thereport24.com
ঢাকা, মঙ্গলবার, ৭ মে 24, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১,  ২৮ শাওয়াল 1445

অবহেলিত শহীদ রফিকের পরিবার

স্মৃতি জাদুঘরে নেই কোনও স্মৃতি

২০১৪ ফেব্রুয়ারি ২১ ০৭:৫২:৫৬
স্মৃতি জাদুঘরে নেই কোনও স্মৃতি

নাসির উদ্দিন সামি, মানিকগঞ্জ : বায়ান্নের ভাষা আন্দোলনে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দৃঢ় প্রত্যয়ে যে ক’জন ভাষাসৈনিক জীবন উৎসর্গ করেছেন তাদের মধ্যে মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইরের শহীদ রফিক উদ্দীন আহম্মেদ অন্যতম। উপজেলার বলধারা ইউনিয়নের নিভৃত পারিল গ্রামে (বর্তমান রফিকনগর) জন্মগ্রহণকারী রফিক আজ বাঙালির ইতিহাসে প্রাণপুরুষ।

বর্ষ পরিক্রমায় ভাষা দিবস ২১ আসে আর যায়। কিন্তু বাংলা বর্ণমালার জন্য শহীদ রফিকের আত্মোৎসর্গ কেবল বিশেষ দিন ছাড়া স্মরণ করা হয় না। জাতির এই কৃপণতায় ভাষা শহীদের আত্মা কতটুকু শান্তি পাচ্ছে তা জানা না থাকলেও তার পরিবার মানসিকভাবে প্রচণ্ড আহত। এই ভাষা শহীদের পরিবার আজ দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিত। এলাকাবাসীর মধ্যে এ নিয়ে দুঃখ ও ক্ষোভ বিরাজ করছে।

২১শে ফেব্রুয়ারি এলে কৃত্রিমতা ও দায়সারা গোছের প্রচলিত কিছু কর্মসূচি পালন করেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। কিন্তু ভাবখানা এমন দেখান যেন অসম্ভব কিছু জয় করে ফেলেছেন। এ দিনে শহীদ রফিক স্মৃতি জাদুঘর ও গ্রন্থাগার প্রাঙ্গণে বাহারি মানুষের ঢল নামলেও রফিকের ভিতর বাড়ির খবর কেউ রাখে না। একমাত্র ভাইসহ আপনজনদের সংসার কীভাবে চলে খবর নেয় না কেউ। শহীদ রফিকের জন্মভূমি পারিল গ্রামের নাম রাখা হয়েছে রফিকনগর। গ্রামের নাম পরিবর্তন হলেও পরিবর্তন হয়নি জনপথ ও ভাষা শহীদের পরিবারের। রফিকের প্রতি সম্মান দেখাতে ৬ বছর আগে রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তে এই ভাষা সৈনিকের নামে গ্রামের নামকরণ করে উন্নয়নমূলক নানা কর্মকাণ্ড শুরু হলেও থমকে গেছে সে সব।এলাকার শিক্ষা, শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির উন্নয়ন ঘটবে এমন আশা করলেও বর্তমান বাস্তবতায় হতাশ এলাকাবাসী।

প্রায় ৫ বছর আগে এ ভাষার মাসে সেখানে ভাষাশহীদ রফিক উদ্দিন আহম্মেদ গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘরের উদ্বোধন হয়। কিন্তু এখনও পর্যন্ত স্মৃতি জাদুঘরে আধুনিক তথ্য প্রযুক্তির ছোঁয়া লাগেনি। এখানে নেই কোনো কম্পিউটার ও ইন্টারনেট সংযোগ। তাছাড়া স্মৃতি জাদুঘরে ভাষা শহীদদের কোনো স্মৃতি চিহ্ন না থাকায় ভবনটি দালান সর্বস্ব হয়ে পড়েছে। স্মৃতি জাদুঘরে ঠাঁই মেলেনি রফিকসহ ভাষা শহীদদের স্মৃতি চিহ্নও। জাদুঘরে রফিকের একটি ছবি ও কিছু বই ছাড়া স্মৃতি বিজরিত কোনো কিছুই নেই। শহীদ রফিকের কোনো স্মৃতি চিহ্ন জাদুঘরে না থাকলেও তার ব্যবহারের চেয়ার টেবিল ও পরনের পাঞ্জাবি, লুঙ্গি এবং নিজ হাতে সুই সুতা দিয়ে নকশা করা রুমালসহ অন্যান্য ব্যবহার্য অনেক কিছুই রয়েছে তার ছোট ভাই খোরশেদ আলমের কাছে। এলাকাবাসী বারবার এই স্মৃতি চিহ্নগুলো জাদুঘরে সংরক্ষণ করার দাবি জানালেও এ ব্যাপারে প্রশাসন কোনো উদ্যোগ নেয়নি।

