডীয় যুগে। আর সেক্ষেত্রে কোনো দেশ বা ভুখণ্ড দখল মূল বিষয় হয়ে দাঁড়াবে না। রাষ্ট্রের ভেতর সমান্তরালে বেড়ে ওঠা চরমপন্থী সংগঠনগুলো এক দেশের মসজিদে হামলার প্রতিশোধ নিতে আরেক দেশের গীর্জায়, প্যাগোডায় বা মন্দিরে হামলা চালাবে। মূল বিষয় হবে সব দেশের সব মসজিদ, গীর্জা মন্দির বা প্যগোডায় আক্রমণ, আর নিরীহ লোকের প্রাণহানী। যা সেই যুগের তুলনায় আরো ভয়াবহ ও অমিমাংসিত।
মূলত আজকের এই পরিস্থিতি উদ্ভবের জন্য পৃথিবীর মোড়ল দেশগুলোই প্রধান ভূমিকা রেথেছে।
কিছুদিন আগে জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাস্প। এর কয়েকদিন পরই তিনি সেখানে মার্কিন দূতাবাস চালু করেন। ১৯৪৭ সালে ইহুদীদের দ্বারা নিজেদের দেশ দখল হয়ে যায় ফিলিস্তিনিদের। নিজদেশে পরবাসী হয়ে পড়েন প্যালিস্টাইনিরা। দীর্ঘ লড়াইয়ে হাজার হাজার প্যালিস্টাইনি দেশ ছাড়া হয়ে বিভিন্ন দেশে আশ্রিত জীবনযাপন করে চলেছেন। নিজের মাটিতে টিকে থাকার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন ফিলিস্তিনি শিশুরাও। এর মধ্যে আামেরিকার এই স্বীকৃতি শুধু প্যালেস্টাইনের মুসলমানদের ক্ষুব্ধ করেনি, সারা পৃথিবীর মুসলমানরা ক্ষুব্ধ হয়েছেন।
গো রক্ষার নামে ভারতে চলছে মুসলিম বিদ্বেষী তাণ্ডব। ক্ষমতায় টিকে থাকতে সংখ্যা গরিষ্টদের ভোটকে পুঁজি করতে মোদি সরকার বেছে নিয়েছে মুসলিম বিদ্বেষ নীতি। মায়ানমারে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা রোহিঙ্গা মুসলমাদের কচুকাটা করে দেশ ছাড়া করেছে। প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা এখন বাংলাদেশে আশ্রিত। উইঘুর মুসলমানরা চীনে বন্দিদশায় জীবন যাপন করেছেন।
এসব ক্ষোভকে আগে থেকে কাজে লাগাতে থাকা ইসলামী চরমপন্থী গোষ্ঠিগুলো আরো সুনিপুণভাবে কাজে লাগানোর সুযোগ পায়। মুসলিম কিশোর, তরুণ মনে এসব বঞ্চনা ও নির্যাতনের ঘটনাগুলো চরমপন্থা বেছে নিতে উদ্বুদ্ধ করে। কখন কোন পরিবারের কোন সন্তানটা কোন সন্ত্রাসী সংগঠনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে তা যেমন জানতে পারছে না পরিবার, তেমনি জানতে পারছে না রাষ্ট্রের কর্ণধারেরা। মুসলমানদের মধ্যে যেসব কারণে ক্ষোভের জন্ম সেসব প্রকৃত কারণগুলোকে আড়াল করে ই্হুদি বা খ্রীস্ট্রান চরমপন্থা দলগুলো সেসব ধর্মের কিশোর বা তরুণদের নিজ নিজ দলে ভেড়াচ্ছে। এসব তরুণদের হাতে অস্ত্রতুলে দিচ্ছে, অথবা নিজেদের মধ্যে সৃষ্ট ক্ষোভ থেকে আক্রমণ চালাচ্ছে মসজিদে।
