thereport24.com
ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল 24, ১২ বৈশাখ ১৪৩১,  ১৬ শাওয়াল 1445

প্রতিবেশগত সঙ্কটাপন্ন : ঘোষণা আসছে

হালদা নদীতে মাছ ধরা, ডিম সংগ্রহ নিষিদ্ধ হচ্ছে

২০১৭ এপ্রিল ০৪ ২২:১৩:৫১
হালদা নদীতে মাছ ধরা, ডিম সংগ্রহ নিষিদ্ধ হচ্ছে

মানুষের অপরিকল্পিত কার্যকলাপের কারণে দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের হালদা নদী ও এর কাছাকাছি অঞ্চলকে প্রতিবেশগত সঙ্কটাপন্ন এলাকা (ইকোলজিক্যালি ক্রিটিক্যাল এরিয়া-ইসিএ) ঘোষণার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।

ইসিএ ঘোষণা করা হলে এ নদী থেকে যে কোনো ধরনের মা মাছ, মাছের ডিম সংগ্রহ করা বা প্রজনন ক্ষেত্রে মা মাছের অবাধ ও নিরাপদ বিচরণ বিঘ্নিত করে এমন কার্যকলাপ নিষিদ্ধ হবে।

প্রতিবেশগত সঙ্কটাপন্ন এলাকা ঘোষণা করতে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় একটি খসড়া প্রজ্ঞাপন প্রস্তুত করেছে। একই সঙ্গে খসড়া ‘হালদা নদী প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকার পরিবেশ ব্যবস্থাপনা নির্দেশিকা’ তৈরি করা হয়েছে। এ বিষয়ে বর্তমানে সংশ্লিষ্টদের মতামত নেওয়া হচ্ছে।

পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (পরিবেশ) মো. নুরুল করিম দ্য রিপোর্ট টুয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছেন, ‘হালদা নদীকে ইসিএ ঘোষণার উদ্যোগ নিয়েছি আমরা। প্রতিবেশগত সঙ্কটাপন্ন এলাকা ঘোষণার পর এনফোর্সমেন্টের কাজসহ ব্যবস্থাপনার বিষয়েও একটি নির্দেশিকা প্রস্তুত করা হচ্ছে।’

তিনি আরও বলেছেন, ‘আগামী ২৬ মে পর্যন্ত আমরা দুটি খসড়ার বিষয়ে মতামত নেব। এরপর সংশ্লিষ্টদের নিয়ে সভা করে ইসিএ’র খসড়া প্রজ্ঞাপন ও নির্দেশিকাটি চূড়ান্ত করে তা গেজেট আকারে জারি করা হবে। তবে কতদিনের মধ্যে সব করতে পারবো তা বলা যাচ্ছে না।’

খসড়া প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, মানুষের অপরিণামদর্শী এবং অপরিকল্পিত কার্যকলাপের কারণে হালদা নদীর প্রতিবেশ ব্যবস্থা (ইকোসিস্টেম) সংকটাপন্ন অবস্থায় উপনীত হয়েছে, যা ভবিষ্যতে আরও সংকটাপন্ন হবে মর্মে প্রতীয়মান হচ্ছে।

এতে আরও বলা হয়েছে, এমতাবস্থায় প্রাকৃতিক পরিবেশ সংরক্ষণ, পরিবেশগত মান উন্নয়ন এবং পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণ ও প্রশমন এবং টেকসই পরিবেশ ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে ‘বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন-১৯৯৫’ অনুসারে হালদা নদী ও নদী সন্নিহিত এলাকাকে প্রতিবেশগত সঙ্কটাপন্ন এলাকা ঘোষণা করা সমীচীন।

খসড়ায় আরও উল্লেখ করা হয়েছে, ‘খাগড়াছড়ি জেলার রামগড় উপজেলার বাদনাতলী পাহাড়ী এলাকার উৎপত্তিস্থল থেকে চট্টগ্রাম মহানগরের চান্দগাঁও থানার কর্ণফুলী নদীর সংযোগস্থল পর্যন্ত ১০৭ কিলোমিটার হালদা নদী ও নদীর উভয় পাড় থেকে ৫০০ মিটার প্রস্থের এলাকাকে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা (ইকোলজিক্যালি ক্রিটিক্যাল এরিয়া-ইসিএ) ঘোষণা করা হলো।

হালদা নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. মঞ্জুরুল কিবরিয়া দ্য রিপোর্টকে বলেছেন, ‘এটা (ইসিএ ঘোষণা) করতে পারলে খুবই ভাল হবে, এতে হালদার এখন যে সমস্যাগুলো আছে সেগুলোর সমাধান মিলবে। হালদা সংরক্ষণে আমরা অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারব। এ সমস্যাগুলো এখন কোনো আইনের মাধ্যমে প্রতিরোধ করা যাচ্ছে না। রাবার ড্যাম তো অবৈধ নয়, কিন্তু এগুলো হালদার উপর খুবই নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।’