স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যন আব্দুল মাজেদ খাঁন বলেন, দূর-দূরান্তের ভাষাপ্রেমিক দর্শনার্থী, গবেষক, শিক্ষার্থীরা এসে স্মৃতিগুলো ও গ্রন্থাগারের বেহাল অবস্থা দেখে হতাশ হয়ে ফিরে যান। এ ছাড়া থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা না থাকায় ক্রমেই দর্শনার্থীদের সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে। অনেকেই এসে চরম দুর্ভোগে পড়েন। গ্রন্থাগারকে কেন্দ্র করে গণমূখি কোনো উদ্যোগ না থাকায় সহসাই কেউ এ মুখো হচ্ছে না।

শহীদ রফিকের ছোট ভাইয়ের স্ত্রী গুলেনুর বেগম ক্ষোভ প্রকাশ করে জানান, সরকার বা কোনো সংস্থা থেকে আমরা এখনো কোনো সাহায্য-সহযোগিতা পাইনি। শহীদের স্মৃতি বিজরিত বাড়িটি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সরকার কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। ভাষার মাস আসলে এখানে দেশ-বিদেশ থেকে অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ আসেন। তারা ভাষা শহীদ রফিক সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য জানতে চান। তাদের প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে আমি ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে আরও বলেন, কি লাভ এসব তথ্য দিয়ে। আমাদের ভিতর বাড়ির খবর কেউ জানতে চায় না। অনেকেই সাহায্যের আশ্বাস দিয়ে চলে গিয়ে আর ফিরে আসেনি। এসব নিয়ে কারও সঙ্গে কথা বলতে আর ভালো লাগে না।রফিকের পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, পাঁচ ভাই দুই বোনের মধ্যে রফিক ছিল সবার বড়। বাবা আব্দুল লতিফ, মা রাজিয়া খাতুন। লেখাপড়ার হাতেখড়ি পারিল গ্রামে। ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত পারিল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ার পর ১৯৪৯ সালে উপজেলার বায়রা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মেট্রিক পাস করেন। এরপর মানিকগঞ্জ দেবেন্দ্র কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক ক্লাসে বাণিজ্য বিভাগে ভর্তি হন। কিছুদিন যেতে না যেতেই অভাব অনটনে লেখাপাড়া বন্ধ হয়ে যায়। ঢাকায় এসে পিতার প্রেস ব্যবসার দায়িত্ব নেন। অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা ফিরে এলে ঢাকা জগন্নাথ কলেজে আবার ভর্তি হন। এ কলেজে পড়ার সময় রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভারে জড়িয়ে পড়েন। ৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ঢাকা ছিল উত্তাল। ২১ ফেব্রুয়ারি ছিল রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে সারাদেশের আন্দোলনের প্রস্তুতি দিবস। এদিন সকাল ৯টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জিমনেশিয়াম মাঠের পাশে ছাত্র-ছাত্রীরা জমায়েত হন। তৎকালীন পাকিস্তান সরকার ভাষা আন্দোলন স্তব্ধ করতে ২০ ফেব্রুয়ারি সারাদেশে মিছিল মিটিংয়ের উপর ১৪৪ ধারা জারি করেন। বাংলার দামাল সন্তানদের সঙ্গে ছাত্র জনতার মিছিলে যোগ দেন রফিক। ওই মিছিলের উপর পুলিশ গুলি চালায়। পুলিশের গুলিতে ঘটনাস্থলেই শহীদ হন রফিক।

(দ্য রিপোর্ট/এনইউএস/এপি/ফেব্রুয়ারি ২১, ২০১৪)

পাঠকের মতামত:

SMS Alert

আ-মরি বাংলা ভাষা এর সর্বশেষ খবর

আ-মরি বাংলা ভাষা - এর সব খবর