ফলে ক্ষোভ প্রশমনের রাজনৈতিক সমাধানের পথ ছেড়ে রাষ্ট্রগুলো বল প্রয়োগের দিকে এগিয়ে গেছে। সন্ত্রাস আরো ছড়িয়ে পড়ছে পরিবার থেকে রাষ্ট্রে। এক রাষ্ট্র থেকে আরেক রাষ্ট্রে।
এভাবে দেশে দেশে জন্ম নেওয়া চরমপন্থী ধর্মীয় দলগুলো সেদেশের ভিন্নধর্মী জনগোষ্ঠির জীবন কেড়ে নিচ্ছে। চরমপন্থা দলগুলো কখনো কখনো রাষ্ট্রের অস্তিত্বের জন্যই হুমকি হয়ে দেখা দিচ্ছে। সন্ত্রাসী সংগঠন বা সন্ত্রাসী সরকার দমনের নামে মোড়ল দেশগুলো অন্যের দেশ দখল করে নিচ্ছে।
শিক্ষা-দীক্ষায় শক্তিশালী না হয়ে মুসলমান তরুণরা যেভাবে ক্ষোভ প্রশমনের হাতিয়ার হিসেবে বেছে নিচ্ছে অস্ত্র। তেমনি এক ধরনের খ্রীস্টান ই্হুদি বৌদ্ধ হিন্দু তরুণও নিজেদেরকে ঠেলে দিচ্ছে চরমপন্থার দিকে। এই চার ধর্মাবলম্বীদের প্রধান লক্ষ্য মুসলমান।
শুধুমাত্র নিউজিল্যান্ডের হামলার প্রতিশোধ নিতেই শ্রীলংকায় এই হামলা-এভাবে সরলীকরণ করলে কয়েকটি বিষয় হয়তো আড়ালে চলে যাবে। সেসব বিষয় নিয়েও কথা বলতে শুরু করেছেন বিশ্লেষকরা। এর মধ্যে রয়েছে শ্রীলংকায় চীনের প্রভাব বৃদ্ধি। ইতোমধ্যে শ্রীলংকার প্রধান সমুদ্রবন্দরের নিয়ন্ত্রণ করছে চীন। ভারত সাগরে চীনের এই প্রভাব বৃদ্ধি আঞ্চলিক শক্তিশালী দেশ ভারতের জন্য যেমন মাথাব্যথার কারণ তেমনি বিশ্বমোড়ল আমেরিকার জন্য বিপদ। সেকারণে কোনো দেশ শ্রীলংকাকে অস্থিতিশীল করে তুলতে আইএসকে কাজে লাগাতে পারে সে সন্দেহ তৈরি হওয়া অস্বাভাবিক নয়। ১০ বছর আগে অবসান হওয়া গৃহযুদ্ধের ক্ষত থেকে বেরিয়ে এসে তামিল আর সিংহলীরা যখন দেশের অথর্নীতিকে এগিয়ে নিচ্ছে, তখন এ ধরনের হামলার মাধ্যমে নতুন অস্থিরতার দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে কীনা সেটাও বিবেচনায় নেওয়া দরকার।
আবার এই হামলা সেদেশে বিদ্যমান বিভেদকে সামনে নিয়ে এসেছে। প্রেসিডেন্ট সিরসিনা ও প্রধানমন্ত্রী বিক্রমাসিংহের মধ্যে চলমান বিরোধ সামনে চলে এসেছে। বিশেষ করে হামলার পর প্রেসিডেন্ট সিরসিনার ডাকা নিরাপত্তা বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী বিক্রমাসিংহকে থাকতে না দেওয়ার ঘটনা দ্বন্দ্বকে প্রকট করে তুলেছে।
তাই ঠিক কোন কারণে শ্রীলংকায় এই ভয়াবহ হামলা হলো তা-এখনই নিশ্চিত করে বলা যাবে না। তবে এই ধরনের হামলা বিশ্ববাসীকে বড় ধরনের দুঃশ্চিন্তায় ফেলেছে।
লেখক : সম্পাদক, দ্য রিপোর্ট টুয়েন্টিফোর ডট কম
(দ্য রিপোর্ট/একেএমএম/এপ্রিল ২৬,২০১৯)