তিনি আরও বলেছেন, ‘এ উদ্যোগের সফলতা নির্ভর করবে মূলত সরকার তা কতটুকু বাস্তবায়ন করতে পারছে সেই বিষয়ের ওপর। খসড়া প্রজ্ঞাপনটি মোটামুটি ঠিক আছে, কিন্তু সেখানে কিছু তথ্যগত ভুল রয়েছে। হালদার গতিপথ ম্যাপে রয়েছে একরকম, আবার লেখা হয়েছে আরেক রকম। মৌজাগুলোতেও ত্রুটি রয়েছে। ভুলগুলো ধরিয়ে দেওয়াসহ পুরো বিষয়টির ওপর আমি একটি মতামত দেব।’

হালদার পরিবেশগত সঙ্কটাপন্ন এলাকার অন্তর্ভুত মৌজাগুলোর একটি তালিকাও দেওয়া হয়েছে খসড়া আদেশে।

হালদা নদী বাংলাদেশের মাছের একমাত্র প্রাকৃতিক প্রজনন ক্ষেত্র, যেখান থেকে সরাসরি রুই জাতীয় (রুই, কাতল, মৃগেল, কালিগনি ইত্যাদি) মাছের নিষিক্ত ডিম সংগ্রহ করা হয়। এটিই দেশের রুই জাতীয় মাছের একমাত্র বিশুদ্ধ প্রাকৃতিক জিন ব্যাংক। নানা স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে এটি শুধু বাংলাদেশেই নয়, বিশ্বের নদীগুলোর মধ্যেও অন্যতম।

দেশের জাতীয় অর্থনীতিতে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখছে হালদা নদী। কিন্তু শিল্প বর্জ্যের কারণে এ নদীর পানি দূষণ, নদীর সংযোগ খালগুলোতে স্থাপিত স্লুইস গেট, নদীর উজানে লোনাপানি বৃদ্ধি, নদীর বাঁক কর্তন, মৎস্য আইন না মানার প্রবণতা, অপরিকল্পিতভাবে বালি উত্তোলন এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে নদীতে মা মাছের আগমন ও বিচরণ যেমন দ্রুত কমছে, তেমনি পরিবর্তিত হচ্ছে ডিম ছাড়ার স্থান। বাঁক কর্তনের ফলে নদীর দৈর্ঘ্য কমে গিয়ে অতি অল্প সময়ে নিষিক্ত হয়ে ডিম কর্ণফুলী নদীতে পতিত হয়ে নষ্ট হয়ে যায়। হালদায় আহরিত ডিমের পরিমাণ ক্রমেই কমছে।

প্রতিবেশগত সঙ্কটাপন্ন এলাকা ঘোষণার গেজেট প্রকাশের দিন থেকে ওই এলাকায় স্থলজ বা জলজ পরিবেশে বসবাসরত বন্যপ্রাণী ধরা বা শিকার এবং মৎস্য অধিদফতরের অনুমতি ছাড়া নদী থেকে যে কোনো ধরনের মা মাছ, মাছের পোনা কিংবা মাছের ডিম সংগ্রহ করা নিষিদ্ধ।

খসড়ায় আরও বলা হয়েছে, ‘প্রজনন ক্ষেত্রে মা মাছের অবাধ ও নিরাপদ বিচরণ বিঘ্নিত করে এমন সকল কার্যকলাপ, ভূমি ও পানির প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য নষ্ট বা পরিবর্তন করতে পারে এমন সব কাজও নিষিদ্ধ।’

ইসিএ ঘোষণার পর ওই এলাকায় মাটি, পানি, বায়ু এবং শব্দ দূষণকারী শিল্পপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করা যাবে না। মাছ, অন্যান্য জলজ উদ্ভিদ ও প্রাণীর জন্য ক্ষতিকারক যে কোনো কাজ এবং নদীর চারপাশের বসতবাড়ি, শিল্পপ্রতিষ্ঠান এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের পয়ঃপ্রণালী সৃষ্ট বর্জ্য বা তরল বর্জ্য নির্গমন এবং কঠিন বর্জ্য নিক্ষেপ করা যাবে না।

এ ছাড়া নদী থেকে মাটি, বালু কিংবা পাথর উত্তোলন বা ড্রেজিং করা যাবে না। তবে প্রাকৃতিক কারণে নদী ভরাট হয়ে গেলে পরিবেশ ও প্রতিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব দূরীকরণের জন্য পরিবেশগত সমীক্ষা করে পরিবেশ অধিদফতরের অনুমতি নিয়ে মাটি, বালু, পাথর উত্তোলন বা প্রয়োজনে ড্রেজিং করা যাবে।

হালদা নদীর স্বাভাবিক পানি প্রবাহ বাধাগ্রস্ত করে বাঁক কেটে গতিপথ সরলরৈখিকীকরণসহ এমন সব ধরনের কাজ, হালদা নদীর প্রতিবেশ ও প্রাকৃতিক প্রজনন ক্ষেত্র ক্ষতিগ্রস্ত করে এমন কর্মকাণ্ড; যেমন- রাবার ড্যামের মাধ্যমে পানি ধারণ ও ছেড়ে দেওয়া, নদীর উজান থেকে পানি প্রত্যাহার করা যাবে না।

নদীর উৎসস্থলের টিলা, পাহাড়ী ভূমি ও ওয়াটারশেডে যে কোনো ধরনের বৃক্ষনিধন এবং প্রাণী ও উদ্ভিদের আবাসস্থল ধ্বংসকারী সব ধরনের কার্যকলাপ খসড়া আদেশে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

বিভিন্ন পর্যায়ে কমিটি গঠনের কথা উল্লেখ করে নির্দেশিকায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি এই পরিবেশগত সঙ্কটাপন্ন এলাকার নিয়ম লঙ্ঘন করলে সর্বোচ্চ ২ বছরের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ২ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

হালদা নদী এলাকায় নিষিদ্ধ কার্যাবলীসহ পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর কোনো কাজ করলে তা প্রতিহত করতে মৎস্য অধিদফতর ও পরিবেশ অধিদফতর প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা নেবে। এজন্য মৎস্য অধিদফতর ও পরিবেশ অধিদফতর প্রয়োজনে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, ইসিএ কমিটি বা গ্রাম সংরক্ষণ দলের সহযোগিতা নেবে।

খসড়া ইসিএ’তে অন্তর্ভুক্ত মৌজা

খসড়া আদেশ অনুযায়ী পরিবেশগত সঙ্কটাপন্ন এলাকায় খাগড়াছড়ি জেলার রামগড় উপজেলার হাপছড়ি, ২৩৭ নং নাভাংগা মৌজা ও মানিকছড়ি উপজেলার মানিকছড়ি, দাইনছড়ি, জুগ্গাচালা, কালাপানি মৌজা অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে।

চট্টগ্রাম জেলার হাটহাজারী উপজেলার বুড়িশ্চর, দক্ষিণ মাদ্রাসা, মধ্য মাদ্রাসা, পশ্চিম ফরহাদাবাদ, পূর্ব মন্দাকিনি, উত্তর মাদ্রাসা, মেখল, মোজাফফরাবাদ, রোহুল্লাপুর, গুমানমর্দন, নাঙ্গলমোড়া, পশ্চিম ধলই, ছিবাতলী ও গড়দুয়ারা মৌজাও অন্তর্ভুক্ত থাকছে।

চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন এলাকা মোহরা ও বোয়ালখালী উপজেলার কধুরখীল মৌজা অন্তর্ভুক্ত হবে।

রাউজান উপজেলার মৌজাগুলোর মধ্যে নোয়াপাড়া, কচুখাইন, পাঁচখাইন, বাগোয়ান, পশ্চিম গুজারা, হারপাড়া, মৈশকরম, সাকারদা, উরকির চর, নোয়াজিসপুর, ফতেনগর, নাদিমপুর, বিনাজুরি, গহিরা, কোটালিঘোনা, উত্তর গুজারা।

ফটিকছড়ি উপজেলার বারমাসিয়া, সুয়াবিল, চান্দপুর, ইদিলপুর, শৈলকোপা, জুজখোলা, হাপানিয়া, লট-৪৪ নেপচুন চা বাগান, পিলখানা, উত্তর সুন্দরপুর, সাংগিরি, দক্ষিণ ধুরং, পূর্ব ফরহাদাবাদ, দক্ষিণ পাইনদাঙ্গা, ডলু, ফকিরাচান, ছিলোনিয়া, দক্ষিণ, সুন্দরপুর, পাঁচ পুকুরিয়া, একখুলিয়া, নিশ্চিন্তপুর, পূর্ব ধলই, অখারা (সমিতির হাট), হারুয়ালছড়ি, পাটিয়ালছড়ি, পূর্ব ফটিকছড়ি, কোটবাড়িয়া, হরিণা, আমতলী, পশ্চিম কৈয়া পুখিয়া, পূর্ব কৈয়া পুখিয়া, জংগল কৈয়াপুখিয়া ও তেলপারাই মৌজা অন্তর্ভুক্ত করার কথা খসড়া আদেশে বলা হয়েছে।

(দ্য রিপোর্ট/আরএমএম/জেডটি/এনআই/এপ্রিল ০৪, ২০১৭)

পাঠকের মতামত:

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

M

M

SMS Alert

এর সর্বশেষ খবর

- এর সব খবর